আকাশযুদ্ধে নেমেই একের পর এক মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলোকে ধরাশায়ী করতে শুরু করেছিল জাপানের মিতসুবিশি জিরো ফাইটার। ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি নিজের ভয়ংকর ক্ষমতার প্রমাণ দিতে শুরু করে জিরো। এরপর থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত জাপানী এই যুদ্ধবিমান প্রতিপক্ষ হিসেবে যে যুদ্ধবিমানেরই মুখোমুখি হয়েছে, প্রায় সবগুলোর বিপক্ষেই পেয়েছে ব্যাপক সাফল্য। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডাচ, ব্রিটিশ, আমেরিকান ও অস্ট্রেলিয়ান বাহিনীর মডেল ৩৩৯ বাফেলোজ, কার্টিস-রাইট সিডব্লিউ-২১ বেস, কার্টিস হক ৭৫এ-৭এস এবং কার্টিস পি-৪০ ইত্যাদি যুদ্ধবিমান। মিতসুবিশির দুর্দান্ত গতি ও অসামান্য ম্যানুভার্যাবিলিটির সামনে দাঁড়াতে না পেরে, একসময় মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো চেষ্টা করেছে কাছাকাছি দূরত্বে ডগফাইট এড়িয়ে চলতে এবং বাধ্য হয়েছে ‘থ্যাচ উইভ’ বা ‘বুম-এন্ড-জুম’ নামের বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে এই দুর্ধর্ষ ক্যারিয়ার বেজড যুদ্ধবিমানের সাথে লড়াই করতে।
আকাশযুদ্ধে জিরো ফাইটারের আধিপত্য খর্ব করার জন্য মরিয়া হয়ে যুক্তরাষ্ট্র আরও শক্তিশালী যুদ্ধবিমান তৈরি করার কাজ হাতে নেয়। ১৯৪৩ সালে মূলত যখন এফ৬এফ হেলক্যাট আকাশযুদ্ধে ব্যাপক পরিসরে অংশগ্রহণ শুরু করে, তখনই শেষ হতে থাকে জিরো ফাইটারের আধিপত্য।
ক্যারিয়ার বেজড যুদ্ধবিমান হলেও, জিরো ফাইটার ল্যান্ড বেজড যুদ্ধবিমানগুলোর বিপক্ষেও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছিল নিজের সেরা সময়ে। পাতলা কাঠামোর জিরো ফাইটারের হালকা ওজনের জন্য ছাড় দিতে হয়েছিল সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো, ঠিক এজন্যই ম্যানুভার্যাবিলিটি ও গতির দিক দিয়ে ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল বিমানটি। ফলে, বিমানটির শক্তির উৎসই ছিল এর দুর্বলতা। আকোতান দ্বীপে ১৯৪২ সালে একটি জিরো ফাইটার প্রায় অক্ষত অবস্থায় ভূপাতিত হলে, আমেরিকার হাতে অসামান্য সুযোগ আসে যুদ্ধবিমানটির শক্তি ও দুর্বলতা বের করে এর বিপক্ষে নতুন যুদ্ধবিমান তৈরির। আকোতান দ্বীপের আকস্মিক ঘটনার দরুন অল্প সময়েই যুদ্ধের ময়দানে নামানো সম্ভব হয়েছিল এফ৬এফ হেলক্যাট ও এফ৪ইউ করসারের মতো যুদ্ধবিমান, যেগুলো অধিক শক্তিশালী হয়ে ও জিরোর দুর্বলতা জেনেই মুখোমুখি হয়েছিল জাপানের অন্যতম সেরা অস্ত্রের বিপক্ষে।
পার্ল হারবারে জাপানের আক্রমণের আগে থেকেই গ্রুমান এফ৪এফ ওয়াইল্ডক্যাটের উত্তরসূরি যুদ্ধবিমান নিয়ে কাজ করছিলেন। পরবর্তীতে জিরো ফাইটারের কাছে ওয়াইল্ডক্যাটের মার খাওয়ার পর, আরও শক্তিশালী ও উন্নত মানের যুদ্ধবিমানের প্রয়োজনীয়তা এমনিতেই প্রকট আকার ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর জন্য। জাপানী জিরোর বিপক্ষে ওয়াইল্ডক্যাটের পরিসংখ্যান পর্যালোচনার উপর ভিত্তি করেই নির্ধারণ করা হয় যে, ঠিক কোন ধরনের যুদ্ধবিমান জিরোকে টেক্কা দিতে পারবে। একইসাথে, অভিজ্ঞদের মতামতের উপরও জোর দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। প্রাথমিক প্রোটোটাইপ বিমানে সাইক্লোন ইঞ্জিন লাগানো হলেও, আরও শক্তিশালী পারফর্মেন্সের জন্য পরে ২০০০ হর্সপাওয়ারের প্র্যাট ও হুইটনি আর-২৮০০ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় বিমানটিতে। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ১৯৪২ সালের শেষের দিকে ফ্যাক্টরিতে পূর্ণ মাত্রায় উৎপাদন শুরু হয় এফ৬এফ হেলক্যাটের। অনেকটা এফ৪এফ ওয়াইল্ডক্যাটের মতো দেখতে হলেও, হেলক্যাট আকারে বড় ছিলো এবং ককপিটের উচ্চতাও বাড়ানো হয়েছিল। পাইলট, ইঞ্জিন ও সেলফ-সিলিং ফুয়েল ট্যাংকের সুরক্ষার জন্য হেলক্যাটে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল অত্যন্ত শক্তিশালী আর্মার। ৩৩ ফুট ৭ ইঞ্চি যুদ্ধবিমানের সর্বোচ্চ গতি ছিল ৩৮০ মাইল/ঘণ্টা, যা জিরোর চেয়েও বেশি। ৬টি ০.৫০ ক্যালিবারের এম২ ব্রাউনিং মেশিনগানের সাথে আরও ছিল ৬টি ১২৭ মিলিমিটারের এইচভিএআরএস (HVARs) বা ২টি ১১.৭৫ ইঞ্চি টাইনি টিম আনগাইডেড রকেট। জিরো ফাইটারকে পরাস্ত করার উদ্দেশ্যে বানানো এই যুদ্ধবিমানটি আকাশযুদ্ধে সামিল হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জিরোর আধিপত্য ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।
১৯৪৩ সালের ৩১ আগস্ট, মার্কাস দ্বীপে হেলক্যাটের প্রথম শিকার ছিল কাওয়ানিশি এইচ৮কে ‘এমিলি’। মূল প্রতিপক্ষ জিরোর মুখোমুখি হতে হয়েছিল আরও কিছুদিন পর। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ওয়েক দ্বীপের আক্রমণে এবং নভেম্বরে রাবাউল ও তারাওয়ার আকাশ যুদ্ধে হেলক্যাটের কাছে জিরোর আধিপত্য খর্ব হওয়া শুরু হয়। মাত্র একটি হেলক্যাট হারিয়ে ৩০টি জিরো ফাইটার ভূপাতিত করে যুক্তরাষ্ট্রের পাইলটরা। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর অন্যতম ভরসায় পরিণত হয় এফ৬এফ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জুড়ে জিরো ফাইটার বধ করে যাওয়া এফ৬এফ যুদ্ধবিমানটিকে দেওয়া হয় ‘জিরো কিলার’ খেতাব। জাপানী এই যুদ্ধবিমানের বিপক্ষে হেলক্যাটের সাফল্যের অনুপাত ছিল ১৩:১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর সার্ভিসে না থাকলেও, সার্ভিসে থাকাকালীন সময়ে ৫,২৭১টি লক্ষ্য ধ্বংস করার রেকর্ড নিয়ে বিমানটি পরিণত হয়েছে নৌ বাহিনীর সর্বকালের সেরা যুদ্ধবিমানের একটিতে। ইউএস নেভি ও ইউএস মেরিন কর্পসের পাইলটরা মাত্র ২৭১টি হেলক্যাট হারিয়ে এই সাফল্য অর্জন করে, যেখানে প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তাদের সাফল্যের অনুপাত ১৯:১!
ফিলিপাইন সমুদ্রের যুদ্ধে ‘গ্রেট মারিয়ানাস টার্কি শুটে’ প্রথম অংশে সকালের দিকে ৬৯টি যুদ্ধবিমান নিয়ে প্রথম ধাপে আক্রমণ শুরু করে জাপান। জাপানের এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ২২০টি হেলক্যাট ওড়ানো হয় আকাশে। মাত্র ৩৫ মিনিটে ৪১টি জাপানী যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়ে যায়। সকাল ১১টার দিকে আবারও ১০৯টি যুদ্ধবিমানের বড় দল নিয়ে আক্রমণ করতে আসলেও জাপান একদমই সুবিধা করতে পারেনি। ১৫টি ক্যারিয়ারের ৪টি দল এবং ৭টি ব্যাটলশিপে নিয়ে গঠিত টিএফ-৫৮ ছিল জাপানের লক্ষ্য। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানোর পূর্বেই ৭০টি যুদ্ধবিমান হারায় জাপান এবং এই আক্রমণ শেষ হতে হতে ধ্বংস হয়ে যায় ৯৭টি জাপানী যুদ্ধবিমান। দুপুরের পরে তৃতীয় দফায় আবারও আক্রমণের ব্যর্থ চেষ্টা চালায় জাপান। এরপর আরও দুবার যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ জাহাজকে লক্ষ্য করে আক্রমণের চেষ্টা করলেও, একবারও তেমন সুবিধা করতে পারেনি দেশটি। পরবর্তীতে, গুয়ামের উপর দিয়ে অরোটে পৌঁছানোর চেষ্টা করলে হেলক্যাটের আক্রমণে ৪২টির মধ্যে ৩০টি যুদ্ধবিমান হারায় জাপান। এটি ছিল হেলক্যাটের সবচেয়ে সেরা দিনগুলোর একটি।
প্রায় সব উচ্চতায় জিরোর চেয়ে দ্রুতগতির এবং ভালো ডাইভার ছিল হেলক্যাট। তাছাড়া, অপেক্ষাকৃত কম গতিতে জিরোর ম্যানুভার্যাবিলিটি সেরা হলেও, গতি বৃদ্ধির সাথে তা কমে যেত। হেলক্যাটের এই সমস্যা ছিল না। যদিও স্বল্প গতিতে তখনও ম্যানুভার্যাবিলিটি ও স্বল্প উচ্চতায় দ্রুত উপরে ওঠায় এগিয়ে ছিল জিরো। তবে জিরোর বিপক্ষে হেলক্যাটের সুবিধা ছিল শক্তিশালী আর্মার ও দ্রুত গতিতেও প্রায় একই পারফর্মেন্স। অন্যদিকে, জিরোর পাতলা সুরক্ষাবিহীন কাঠামোতে মাত্র একটি গুলির আঘাতও ছিল মারাত্মক রকমের প্রাণঘাতী। তাই, জিরোর বিপক্ষে শক্তিশালী হেলক্যাটের সাফল্য পেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি।
হেলক্যাট খুব দ্রুত তৈরি করা যেত, গ্রুমান প্ল্যান্টে প্রায় ২০,০০০ কর্মী হেলক্যাট উৎপাদনে কাজ করত। ১৯৪৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১২,২৭৫টি এফ৬এফ তৈরি করা হয়েছিল। এই সময়ে এই যুদ্ধবিমানটির বেশ কয়েকটি সংস্করণ বের করা হয়। মোটামুটি প্রতিটি সংস্করণ ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্যের বা বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি। যেমন, এফ৬এফ-৩/৫এন ছিল নৌ বাহিনীর রাতের আক্রমণের জন্য, যেটিতে এএন/এপিএস-৪ রাডার সংযুক্ত করা হয়েছিল। এফ৬এফ যুদ্ধবিমানের বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে অন্যতম হলো এফ৬এফ-৩এনএস, এফ৬এফ-৫, এফ৬এফ-৩এন, এফ৬এফ-৫এন, এফ৬এফ-৫এস এবং এফ৬এফপি ইত্যাদি।
জাপানীদের কামিকাজে আক্রমণ প্রতিহত করার হেলক্যাটের সাথে যোগ দেয় এফ৪ইউ করসার। মূলত ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মেরিন কর্পসের পাইলটদের মধ্যেই এই অত্যন্ত দ্রুত গতির যুদ্ধবিমানটির ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকলেও, ১৯৪৪ সালে নৌ বাহিনীও এটি ব্যাপক হারে ব্যবহার শুরু করে। হেলক্যাট ও করসার, এই দুটি যুদ্ধবিমান একসাথে যোগ দেওয়ার পর আকাশযুদ্ধে আরও শক্তিশালী হয়ে মার্কিনীরা।
যুদ্ধের শেষের দিকে আকাশে হেলক্যাটের প্রবল কর্তৃত্বের বিপক্ষে জাপানের একমাত্র উপযুক্ত ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রমাণ করেছিল কাওয়ানিশি এন১কে ‘জর্জ’। যদিও, এফ৬এফ যুদ্ধবিমানের তুলনায় সংখ্যায় অত্যন্ত কম হওয়ায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি এটি। ততদিনে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত বিমান হামলায় জাপানের অবকাঠামো ও বিমান তৈরির পর্যাপ্ত কাঁচামাল যোগান ব্যবস্থা সবই প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ‘জিরো কিলার’ খ্যাত এফ৬এফ হেলক্যাট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষেই দৃশ্যপট থেকে অনেকটা হারিয়ে যায়, কারণ ততদিনে সার্ভিসে চলে এসেছে আরও উন্নত নতুন এফ৮এফ বেয়ারক্যাট।