তালাস নদীর যুদ্ধ: যে যুদ্ধের মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছিল কাগজ তৈরির রহস্য

কাগজের জন্ম চীন দেশে এ কথা কে না জানে? সভ্যতার গতিপথ বদলে দেওয়া অনন্য এই আবিষ্কারের জন্য আজও বিশ্বসভ্যতা চৈনিকদের কাছে ঋণী। তবে আবিষ্কারের সাথে সাথেই কাগজের প্রযুক্তি বিশ্ববাসী জানতে পারেনি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বহিঃবিশ্ব থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখতে সর্বদা আগ্রহী চীনারা কাগজ তৈরির নিগূঢ় রহস্য গোপন করে রাখতে পেরেছিল প্রায় আটশ বছর! কিন্তু হঠাৎ একদিন চীনের এই টপ সিক্রেট জেনে গেল সারাবিশ্ব। অবশ্য সেটা কোনো শান্তিপূর্ণ সায়েন্টিফিক কনফারেন্সের মাধ্যমে নয়, বরং রীতিমত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন বাঁকের সূচনা করা এই যুদ্ধ ‘ব্যাটেল অফ তালাস রিভার’ বা ‘তালাস নদীর যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। ফিচারটি সাজানো হয়েছে এই যুদ্ধের আদ্যোপান্ত নিয়ে।

পটভূমি

সময়টা অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি। চীনের ট্যাং রাজবংশ (৬১৮-৯০৬ খ্রি.) তখন পূর্বদিকের একচ্ছত্র অধিপতি। একে একে মধ্য এশিয়ার তুর্কি রাজ্যগুলো চলে আসছিল তাদের করায়ত্বে। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে জেগে উঠেছে ইসলামী খেলাফত। হযরত উমার ফারুক (রাঃ) এর খিলাফতের সময় (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিঃ) বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য জয় করে মধ্য এশিয়ার উপকন্ঠে পৌঁছে গিয়েছিল মুসলিম বাহিনী। তাঁর মৃত্যু পরবর্তী একশ বছর অর্থাৎ খুলাফায়ে রাশেদিন (৬৪৪-৬৬১ খ্রিঃ) এবং উমাইয়া আমলে (৬৬১-৭৫০ খ্রিঃ) সেই ধারা অব্যহত ছিল। অবশ্য এ সময়ে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের গতি ছিল প্রথম যুগের তুলনায় মন্থর। তা সত্ত্বেও মোটামুটি অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের মধ্যে সমরখন্দ, বুখারাসহ মধ্য এশিয়া; বিশেষ করে আফগানিস্তান ও উজবেকিস্তানের বিরাট অংশ মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। ফলে প্রাচ্য এবং মধ্য প্রাচ্যের দুই পরাশক্তির মধ্যে মোকাবিলা তখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। উল্লেখ্য, ৭০৫-৭১৫ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের খিলাফতকালে সেনাপতি কুতাইবা ইবনে মুসলিমের নেতৃত্বে মুসলিমরা সেন্ট্রাল এশিয়ার বিস্তৃত অংশ জয় করেছিলেন।

রাসুল (সাঃ), খুলাফায়ে রাশেদিন ও উমাইয়া আমলে বিজিত বিস্তৃত ভূখন্ড; Image source: wikipedia.com 

ট্যাং রাজবংশের সাথে উমাইয়া খিলাফতের প্রথম সংঘর্ষ বাঁধে ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে। কারণটা ছিল ফারগানা উপতক্যায় আধিপত্য বিস্তার। সে সময় তিব্বতীয় রাজবংশ উমাইয়াদের পক্ষাবলম্বন করেছিল। প্রাথমিকভাবে উমাইয়া ও তিব্বতীয়দের মিলিত শক্তির লক্ষ্য অর্জিত হলেও অচিরেই ট্যাং সেনাবাহিনী তাদের হৃত স্বার্থ পুনরুদ্ধার করে। এদিকে দুই বছর পর ৭১৭ সালে উমাইয়া ও তিব্বতীয়রা মিলিতভাবে শিনজিয়াং আক্রমণ করে এবং আকসু অঞ্চলের দুটি শহর অবরোধ করে বসে। অবশ্য ট্যাং রাজবংশের অনুগত কারলুক তুর্কদের একটি বাহিনী সেই অবরোধ ভেঙে শহর দুটিকে পুনরায় ট্যাং রাজবংশের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এই কারলুকরাই পরবর্তীতে সময়ে তালাস নদীর যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।   

পরের তিন দশক পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত ছিল। উমাইয়াদের সাথে তুর্কি রাজ্যগুলোর বেশ কিছু সংঘর্ষ হলেও এ সময় উমাইয়া খিলাফতের সীমানায় খুব বেশি পরিবর্তনও আসেনি। তবে এ সময়ে মধ্য এশিয়ায় ট্যাং রাজবংশের আধিপত্য ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট বেড়েছিল। বলা হয়, ট্যাং রাজবংশ তাদের তিন শতাব্দী রাজত্বকালের ইতিহাসে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রতিপত্তির একদম চূড়ায় আরোহণ করেছিল। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো, পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করতে দীর্ঘসময় লাগলেও পতনকাল কিন্তু খুবই সামান্য। ট্যাং রাজবংশের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটেছিল।

ক্ষমতার মধ্য গগনে ট্যাং সাম্রাজ্যের মানচিত্র; Image source: warhistoryonline.com

মধ্য এশিয়ায় ট্যাং সেনাপতি গাও শিয়ানশির সফল অভিযান

৭৪৭ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ট্যাং সেনাবাহিনীর কোরীয় সেনাপতি গাও শিয়ানশি তৎকালীন তিব্বত রাজ্যের অন্তর্গত গিলগিত (বর্তমানে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে ) জয় করেন ও মধ্য এশিয়ার বেশ কিছু ছোট ছোট রাজ্যকে ট্যাং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্যে পরিণত করে। বিদ্রোহের কারণে উমাইয়া সাম্রাজ্যের অবস্থা তখন টালমাটাল। উমাইয়াদের এই দুর্বলতাকে গাও প্রাধান্য বিস্তারের মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলেন। তবে এক আচানক পরিবর্তন সব হিসাব নিকাশ পাল্টে ফেললো। উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সফল হলো। প্রায় নব্বই বছর মুসলিম বিশ্বকে শাসন করার পর ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়াদের খিলাফতের অবসান ঘটলো আব্বাসীয়দের হাতে। বিদ্রোহীদের নেতারা ছিলেন রাসুল (সাঃ) এর আপন চাচা হযরত আব্বাস (রাঃ) এর বংশধর। তাই তাদের আব্বাসীয় বলা হতো। এছাড়া তৎকালীন নিজের আহলে বায়াতের অনুসারী দাবিকারী শিয়ারাও আব্বাসীয়দের সাথে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল।

প্রথম আব্বাসীয় খলিফা হলেন আস সাফফা। তাঁর আসল নাম যা-ই হোক, উপনাম আস সাফফা হিসেবেই তিনি ইতিহাসে বহুল পরিচিত, যার অর্থ রক্তপিপাসু। শুরুর দিকে আব্বাসীয় খিলাফতের বিজয়নেশা উমাইয়াদের চেয়েও তীক্ষ্ণ ছিল। আর এ কারণেই ক্ষমতায় বসে আস সাফফা মধ্য এশিয়ার দিকে মনোনিবেশ করেন।

এবারও ফারগানা উপত্যকা ছিল দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্বের কারণ। ছোট্ট রাজ্য ফারগানা ও তাসখেন্তের মধ্যে দ্বন্দ্ব গড়ালো দুই পরাশক্তির যুদ্ধে।

তালাস নদীর অববাহিকায় দুপক্ষে সৈন্য সমাবেশ; Image source: warhistoryonline.com

ফারগানার আমীরের আমন্ত্রণে গাও শিয়ানশির সৈন্যরা তাসখেন্ত দখল করে নিলে অনন্যোপায় তাসখেন্তের আমীর স্থানীয় আরবদের সাহায্য চান। উল্লেখ্য উজবেকিস্তানের বর্তমান রাজধানী হল তাসখেন্ত। তাসখেন্তের আমীরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুসলিম সেনাপতি যিয়াদ ইবনে সালিহ তাঁর সৈন্যদের নিয়ে অগ্রসর হয়। তাঁর সাথে ছিল তিব্বতীয় এবং উইঘুররা। এদিকে রিইনফোর্সমেন্টের আশায় গাও শিয়ানশি পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করলেন উত্তর দিকে।

শুরু হলো তালাস নদীর যুদ্ধ

অনিবার্য সংঘর্ষের আগে পূর্ব ও পশ্চিমের দুই পরাশক্তি এবং তাদের মিত্রদের নিয়ে গঠিত সেনাদল মিলিত হলো তালাস নদীর পাড়ে। তালাস নদী কিরগিজস্তান এবং কাজাখস্তানের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ‘তালাস নদীর যুদ্ধ’ যে তালাস নদীর পাড়ে বা এর আশেপাশে সংঘঠিত হয়েছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক স্থানটি ঠিক কোথায় অবস্থিত তা আজও চিহ্নিত করা যায়নি। তবে মনে করা হয়, খুব সম্ভবত জায়গাটি কিরগিজস্তান এবং কাজাখস্তান সীমান্তের কাছে।

ঐতিহাসিক তালাস নদী; Image Source: tombussen – WordPress.com

যুদ্ধে কোন পক্ষে সৈন্য কত ছিল এ নিয়ে দু’পক্ষের পরস্পর বিরোধী দাবি রয়েছে। চীনাদের ভাষ্যমতে, আব্বাসী বাহিনী এবং তাদের মিত্রদের নিয়ে গঠিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল দুই লক্ষাধিক। এদিকে ট্যাং ও তাদের মিত্রদের দ্বারা গঠিত চৈনিক বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে আব্বাসীয়দের দাবি ছিল এক লক্ষের কাছাকাছি। তবে নিরপেক্ষ বিচার বিশ্লেষণ এবং আধুনিক গবেষণা থেকে জানা যায়, উভয় পক্ষেরই সৈন্য সংখ্যা ছিল মোটামুটি ২৫-৩০ হাজারের মতো, অর্থাৎ দুই পক্ষের শক্তিমত্তা সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

শিল্পীর আঁকা ছবিতে ‘তালাস নদীর যুদ্ধ’; Image Source: warhistoryonline.com

প্রথম পাঁচদিন উভয় পক্ষের লড়াই চলছিল সমানে সমানে। বলতে গেলে, ট্যাং সেনাবাহিনীই কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে, খিলাফতের প্রাণকেন্দ্রগুলো থেকে মধ্য এশিয়ার বিশাল দূরত্ব এবং এসব অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ অনারব ও অমুসলিম হওয়ায়, আব্বাসীয় বাহিনী পশ্চিমদিকের ফ্রন্টগুলোতে যতটুকু শক্তিশালী ছিল, মধ্য এশিয়া ফ্রন্টে ততটা শক্তিশালী ছিল না। এতদসত্ত্বেও কারলুক তুর্কদের এক রহস্যজনক ভূমিকায় ষষ্ঠ দিনে যুদ্ধের ফলাফল আব্বাসীয়দের পক্ষে এলো। পরাজয় ঘটলো ট্যাং সেনাবাহিনীর। চৈনিক সূত্রগুলোর দাবি, কারলুক তুর্করা যুদ্ধের মাঝখানে আচমকা বিশ্বাসঘাতকতা করে আব্বাসীয়দের পক্ষাবলম্বন করায় তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। এদিকে আব্বাসীয়দের দাবি, কারলুক তুর্করা যুদ্ধের আগেই তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল এবং তারা দূর থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল।

কারলুকরা কি সত্যিই বিশ্বাসঘতকতা করেছিল?

দুই পক্ষের এমন পরস্পরবিরোধী দাবি থেকে সত্যটা নিরূপণ করা বেশ কঠিন। তবে চৈনিকদের দাবি যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে কারলুক তুর্করা তাদের সাথেই আব্বাসীয়দের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করছিল। হঠাৎ করে এতগুলো সৈন্যের পক্ষ পরিবর্তন করার কাহিনী শুনতে বেশ অবিশ্বাস্য লাগে। তার চেয়ে বরং দুই পক্ষের দাবি থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি- কারলুক তুর্করা প্রথম পাঁচদিন যুদ্ধ না করে দূরে ছাউনি করে অবস্থান করছিল। পূর্বের মিত্রতা থেকে ট্যাং সেনাবাহিনী মনে করেছিল, এবারো বুঝি কারলুকদের সমর্থন পাওয়া যাবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে কারলুক ও আব্বাসীয় কোয়ালিশনের মধ্যে কারলুকদের চুক্তি হয়েছে, সেই কথা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। তাই কারলুকদের এই আচমকা আক্রমণ ট্যাংদের দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকটাই বিশ্বাসঘতকতার শামিল। এছাড়া এই তত্ত্ব মেনে নিলে, আব্বাসীয়দের সাথে যে কারলুকরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল সেটাও সত্য বলে প্রমাণিত হয়।  

সে যা-ই হোক, তালাস নদীর যুদ্ধে যুদ্ধে চীনাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল। তবে যুদ্ধে চৈনিকদের কেন পরাজয় হয়েছিল সেই বিশ্লেষণের চেয়ে এই পরাজয়ের সুদূরপ্রসারী ভূমিকা কী ছিল তা ঐতিহাসিকভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা

এই যুদ্ধে আব্বাসীয়দের একতরফা বিজয় অর্জিত হলেও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই যুদ্ধ থেকে কোনো পক্ষই আসলে সুবিধা নিতে পারেনি। কারণ আব্বাসীয়রা এই বিজয়কে পুঁজি করে সামনের দিকে অর্থাৎ চীনের মূল ভূখন্ডে অগ্রসর হতে পারতো। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দূরত্ব। এত লম্বা সাপ্লাই লাইন রক্ষা করা যেকোনো সেনাবাহিনীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এছাড়া প্রতিশোধের নেশায় মত্ত ট্যাং রাজবংশও পরবর্তীতে আব্বাসীয়দের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ৭৫৫ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে শুরু হওয়া বিদ্রোহের ভয়াবহ দাবানলে উল্টো ট্যাং সাম্রাজ্যই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। ট্যাং রাজবংশের মসনদ কাঁপিয়ে দেওয়া এই বিদ্রোহ লুশান বিদ্রোহ নামে পরিচিত। লুশান বিদ্রোহ স্থায়ী হয়েছিল প্রায় ৭ বছর। আব্বাসীয়রা এ সময় ট্যাং রাজবংশের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ফলে বৈরিতার অবসান ঘটে দুই পরাশক্তির।

যেভাবে দুনিয়া জেনে গেল কাগজের অজানা রহস্য

তালাস নদীর যুদ্ধে বহু সংখ্যক চীনা সৈন্য যুদ্ধবন্দী ও নিহত হয়। বিশাল ট্যাং সেনাবাহিনীর সেনাপতি গাও শিয়ানশি অল্প কিছু সৈন্যসহ প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হন। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, যুদ্ধবন্দী চীনাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন দক্ষ কারিগর এবং প্রকৌশলী। তাদের মাধ্যমেই কাগজ তৈরির প্রযুক্তি আরবদের হস্তগত হয়। সেই খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সাই লুন কাগজ আবিষ্কার করার পর, দীর্ঘ আটশ বছর সেই কৌশল কেবল চীনা, কোরীয় ও জাপানীদেরই জানা ছিল।

কিন্তু তালাস নদীর যুদ্ধের পর কাগজ তৈরির প্রযুক্তি প্রথমবারের মতো পূর্ব এশিয়ার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সমরখন্দে কাগজ কল স্থাপিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে বাগদাদসহ আব্বাসীয় খিলাফতের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে এই শিল্পের বিকাশ ঘটে। ইউরোপের প্রথম কাগজকল স্থাপিত হয়েছিল স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায়, ১০৫৬ সালে। অবশ্যি সেটাও আরব বণিকদেরই প্রভাবে, কেননা সে সময়ে আইবেরীয় উপদ্বীপ অর্থাৎ স্পেন-পর্তুগালের বিশাল অংশ মুসলিম-আরবদের অধীনে ছিল।

আজও তৈরি হয় সমরখন্দের সেই বিখ্যাত কাগজ; Image source: pinterest.com

তালাস নদীর যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী প্রভাব

শুধু কাগজের প্রযুক্তি স্থানান্তরের কারণে নয়, তালাস নদীর যুদ্ধ বহুমাত্রিক কারণে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে।

প্রথমত, মধ্য এশিয়ার পরবর্তী চার শতাব্দীর ভূ-রাজনীতি বদলে দিয়েছিল এই একটি যুদ্ধ। সাথে সাথে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিস্তার করেছিল ধর্ম, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে। কারণ তালাস নদীর যুদ্ধ অনেকটা অলিখিতভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছিল মধ্যে এশিয়ার কতটুকু অংশ আব্বাসীয় খেলাফত ও ট্যাং রাজবংশের মধ্যে থাকবে। অর্থাৎ সে সময়ের দুই পরাশক্তির স্থানগত সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল এই যুদ্ধে।

তালাস নদীর যুদ্ধে বিজয়ের পর সিল্করুটের একটা বড় অংশ আব্বাসীয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, যা তাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক ছিল। এছাড়া মধ্য এশিয়ার তুর্কী গোত্রগুলো এ সময় মুসলিমদের সান্নিধ্যে আসে এবং পরবর্তী তিন শতাব্দীতে ক্রমান্বয়ে এদের অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করে। এদিকে তালাস নদীর যুদ্ধের পর তিব্বত ও চীনের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। এ কারণে পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে তিব্বত এবং চীনের বৌদ্ধ ধর্ম ভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে বৌদ্ধ ধর্মের চীনা সংস্করণ এবং তিব্বতীয় সংস্করণে এত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

তিব্বতীয় বুদ্ধমূর্তি এবং চীনা বুদ্ধমূর্তি; Image source: www.invaluable.com 

ইতিহাসে পাতায় তালাস নদীর যুদ্ধ    

মজার ব্যাপার হলো, তৎকালীন মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখায় কিন্তু ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধের তেমন কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। এমনকি জগৎবিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং তাফসীরকারক জারির তাবারী (রাহিঃ) (৮৩৯-৯২৩) তাঁর কোনো লেখায় তালাস নদীর যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেননি। তবে এই যুদ্ধের প্রায় অর্ধ সহস্রাব্দ পর ইবনে আসির (রাহিঃ) (১১৬০-১২৩৩) এবং ইমাম যাহাবি (রাহিঃ) (১২৭৪-১৩৪৮) এর লেখায় এই যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায়। সে যা-ই হোক, তালাস নদীর যুদ্ধ ইতিহাসে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিল, যা কোনো অংশেই টুরসের যুদ্ধ কিংবা আইন জালুতের যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, এই যুদ্ধটি সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি ইতিহাসের ঔৎসুক পাঠকদের কাছেও বেশ অপরিচিত।

শেষ কথা

‘তালাস নদীর যুদ্ধ’কে আদর্শিক যুদ্ধ না বলে স্বার্থভিত্তিক যুদ্ধ বলাই শ্রেয়। কারণ মুসলিম আব্বাসীয় বাহিনীর সাথে অমুসলিম উইঘুর ও তিব্বতীয় সেনারাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ট্যাং সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এ যুদ্ধে ট্যাং বাহিনীর প্রধান সেনাপতি গাও শিয়ানশি নিজেও জাতিগতভাবে চৈনিক ছিলেন না। সব মিলিয়ে তালাস নদীর যুদ্ধটি ছিল আপাতভাবে অগুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়া একটি মহাকাব্যিক যুদ্ধ। আর এ কারণেই হাজার বছর পরও এই যুদ্ধের উপাখ্যান লেখা হচ্ছে, হচ্ছে আলোচনা-সমালোচনা।  

ফিচার ইমেজঃ youtube চ্যানেল Kings and Generals

Related Articles

Exit mobile version