১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ; দ্বিতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শেষের তিন বছর পরের কথা। সম্মিলিত আরব ফ্রন্ট যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই আরব শহরগুলো তখনও এই পরাজয়ের হতাশায় আচ্ছন্ন। নৈরাশ্য বিরাজমান লেবাননের রাজধানী বৈরুতেও। আরব শহরসমূহের মধ্যে বৈরুত তখনও পাশ্চত্যকরণে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনের নানা নিদর্শন তখনও শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ভৌগোলিকভাবে পর্যটন ও ব্যবসার জন্য দারুণ উপযোগী এ শহর। কিন্তু তিন বছর পেরিয়ে গেলেও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আবহ তখনও ধুয়ে যায়নি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে লেবানিজ আর্মি। ঠিকই দাঁড়িয়ে তাদের সুসজ্জিত ট্যাংক বহর। শহরটি তন্মধ্যে হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিন বিপ্লবীদের আঁতুড়ঘর। এর প্রভাবে পথে পথে শোভা পাচ্ছিল পৃথিবীর সব বিখ্যাত বিপ্লবীর ছবি। শহরের প্রাণকেন্দ্রেই অবস্থান করছে ফিলিস্তিনের বিখ্যাত গেরিলা সংগঠন পিএফএলপির অফিস। গাসসান কানাফানি, এ সংগঠনের অন্যতম নেতা। সংগঠনটির ইন্টেলেকচুয়াল মাস্টার-মাইন্ড। একজন কবি, সংবাদিক, চিত্রশিল্পী, ও সাহিত্যিক। বৈরুত অফিসে তার সাক্ষাৎকার নেবেন অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক এবিসি নিউজের সাংবাদিক রিচার্ড কার্লটন।
কানাফানি বসে আছেন একটি অগোছালো অফিসকক্ষে। পেছনে শ্লোগান সংবিলত কিছু পোস্টার, পত্রিকার কাটিং, কিছু বিল্পবী চিত্রকর্ম, এবং মার্ক্স-লেনিন-চের ছবি। এলোমেলো টেবিলের একপ্রান্তে তিনি, অপরপ্রান্তে রিচার্ড কার্লটন। একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ছেন কার্লটন, পশ্চিমা একচোখা প্রশ্ন। উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন কানাফানি; স্পষ্ট, সুচিন্তিত, স্বতঃস্ফূর্ত।
কার্লটন: আপনার কী মনে হয়? এই গৃহযুদ্ধের কোনো মানে আছে?
কানাফানি: গৃহযুদ্ধ নয়। এখানে মানুষ একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার সংগ্রাম করছে।
কার্লটন: আমি সংর্ঘষের কথা বলছি।
কানাফানি: না। এটা সংর্ঘষও নয়। এটা মুক্তির জন্য যুদ্ধ, ন্যায়বিচার আদায়ের যুদ্ধ।
কার্লটন: আচ্ছা, সে যা-ই হোক।
কানাফানি: না। এটা ‘সে যা-ই হোক’ না। এটাই সকল সমস্যার সূচনা।
কার্লটন: আপনারা আলোচনা করছেন না কেন?
কানাফানি: কার সাথে আলোচনা?
কার্লটন: ইসরায়েলের সাথে।
কানাফানি: গর্দানের সাথে তলোয়ারের আলোচনা?
কার্লটন: না, যেকোনো মূল্যে আলোচনা।
কানাফানি: কিন্তু আলোচনা হবে কীজন্য?
কার্লটন: যুদ্ধ বন্ধের জন্য।
কানাফানি: যুদ্ধ বন্ধ! কী পাওয়ার জন্য?
কার্লটন: হতাহত বন্ধের জন্য।
কানাফানি: কাদের হতাহত?
কার্লটন: ফিলিস্তিনি, ইসরায়েলি, আরবদের।
কানাফানি: অথচ এই ফিলিস্তিনিরা তো নিজেদের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হয়েছে। বিশ বছর ধরে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। এমনকি ফিলিস্তিনি পরিচয় ব্যবহার করার অধিকারও তারা হারিয়েছে।
কার্লটন: কিন্তু যুদ্ধে যুদ্ধে এমন মৃত্যুর তো কোনো অর্থ নেই।
কানাফানি: সেটা আপনাদের জন্য, আমাদের জন্য নয় (আমাদের জন্য এসব মৃত্যু অর্থহীন নয়)। আমাদের জন্য স্বাধীনতা, মর্যাদা আর সম্মান জীবনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
আরবীয় আঞ্চলিক টানে বলিষ্ঠ ইংরেজিতে কানাফানি সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন। ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে দেয়া সবচেয়ে যথাযথ বক্তব্যগুলোর মধ্যে অন্যতম মনে করা হয় একে। বার্লিন ফ্রি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রফিক আবু রামিলেহ বলেন,
গাসসান কানাফানির এ কথাগুলোই হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের সেসব বয়ান, যা দুঃখজনকভাবে ফিলিস্তিনিরা প্রচার করতে পারে না।
কানাফানি ১৯৩৬ সালে ফিলিস্তিনের আক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তখনও ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফিলিস্তিন তখনও ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শাসনের অধীনে। কানাফানির বাবা ছিলেন একজন প্রতিথযশা আইনজীবী। ফিলিস্তিনি অবৈধ ইহুদি সেটেলমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে যিনি ব্রিটিশদের দ্বারা বন্দীও হন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর কানাফানির পরিবার আর ফিলিস্তিনে থাকতে পারেনি। শরণার্থী হিসেবে আক্কা ত্যাগ করে কানাফানি আশ্রয় নেন লেবাননে। পরে সিরিয়াতে তার পরিবার স্থায়ী হয়। সিরিয়াতেই কানাফানি তার সেকেন্ডারি পড়াশোনা শেষ করেন। পরে একটি শরণার্থী শিবিরে শিক্ষকতার চাকরি নেন। এ সময়েই তিনি লেখালেখিতে মন দেন।
এরপর দামেস্ক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া, ইউনিভার্সিটি থেকে বহিষ্কার, কুয়েত গমন শেষে ১৯৬০ সালে কানাফানি লেবাননে ফিরে আসেন। স্থায়ী হন রাজধানী বৈরুতে। সেখানে তিনি পুরোদমে সাংবাদিকতায় মন দেন। ১৯৬৭ সালে তিনি তৎকালীন ফিলিস্তিন বিপ্লবের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী গেরিলা সংগঠন পিএফএলপিতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পিএফএলপির মুখপাত্র আল আহদাফের ম্যাগাজিনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ম্যাগাজিনটি তার হাত ধরে আরববিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। যদিও সেসময় এ ম্যাগাজিনটিকে অনেকে প্রোপাগাণ্ডা মেশিন হিসেবে অভিযুক্ত করেন, যার জবাবে কানাফানি বলেছিলেন, ‘আমরা সত্য প্রচার করছি, প্রোপাগান্ডা নয়’।
কানাফানি সমকালীন বাম আইকন লেনিন, কাস্ত্রো, গুয়েভারার বিপ্লবী দর্শনে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। তিনি কখনো সশস্ত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রামের প্রবল সমর্থক ছিলেন। তিনি বলেন, “সংগ্রাম যদি চুপিসারে চলে, তবে কোনো টিভি নেটওয়ার্ক ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের এক মিনিটের জন্যও টিভি কাভারেজ দেবে না।”
তবুও আন্দোলনের বৌদ্ধিক দিককে কানাফানি কখনও ছোট করে দেখেননি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ফিলিস্তিন-বিপ্লবকেন্দ্রিক প্রায় সব বিখ্যাত পত্রিকা ও ম্যাগাজিন প্রকাশের ক্ষেত্রে কানাফানি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের পর কানাফানি বুঝতে পারেন- ফিলিস্তিনিদের মুক্তির জন্য আরব দেশগুলোর সাহায্য যথেষ্ট নয়। ফিলিস্তিনিদের নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদের অর্জন করতে হবে। এজন্য সশস্ত্র বিপ্লবের পাশাপাশি সাহিত্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাস আর সাংবাদিকতার মাধ্যম্যে একটি সমান্তরাল বিপ্লব চালিয়ে নিতে হবে, যা সেঈ অঞ্চলের বিপ্লবী জনগোষ্ঠীকে এক দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলবে। আর বৈরুতকে কেন্দ্র করে কানাফানি সেই বিকল্প বিপ্লবের সত্যিকারের সারথি হয়ে উঠেছিলেন।
একজন বিপ্লবী হওয়া সত্ত্বেও আরব-মননে কানাফানি একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক হয়ে বেঁচে আছেন। যিনি গল্পে গল্পে ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রহীনতা, বিচ্ছেদ, দুঃখ-দুর্দশার কথা বলে গিয়েছেন। বিপ্লবকেন্দ্রিক নবজাগরণী আরব সাহিত্যের পথিকৃৎ ছিলেন কানাফানি। তিনি ছিলেন প্রতিরোধী সাহিত্যধারার প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় তার বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘Men in the Sun’, যাকে আরবি ফিকশন সাহিত্যের সবচেয়ে প্রশংসিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গাজা উপত্যকার শরণার্থীদের নিয়ে ১৯৬৬ সালে তিনি রচনা করেন ‘All That Left To You’। ১৯৭০ সালে রচনা করেন উপন্যাস ‘Return To Haifa’, যেখানে রয়েছে কানাফানির নিজের জীবনের ছায়া। ২০০৭ সালে ‘রিটার্ন টু হাইফা’ অবলম্বনে বিখ্যাত ইরানী পরিচালক সাইফুল্লাহ দাদা নির্মাণ করেন ‘বাযমান্দেহ’ নামক চলচ্চিত্র।
উপন্যাস ছাড়াও কানাফানি লিখে গেছেনে অনেক গল্প, নাটক, ও প্রবন্ধ, যেগুলোর প্রেক্ষাপট জুড়ে ছিল ফিলিস্তিনের আর্তনাদ। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সাহিত্যে কানাফানির সেই লিগ্যাসি পরবর্তীতে বহন করে গেছেন মাহমুদ দারবিশ, ইবরাহিম নসরুল্লাহ, সোহেইল কিওয়ানের মতো সাহিত্যিকগণ।
জুলাই, ১৯৭২; বাড়ির সামনে গাড়িতে বসা গাসসান কানাফানি ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র। হঠাৎ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল চারদিক। কানফানিকে বহনকারী গাড়ি নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ভ্রাতুষ্পুত্রকে বুকে ধরে সেখানেই নিথর হয়ে গেলেন কানাফানি। থেমে গেল এক বিপ্লবী প্রাণ। মোসাদ এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। ইসরায়েলী সন্ত্রাসবাদের কালচারাল টার্গেটের প্রথম শিকার কানাফানি। তার বয়স তখন মাত্র ৩৬। ইতোমধ্যেই তার ১৮টি বই লেখা হয়েছে, লেখা হয়েছে শত শত প্রবন্ধ। সেগুলো হত্যা করা সম্ভব হয়নি। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানসহ আরো নানা ভাষায় সেসব বই অনূদিত হয়েছে।
“গাসসান কানাফানি ছিলেন একজন কমান্ডো, যিনি কখনো একটি গুলিও ছোড়েননি। তার অস্ত্র ছিল একটি বলপয়েন্ট কলম। তার যুদ্ধক্ষেত্র ছিল পত্রিকার পাতা।”- কানাফানির মৃত্যুর পর বিখ্যাত লেবানিজ পত্রিকা ডেইলি স্টারে প্রকাশিত অবিচুয়ারিতে এমনটাই জানান দেয়া হয়।