চীনের এক প্রাচীন শহর সিয়ান। চীনের সানসি প্রদেশের রাজধানী এই সিয়ান। প্রাচীনকালে এর নাম ছিল ছাংআন। চীনের সবচেয়ে পুরনো শহরগুলোর একটি। খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতক থেকে ছাংআন ছিল চীনের রাজধানী। পরপর এগারোটি রাজবংশ এখানে রাজত্ব করেছে। হাজার বছরের পুরনো এই শহর থেকেই ঐতিহাসিক সিল্ক রুটের শুরু।
হান রাজত্বকালেই শুরু হয় সিল্ক রুটের ঐতিহাসিক যাত্রাপথ
হান রাজাদের আমল থেকে (খ্রিস্টপূর্ব ২০৬-২২০) ছাংআনের গুরুত্ব খুব বেড়ে যায়। এ সময়েই দেশ-বিদেশের সাথে ছাংআনের বাণিজ্য ও সংস্কৃতি বিনিময়ের পথ উন্মুক্ত হয়। মুক্ত করে দেয়া হয় বাইরের পৃথিবীর সাথে ছাংআনের যাতায়াতের পথ, ঐতিহাসিকরা যে পথটির নাম দিয়েছের সিল্ক রুট।
রেশম ছিল এই পথে পণ্য রপ্তানির এক প্রধান উপকরণ। সেই থেকেই এ পথের নাম রেশম পথ বা সিল্ক রুট। এ পথের শুরু ছাংআন বা সিয়ান থেকে। সানসি রাজ্যেই এই সিল্ক রুট দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একটি পথ গেছে ইয়ানগজি নদীর তীর বরাবর। আর অন্যটি উইহে নদীর পাশ দিয়ে। আবার এই দুটি পথই পরবর্তীতে এসে মিলেছে উওয়েই রাজ্যে। তিয়ানশান পাহাড়ের দক্ষিণে, লোপজুরের উত্তর-পশ্চিমে টাকলামাকান মরুভূমির পাশ দিয়ে পামির মালভূমি পেরিয়ে সিল্ক রুটের একটি অংশ চলে গেছে। অন্যটি তুরফান ছেড়ে টাকলামাকান মরুভূমির মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে।
হাজার হাজার কিলোমিটারের এই দুর্গম পথ মধ্য এশিয়ার বহু রাজ্যের সাথে মিলিত হয়েছে। তারপর সিনসিয়াংয়ের মধ্য দিয়ে আধুনিক সোভিয়েত মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তান পেরিয়ে রেশম পথ ভারতে এসে প্রবেশ করেছে। শুধু ভারতের সাথেই নয়, পারস্য এবং রোম সাম্রাজ্যের সাথেও চীনের যোগাযোগের প্রধান সূত্র ছিল এই সিল্ক রুট।
ভারত থেকে চীনে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে এই সিল্ক রুট ধরেই
চীন ও ভারত এই দুই দেশের বিশাল সীমান্ত জুড়ে আছে হিমালয় পর্বতমালা। তিব্বত থেকে নেমে এসেছে খরস্রোতা ইয়ালুজাংপো, ভারতে তার নাম ব্রহ্মপুত্র। খুব একটা নাব্য নয় পার্বত্য এই নদ। চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক দু’হাজার বছরেরও বেশি পুরনো হলেও দু’দেশের মধ্যে যাতায়াতের পথ কিন্তু কোনো সময়ই সুগম ছিল না। তুষারাবৃত গিরিপর্বত, শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য, জনমানবহীন মরুভূমির মধ্য দিয়ে বিপদকে হাতে নিয়ে যাত্রীদল সিল্ক রুট ধরে যাতায়াত করতেন।
চীন থেকে ভারতে যাতায়াতের আরও একটি পথ ছিল, তা তিব্বত ও নেপাল হয়ে, এই দুর্গম পথে ভারতে এসেছিলেন বৌদ্ধভিক্ষু জুয়ান জ্যাং (অনেকে তাকে হুয়ান চুয়াং নামেও ডাকেন) (৬২৭-৬৪৯ খ্রিস্টাব্দ) আর একাদশ শতকে তিব্বতে গিয়েছিলেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ। জলপথেও অনেকে ভারতে এসেছেন। তবে অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ভারত থেকে চীনে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব, প্রচার ও প্রসার এই সিল্ক রুট ধরেই।
সম্রাট মিংয়ের আমন্ত্রণে প্রথম আচার্য মাতঙ্গ কাশ্যপের চীন যাত্রা
চীনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে চীনারা প্রথম বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জানতে পারেন। এর এক শতাব্দী পরে হান রাজদরবারে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে প্রথম তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে হান রাজবংশে কীভাবে বৌদ্ধ ধর্মের সূত্রপাত ঘটে তা নিয়ে এক মজার কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।
৬৮ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে কথা। হান সম্রাট মিংয়ের রাজধানী ছিল লুওইয়াং। সেসময় এ অঞ্চলে তাওবাদ নামে এক ধর্মের উদ্ভব হয়, যা উচ্চশ্রেণীর মানুষদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে সম্রাট মিং এই সময় এমন এক মতবাদের প্রচলনের চেষ্টা করছিলেন যেন তার সব প্রজা তা গ্রহণ করতে পারেন।
এমনই সময় সম্রাট মিং এক রাতে গৌতম বুদ্ধের উজ্জ্বল এক সৌম্যমূর্তি চেহারা স্বপ্নে দেখতে পান। পরদিন রাজদরবারে মন্ত্রীদেরকে তিনি বিষয়টি জানান। সবাই সেই সৌম্যমূর্তিকে পশ্চিমের ভগবান হিসেবে উল্লেখ করেন। পরবতীকালে বিভিন্নভাবে বৌদ্ধ ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতাবাদ সম্পর্কে টুকরো টুকরো তথ্য তার কাছে আসতে থাকে। কিন্তু তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে বিশদভাবে জানার জন্য তিনি ভারতবর্ষে তার আঠারোজনের এক প্রতিনিধি দল পাঠান।
আফগানিস্তানের গান্ধারা প্রদেশে এসে প্রতিনিধিদল দুজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ পান। এদের একজন ছিলেন মাতঙ্গ কাশ্যপ এবং অপরজন ছিলেন ভারানা গোবাকরণ পন্ডিত (পরবর্তীকালে মাতঙ্গ কাশ্যপ, শি মাত্যাং নামে এবং ভারানা গোবাকরণ, জু ফাল্যাং নামে চীনে পরিচিতি পান)। সম্রাটের প্রতিনিধিরা এ দুজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে চীনে আসার আমন্ত্রণ জানান। ওই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এ দুই পন্ডিত সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হন। সম্রাটকে উপহার দেয়ার জন্য কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রের নানা পুঁথি তারা সাথে নিয়ে আসেন।
সিল্ক রুট ধরে সাদা ঘোড়ায় চেপে তারা আসেন বলে সম্রাট মিং তাদের সম্মানার্থে যে বিহার লুওইয়াংয়ে তৈরি করেন, তার নাম দেয়া হয় ‘শ্বেতাশ্ব বিহার’। ৬৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত চীনের এটি সর্বপ্রথম বৌদ্ধবিহার। এখানে সযত্নে রক্ষিত আছে মাতঙ্গ কাশ্যপের বাসস্থান, ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও পাহাড়ের চূড়ায় তার সমাধি। লুওইয়াংয়ে শ্বেতাশ্ব বিহারের প্রবেশপথের দু’পাশে পাথরের তৈরি দুটি বিরাট সাদা ঘোড়ার স্ট্যাচু। এ বিহারে থেকে এ দুজন পন্ডিত বৌদ্ধধর্মের বেশ কিছু পবিত্র গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনুবাদ করেন।
চতুর্থ শতকে ধর্মপ্রচারের জন্য বৌদ্ধভিক্ষু কুমারজীবের চীনে আগমন
কুমারজীব, কাশ্মিরের ভারতীয় এক পণ্ডিতের সন্তান। তিনি ৩৪৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী হন। মাত্র ১২ বছরে বয়সে তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষিত হন। পরবর্তীকালে একজন স্বনামধন্য বৌদ্ধপন্ডিত হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন।
শৈশবে সংস্কৃতি ভাষায় শিক্ষালাভ করলেও চীনা ভাষায়ও তার সমান দক্ষতা ছিল। তাই ৪০২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ইউ চ্যাংয়ের আমন্ত্রণে কুমারজীব সিল্ক রুট ধরেই চীনে যান। চীনে ভাষায় বৌদ্ধধর্মের প্রচার এবং প্রসারের ব্যাপারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সম্রাট তার সম্মানে কাওটাং বিহার নির্মাণ করেন। কুমারজীব কাওটাং বিহারে তার জীবনের বাকি সময়টা অতিবাহিত করেন।
এই বারো বছর ধরে, ৪১৩ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত, কুমারজীব বৌদ্ধ গ্রন্থের নানা অনুবাদ এবং তার পূর্ববর্তী সময়ের বিভিন্ন অনুবাদের সংশোধনের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। সম্রাটের উদ্যোগে কুমারজীবের তত্ত্বাবধানে একটি অনুবাদ সংস্থা গড়ে তোলা হয়, যেখানে ৮০০ এর বেশি পন্ডিত এই অনুবাদের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। কুমারজীবের তত্ত্বাবধানে মহায়ণ গ্রন্থের অনুবাদসহ ১০৬টিরও বেশি গ্রন্থের অনুবাদ করা হয়। এর মধ্যে ৫৬টি অনুবাদ গ্রন্থ এখনও পাওয়া যায়। কুমারজীবের জীবনকথায় সিল্ক রুট ধরে ভারতে যাতায়াতের এক বিস্তৃত এবং তথ্যবহুল বর্ণনা পাওয়া যায়।
চীনের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ফা-সিয়ান-এর ভারত ভ্রমণ
ফা-সিয়ান ভারতে এসেছিলেন সিল্ক রুট ধরে, দেশে ফিরেছিলেন পনেরো বছর পরে, জলপথে। তিনি ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে চীন থেকে যাত্রা করে ত্রিশটি রাজ্য পার হয়ে ভারতে পৌঁছেছিলেন। রাজধানী ছাংআন ছেড়ে ফা-সিয়ান ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন তার পনেরো বছর পরে তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। এই পনেরো বছরের মধ্যে তার ছয় বছর কেটেছিল ভারতে যাত্রাপথে, ছয় বছর ভারতে, আর তিন বছর দেশে ফেরার পথে। দলের নয়জনের মধ্যে মাত্র তিনজন ৪১৪ খ্রিস্টাব্দে চীনে ফিরে এসেছিলেন। ফা-সিয়ান রচিত ‘বৌদ্ধদেশের বিবরণ’ (কোকুওচি) গ্রন্থে সিল্ক রুট ধরে ভারতে যাওয়ার এই দুঃসাহসিক অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায়। ফা-সিয়ানের সেই গ্রন্থে রুক্ষ এবং বিপদসঙ্কুল এক সিল্ক রুটের চিত্র উঠে আসে।
তুনহুয়াং ছেড়ে একটি মরুভূমি পার হয়ে তিনি ও তার দল দল পশ্চিমদিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই মরুভূমির মধ্যে একটি পাখিকেও তারা উড়তে দেখেননি, কোনো পশুর ডাকও শোনেননি, যত দূর দৃষ্টি যায়, শুধু চারদিকে ছড়িয়ে থাকা মানুষের কঙ্কাল তাদের পথের নিশানা দিয়েছে।
তিনি ও তার সঙ্গীরা খাড়া পাহাড়ের গায়ে খোদিত সাতশো সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটি দড়ির ঝোলানো সেতু পেয়েছিলেন। এরপর বিশাল সিন্ধু নদ পেরিয়ে তিনি ও তার দল ভারতের সীমান্তে এসে পৌঁছেছিলেন। সেই সময় পশ্চিামঞ্চল বলতে অনেকগুলো রাজ্যকে বোঝানো হতো। এই সব দেশের মানুষ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। তারা বিভিন্ন ভাষাভাষী হলেও বৌদ্ধভিক্ষুরা সবাই সংস্কৃত জানতেন। সংস্কৃতে কথাবার্তা বলতে পারতেন। এই পশ্চিমাঞ্চলের অনেকগুলো রাজ্যই পরবর্তীকালে সিনচিয়াং প্রদেশের অধীনে চলে আসে।
বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জানতে জুয়ান জ্যাংয়ের ভারত যাত্রা
জুয়ান জ্যাং তার ‘তাথাং সিইয়ুচি’ (থাং রাজবংশের সময়ে পশ্চিাঞ্চলের দেশগুলোর বিবরণ) গ্রন্থে পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের ১৩৮টি রাজ্যের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। এই বিবরণে সিনচিয়াং, আধুনিক সোভিয়েত মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, ভারতবর্ষ, বর্তমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশ সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে জুয়ান জ্যাং বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন। শুধু ধর্মে নয়, বৌদ্ধ সাহিত্য দর্শনেও তার প্রবল আগ্রহ ছিল। বৌদ্ধধর্ম চর্চার কেন্দ্র ভারতে আরও উচ্চতর, গভীরতর জ্ঞানের সন্ধানে তিনি ভারতবর্ষে যেতে চান। কিন্তু সম্রাট অনুমতি দিচ্ছিলেন না। কিন্তু কিছুতেই জুয়ান জ্যাংকে নিরস্ত করা গেল না। ছদ্মবেশে গোপনে তিনি ছাংআন ছেড়ে গেলেন, ভয়ঙ্কর বিপদে ভরা সিল্ক রুটে শুরু হলো তার নিঃসঙ্গ যাত্রা।
হাজার হাজার কিলোমিটার পথে, বছরের পর বছর ধরে। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে, পানির অভাবে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। মৃত্যুকে হাতে নিয়ে তিনি বিপদসঙ্কুল সিল্ক রুট অতিক্রম করেছিলেন। আধুনিক সিনচিয়াংয়ের তুরফান অঞ্চল পেরিয়ে একে একে সোভিয়েত উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে তিনি এসে পৌঁছলেন ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে। ভারতের নালন্দা বিহারে ও সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজসভায় কয়েক বছর কাটিয়ে নানা দেশ ঘুরে তিনি সিল্ক রুট ধরেই তার দেশে ফিরে যান।
সিল্ক রুটের শেষে সিয়ানে নিজের হাতে গড়া ‘তা ইয়ান তা’ বিহারে জীবনের শেষ বছরগুলো শাস্ত্রচর্চা ও অধ্যাপনা এবং বৌদ্ধগ্রন্থ অনুবাদের কাজে কাটালেন জুয়ান জ্যাং। সিয়ানের এ বিশাল রাজহংস বিহারে ভারত ও অন্য দেশ থেকে আনা তার অমূল্য সংগ্রহ সযত্নে রক্ষিত আছে।
রেশম পথের ধরে বোধিধর্মের চীনে আগমন
সিল্ক রুটের ধারে লুওইয়াংয়ের পাহাড়ের মাথায় শাওলিন বৌদ্ধবিহার। মূল মন্দিরের পেছনের দেওয়াল জুড়ে এক বিরাট রঙিন ছবি। সেই ছবিতে দেখা যায়, উঁচু পাহাড় আর ঘন বনের পাশ কাটিয়ে এক দীর্ঘ পথ চলেছে। সেই পথের একদিক থেকে আসছেন এক ঘোড়াসওয়ার চীনা রাজদূত, অন্য দিক থেকে পায়ে হেঁটে আসছেন এক বৌদ্ধভিক্ষু। তিনিই বোধিধর্ম বা ‘তামো’, চীনের ছেলে-বুড়ো সবার নমস্য।
ভারতীয় এই বৌদ্ধপন্ডিত একটি কারণে চীনে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। খালি হাতে লড়াই, কুং-ফ, ক্যারাটে, জুজুৎসু, জুডো এই ধরনের লড়াই বোধিধর্মই প্রথম চীনের মানুষদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। অস্ত্রহীন বৌদ্ধভিক্ষু সশস্ত্র শত্রুর আক্রমণ ঠেকিয়েছেন- এই ‘মার্শাল আর্ট’ বা যুদ্ধবিদ্যা বোধিধর্মেরই উদ্ভাবনা।
শাওলিন বৌদ্ধবিহারের আশেপাশের পাহাড়ের মাথায় ঢালু জমিতে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা, তরুণ-তরুণীরা শয়ে শয়ে এই মার্শাল আর্ট শেখার জন্য দল বেঁধে আসে। এখনও তারা সেই শিক্ষা গ্রহণ করে চলেছে। নয় বছর চীনে কাটিয়ে বোধিধর্ম রেশম পথ ধরেই ভারতে ফিরে যান।
সমগ্র রেশম পথ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন
সেই অতীতকাল থেকেই কত বণিক, ধর্মপ্রচারক আর ভাগ্যন্বেষীর দল কখনও উট, কখনও বা ঘোড়ায় চড়ে আবার কখনও পায়ে হেঁটে এই এই পথ ধরে বেরিয়ে পড়েছিলেন। সেসব দুঃসাহসিক অভিযানে পথের দু’ধারে ছড়িয়ে আছে হাজারো বছরের কত অনন্য সব সাংস্কৃতিক সম্পদ, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা দর্শনীয় সব স্থান। এ পথে যেতে যেতেই দেখা মিলবে প্রাচীন ছিন রাজবংশের রাজধানী সিয়ানইয়াং, জিনতাই মন্দির, বৌদ্ধাচার্য জুয়ান জ্যাংয়ের নির্মিত বিহার, ফা-হিয়েনের নির্মিত বিহার, ছিন পর্বতমালা, মাইজিশন গুহামন্দির, শ্বেতস্তূপ ও পঞ্চনির্কর পাহাড়, হাজার বুদ্ধের গুহামন্দির, মানব সভ্যতার ইতিহাসের আরও কতশত বিচিত্র সব নিদর্শন।
চীনের প্রথম বৌদ্ধবিহার ‘শ্বেতাশ্ব বিহারে’ ভারতীয় বৌদ্ধপন্ডিত কুমারজীব, বোধিধর্ম, চীনের বৌদ্ধভিক্ষু ফা-সিয়ান, ত্রিপিটকধর জুয়ান জ্যাং, ই-চিং প্রভৃতি ইতিহাসখ্যাত বৌদ্ধপন্ডিতদের বিহারাবাসের নানা নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে।
পীত নদীর তীরে বারোশ কিলোমিটার বিস্তৃত মরূদ্যান। সিল্ক রুটের যাত্রীদের দীর্ঘ পথযাত্রায় নিশ্চিন্ত বিশ্রাম স্থান। দাজু গুহায় শায়িত বুদ্ধের বিশাল মূর্তি, তুনহুয়াংয়ে মোগাও গুহার স্থাপত্যশিল্প, চীনের শিল্পকলায় ভারতীয় প্রভাবের চিহ্নবাহী।
আধুনিক মানুষের কাছেও এই সিল্ক রুটের আকর্ষণ কম নয়। জুয়ান জ্যাংয়ের ঐতিহাসিক বিবরণ অনুসরণ করে সোভিয়েত পন্ডিতরা মধ্য এশিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা চালিয়েছেন। নিফা আর তুরফানে খননকাজে পাওয়া গেছে বহুবর্ণের বিচিত্র কারুকার্যময় রেশমবস্ত্র, সিফানে পাওয়া গেছে ব্রোঞ্জের ছুটন্ত ঘোড়া, রথ, রোমের স্বর্ণমুদ্রা, এমনই কত পুরাকীর্তি।
চীনের সিল্ক রুট শুধুমাত্র পণ্যবাহী পথ ছিল না, সে যুগের এশিয়া ও ইউরোপের যোগসূত্র ছিল, সিল্ক রুট নিয়ে আধুনিক গবেষকদের কৌতূহল আজও তাই কিছুমাত্র কমেনি।