গিলোটিনের নাম আমরা কম বেশি সবাই শুনেছি। গিলোটিন হলো অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রচলিত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার একটি যন্ত্র। অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডকে অপেক্ষাকৃত কম বেদনাদায়ক, দ্রুত ও মানবিক করার জন্যই গিলোটিনের প্রচলন ঘটেছিল। গিলোটিনের প্রচলন ঘটার আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বেশিরভাগ পদ্ধতিই ছিল নির্মম ও অমানবিক। সেসময় কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তাকে জনসম্মুখে নানা ভাবে নানা রকম নিষ্ঠুর নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। যেমন, অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে ইউরোপের একটি বহুল প্রচলিত মৃতুদণ্ডের মাধ্যম ছিল অপরাধীকে ‘ভেঙ্গে ভেঙ্গে’ হত্যা করা। এই পদ্ধতিতে অপরাধীকে একটি চাকায় হাত পা টান টান করে বাঁধা হতো। এরপর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারী জল্লাদ আক্ষরিকভাবেই মুগুর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তার শরীরের প্রত্যেকটি হাড় ভেঙ্গে ফেলতো।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জল্লাদ অপরাধীর এমন জায়গায় আঘাত করতো যাতে সাথে সাথেই তার মৃত্যু না হয়। সে হাত কিংবা পায়ের মতো স্থানের হাড়গুলো আগে পিটিয়ে ভেঙ্গে নিতো। এরপর ধীরে ধীরে পিটিয়ে পিটিয়ে অপরাধীর দেহের সমস্ত হাড় চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলতো জল্লাদ। ফলে একসময় অমানবিক যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যু হতো অপরাধীর। এভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ফলে জঘন্য ও লোমহর্ষক এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটতো।
সেসময় প্রায় প্রতিটি মৃত্যুদণ্ডই জনসম্মুখে কার্যকর করা হতো যাতে জনগণ বুঝতে পারে, এধরনের অপরাধ করলে তাদেরও ঠিক এমন পরিণতিই ঘটবে। মূলত প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমন কঠিন নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো। তবে সেসময় শিরচ্ছেদের মাধ্যমেও মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু সেগুলো কেবল মাত্র সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষের জন্য প্রযোজ্য ছিল।
আর শিরচ্ছেদের পদ্ধটিও যে খুব একটা মানবিক ছিল তা কিন্তু নয়। যে অস্ত্রের মাধ্যমে কুপিয়ে শিরচ্ছেদ করা হতো সেটি বেশি ব্যবহারের ফলে প্রায়ই ভোঁতা হয়ে যেত। ফলে ধড় থেকে মাথা আলাদা করতে কয়েকবার কোপ দিতে হতো জল্লাদকে। ফলে খুবই মর্মান্তিক এক মৃত্যু হতো অপরাধীর। আর এক্ষেত্রে জল্লাদ নতুন কিংবা অনভিজ্ঞ হলে তো কথাই নেই।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্কটল্যান্ডের রানী মেরি ও এসেক্সের দ্বিতীয় আর্ল রবার্ট ডেভেরিউক্সের শিরচ্ছেদের সময় ধড় থেকে মাথা আলাদা করতে ৩ বার কোপ দিতে হয়েছিলো। অপরদিকে সালিসবারির কাউন্টেস মার্গারেট পোলের শিরচ্ছেদের সময় ১০ বার আঘাত করে শিরচ্ছেদ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। ফলে বোঝাই যাচ্ছে কতটা নির্মম ছিল এই শিরচ্ছেদের পদ্ধতি। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, বহু অপরাধীর পরিবারই জল্লাদকে তার অস্ত্রটি ধার দিয়ে ধারালো করে নেওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিতো। যাতে এক কোপেই তাদের পরিচিত জনের শিরচ্ছেদ সম্পন্ন হয়ে যায়!
কিন্তু এভাবে আর কত দিন! সময়ের সাথে সাথে মানুষ এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ফ্রান্সের সবাই একটি ব্যাপারে একমত হলো যে, মৃত্যুদণ্ড একটি জীবনকে শেষ করে দেওয়ার জন্যই দেওয়া হয়। তাকে অপ্রয়োজনীয় কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়। ঠিক সেসময় ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের গোড়াপত্তন ঘটে। সমাজের সর্বস্তরে সমতার দাবী ছিল এই ফরাসি বিপ্লবের একটি অংশ। আর তার রেশ ধরেই অপরাধীদের জন্য মানবিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দাবী করা হয়। এসবের মধ্যেই ১৭৮৯ সালে ডাক্তার জোসেফ ইগ্নেস গিলোটিন নামের এক ফরাসি ডাক্তার জাতীয় পরিষদ বা বিধানসভার নিকট ৬টি প্রবন্ধ পেশ করেন। মৃত্যুদণ্ডকে ঢেলে সাজানোর বিশদ বিবরণ ছিল এই প্রবন্ধগুলোতে।
ডাক্তারের সেই প্রস্তাবনা প্রথম দিকে নাকচ করে দেওয়া হলেও ১৭৯১ সালে পরিষদ তা গ্রহণ করেন। সেসময় সকলের দাবি ছিল, “মৃত্যুদণ্ড পদ, শ্রেণী, মর্যাদা নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষের জন্যই সমান হতে হবে। এটি হতে হবে মানবিক, দ্রুত ও কম যন্ত্রণাদায়ক।” ফলে এই দাবীর বাস্তবায়নের জন্য রাজার ব্যক্তিগত চিকিৎসক আন্টনি লুইসের অধীনে ডাঃ গিলোটিন একটি কমিটি গঠন করেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য নতুন একটি যন্ত্র উদ্ভাবনের কাজ শুরু করেন।
ডাঃ গিলোটিন ও তার সহকর্মীরা এসময় হালিফ্যক্স গিব্বেট ও স্কটিশ মেইডেন নামের দুটি পূর্ববর্তী শিরচ্ছেদ যন্ত্র থেকে নতুন ও উন্নত একটি যন্ত্র তৈরির অনুপ্রেরণা লাভ করেন। পূর্বের এ দুটি যন্ত্রই ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রিটেনে প্রচলিত ছিল।
তবে এই যন্ত্রগুলোতে বিশাল আকারের কুড়ালের মাথা ব্যবহার হতো। ভোঁতা এই অস্ত্রটি দিয়ে খুব জোরে আঘাত করে শিরচ্ছেদ করা হতো যা মোটেই পরিচ্ছন্নভাবে সম্পন্ন হতো না। এভাবে কয়েক মাস যাবার পরে ল্যাক্যুইয়ান্তে নামের স্ট্রাসবার্গ ক্রিমিনাল কোর্টের একজন অফিসার একটি যন্ত্রের নকশা তৈরি করেন যেটিই আসলে বিখ্যাত গিলোটিনের প্রকৃত রূপ। তার এই নকশা কমিটির সবারই খুব পছন্দ হয় ফলে তারা এটির একটি আনুমানিক ক্ষুদ্র সংস্করণ বা প্রোটোটাইপ নির্মাণ করার জন্য টোবিয়াস স্কিমিড নামের এক জার্মান প্রকৌশলীকে নিয়োগ দেন।
টোবিয়াস সেই নকশায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনে আরো উন্নত রূপে একটি যন্ত্র নির্মাণ করেন। তিনি এটিতে ৪৫ ডিগ্রী কোণে একটি লম্বা ব্লেড যুক্ত করেন। নির্মাণের পর অ্যান্টনি লুইসের নামে যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয় ‘লুইসেট্টে’। পরে তার নাম বদলে যে মানুষটি এই যন্ত্রের প্রথম প্রস্তাবনা করেছিলেন সেই ডাঃ গিলোটিনের নামে এই যন্ত্রটির নাম গিলোটিন রাখা হয়।
গিলোটিনের গঠন ছিল অনেকটাই সরল। আমাদের দেশে একসময় নানা পূজা-পার্বণে যে হাড়িকাঠে বিভিন্ন পশু বলি দেওয়া হতো, গিলোটিন ছিল অনেকটা তেমনই। একটি সুদৃশ্য কাঠের উপর উপুড় করে অপরাধীকে শুইয়ে দেওয়া হতো। তার গলাটি গোল করে কাটা হাড়িকাঠের মধ্যে আটকানো থাকতো। এবার তার মাথার উপর থেকে ৪৫ ডিগ্রী কোণে বাঁকানো একটি ধারালো ভারী ব্লেড ছেড়ে দেওয়া হতো। ফলে নিমেষেই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো মাথা।
গিলোটিনের মাধ্যমে প্রথম মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৭৯২ সালের ২৫ এপ্রিলে। নিকোলাস জ্যাকুইস পেল্লেটিয়ার নামের এক দস্যুকে এই দিন মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা দেওয়া হয়। বিপুল পরিমাণ দর্শক নতুন এই পদ্ধতির মৃত্যুদণ্ড দেখতে ভিড় করেন। পেল্লেটিয়ারকে গিলোটিনে চড়ানো হয়। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই নেমে আসে মৃত্যুর সেই ব্লেড। আর সাথে সাথেই ধড় হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার মাথা। তবে এতদিন পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেখে অভ্যস্ত উপস্থিত জনতার সবাই এই মৃত্যুদণ্ড দেখে হতাশ হয়ে পড়ে।
তারা এতদিন ফাঁসী কিংবা ‘ভেঙ্গে ভেঙ্গে’ মৃত্যুদণ্ডের মতো যেসব পদ্ধতি প্রচলিত ছিল সেগুলোতেই বেশি বিনোদন লাভ করতো। গিলোটিনের এই দ্রুত শিরচ্ছেদ পদ্ধতিকে তারা ‘বেশি দ্রুত’ ও বিনোদনহীন আখ্যা দেন। অসন্তুষ্ট জনতার মধ্যে অনেকে তো চিৎকার করেই বসেন, “এই গিলোটিন আমরা চাই না! আমাদের পুরানো সেই ফাঁশিকাঠ ফিরিয়ে আনা হোক!” অন্যকে নির্মমভাবে নির্যাতিত হতে দেখেও যে মানুষ কতটা পাশবিক আনন্দ পায় সেটি বোঝা যায় এ ঘটনা থেকে।
জনগণের অপছন্দের হলেও এই গিলোটিনকেই ফ্রান্সের একমাত্র বৈধ মৃত্যুদন্ডের মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। আর গিলোটিন আবিষ্কারের এক বছরের মধ্যেই ফরাসি বিল্পবের কুখ্যাত ‘Reign of Terror’ সময়কালের প্রধান প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় এই গিলোটিন। এক বছরের মধ্যেই গিলোটিনের মাধ্যমে প্রায় ৪০,০০০ মানুষের শিরচ্ছেদ করা হয়। বহু বিখ্যাত ব্যক্তিকে এসময় গিলোটিন চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ডাঃ গিলোটিনও খুব অল্পের জন্য বেঁচে যান তার প্রস্তাবিত এই গিলোটিনে নিজের মুন্ডু হারানোর হাত থেকে!
জনসম্মুখে গিলোটিনে শেষ মৃত্যুদণ্ডটি কার্যকর করা হয় ১৯৩৯ সালের ১৭ জুন ভার্সাইল্লেসে। এসময় ইউগেন উইল্ডম্যান নামের এক জার্মান অপরাধীকে কারাগারের বাইরে গিলোটিনে চড়িয়ে শিরচ্ছেদ করা হয়। সেসময় উপস্থিত জনতা এই দৃশ্যে এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন যে, এরপর থেকে জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে গোপনীয়ভাবে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত গিলোটিনের ব্যবহার চলতে থাকে। এরপর সেই বছরেরই ১০ সেপ্টেম্বর মারসেইল্লিতে গিলোটিনের মাধ্যমে সর্বশেষ মৃত্যুদণ্ডটি কার্যকর করা হয়। হামিদা জানদৌবি নামের এক তিউনিসীয় অভিবাসীকে নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের অপরাধে এই দিন গিলোটিন চড়ানো হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নেমে আসে ব্লেড। আর সেই সাথে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গিলোটিনের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হওয়া শেষ নরমুণ্ড।
তথ্যসূত্র:
Kellaway, J. (2002). The history of torture and execution: From early civilization through medieval times to the present. Globe Pequot.
Laurence, J. (1963). A history of capital punishment. Citadel Press.
Ballard, R. (2011). A new dictionary of the French Revolution. IB Tauris.
Mercer, J. (2008). When the Guillotine Fell: The Bloody Beginning and Horrifying End to France’s River of Blood, 1791–1977. Macmillan.
ফিচার ইমেজ – deviantart.com