২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি আল-কায়েদার ঘাঁটিতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ ইয়েমেনের আল-সাইদ এলাকার এক ১৪ বছর বয়সী কিশোর, আব্দুল্লাহ সালেহ বিন আলউইয়া। তার অন্তর্ধান রহস্য এবং তার সন্ধানে তার পরিবারের অভিযানের এ ঘটনাটি তদন্ত করেছেন বার্তাসংস্থা এপির মিসরীয় অনুসন্ধানী সাংবাদিক ম্যাগি মাইকেল এবং ইয়েমেনি ভিডিও প্রতিবেদক মাদ আল-জিকরি।
পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী এই প্রতিবেদনটি অবলম্বনে আব্দুল্লাহর কাহিনী নিয়ে পড়ুন আমাদের তিন পর্বের সিরিজের তৃতীয় ও সর্বশেষ পর্ব। আর সবগুলো পর্ব পড়তে পারবেন এখান থাকে: ১ম পর্ব, ২য় পর্ব, ৩য় পর্ব।
২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি। দক্ষিণ ইয়েমেনের শাবওয়া প্রদেশের মুসাইনা শহরের আকাশে মৃদু শব্দে উড়ছে একটি আমেরিকান ড্রোন, যার অপারেটর হয়তো বসে আছে পার্শ্ববর্তী সৌদি আরবে অথবা সুদূর আমেরিকার নেভাদা বা জর্জিয়ার কোনো এক মার্কিন ঘাঁটিতে। সেখানে বসেই রাতের আঁধারে সে নজরদারি করছে আল-কায়েদার শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মুসাইনার উঁচু-নিচু পার্বত্য ভূমিতে। সন্ধান করছে সম্ভাব্য আল-কায়েদা সন্ত্রাসীদের গোপন ঘাঁটির অথবা রাতের অন্ধকারের চাদরের আড়ালে চলাফেরা করা তাদের গোপন কনভয়ের।
সেই মুসাইনা শহরের পাহাড়ের উপরেই আল-কায়েদার এক গোপন ক্যাম্পের পাশে গাছতলায় শুয়ে আছে ১৪ বছর বয়সী কিশোর আব্দুল্লাহ সালেহ বিন আলউইয়া। আর কয়েক কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের পাদদেশে ট্যাক্সির ভেতর অপেক্ষা করছে তাকে খুঁজতে আসা তার বাবা সালেহ বিন আলউইয়া, ভাই জায়েদ, ভগ্নিপতি নাবিল, তার দুই চাচাতো ভাই আলি ও খালেদ, মুসাইনা শহরের মৌচাষী মোবারক এবং মোবারকের ভ্রাতুষ্পুত্র নাজিব।
রাত সাড়ে এগারোটার সময় ড্রোন অপারেটর একটি সুইচ চাপল। সাথে সাথেই ড্রোনটি থেকে নিক্ষিপ্ত হলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম দুইটি হেলফায়ার মিসাইল। নীরব-নিস্তব্ধ পাহাড়ের উপর প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো মিসাইল দুটি। গাছতলায় শুয়ে আব্দুল্লাহ বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল। প্রচণ্ড আতঙ্কে সে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু না, মিসাইল দুইটি আল-কায়েদার ক্যাম্পের উপর পড়েনি, পড়েছে আরেকটু দূরে কোথাও।
সকাল বেলা আল-কায়েদা সদস্যরা আব্দুল্লাহ আর তার বন্ধুকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিল। ফেরার পথে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে অর্ধেক নামার পরেই তারা দেখতে পেল আগের রাতের ড্রোন হামলার শিকার লক্ষ্যবস্তুটিকে। দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা একটি গাড়ি, চারপাশে রক্তের দাগ। কাছে আসার পর আব্দুল্লাহ চিনতে পারল, এটা অন্য কোনো গাড়ি না, তার বাবারই ট্যাক্সি। সেদিনের সেই মার্কিন ড্রোনের হামলায় কোনো আল-কায়েদা সন্ত্রাসী নিহত হয়নি, বরং শহিদ হয়েছিল তাকে খুঁজতে যাওয়া তার বাবা ও ভাইসহ মোট সাতজন বেসামরিক ব্যক্তি, যাদের সাথে আল-কায়েদার দূরতম কোনো সম্পর্কও ছিল না।
মিসাইলের আঘাতে গাড়ির ভেতরে থাকা সবার শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আব্দুল্লাহ অবশ্য তাদের মৃতদেহ দেখার সুযোগ পায়নি। রাতেই আল-কায়েদা সদস্যরা নিজেদের কারো ওপর হামলা হয়েছে মনে করে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিল। তারা মৃতদেহগুলোর অবশিষ্ট অংশগুলো উদ্ধার করে মুসাইনা শহরে নিয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় পড়ে ছিল শুধু বিধ্বস্ত ট্যাক্সি এবং তাজা রক্তের দাগ। আব্দুল্লাহ উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল। সে যদি আল-কায়েদার ঘাঁটিতে না যেত, তাহলে তার বাবা-ভাই তখনো বেঁচে থাকত।
মোবাইল ফোনে এবং হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজের মাধ্যমে ড্রোন হামলায় মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল খুব দ্রুত। আতাক শহরে সালেহ’র ভ্রাতুষ্পুত্ররা ভোরবেলায়ই তাদের ভাইদের, চাচার এবং চাচাতো ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেল। তারা মৃতদেহগুলো মুসাইনা থেকে এনে ইয়াশবম শহরের একটি মসজিদে রাখল। সালেহ’র দুই পা ছিল বিচ্ছিন্ন, আর জায়েদের শরীর ছিল সম্পূর্ণ দ্বি-খন্ডিত। ইসলামি রীতি অনুযায়ী দেরি না করে তখনই ইয়াশবম কবরস্থানে তাদেরকে দাফন করা হলো।
আল-সাইদ এলাকার শা’ব আরশান গ্রামে আব্দুল্লাহ’র মা মোহসানার ঘুম ভেঙেছিল ফযরের আযানের সাথে সাথেই। কিন্তু তিনি তখনো কিছু জানতেন না। তার সাথে রাতের বেলাও তার ছেলে জায়েদের কথা হয়েছিল। তিনি তাদেরকে রাতের বেলা বের হতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু সকাল সাড়ে সাতটার দিকে যখন প্রতিবেশি মহিলারা দলে দলে কালো পোশাকে কাঁদতে কাঁদতে তাদের বাড়িতে আসতে শুরু করল, তখনই তিনি জানতে পারলেন তার স্বামী, ছেলে এবং মেয়ের জামাই মার্কিন হামলায় নিহত হয়েছে।
আব্দুল্লাহ বাড়িতে এসে পৌঁছালো দুপুরের দিকে। কপদর্কহীন অবস্থায় তাকে চার ঘণ্টা হেঁটে বাসায় পৌঁছতে হয়েছে। ক্লান্ত অবস্থায় সে এসে বসল বাড়ির বাইরে একটি গাছের নিচে। দুঃখের চেয়েও সে সময় তার মধ্যে ভয়ই কাজ করছিল বেশি। তার ধারণা ছিল সবাই তাকেই দোষারপ করবে। কিন্তু ক্রন্দনরত মোহসানা তাকে কিছু না বলে কাছে টেনে নিলেন। তার ধারণা ছিল বাকিদের সাথে আব্দুল্লাহও হয়তো মারা গিয়েছিল। আপাতত এক ছেলেকে জীবিত ফিরে পাওয়াটাই তার কাছে অনেক বেশি।
গ্রামের নেতারা সালেহ’র মৃত্যুর জন্য আমেরিকার পাশাপাশি আল-কায়েদার উপস্থিতিকেও সমানভাবে দায়ী করেছিলেন। তারা পাহাড়ের উপর আল-কায়েদার নেতাদের কাছে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন তাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়ে আসেনি। কিন্তু ঘটনার পর কয়েকমাস পেরিয়ে গেলেও আব্দুল্লাহ এখনো আমেরিকাকে কিংবা আল-কায়েদাকে দায়ী করার চেয়ে নিজেকেই বেশি দায়ী করে। তার বিশ্বাস, তার কারণেই তার বাবা-ভাইয়ের মৃত্যু ঘটে ছে।
পেন্টাগন স্বীকার করেছিল, ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি তারা ইয়েমেনের শাবওয়া প্রদেশে বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের দাবি, তারা আল-কায়েদাকে লক্ষ্য করেই হামলা চালিয়েছিল। এখনো পর্যন্ত তারা ঐ হামলায় বেসামরিক জনগণের হতাহতের কথা স্বীকার করেনি। পেন্টাগনের মুখপাত্র রেবেকা রেবারিচ জানান, ড্রোন হামলায় হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করা তাদের বিধানে নেই।
মোহসানা এবং তার পরিবারের সদস্যদের জীবন সেই থেকে আটকে আছে নির্দিষ্ট রুটিনে। তাদের নিহত আত্মীয়রা যে সন্ত্রাসী ছিল না, সেটা প্রমাণ করাই এখন তাদের প্রধান কর্তব্য। পুলিশ অফিসার, জেলা কর্মকর্তা, গ্রামের গোত্র প্রধান, স্কুলের প্রধান শিক্ষক- যেখানে যাকে পাচ্ছেন, তার কাছ থকেই তারা চিঠি সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন, যে চিঠিতে তারা সাক্ষ্য দেবেন যে, নিহতরা আল-কায়েদার সদস্য ছিল না।
তারা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ করেছেন, ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রসের সাথে যোগাযোগ করেছেন। তাদেরকে অনুরোধ করেছেন এই হত্যার বিষয়ে তদন্ত করার জন্য। আতাক শহরে তারা একটি মিছিলেরও আয়োজন করেছিলেন। প্রায় ২০০ জন অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতিতে তারা আমেরিকার কাছে দাবি জানিয়েছেন তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য এবং স্বীকার করার জন্য যে, তাদের আত্মীয়রা সন্ত্রাসী ছিল না। এখন পর্যন্ত তাদের আওয়াজ আমেরিকার কানে পৌঁছেনি।
আমেরিকার হাতে ভুলক্রমে নিহত বেসামরিক জনগণের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ চাওয়ার ব্যাপারে মার্কিন সেনাবাহিনীর কিছু আনুষ্ঠানিক নিয়ম আছে। অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ সে নিয়ম অনুসরণ করে ইরাক এবং পাকিস্তানের হাতে গোণা কয়েকটি পরিবার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পেরেছে। কিন্তু ইয়েমেনে যেখানে কোনো মার্কিন দূতাবাসই নেই, সেখানে সালেহ’র পরিবারের পক্ষে সেই প্রক্রিয়া শুরু করাই সম্ভব না।
আব্দুল্লাহ’র পরিবার ধ্বংসস্তুপ থেকে মিসাইলের টুকরাগুলো সংগ্রহ করে এনেছে। সিরিয়াল নম্বর খোদাই করা মিসাইলের শার্পনেলগুলোকে তারা অত্যন্ত যত্নের সাথে কম্বলের ভেতর পেঁচিয়ে রাখে। তাদের আশা, কোনো একদিন কেউ হয়তো এই ঘটনাটির তদন্ত করবে। সেদিন হয়তো এই প্রমাণগুলো কাজে লাগবে। এই আশায় তাদের দিন কেটে যায়। আর ওদিকে চলতে থাকে ইয়েমেনের ত্রিমুখী যুদ্ধ। আকাশে উড়তে থাকে ভিনদেশী প্লেন। মারা যেতে থাকে অন্য কোনো পরিবারের অন্য কোনো সদস্যরা।