Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্রাঙ্কা ভিয়োলা: ধর্ষককে বিয়েতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন যে নারী

আচ্ছা, আপনি কি ফ্রাঙ্কা ভিয়োলাকে চেনেন? উত্তর যদি “না” হয়, তাহলে সেটাই স্বাভাবিক। তবে গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, এই যে আজকের লেখার মধ্য দিয়ে আপনি তার নাম জানতে পারছেন, জানতে পারছেন তার খ্যাতির কারণটাও, এরপর আপনি আর এই নাম ভুলতে পারবেন না। কেন বলা হলো এই কথা?

ইতালিতে একসময় আইন ছিল যে ধর্ষক যদি তার হাতে ধর্ষণের শিকার নারীকে বিয়ে করে নেয়, তাহলে তার অপরাধ মাফ হয়ে যাবে! ফ্রাঙ্কা ভিওলা নিজে এই অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে জঘন্য এই আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন একাই, যার ফলে একসময় পরিবর্তন ঘটে এই আইনের। আজকের গল্প সাহসী এই নারীকে নিয়েই।

ফ্রাঙ্কা ভিওলা; Image source: The Vintage News

ফ্রাঙ্কা ভিওলার জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার কয়েক বছর পরই, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে, ইতালির সিসিলি দ্বীপের আলকামো শহরে। কৃষক বাবা বার্নার্দো ভিওলা আর গৃহিনী মা ভিতা ফেরার সংসারে জ্যেষ্ঠ কন্যা হিসেবে দিনগুলো ভালই কাটছিল ফ্রাঙ্কার। তার বয়স যখন ১৫ বছর (১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ), তখন ফিলিপ্পো মেলোদিয়া নামে স্থানীয় এক মাফিয়া সদস্যের সাথে বাগদান হয় তার। তবে সেটা বিয়েতে রুপ নেবার আগেই চুরির দায়ে জেলে যায় মেলোদিয়া।

হবু জামাইয়ের এমন পরিণতি মেনে নিতে পারলেন না ফ্রাঙ্কার বাবা বার্নার্দো। তার পরামর্শে তাই ফ্রাঙ্কা এই সম্পর্ককে আর এগোতে দেয়নি। এরপর মেলোদিয়া চলে যায় জার্মানিতে। আর দু’বছর পর আরেক তরুণের সাথে ফ্রাঙ্কার বাগদান সম্পন্ন হয়। ততদিনে মেলোদিয়াও আলকামোতে ফিরে এসেছে, পুরনো সম্পর্ক জোড়া লাগাবার খায়েশ তার মনে জেগে ওঠে। ফলে এই বাগদান ভেঙে দিয়ে তার সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগাবার জন্য ক্রমাগত ফ্রাঙ্কাকে চাপ দিতে থাকে সে, হুমকি দিতে থাকে ফ্রাঙ্কার বাবা আর হবু জামাইকেও।

কোনোভাবেই যখন ফ্রাঙ্কাকে রাজি করাতে পারল না, তখনই নিজের আসল রূপটা দেখিয়ে দিল মেলোদিয়া। অস্ত্রশস্ত্রসহ এক ডজন সঙ্গী নিয়ে ১৯৬৫-র ২৬ ডিসেম্বর মেয়েটিকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সে। অপকর্মে বাধা দিতে এলে মার খায় ফ্রাঙ্কার মা ও ছোট ভাই মারিয়ানো।

সমাজের অন্যায় আবদার ও অমানবিক প্রথার সামনে মাথা নত করেননি ফ্রাঙ্কা ভিওলা; Image source: Collection of Daisy Alioto

সেখান থেকে গাড়িতে করে মেলোদিয়া ফ্রাঙ্কাকে নিয়ে ওঠে শহরের বাইরের দিকে তার বোন আর দুলাভাইয়ের খামারবাড়িতে। টানা আট দিন ধরে মেয়েটির উপর চলে অমানবিক শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, চলে ক্রমাগত ধর্ষণও। এই দিনগুলোতে মেলোদিয়া মাঝে মাঝেই খুব তৃপ্তি নিয়ে ফ্রাঙ্কাকে বলতো, তাকে বিয়ে করা ছাড়া ফ্রাঙ্কার আর কোনো উপায়ও নেই এখন, কারণ নাহলে লোকে তাকে ‘দুশ্চরিত্রা’ বলে ডাকবে। যতবার সে এই কথা বলতো, ততবারই ফ্রাঙ্কা প্রতিবাদ করেছে, জানিয়েছে মুক্তি পেলেই তাকে অপহরণ আর ধর্ষণের দায়ে জেলে পুরবার প্রতিজ্ঞার কথা, যার ফলস্বরুপ অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছিল।

অবশেষে ৩১ ডিসেম্বর ফ্রাঙ্কার বাবাকে ফোন করে মেলোদিয়া, উদ্দেশ্য দুই পক্ষ সমঝোতায় এসে ফ্রাঙ্কার সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করা। ফ্রাঙ্কার বাবা বার্নার্দো ভিওলা সামনাসামনি বিয়ের ব্যাপারে ইতিবাচক থাকলেও আড়ালে তিনি ঠিকই পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেন, যাতে মেলোদিয়ার একটা ব্যবস্থা করা যায়। ২ জানুয়ারি সাঙ্গোপাঙ্গোসহ ধরা পড়ে মেলোদিয়া, মুক্ত হয় ফ্রাঙ্কা। বাবা তাকে কেবল জিজ্ঞাসাই করেছিলেন সে মেলোদিয়াকে বিয়ে করতে চায় কি না। ফ্রাঙ্কা যখন দৃঢ়চিত্তে “না” বলে উঠল, তখন তিনিও বললেন, মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষার্থে ও তার জন্য ন্যায্যবিচার আদায়ে তিনি কোনো কিছু করতেই বাকি রাখবেন না।

উদ্ধারের পর চলছে পুলিশের জেরা; Image source: Collection of Daisy Alioto

আচ্ছা, আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগছে না যে বারবার কেন একজন ধর্ষককে বিয়ের কথা আসছে? বিষয়টা একটু খুলেই বলা যাক। সেসময় সিসিলিয়ান সমাজে ‘ম্যাত্রিমোনিও রিপারাতোরে’ নামে এক প্রথা চালু ছিল, বাংলায় যেটাকে ‘পুনর্বাসনমূলক বিয়ে’ বলা যায়। অর্থাৎ যে নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, দিনশেষে তাকে আবার ঐ ধর্ষককেই বিয়ে করতে হবে। নাহলে সমাজ তার গায়ে জুড়ে দিত ‘দন্না স্‌ভার্গগনাতা’ নামে ট্যাগ, সহজ বাংলায় ‘দুশ্চরিত্রা নারী’! বুঝুন অবস্থা, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করল মেলোদিয়া, ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেল ফ্রাঙ্কা, কিন্তু ‘দুশ্চরিত্রা’ ট্যাগ লাগলো দিনশেষে এই নিরপরাধ মেয়ের গায়েই।

আরও অদ্ভুত বিষয় হলো, ইতালির সেই আমলের দণ্ডবিধিও এই বিষয়টিকে সমর্থন করেছিল, তবে ঘুরিয়ে-পেচিয়ে। দেশটির দণ্ডবিধির ৫৪৪ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণকে তখন ‘ব্যক্তির প্রতি অপরাধ’ হিসেবে না দেখে কেবল ‘নৈতিকতা বহির্ভূত কাজ’ হিসেবেই দেখা হত। সেই সাথে ধর্ষক যদি ধর্ষণের শিকার নারীকে বিয়ে করত, তাহলে বিধি অনুসারে তার ধর্ষণের অপরাধই মাফ হয়ে যেত!

মিডিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ থেকে আড়াল করাই যখন উদ্দেশ্য; Image source: Collection of Daisy Alioto

আজকের দিনে আমাদের দেশে প্রায় সময়ই খবরের কাগজে দেখা যায়, ধর্ষকের ক্ষমতার দাপটে ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবার নিয়মিত হুমকিধামকির উপর থাকে, শিকার হতে হয় নানা নির্যাতনেরও। ফ্রাঙ্কার পরিবারের বেলাতেও ঠিক সেটাই ঘটেছিল। মেলোদিয়াকে বিয়েতে অস্বীকৃতি জানাবার পর কোথায় শহরবাসী তার এই সাহসী সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাবে, তার পাশে এসে দাঁড়াবে- তা না করে বরং তারা তার পরিবারকেই একঘরে করে ফেলে। নিয়মিতভাবেই হুমকি দেয়া হচ্ছিল তাদের, চালানো হচ্ছিল নির্যাতনও।

গোটা ইতালির সবচেয়ে আলোচিত বিষয় তখন ফ্রাঙ্কার এই কাহিনী, তার রুখে দাঁড়ানোর গল্প। মেলোদিয়ার পক্ষের আইনজীবীরা তো নির্লজ্জভাবে দাবি করে বসে, ফ্রাঙ্কা আসলে অপহৃতই হয়নি, বরং সে আর মেলোদিয়া মিলে পরিকল্পনা করেই পালিয়েছিল, যাতে গোপনে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলা যায়!

ভাগ্য ভাল ছিল ফ্রাঙ্কার। এই কঠিন সময়ের পুরোটা জুড়ে পরিবারকে পাশে পেয়েছিল সে। তাই তো সব সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাইবাছাই শেষে আদালতের রায় যায় ফ্রাঙ্কার পক্ষেই। রায়ে মেলোদিয়াকে ১১ বছর আর তার সাত সহযোগীর প্রত্যেককে ৪ বছর করে সাজা দেয়া হয়। মেলোদিয়ার এই সাজা পরে অবশ্য ১ বছর কমিয়ে আনা হয়।

শুনানী চলাকালে দুষ্কর্মের সহযোগীদের সাথে মেলোদিয়া; Image source: Collection of Daisy Alioto

পুরো সাজা খেটে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পায় মেলোদিয়া। এরপর অবশ্য আর বেশিদিন বাঁচতে পারেনি সে। নিজের কৃতকর্মের ফলস্বরূপই যেন মুক্তি পাবার মাত্র দু’বছরের মাথায় গুলি খেয়ে মডেনার রাস্তায় কুকুরের মতো পড়ে থাকে সে।

সংবাদপত্রের শিরোনামে ফ্রাঙ্কার সেই সাহসিকতার কথা; Image source: Collection of Daisy Alioto

ফ্রাঙ্কার জয় হলো, মেলোদিয়া মারা পড়লো, কিন্তু ধর্ষণের শিকার নারীকে বিয়ে করলে ধর্ষকের মাফ পেয়ে যাবার আইন কিন্তু বাতিল হলো না। সেজন্য অপেক্ষা করা লেগেছিল ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। ওদিকে ধর্ষণকে ‘নৈতিকতা বহির্ভূত কাজ’ বলেই পার পেয়ে যাবার যে বিধান, তারও বদল আসলো ১৯৯৬ সালে। ধর্ষণকে উল্লেখ করা হলো ‘ব্যক্তির প্রতি অপরাধ’ হিসেবেই।

ফ্রাঙ্কা ভিওলা এখন যেমন; Image source: Collection of Daisy Alioto

ফ্রাঙ্কার কী হলো জানতে ইচ্ছা করছে? তিনি আজও বেঁচে আছেন। বয়স প্রায় ৭২ বছর। সেই ঘটনার পর ১৯৬৮ সালে জিউসেপ্পে রুইজি নামের এক পুরুষকে বিয়ে করেন তিনি। রুপকথার গল্পের মতো সত্যি সত্যিই তারা সুখে-শান্তিতে কাটাতে থাকেন বিয়ের পরের দিনগুলো। তাদের ঘর আলো করে আসে তিন সন্তান; দুই ছেলে ও এক মেয়ে। আজও তারা আছেন বহু ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত সেই আলকামো শহরেই।

Related Articles