যুদ্ধের সময় যুদ্ধরত বাহিনীগুলোর রণকৌশল যেমন আমাদের জন্য শিক্ষণীয়, তেমনই যুদ্ধের নামে কালে কালে সংঘটিত বিভিন্ন নারকীয় হত্যাকাণ্ডও সকলের কাছেই নিন্দনীয়। মানবজাতির হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এমন অনেক হত্যাকাণ্ডেরই সাক্ষী। আজকের লেখার মধ্য দিয়ে আমরা ব্রিটিশদের নিজভূমে সংঘটিত এমনই কিছু নারকীয় হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানবো, যেখানে যুদ্ধজয় কিংবা শত্রুকে দমনের অজুহাতে হত্যা করা হয়েছে অজস্র নিরপরাধ মানুষকে।
১.
রাজা প্রথম উইলিয়াম, যিনি উইলিয়াম দ্য কনক্যারার নামেই বেশি পরিচিত, ১০৬৬ সালে ব্রিটেনে সফলভাবে আক্রমণ পরিচালনা করেন। ইংল্যান্ডের প্রথম এই নরম্যান রাজা ১০৬৬ থেকে ১০৮৭ সাল পর্যন্ত জীবনের বাকিটা সময় ইংল্যান্ডের সিংহাসনেই ছিলেন। এ সময় তাকে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করতেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছে।
ক্ষমতায় আরোহণের বছর তিনেক পর উইলিয়াম তার সবচেয়ে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে। সেখানকার বিদ্রোহীরা গেরিলা পদ্ধতিতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছিলো। উইলিয়ামের সেনারা যখন প্রহরা থেকে কিছু সময়ের জন্য বিরতি দিত, তখনই তারা ঝড়ের বেগে এসে আক্রমণ করে আবার চলে যেত। এই বিদ্রোহীদের কোনো নাগাল যেমন তার বাহিনী পাচ্ছিলো না, তেমনই কোনো যুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত সমাধানে আসার বিষয়েও তাদেরকে রাজি করানো যাচ্ছিলো না। ফলে ভিন্নপন্থা অবলম্বনে বাধ্য হন উইলিয়াম।
১০৬৯ সালের শেষের দিকে উইলিয়ামের বাহিনী উত্তরাঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পুড়িয়ে দেয়া হয় প্রতিটি গ্রাম, নির্বিচারে হত্যা করা হয় গ্রামবাসীদের। কেবলমাত্র এটুকু করেই থামেননি উইলিয়াম। এই পথে যাবতীয় খাদ্যের চালানও ধ্বংস করে দেন তিনি, যাতে করে কেউ যদি বেঁচেও থাকে, সে-ও যেন তীব্র শীতে অনাহারে মৃত্যুবরণ করে এটা নিশ্চিত করা যায়। ধারণা করা হয়, এই ধ্বংসযজ্ঞে আনুমানিক ১,০০,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল।
২.
৬৮৬ খ্রিস্টাব্দের কথা, ওয়েসেক্সের রাজা সিডওয়ালা জয় করে নিলেন তৎকালীন উইহ্তওয়ারাকে, যা আজকের দিনে আইল অফ ওয়াইট নামে পরিচিত।
অতীতে বিভিন্ন সময়ই দ্বীপটির শাসক বদল হয়েছিল। প্রতিবারই নতুন নতুন শাসকেরা তাদের ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দিয়েছিল দ্বীপের অধিবাসীদের উপর। সিডওয়ালার শাসনামল শুরুর পর যখন তিনি এখানে ক্ষমতা সুসংহত করে ইংল্যান্ডের মূল ভূমির দিকে নজর দিলেন, তখনই দ্বীপের অধিবাসীরা তাদের পুরাতন ধর্ম মূর্তিপূজায় ফিরে গেল। এ বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলেন না খ্রিস্টধর্মের অনুসারী রাজা সিডওয়ালা, কারণ তিনি মূর্তিপূজাকে দু’চোখে দেখতে পারতেন না।
ফলে দ্বীপটিতে নিজের ক্ষমতা সুসংহতকরণ এবং একইসাথে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি দ্বীপের অধিবাসীদের দুটি পথের যেকোনো একটি বেছে নিতে বলতেন- হয় খ্রিস্টধর্মকে বেছে নিতে হবে, কিংবা আলিঙ্গন করতে হবে মৃত্যুকে। ধারণা করা হয়, দ্বীপের অধিকাংশ অধিবাসীই মৃত্যুবরণ করেছিল সিডওয়ালার বাহিনীর চালানো গণহত্যায়।
এই গণহত্যায় যে ঠিক কতজন মানুষ মারা গিয়েছিল সেই সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছুই জানা যায় না। তবে কেবলমাত্র একজন বেঁচে যাবার খবরই লিপিবদ্ধ করা আছে। তিনি উইহ্তওয়ারার রাজার বোন, পরবর্তীতে কেন্টের রাজা এগবার্টের সাথে যার বিয়ে হয়েছিল।
৩.
ষোড়শ শতকের শেষভাগের কথা। ক্লানাবয়ের (আজকের উত্তর আয়ারল্যান্ড) ও’নিল গোত্রের গোত্রপতি স্যার ব্রায়ান ম্যাকফেলিম ও’নিলকে বেশ পছন্দই করতো ইংরেজরা। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৫৬৮ সালে তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কিন্তু এরপর থেকেই কী যেন হয়ে যায়। পরবর্তী ছ’বছর ধরে আস্তে আস্তে ও’নিল ইংরেজদের কাছে আগের সেই প্রিয়ভাজন অবস্থানটি হারিয়ে ফেলেন।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ও’নিল জানতে পারেন, ক্লানাবয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে সেনা সমাবেশ ঘটাচ্ছে ইংরেজরা। এই খবর স্বাভাবিকভাবেই তাকে ক্ষেপিয়ে তোলে। মৈত্রি-চুক্তি ভঙ্গ করে তিনি সেসব স্থাপনায় হামলা চালান।
এরপর ও’নিল এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন। শান্তি পুনঃস্থাপনের উদ্দেশ্যে সাসেক্সের আর্লকে নিজের দুর্গে এক প্রীতিভোজে আমন্ত্রণ জানান তিনি। ভোজনপর্ব শেষ হওয়ার আগে সবকিছু ঠিকমতোই চলছিলো। খাওয়া শেষ হতেই ইংরেজ সেনারা ও’নিল আর তার পরিবারের কাছের মানুষদের অবরুদ্ধ করে ফেললো। এরপর সেখানে উপস্থিত, ও’নিলের অনুগত নিরস্ত্র ২০০-৫০০ সেনাকে হত্যা করে ইংরেজ সেনারা। এরপর ও’নিল, তার স্ত্রী ও ভাইকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় ডাবলিন দুর্গে। সেখানে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে, পানিতে নিমজ্জিত করে এবং সর্বশেষে টুকরা টুকরা করে তাদেরকে শেষ করে দেয়া হয়!
৪.
এখন যে গণহত্যার কথা বলা হবে, সেটি সংঘটিত হয়েছিল ১০০২ সালে, নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখে। তখন ডেনমার্কের রাজা ছিলেন প্রথম সোয়েইন। তার সেনাদের বারবার ইংল্যান্ডের ভূমিতে চালানো আক্রমণে অতিষ্ট হয়ে ওঠেন তৎকালীন ইংরেজ রাজা এথেল্রেড, সিদ্ধান্ত নেন ড্যানিশদের চরম এক শিক্ষা দেয়ার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তার দেশে যেসব ড্যানিশ নাগরিক রয়েছে, তাদের সবাইকে একে একে হত্যা করা হবে।
এথেল্রেডের বিরাগভাজন হবার ফলে ঠিক কতজন ড্যানিশ নাগরিককে প্রাণ দিতে হয়েছিল সেই সংখ্যাটি সঠিকভাবে জানা না গেলেও সংখ্যাটি যে কম ছিলো না তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইংল্যান্ডের সেসব এলাকাতেই গণহত্যা চালানো হয়, যেসব এলাকায় ড্যানিশ আইন কার্যকর ছিলো না।
অক্সফোর্ডের স্থানীয় এক চার্চে চালানো হত্যাযজ্ঞের কথাই উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়। সেখানকার স্থানীয় লোকজন জীবন বাঁচাতে সেই চার্চে গিয়ে ঢুকেছিল। কিন্তু এতেও নিস্তার মেলেনি তাদের। এথেল্রেডের সেনারা চার্চে আগুন দিয়েই সেই দুর্ভাগাদের হত্যা নিশ্চিত করে। ২০০৮ সালে অক্সফোর্ডের সেইন্ট জন্স কলেজে খননকার্য চালানোর সময় ৩৫ জন দুর্ভাগার পুড়ে যাওয়া দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়।
৫.
১৬৪৪ সালের ২৮ মে; ইংরেজদের মাঝে চলমান গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ শিকার হলো বোল্টন শহরটি, ইতিহাসে যে ঘটনাটি বোল্টন ম্যাসাকার নামেই পরিচিত। সেদিন রাজপুত্র রুপার্টের নেতৃত্বে ক্যাভেলিয়ার্সরা বোল্টনে হামলা চালায়। তার বাহিনীতে ছিলো আনুমানিক ২,০০০ অশ্বারোহী এবং ৬,০০০ পদাতিক সেনা। অন্ধকারাচ্ছন্ন, ঝড়ো আবহাওয়ার সেই রাতে তারা যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। সামরিক-বেসামরিক নাগরিক মিলিয়ে বোল্টনের প্রায় ১,৬০০ নাগরিক মারা যায় নারকীয় এই গণহত্যায়।
তবে নিহতদের সংখ্যাটি আসলেই সঠিক কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ, শহরটির রেজিস্টার বইয়ে মাত্র ৭৮ জন বোল্টনবাসীর নাম নথিভুক্ত আছে, যারা সেদিন মারা গিয়েছিল।
৬.
ব্রিটিশদের নিজভূমে চালানো হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাজানো আজকের এই লেখার ইতি টানা যাক পিটারলু হত্যাকাণ্ডের কাহিনী দিয়েই। এটি সংঘটিত হয়েছিল ১৮১৯ সালের ১৬ আগস্ট। বিগত বছরগুলো ধরে ল্যাঙ্কাশায়ার এলাকায় চলে আসা নানাবিধ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিই এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল।
তখন ইংল্যান্ডের পোশাকশিল্প গড়ে উঠেছিল মূলত দেশটির উত্তরাঞ্চলকে কেন্দ্র করে। জাতীয় অর্থনীতির মন্দাভাব প্রভাব ফেলেছিল এখানেও। কলকারখানার মালিকেরা শ্রমিকদের বেতন দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে এনেছিলেন। ১৮১৫ সালে চালু হওয়া শস্য আইনের ফলে শস্যের উপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হয়। এভাবে নানা দিক থেকে শোষিত, নিপীড়িত শ্রমিকদের দৈনন্দিন খাবার কেনার অর্থটুকু পর্যন্ত থাকছিলো না। ল্যাঙ্কাশায়ারে বসবাসরত কর্মজীবী শ্রেণীর প্রায় ১০ লাখ মানুষের জন্য সংসদে ছিলেন মাত্র দুজন প্রতিনিধি।
সেই সময় কর্মজীবী শ্রেণীর মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতিবিদ হেনরি হান্টের মতো লোকজন। কারণ শোষিত শ্রেণীর পক্ষে কথা বলতেন তিনি, চাইতেন শস্য আইনের বিলোপসাধন। ১৮১৯ সালের ১৬ আগস্ট এমনই এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে অন্যান্য রাজনীতিবিদের সাথে উপস্থিত ছিলেন হান্টও। সেই জনসভার প্রায় ৬০,০০০-৮০,০০০ লোক অংশ নেয়।
জনগণ বেশ শান্তই ছিলো। যখনই হান্ট বক্তৃতা দিতে যাবেন, তখনই স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের চেয়ারম্যান তার অশ্বারোহী বাহিনীকে নির্দেশ দেন হান্টকে গ্রেফতার করতে। উত্তেজিত জনতা অশ্বারোহী বাহিনী ও হান্টের মাঝে বাঁধার দেয়াল তৈরি করতে চেষ্টা করে। অশ্বারোহী বাহিনীও সেই জনতার উপর নির্বিচারে তলোয়ার চালাতে শুরু করে। আতঙ্কিত জনতা পালিয়ে গেলে ১০ মিনিটের মাঝেই ময়দান ফাঁকা হয়ে যায়, নিহত হন ১১-১৮ জন, আহত হন প্রায় ৭০০ জন।