১৯৪৪ সালের ১৬ জুন। যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী কলাম্বিয়া। সন্ধ্যা ৭টা বেজে ঘড়ির কাঁটা তখন আর কিছু দূর এগিয়েছে। ছোট ছোট পায়ে অন্ধকার এক ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ১৪ বছরের কিশোর জর্জ স্টিনি জুনিয়র।
সেখানে তার অপেক্ষায় আছে বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবী, মামলার বাদী পক্ষ, চিকিৎসক এবং একটি চেয়ার। চেয়ারটি কেবল স্টিনির জন্য এবং এটি আমাদের বসার ঘরের সাধারণ কোনো চেয়ারও নয়। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে মারার জন্য এই বিশেষ চেয়ার।
খানিক পরেই সেখানে বসানো হবে ছোট জর্জকে। জোড়া খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী জর্জ স্টিনি জুনিয়র তার ১৪ বছর বয়সী জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো দেখছে।
জর্জকে ধরে ধীরে ধীরে চেয়ারে বসানো হলো। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখা তার শেষ সম্বল বাইবেলটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৪ বছর বয়সী জর্জের জন্য চেয়ারটি বেশ বড়ই ছিল। তাই বৈদ্যুতিক চেয়ারের উপর একটি মোটা টেলিফোন বই দিয়ে তার ওপর তাকে বসানো হলো। সেই সাথে চেয়ারের হাতল এবং পায়ার সাথে যথাক্রমে তার হাত এবং পা বেঁধে দেওয়া হলো।
বেল্ট দিয়ে মুখ বেঁধে দেওয়ার পর তার চেহারাও ঢেকে দেওয়া হলো, যাতে কেউ তার কান্না দেখতে না পারে। কিন্তু বড়দের মুখোশ কিশোর জর্জের মুখ ধরে রাখতে পারছিল না। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য মাথার সাথে সংযোগ দেওয়া হলো বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের। এর কিছুক্ষণ পরই সংকেত পাওয়ার সাথে সাথে জর্জ স্টিনি জুনিয়রের শরীর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হবে ২,৪০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ।
পড়ছিলেন বিগত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া হাজারো নারকীয় ঘটনাবলীর মধ্যে একটির কথা। দুজন কিশোরীকে খুনের দায়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড পেতে হয়েছিল ১৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ বালক জর্জ স্টিনি জুনিয়রকে। সময়টা শ্বেতাঙ্গদের দখলে ছিল বলেই হয়তো একরকম বিচার ছাড়াই কঠিন মৃত্যুদণ্ড মেনে নিতে হয়েছিল জর্জকে।
তার মৃত্যুর দীর্ঘ ৭০ বছর পর ২০১৪ সালে মামলাটি আবার উত্থাপন করা হয়। তখনই বেরিয়ে আসে মর্মভেদী একটি তথ্য- একেবারেই নির্দোষ ছিল বেচারা জর্জ স্টিনি! দুটি মেয়ে হত্যার সাথে সে কোনোভাবেই জড়িত ছিল না। কিন্তু তবুই আইনের হাতেই খুন হতে হয়েছে তাকে। কীভাবে আইনের হাতেই ঘটে গেলো কলঙ্কিত এই হত্যাকাণ্ড? তা জানার জন্য মূল ঘটনার কিছুটা পেছনে ফিরে যেতে হবে আমাদের।
১৯২৯ সালের ২১ অক্টোবর সাউথ ক্যারোলাইনার পাইনউড অঞ্চলে জন্ম জর্জ স্টিনি জুনিয়রের। সেখানেই বেড়ে ওঠা। একটি মিলে তার বাবার চাকরির সূত্রে পুরো পরিবার মিলে চলে যায় অ্যালকলু এলাকায়। জর্জের পরিবারে সে এবং তার বাবা-মা ছাড়া আরো ছিল দুই ছোট ভাই-বোন।
সে সময় চরম বর্ণবাদ নীতির জন্য শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আলাদা আলাদা গির্জা ছিল। অ্যালকলু অঞ্চলে শ্বেতাঙ্গরা ধর্মচর্চা করতো ক্ল্যারেনডন ব্যাপিস্ট চার্চে এবং কৃষ্ণাঙ্গরা ধর্মচর্চা করতো গ্রিন হিল চার্চে। ধর্মীয়ভাবে শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের আলাদা গির্জার কথা বলা না হলেও, সামাজিক সংস্কৃতি এবং নানা কুসংস্কারের কারণে এমন বিভাজন তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
একদিন সকালে হঠাৎ দেখা গেলো, গ্রিন হিল চার্চ থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্বে দুইজন কিশোরীর লাশ পড়ে আছে। একজন ১১ বছর বয়সী বেটি জুন বিনিকার এবং আরেকজন ৭ বছর বয়সী মেরি এমা থেমস। আগেরদিন বিকাল থেকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তাদের দুইজনকে।
সে সময় শাসন ব্যবস্থায় থাকা শ্বেতাঙ্গদের ধারণা ছিল, যত দোষ সব কৃষ্ণাঙ্গরা করে! আর লাশ দুটিও আবার পাওয়া গিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের গির্জার কাছেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই জোড়া খুনের সন্দেহ গিয়ে পড়লো কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর।
মেয়ে দুটির লাশ পাওয়ার আগেই তাদের হারিয়ে যাওয়ার খবর পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেউই দেখেনি মেয়ে দুটি সেদিন কোথায় গিয়েছিল, শুধুমাত্র জর্জ স্টিনি জুনিয়র ছাড়া। স্টিনি এবং তার বোন সেদিন সকালে কোনো এক দরকারে বের হয়েছিল। তখন বিনিকার এবং থেমসের সাথে তাদের দেখা হয়। ছোট চারজন কিশোর-কিশোরীর মতোই তারা সেদিন কথা বলেছিল।
তাদের সাথে কথা বলার সময় স্টিনি জানতে পারে, মেয়ে দুটি একটি ভুট্টার ক্ষেতে যাচ্ছে, যেটি গ্রিন হিল চার্চ থেকে বেশ কাছে। স্টিনিই তাদের রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছিল। এটিই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায় ১৪ বছরের কিশোর জর্জ স্টিনির জন্য!
ছোট স্টিনি যখন হারিয়ে যাওয়া মেয়ে দুটির সন্ধানের ব্যাপারে ভুট্টার ক্ষেতের কথা বলে, তখন তার কথা মতোই সেখানে লাশ দুটি পাওয়া যায়। এতেই পুরো সন্দেহ চলে যায় স্টিনির দিকে। পুলিশ আসে তাকে গ্রেফতারের জন্য। কিন্তু কিশোর স্টিনি বুঝতেই পারে না, কী অন্যায় সে করেছে!
গ্রেফতারের পর থেকেই পরিবার থেকে আলাদা করে ফেলা হয় জর্জ স্টিনিকে। সম্পূর্ণ পুলিশি হেফাজতে তাকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়। ছোট জর্জ ভয় পেয়ে পুলিশ যা বলে, তাতেই হ্যাঁ-বোধক জবাব দিতে থাকে। তাকে বলা হয়, পুলিশের কথা শুনলে ছেড়ে দেয়া হবে। বেচারা তো জানে না কী ভয়ংকর মৃত্যুর ফাঁদ সে তৈরি করে ফেলেছে তার জন্য।
পুলিশের কাছ থেকে জানা যায়, জর্জ হত্যার দায় স্বীকার করে নিয়েছে এবং সেই সাথে ১১ বছর বয়সী বিনিকারকে সে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল। তাতে সায় না দিলে, সে তাদের দুইজনকে মেরে ফেলে। শুধু তাই নয়, তাদেরকে চার্চের নিকটবর্তী রেললাইনের লোহার পাত দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করার পর, লাশ ফেলে আসে চার্চের নিকটবর্তী এক ভুট্টার ক্ষেতে। এই সকল অভিযোগে ফেঁসে যায় জর্জ স্টিনি।
মামলার শুনানির দিন মাত্র ৩ ঘন্টায় পুরো রায় দিয়ে দেওয়া হয়। ৩০ ঘন্টারও কম সময়ে উভয়পক্ষের কথা শোনা হয় এবং এর পর মাত্র ১০ মিনিটে এক হাজার শ্বেতাঙ্গ জুরি তাদের মতামত দেয়। আশ্চর্যজনকভাবে এই মামলার জুরি সদস্যদের মাঝে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন না। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নেওয়া হয় মাত্র তিনজনকে – যিনি মেয়ে দুটির লাশ পেয়েছিলেন এবং দুই জন চিকিৎসক, যারা লাশ দুটির ময়নাতদন্তে কাজ করেছেন।
১০ মিনিটেরও কম সময়ে জুরি সদস্যরা সিদ্ধান্ত জানান যে, জর্জ স্টিনি এই খুনের মূল আসামী এবং সে দোষী। সেই সাথে আদালত বিদ্যুৎস্পৃষ্টকরণের দ্বারা স্টিনির মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন।
কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণেই কিনা মামলা পুনর্বিবেচনার আবেদন করার সুযোগও পায়নি স্টিনি। সেই সাথে পুরো পরিবার থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দূরে সরিয়ে রাখা হয় তাকে। বাসস্থান থেকে সরিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার কেন্দ্রের কারাগারে। সেখানে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টানা ৮৮ দিন বন্দী ছিলো জর্জ স্টিনি জুনিয়র। এর মাঝে কেবল একবার তার পরিবার তার সাথে দেখা করার সুযোগ পায়।
এরপর ১৬ জুনের ঘটনা তো এখন সবারই জানা। সেদিন ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় পুরো শরীরে ২,৪০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ চালিয়ে হত্যা করা হয় জর্জ স্টিনি জুনিয়রকে। ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু প্রকৃতি সবসময় সত্য তুলে ধরতে পছন্দ করে, তা যতো দেরিতেই হোক না কেন!
২০০৪ সালে স্টিনির এলাকারই এক ইতিহাসবিদ জর্জ ফ্রেরারসন সেই মামলাটি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। স্টিনির ব্যাপারটি তার কাছে খটকা লাগলে, বিষয়টি আবার আদালতে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত তার পরিবারের ইচ্ছায় মামলাটি পুনরায় শুনানির জন্য আদালতে যায়।
ততদিনে মামলার ৩ জন প্রত্যক্ষদর্শীই মারা গিয়েছেন। কিন্তু তাদের জবানবন্দী বিবেচনা করে জানা যায়, তারা কেউই স্টিনির সরাসরি সম্পৃক্ততার ব্যাপারে অবগত নন। তার ওপর পুলিশের কথামতো একটি রেললাইনের লোহার পাত তুলে তা দিয়ে কাউকে আঘাত করার মতো শক্তি একজন ১৪ বছরের কিশোরের থাকার কথা না।
সেই সাথে একজন ১১ বছর বয়সী এবং একজন ৭ বছর বয়সী বালিকাকে কোলে নিয়ে একা দেড় মাইল রাস্তা পার হওয়া, একজন ১৪ বছর বয়সীর কাছে এক কথায় অসম্ভব ব্যাপার!
এসকল বিষয় বিবেচনা করে এবং নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবশেষে ২০১৪ সালে রায় দেওয়া হয়, জর্জ স্টিনি জুনিয়র ছিল নির্দোষ। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বর্ণবাদের দায় নিয়ে আইনের হাতে এরকম খুন হওয়ার ঘটনা একদিকে যেমন কলঙ্কিত, অন্যদিকে এত অল্প বয়সে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ঘটনাও ইতিহাসে বিরল। স্টিনি হয়তো মৃত্যুর পর নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু তার হত্যাকারীদের কি প্রকৃতি ক্ষমা করবে কোনোদিন?