প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিকথা | পর্ব ২

[১ম পর্ব]

পশ্চিমে জার্মান বাহিনী যখন বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন পূর্বে তাদের অবস্থা খুব একটা ভাল না। জার্মান নীতিনির্ধারকরা ধারণা করেছিল, রাশিয়ান বাহিনীর সেনা জোর করে জার্মান সীমান্তে আক্রমণ করতে সময় লাগবে। কিন্তু তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে ১৭ই আগস্ট পূর্ব প্রুশিয়াতে রাশিয়ান বাহিনী আক্রমণ চালায়। জার্মানি সুরক্ষাস্বরূপ সামান্য কিছু সৈন্য রেখেছিল জার্মান-রাশিয়ান সীমান্তে। রাশিয়ান বাহিনী খুব সহজেই জার্মান প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয় এবং তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে। 

যুদ্ধের এই পর্যায়ে জার্মান সেনাপ্রধান ছিলেন ভন মল্টকা। মল্টকা ভয় পান- এভাবে রাশিয়ান বাহিনী এগোতে থাকলে শীঘ্রই পতন ঘটতে পারে বার্লিনের। তাহলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই হেরে যাবে জার্মানি। মল্টকা তার সেরা দুই জেনারেলকে পশ্চিম থেকে সরিয়ে পূর্বে পাঠান রাশিয়ান বাহিনীকে মোকাবেলা করতে। উল্লেখ্য, তৎকালীন রাশিয়ার সেনাবাহিনী ছিল সংখ্যায় সর্ববৃহৎ- ৬০ লাখ। কিন্তু যুদ্ধের প্রযুক্তিতে তারা ছিল অনেক পিছিয়ে। রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অপরিণত। সৈন্যদের ছিল না যথেষ্ট অস্ত্র। তাদের রেডিও যোগাযোগ এনকোডেড ছিল না, ফলে জার্মানরা খুব সহজেই জেনে যেত তাদের পরিকল্পনা। এসব কারণে সংখ্যায় কম হলেও জার্মানরা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় এবং ২৯শে আগস্ট রাশিয়ানদের পিছু হটতে বাধ্য করে। প্রায় এক লাখ রাশিয়ান সৈন্য বন্দী হয়।

অন্যদিকে, যে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ানদের সার্বিয়া আক্রমণের মাধ্যমে এই যুদ্ধ শুরু হয়, তাদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। উত্তরে রাশিয়ান আক্রমণে তারা পর্যুদস্ত হয়। আবার সার্বিয়াতে তারা ব্যাপক গেরিলা আক্রমণের শিকার হয়। বেশ কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যা ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান বাহিনীর, যেটা পুরো যুদ্ধ জুড়েই তাদের অনেক ভোগায়। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়াতে বস্তুত বহু জাতি বাস করে, যাদের ভাষা ও সংস্কৃতি একেবারে ভিন্ন। ফলে তাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল। অনেক সময় তারা নিজেরাই নিজেদের আক্রমণ করে বসত শত্রু ভেবে। সেই সাথে তাদের ছিল বিশাল স্লাভ জনগোষ্ঠী, যারা স্বভাবতই সার্বিয়া ও রাশিয়া-ঘেঁষা।

অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়াতে বহু জাতির বসবাস
অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়াতে বহু জাতির বসবাস; Image Source: alphahistory.com

আবার ফিরে যাওয়া যাক পশ্চিমে। এই সময় ফ্রেঞ্চ বাহিনীর প্রধান ছিলেন জোসেফ জফ্রা। বিশালদেহী জফ্রা পরিচিত ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলানোর জন্য। আধুনিক অস্ত্র ফ্রেঞ্চ বাহিনীর কাছে থাকলেও, যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা ছিল অনেকটাই সনাতন মতাদর্শী। অন্যান্য দেশ যখন তাদের ইউনিফর্মের রং বদলে নিয়েছে যাতে দূর থেকে তাদের দেখা না যায়, ফ্রেঞ্চ বাহিনীর ইউনিফর্ম সেখানে গাঢ় নীল, মাথায় লাল টুপি। এছাড়া, যুদ্ধক্ষেত্রে ঢালের আশ্রয় নেয়া তাদের কাছে ছিল বিশাল অসম্মানের ব্যাপার।

যা-ই হোক, যুদ্ধের শুরুতে তারা বুঝতে পারে জার্মান বাহিনী বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে তাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই আক্রমণের মাত্রা সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না। ১৪ই আগস্ট তারা আলসাস-লোরেইনে জার্মান বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। জার্মান বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। মজার ব্যাপার হলো, জার্মান বাহিনীর এই পিছু হটা পরাজয় স্বীকার মনে হলেও, এটা ছিল তাদের পরিকল্পনার অংশ। ফ্রেঞ্চ বাহিনী যত জার্মান-ফ্রেঞ্চ সীমানা দিয়ে আক্রমণ করবে, তারা তত বেলজিয়াম দিয়ে আসা জার্মান বাহিনীকে প্রতিরোধের ক্ষমতা হারাবে। কিন্তু পিছু হটতে কার ভাল লাগে? আর জার্মান বাহিনী জানে, তারা চাইলেই এই ফ্রেঞ্চ আক্রমণ গুঁড়িয়ে দিতে পারে। অবশেষে ২০শে আগস্ট তারা পাল্টা আক্রমণ চালায় ফ্রেঞ্চ বাহিনীর উপর। উজ্জ্বল রঙিন পোশাকে দলে দলে মার্চ করতে করতে আসা ফ্রেঞ্চ সৈন্যরা সহজ শিকারে পরিণত হয় জার্মান কামান আর মেশিনগানের। একেবারে কচুকাটা হয়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। 

যুদ্ধের শুরুতে ফ্রেঞ্চ বাহিনীর ইউনিফর্ম
যুদ্ধের শুরুতে ফ্রেঞ্চ বাহিনীর ইউনিফর্ম; Image Source: historicalfirearms.info

এখন জফ্রা হিসাব কষেন, দক্ষিণে আর উত্তরে জার্মান বাহিনী এত শক্তিশালী, নিশ্চয়ই তাদের মধ্যভাগ দুর্বল। পরিকল্পনানুযায়ী আরডেনে (Ardenne) তারা আবার আক্রমণ করে জার্মান বাহিনীর উপর। আবারও জার্মানদের ক্ষমতাকে হালকাভাবে নেন জফ্রা। জার্মানদের মূল বাহিনী উত্তরে বেলজিয়ামে থাকলেও পুরা সীমানা জুড়ে তাদের ছিল প্রশিক্ষিত রিজার্ভ বাহিনী, যারা এ ধরনের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল। জার্মান কামান আর মেশিনগানের সামনে পড়ে নির্বিচারে মারা পড়ে ফ্রেঞ্চ পদাতিক বাহিনী। শুধুমাত্র ২২শে আগস্ট, ২৪ ঘণ্টার যুদ্ধে ২৭ হাজার ফ্রেঞ্চ সৈন্য মারা পড়ে। অগত্যা তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

জার্মানির স্লিফেন প্ল্যান (লাল) আর ফ্রান্সের আলসাস-লোরেইনে আক্রমণ
জার্মানির শ্লিফেন প্ল্যান আর ফ্রান্সের আলসাস-লোরেইনে আক্রমণ; Image Source: spartacus-educational.com

এবার আসা যাক ব্রিটিশ বাহিনীর ভূমিকায়। ৭ই আগস্ট প্রায় এক লক্ষ ব্রিটিশ সেনা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে নামে ফ্রান্সে। তাদের নেতৃত্বে জন ফ্রেঞ্চ। সংখ্যায় কম হলেও এই ব্রিটিশ বাহিনী ছিল অত্যন্ত প্রশিক্ষিত এবং পেশাদার। এই বাহিনীই প্রথম বেলজিয়ামের মন্সে মুখোমুখি হয় জার্মান মূল বাহিনীর। প্রথমে শুরু হয় ব্যাপক গোলাবর্ষণ। গোলাবর্ষণ শেষে দলে দলে আসতে থাকে জার্মান পদাতিক বাহিনী। এটা ছিল সেসময়ের খুব পরিচিত রণকৌশল। প্রথমে কামান দিয়ে গোলাবর্ষণ করে শত্রুবাহিনীকে ঝাঁঝরা করে দেয়া, এরপর পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ। অনেক সময় কয়েকদিন ধরে চলত এই গোলাবর্ষণ।

জার্মান পদাতিক বাহিনী যখন এগোতে থাকে, তখন ব্রিটিশ বাহিনী সুযোগ পায় তাদের সামর্থ্য দেখানোর। তারা ছিল রাইফেলে খুবই পারদর্শী। এবার রাইফেলের গুলিতে ধরাশায়ী হয় জার্মান বাহিনী। যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করলেও ব্রিটিশরা জার্মান বাহিনীর সামনে শেষপর্যন্ত টিকতে পারেনি। পিছু হটতে থাকে তারা।

যুদ্ধের এই পর্যায়কে বলা হয় ‘The Great Retreat’। উত্তরে বেলজিয়াম থেকে দক্ষিণে সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত পুরো সীমানা জুড়ে ফ্রেঞ্চ-ব্রিটিশ বাহিনী পিছু হটতে থাকে। পিছু হটার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন— সীমানার একাংশের সৈন্য যদি পিছু হটে, তাহলে পুরো সীমানা জুড়ে থাকা সৈন্যদের পিছু হটতে হয়। কারণ, নাহলে সীমানায় ফাঁকা অংশ তৈরি হবে, যা দিয়ে শত্রুবাহিনী ঢুকে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারে। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, মুখোমুখি যুদ্ধের চেয়ে পিছু হটার সময় অনেক বেশি ক্ষতি হয়। অতীতের বেশিরভাগ যুদ্ধে দেখা যায়, কোনো বাহিনী যখন পিছু হটতে থাকে, আক্রমণকারী বাহিনী তখন তাদের পিছু নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘোড়া দিয়ে পিছু ধাওয়া করা হয়। ফলে খুব সহজেই ধরে ফেলা যায় পালাতে থাকা সৈন্যদের। কিন্তু অতীতের যুদ্ধের চেয়ে এই যুদ্ধ আলাদা। এই যুদ্ধে অশ্বারোহী সেনা খুবই অকার্যকর এবং অরক্ষিত। পেছাতে থাকা বাহিনী ঘুরে দাঁড়ালে তাদের রাইফেল বা মেশিনগানের সহজ শিকারে পরিণত হয় এরা। ফলে খুব বেশি ক্ষতি ছাড়াই প্রায় প্যারিস পর্যন্ত পিছু হটে ফ্রেঞ্চ-ব্রিটিশ বাহিনী।

ডিফেন্স লাইনে গ্যাপ তৈরি হওয়ার উদাহরণ
ডিফেন্স লাইনে গ্যাপ তৈরি হওয়ার উদাহরণ; Image Source: Sharafat Hossain

এবার দু’পক্ষেরই সেনাবাহিনীর কথা চিন্তা করা যাক। জার্মান বাহিনী প্রায় এক মাস ধরে এগোচ্ছে। বেলজিয়াম তাদের রেললাইন ধ্বংস করে দেয়ায় অনেকটা পায়ে হেঁটেই তাদের পুরো একটা দেশ পাড়ি দিতে হচ্ছে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত মার্চ করতে করতে এগিয়ে যাওয়া। ঘুমের সুযোগ নেই খুব একটা। খাদ্যের জোগানও এত দূরে আসতে পারছে না ঠিকমতো। আগেই বলা হয়েছে মানুষের সহ্যক্ষমতার কথা। প্রায় এক মাস ধরে প্রতিকূল পরিবেশে বিরামহীনভাবে চলতে থাকা এই বাহিনীর যুদ্ধক্ষমতা কতটা বাকি থাকা সম্ভব? শুধু জার্মানি না, ফ্রেঞ্চ এবং ব্রিটিশ বাহিনীরও একই অবস্থা। তারা জানে, পিছু হটতে একটু দেরি হলেই, জার্মান বাহিনী তাদের ধরে ফেলবে। থামার অবকাশ নেই। 

ফ্রেঞ্চ সেনা প্রধান জফ্রা বুঝতে পারেন এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই পতন ঘটবে ফ্রান্সের। তিনি এবার এমন কিছু পদক্ষেপ নেন যা ফ্রান্সকে এই যাত্রার বাঁচিয়ে দেয়, এবং নিজে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেন। এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি প্রায় দেড়শো জেনারেলকে পদচ্যুত করেন, এবং সেসব জায়গায় বসান এমন লোকদের যারা ইতিমধ্যে যুদ্ধে তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে। এরপর তিনি শুরু করেন লোকবল বাড়ানো। ফ্রান্সে ছড়িয়ে থাকা বহু দুর্গ থেকে সৈন্য জোগাড় করে পাঠানো হয় জার্মান বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য।

উল্লেখ্য, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের আরেকটি ক্ষমতা আছে যা জার্মানির নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাদের আছে অসংখ্য কলোনি। ফ্রান্স প্রথম সেসব কলোনি থেকে সৈন্য আনা শুরু করে। অবশেষে তারা জার্মানি বাহিনীকে প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করে। প্যারিসের উত্তরে তারা ঘুরে দাঁড়ায় ও জার্মান বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। শুরু হয় মার্নের যুদ্ধ। এই পর্যায়ে জার্মান বাহিনী এতটাই এগিয়ে যায় যে বিভিন্ন ডিভিশনের মধ্যে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই আক্রমণের একপর্যায়ে জার্মানির দুই ডিভিশনের মধ্যে একটা গ্যাপ তৈরি হয়।

এরকম গ্যাপ খুবই ভয়ঙ্কর। ব্রিটিশ বাহিনী নিজেদের আবিষ্কার করে সেই গ্যাপের সামনে, এবং তারা বিনা প্রতিরোধে সামনে এগোতে শুরু করে। জার্মান বাহিনী বুঝতে পারে- ব্রিটিশ বাহিনী এগোতে থাকলে তাদের পেছন থেকে আক্রমণের শিকার হতে হবে। অগত্যা জার্মানির দুই ডিভিশনই পিছু হটে। ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার পিছু হটে রাইন নদীর তীরে তারা ঘাঁটি স্থাপন করে। 

এই ঘাঁটি গাড়ার মাধ্যমে যুদ্ধের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এই যুদ্ধ হয়ে যায় অতীতের অন্য সব যুদ্ধের থেকে আলাদা। শুরু হয় ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার। ভয়ানক অনেক অস্ত্রের ধ্বংসক্ষমতা জানা ছিল। কিন্তু খুব সাধারণ কিছু উপকরণ, যেমন- কোদাল বা কাঁটাতার যে কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে, সেটা তখন প্রতীয়মান হয়। রাইন নদীর তীর ধরে জার্মান বাহিনী মাটি খুঁড়ে প্রায় মানুষের উচ্চতার সমান গভীর গর্ত তৈরি করে এবং সেই গর্তে অবস্থান নেয়। এরকম গর্তে থাকার কারণে সৈন্যরা কামানের গোলার স্প্লিন্টার থেকে অনেকটাই সুরক্ষিত থাকে। সেই সাথে থাকে রাইফেল বা মেশিন গানের নিশানার বাইরে।

ফ্রেঞ্চ বাহিনী প্রথমদিকে ট্রেঞ্চের ব্যবহার থেকে দূরে থাকে। তাদের কাছে ট্রেঞ্চে লুকানো ছিল অসম্মানের ব্যাপার। অনেক জীবন অর্থহীনভাবে জলাঞ্জলি দিয়ে তারা বুঝতে পারে যে, যন্ত্রের সামনে বীরত্বের কোনো মূল্য নেই। তারাও একসময় জার্মান বাহিনীর বিপরীতে ট্রেঞ্চ কাটে। যে যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল, এই ট্রেঞ্চের কারণে সেটা প্রলম্বিত হয় আরো চার বছর। যে শ্লিফেন প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে জার্মানি বেলজিয়ামের মতো নিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে, যে প্ল্যান অনুযায়ী ফ্রান্সকে ছ’সপ্তাহে হারানোর কথা, সেই প্ল্যান ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপে জার্মান প্রধান ভন মল্টকা ভেঙে পড়েন। দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াযন তিনি। 

যুদ্ধের বাকি চার বছর ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট বিখ্যাত হয়ে থাকে ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ারের জন্য। সুইস আল্পস থেকে ইংলিশ চ্যানেল পর্যন্ত প্রায় ৭০০ কিলোমিটার জুড়ে ট্রেঞ্চ কাটা হয়। দুই পক্ষের ট্রেঞ্চের মাঝের জায়গা ভরা থাকত কাঁটাতারে। ট্রেঞ্চগুলো কাটা হতো আঁকাবাঁকাভাবে, যাতে শত্রুপক্ষ ট্রেঞ্চে ঢুকে পড়লেও বেশিদূর গুলি করতে না পারে। ধীরে ধীরে ট্রেঞ্চ ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হয়, কয়েক স্তরে ট্রেঞ্চ কাটা হয়, যেগুলো নিজেদের মধ্যে যুক্ত থাকত।

ট্রেঞ্চের কাদায় দুই ব্রিটিশ সৈন্য
ট্রেঞ্চের কাদায় দুই ব্রিটিশ সৈন্য; Image Source: theworldwar.org

ট্রেঞ্চ সৈন্যদের গুলি বা বোমা থেকে রক্ষা করলেও অত্যন্ত অমানবিক ছিল এই ট্রেঞ্চে সৈনিকদের জীবন। অনেক সময় হাঁটু সমান কাদায় পা ডুবিয়ে তাদের কাটাতে হতো দিনের পর দিন। ঘুম-খাওয়া সবই এই কাদার মধ্যে। মাথার উপর খোলা আকাশ। সামান্য অসতর্ক হলেই মৃত্যু। শুধু কাদা বা মৃত্যুভয় না, অনেক সময় তাদের বাস করতে হতো মৃত সহযোদ্ধাদের সাথে। অনেকক্ষেত্রে প্রবল যুদ্ধের মাঝে লাশ সরানোর কোনো উপায় ছিল না। চোখের সামনে অসহায়ভাবে দেখতে হতো আহত সহযোদ্ধার ধুঁকে ধুঁকে মারা যাওয়ার দৃশ্য, আর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে পচতে থাকা লাশ। লাশ খেতে আসত ইঁদুর। অনেকক্ষেত্রে এসব সৈন্য ছিল স্কুল-কলেজের ছাত্র। অনেকেই আগে মৃত্যু দেখেনি। এরকম পরিবেশে মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখাই কঠিন, যুদ্ধ করা তো পরের কথা। এই পর্ব শেষ করা যাক এক জার্মান সৈন্যের তার প্রেমিকার প্রতি লেখা চিঠির অংশ দিয়ে,

“প্রিয়তমা,

আমি এত ভয়াবহ বোধ করি যে, তোমাকে চিঠি লিখার শক্তিই খুঁজে পাই না। আমরা এতটাই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। তার মানে এই না যে, আমি তোমায় ভুলে গেছি। এখানে অতিবাহিত করা প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমাদের ছোট্ট ঘরটা কত সুন্দর। ‘ঘর’— এই শব্দটাই আমার মনে আলোড়ন জাগায়। আমি ভাবিনি যুদ্ধ এরকম হবে।”

Language: Bangla

Topic: This article is about first world war history. 

References:

1. 'Blueprint for Armageddon' by Dan Carlin's Hardcore History

2. 'The Great War: 1914-1918' by Peter Hart

3. 'The Guns of August' by Barbara W. Tuchman

Featured Image: John Warwick Brooke / National Library of Scotland

Related Articles

Exit mobile version