ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় পুরো পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে এই বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা একটি জায়গা দখল করে আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িয়ে আছে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘটনা। এরপরে সময়ের সাথে পাকিস্তান আমলে বাঙালী জাতীয়তাবাদের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও হাজারো আন্দোলন সংগ্রামের বীজ বপন করা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায়।
বঙ্গভঙ্গ রদের সান্ত্বনা
বঙ্গভঙ্গের ইতিহাসের দিকে খুব ভালো করে তাকালে দেখা যাবে পূর্ব বাংলা আর আসামের মুসলমান সমাজে এর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। নতুন রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে শিক্ষাদীক্ষা আর কর্মক্ষেত্রের সুযোগ বাড়তে থাকে। একে স্বাগত জানায় তারা। বঙ্গভঙ্গ এবং পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠনের ফলে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায় এই এলাকার শিক্ষাখাতে। ১৯০৫ থেকে ১৯১০-১১ সালের মধ্যে প্রদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬,৯৯,০৫১ জন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৯,৩৬,৬৫৩ জনে। শিক্ষাখাতে রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। নতুন করে স্কুল কলেজ নির্মাণ শুরু করা হয়। ১৯০৮-০৯ সালের মধ্যে ৮১৯টি নতুন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু হয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পূর্ব বাংলা এবং আসামের প্রতিটি স্কুল-কলেজে মুসলিম হোস্টেল নির্মাণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ’ বিলুপ্ত হয়, পূর্ববাংলায় অনেক সোনালী স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে।
বঙ্গভঙ্গ রদের পরে ১৯১২ সালে পূর্ব বাংলা ও আসাম সফরে এসে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেছিলেন,
“গত কয়েক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার যে অগ্রগতি হয়েছে তাতে ভারত সরকার আনন্দিত হয়েছে এবং ভারত সচিবের কাছে তারা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পূর্ব বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নতির জন্য একজন বিশেষ অফিসার নিয়োগের সুপারিশ করবে।”
শুরুতেই বিরোধিতা
তবে লর্ড হার্ডিঞ্জের ঢাকা সফর শেষে কলকাতা ফিরে যাওয়ার পরে ১৯১২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ড. রাশবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে স্মারকলিপি দেয়। রাশবিহারী ঘোষের সাথে একমত ছিলেন বিপিন চন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি, ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, পেয়ারী মোহন মুখোপাধ্যায়, অম্বিকা চরণ মজুমদারের মতো নেতারা। ভাইসরয় তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেটি কোনো মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, বরং সবার জন্য উন্মুক্ত সাধারণ একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে।
এ লক্ষ্যেই সেই বছরের মে মাসে গঠন করা হয় নাথান কমিটি। মোট পঁচিশটি সাব-কমিটি করে ১৯১২ সালের ডিসেম্বরের মাঝেই নাথান কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। নাথান কমিটির হিসেব অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রায় ৫৩ লক্ষ টাকা এবং বাৎসরিক খরচ প্রায় ১২ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
রমনা অঞ্চলের ৪৫০ একর জমির উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। এই এলাকার মধ্যে ছিল ঢাকা কলেজ, গভর্নমেন্ট হাউজ, সেক্রেটারিয়েট, গভর্নমেন্ট প্রেস ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভবন।
সেই কমিটির রিপোর্ট যাচাই বাছাই শেষে ১৯১৩ সালে প্রকাশিত এবং সেক্রেটারি অফ স্টেট কর্তৃক অনুমোদিত হয়। নাথান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরে ইউরোপজুড়ে শুরু হয়ে যায় বিশ্বযুদ্ধের তোড়জোড়। ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে, এই স্বপ্ন চাপা পড়ে যায় কাগজের স্তুপে। ঢাকার প্রভাবশালী নওয়াব সলিমুল্লাহ নানাভাবে ব্রিটিশ প্রশাসনকে চাপ দিয়ে বারবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে তার মৃত্যুর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইংরেজ প্রশাসনকে চাপ দেওয়ার কাজটি হাতে তুলে নিয়েছিলেন নওয়াব আলী চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীকে বারবার সামনে নিয়ে আসতে তার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন নবাব সিরাজুল ইসলাম, স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, আবদুল করিম, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো নেতারা।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অন্যতম বড় বাঁধা ছিলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় শুরু থেকেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে আসছিলেন। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ‘ঢাকার স্মৃতি’ নামক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
“ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি সরাসরি আশুতোষ বাবুর কাছে জানতে চেয়েছিলনে কীসের বিনিময়ে তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন। শেষ পর্যন্ত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি নতুন প্রফেসর পদ সৃষ্টির বিনিময়ে বিরোধের অবসান ঘটান।”
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়েই গঠন করা হয়েছিল ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ বা ‘স্যাডলার কমিশন’। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিভিন্ন আবাসিক হলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিট হিসেবে ধরা হয়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কে আরো তেরোটি সুপারিশ করে, যা কিছুটা রদবদল করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ হিসবে ১৯২০ সালে ভারতীয় আইনসভায় গৃহীত হয়, গভর্নর জেনারেল তাতে ১৯২০ সালের ২৩শে মার্চ সম্মতি দিয়েছিলেন।
মুসলিম হল, ঢাকা হল আর জগন্নাথ হলে যথাক্রমে ১৭৮ জন, ৩৮৬ জন এবং ৩১৩ জন নিয়ে যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয় ১৯২১ সালের জুলাই মাসের এক তারিখ। ভাইস চ্যান্সেলার হিসেবে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্টার ফিলিপ হার্টগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিজমা
মোগল আমল থেকেই ঢাকা শহরের বিকাশ শুরু হয়েছিল, বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হওয়ার সুবাদে রমনা এলাকাটি সাজিয়ে তোলা হয়েছিল নতুনভাবে। তবে ঢাকার সেই সুদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নাথান কমিশন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য রমনা এলাকাকে উপযুক্ত গণ্য করেছিল। যাচাই বাছাইয়ে এই ব্যাপারটি টিকে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির ব্যাপারে একটি জনপ্রিয় ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির একটি বড় অংশই নাকি ঢাকার নবার পরিবারের দান করা। নবাব সলিমুল্লাহর নামটি জোরেশোরেই শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আসার পরেই নাকি তিনি ৬০০ একর জমি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কিন্তু কাগজে-কলমে সেই ধরনের কোনো হিসেব পাওয়া যায় না। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হয়েছিল সরকারি খাস জমিতে। রাজধানীর অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজনে যে ভবনগুলো নির্মিত হয়েছিল, সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। এই ভবনগুলোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে টাকাও কেটে রাখা হয়। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ১৯১০ সাল থেকে বাজেটে আলাদা করে টাকা রাখা শুরু করে। ১৯২০-২১ এ এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ লক্ষ টাকা। সেই টাকার পুরোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আসেনি, ভবন বরাদ্দ দেওয়া বাবদ সেই টাকার বিপুল অংশ কেটে রাখা হয়।
আর রমনা এলাকায় যে জমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন তার পুরোটাই খাস জমি। সেটেলমেন্ট রিপোর্টের দলিল দস্তাবেজে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। নবাব পরিবার নিজেই ছিলো ঋণের বোঝায় ক্লান্ত। তবে ঢাকার অনেক ধনী ব্যক্তি সেই আমলে মারা যাওয়ার পরে তাদের সম্পত্তি নবাব পরিবারের নামে ওয়াকফ করে দিয়ে যেত। নবাব পরিবারের জমির অন্যতম উৎস ছিল এটি। তাই নবাব পরিবারের পক্ষে এই বিপুল পরিমাণ জমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে যাওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্ববঙ্গীয় সমাজ’ নামক বইয়ে দেওয়া এক প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা এবং জমির উৎস সম্পর্কে বলেছিলেন,
“কোনো মুসলিম ধনীর কাছ থেকেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডাইরেক্টলি কোনো ফাইনেন্সিয়াল কন্ট্রিবিউশন পায় নাই। সলিমুল্লাহ হল যে তৈরি হলো তা পুরোই সরকারের টাকায়।
… নওয়াব পরিবারের টাকায় নয়; নওয়াব পরিবারের জায়গাতেও নয়। রমনার যে জায়গায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি এর পুরাই খাসমহল, সরকারের জমি। সেটলমেন্ট রিপোর্টে তা-ই আছে। … এটার ভেরিফিকেশন তো সোজা। যে কেউ ইন্টারেস্টেড, সে ঢাকা কালেক্টরেটে যেয়ে দেখে আসতে পার।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরেছিলেন যারা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটা হয়েছিল একদল প্রতিভাবান আর কর্মদক্ষ শিক্ষক দিয়ে, এদের অনেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন জগৎবিখ্যাত। প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্টার পি. জে. হার্টগ। তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণচঞ্চল হতে থাকে ধীরে ধীরে। সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে যোগ দেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, তার সাথে ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং রাধাগোবিন্দ বসাক। ইতিহাস বিভাগে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং স্যার এ. এফ. রহমান। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে সত্যেন্দ্রনাথ বসু আর রসায়নে ড. জ্ঞানচন্দ্র। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন আইন বিভাগের প্রধান। উপাচার্য হার্টগ সারা ভারতের সেরা শিক্ষক দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালকে সত্যিকার একটি ‘নক্ষত্রের মেলা’ করতে চেয়েছিলেন। তবে ইংরেজ আর ভারতীয় শিক্ষকদের বেতনে বৈষম্য থাকায় ক্ষোভ ছিল অনেকের মনেই।
শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে। ১৯১৯ সালে নতুন শিক্ষামন্ত্রী প্রভাসচন্দ্র মিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কমানোর আদেশ দেন। তবে ফজলুল হক এবং স্যার আব্দুর রহিমের চেষ্টায় তা বাড়ানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজ
১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তার ভাষণে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সাম্প্রদায়িক বিদ্যাপীঠ হবে না। অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মেক্কা অফ দি ইস্ট’ বলে আখ্যা দিতেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শরীর থেকে এই পরিচয় বারবার ঝেড়ে ফেলেছে। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববাংলায় একটি সচেতন মুসলিম সমাজ তৈরি করেছে, যারা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। এই ব্যাপারটি আরো স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক শ্রী প্রফুল্লকুমার গুহ তার এক লেখায়,
“প্রতিষ্ঠার পনের-ষোল বৎসরের মধ্যেই ইহা ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। কিন্তু প্রারম্ভে ইহাকে গুরুতর প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ঢাকায় রব উঠলোঃ They Killed a good college (Dhaka College) to make a bad university। ওদিকে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পেছনে একটি গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সরকারের মনে ছিল। সরকার চেয়েছিলেন যে মুসলমান শিক্ষক আর মুসলমান ছাত্রদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করলে এটি একটি সাম্প্রদায়িক কলহকেন্দ্র (Communal Cockpit) এ পরিণত হবে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সৌভাগ্য যে এর প্রাথমিক কর্ণধারেরা প্রত্যেকেই ছিলেন সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা মুক্ত। মুসলমানদিগের মধ্যে উচ্চশিক্ষা প্রসারিত হয় নাই-মুসলমান ছাত্রদিগকে শিক্ষাদান করে তাদের দ্বারা মুসলমানের সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি মিডল ক্লাস সৃষ্টি করার সহায়তা হিন্দু শিক্ষক ও প্রশাসকগণ একটি পূণ্যকার্য হিসেবে গ্রহণ করলেন। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত একটি মুসলমান মিডল ক্লাস সৃজন করা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কীর্তি।”
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ঘাটলে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরেই মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা খুব উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এমনটি কিন্তু নয়। পূর্ববঙ্গের সাধারণ মুসলমান ছাত্ররা কলকাতায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের পথে অর্থনৈতিক বাধার পাশাপাশি মানসিক একটি বাঁধা ছিল। খুব সূক্ষ্ম হলেও পূর্ববাংলার সাথে পশ্চিম বাংলার একটি সাংস্কৃতিক দূরত্ব সবসময়েই ছিল। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলিম উপর সম্প্রদায়ের সেই বাঁধাটি কেটে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ঢাকায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠে একটি সচেতন সমাজ। ঢাকা শহরটিও জন্ম নিতে থাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠিক মাঝে রেখে।
চল্লিশের দশক থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক জাগরণ শুরু হয়। চল্লিশে লাহোর প্রস্তাবের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে পাকিস্তানের সমর্থক যেমন দেখা যায় ঠিক তেমনি অখণ্ড ভারতের সমর্থকও ছিলেন অনেকেই। তেতাল্লিশে এই বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস মোড় নেয় নতুন দিকে। পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল সৃষ্টির গুঞ্জন ওঠে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সারির নেতা আর কর্মীদের বড় অংশই ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশের চারণভূমি হয়ে উঠতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। বঙ্গভঙ্গ রদের সান্ত্বনা হিসেবে জন্ম নিয়েছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমগুলো থেকে জন্ম নেওয়া সচেতন মধ্যবিত্ত সমাজ বদলে দেয় পুরো এলাকার রাজনৈতিক দৃশ্যপট।