সত্যিকারের নেতা হতে অনেক গুণের দরকার হয়। পেতে হয় মানুষের অগাধ ভালবাসা আর ভরসা। কিন্তু নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য খুব বিশেষ কোনো গুণাবলীর দরকার হয় না। দেশের নাগরিকত্ব, গরম পকেট আর নিজের ওপর অগাধ আত্মবিশ্বাস থাকলেই চলে। সেজন্যই যুগে যুগে অনেক অদ্ভুত স্বভাবের প্রার্থীর কথা জানা যায়, যারা জনগণকে উদ্ভট কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেদেরকে হাসির পাত্র করে তুলেছেন। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোর মধ্যে দেয়াল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যিনি আলোচনার শীর্ষে চলে এসেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি কথা দিয়েছিলেন, ওরিও কুকি খাওয়া বাদ দেবেন। কারণ ওরিওর প্রস্তুতকারক কোম্পানি নাবিস্কো মেক্সিকোতে অবস্থিত। চলুন, জেনে আসা যাক এরকম আরো কিছু অদ্ভুত প্রতিশ্রুতি দেওয়া রাজনীতিবিদদের কথা।
ফার্দিনান্দ লপ
ফ্রান্সের ফার্দিনান্দ লপকে উদ্ভট নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অগ্রদূত বলা যেতে পারে। ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি থেকে তিনি পদপ্রার্থিতার কার্যক্রম শুরু করেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসেবে তিনি প্রথম নির্বাচনে দাঁড়ান ১৯৩৮ সালে। চল্লিশের দশকের শেষ পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট হবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। কখনো জিততে না পারলেও পার্সিয়ানদের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। তারা লপের নামানুসারে নিজেদেরকে ‘লপুলার ফ্রন্ট’ বলে ডাকতেন। বিভিন্ন নিয়ম-কানুনে আমূল পরিবর্তন আনার জন্য তিনি ‘লপিওথেরাপি’ নামে একটি প্রোগ্রাম শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
সেই প্রোগ্রামের মধ্যে ছিল রাত ১২টার পরে থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ, প্যারিসবাসীকে বিশুদ্ধ বাতাস উপভোগের সুযোগ দেবার জন্য প্যারিসের অবস্থান গ্রামের দিকে সরিয়ে আনা, যৌনতা বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া, সরকারি রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে পতিতালয়ের জাতীয়তাকরণ ইত্যাদি। শুধু এসবের মাঝেই তার উদ্ভট কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৫৯ সালে তিনি প্রিন্সেস মার্গারেটকে বিয়ে করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ফলশ্রুতিতে তাকে জেলও খাটতে হয়েছিল।
ভারমিন সুপ্রিম
নিজের প্রকৃত নাম বাদ দিয়ে ‘ভারমিন লাভ সুপ্রিম’ নামেই পরিচিত ছিলেন উদ্ভট চরিত্রের এই পারফরম্যান্স আর্টিস্ট। নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন এই নামেই। আশির দশকের শেষের দিকে আমেরিকার জাতীয় নির্বাচনে বেশ কয়েকবার দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার মতে, প্রত্যেক রাজনীতিবিদই পরজীবী কীট (ভারমিন) আর তিনি সেই কীটদের নেতা (ভারমিন সুপ্রিম)।
মাথায় পরে থাকা লম্বা কালো বুটজুতো দিয়ে সহজেই তাকে চেনা যেত। দেশের সবার জন্য পনি ঘোড়ার ব্যবস্থা করা, দাঁত মাজার উপর আইন প্রণয়ন করা, বেশি অসুস্থ মানুষদের হাতে কানাডার বাস টিকেট ধরিয়ে দেয়া, সময় পরিভ্রমণ বিষয়ক গবেষণার পেছনে অর্থ লগ্নি করা, মানুষের মাংস খাওয়া বৈধ করা, জম্বি অ্যাপোক্যালিপ্সের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা; এরকম বিচিত্র কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের মন জয় করতে চেয়েছিলেন তিনি।
স্ক্রিমিং লর্ড সাচ
প্রকৃত নাম ডেভিড এডওয়ার্ড সাচ। তবে থার্ড আর্ল অফ হ্যারো কিংবা স্ক্রিমিং লর্ড সাচ নামেই ছিলেন বহুল পরিচিত। নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেনও এই নামেই। জীবনে প্রথমবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন ১৯৬৩ সালে, তখন তার বয়স ছিল ২২।
সেই থেকে শুরু করে সারাজীবনে অনেকবারই চেষ্টা চালিয়ে গেছেন জনগণের মন জয় করার। যেসব দলের প্রার্থিতা অর্জন করেছেন, তাদের নামগুলো ছিল তার মতোই অদ্ভুত। যেমন ন্যাশনাল টিনেজ পার্টি, সড ‘এম অল পার্টি, গো টু ব্লেজ পার্টি, অফিশিয়াল মনস্টার রেভিং লুনি পার্টি। তার প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গ্রাম্য ভাঁড়ের সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা, সারারাত ধরে পানশালা চালু রাখা, জগিং করা ব্যক্তিদেরকে ব্যবহার করে ট্রেডমিলের সাহায্যে বিদ্যুত উৎপাদন ইত্যাদি।
অ্যাডেলিন জে জিও-ক্যারিস
১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় থেকে রিপাবলিকান দলের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন এই নারী। তার দেয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অবশ্য ছিল বেশ সোজাসাপ্টা। তিনি কথা দিয়েছিলেন, নির্বাচনে জিতলে তিনি ৫০ পাউন্ড ওজন কমাবেন।
তার ধারণা ছিল, এর মাধ্যমে তিনি আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবেন। ফলে ভিন্ন ভিন্ন স্টেটে গিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদেরকে ইলিনয়ে আসতে রাজি করাতে পারবেন। দুর্ভাগ্য তার, নির্বাচনে বড় ব্যবধানে ডেমোক্রেট প্রার্থী রোল্যান্ড বারিসের কাছে পরাজয় বরণ করতে হয় তাকে। অবশ্য তার ক্যারিয়ার এমনিতে বেশ সমৃদ্ধ ছিল। ইলিনয়ের রিপাবলিকান সিনেটর হয়ে কাজ করেছেন প্রায় ২৫ বছর।
হান্টার এস. থম্পসন
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর এই সাংবাদিক ১৯৭০ সালে শেরিফ পদে নির্বাচিত হবার জন্য ‘ফ্রিক পাওয়ার’ নামের একটি অদ্ভুত ক্যাম্পেইন করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল অ্যাসপেন শহরের নাম পরিবর্তন করে ‘ফ্যাট সিটি’ রাখা, পুলিশ এবং ডেপুটিদের অস্ত্রবিহীন চলাফেরার আইন প্রণয়ন, মাদক বিক্রেতাদের শেয়ার কেনার অনুমতি দেয়া, শহরের সব পাকা রাস্তা গুঁড়িয়ে দিয়ে কেবল পায়ে হাঁটা আর বাইসাইকেল চালানোর নিয়ম করা ইত্যাদি।
মজার ব্যাপার, নির্বাচনে হান্টার পরাজয় বরণ করেন খুবই সামান্য ব্যবধানে, যেটা কি না তার কাছে ছিল প্রায় জয়েরই শামিল। তার এই বিচিত্র ক্যাম্পেইনকে কেন্দ্র করে ‘হাই নুন ইন অ্যাসপেন’ নামের একটি ডকুমেন্টারিও নির্মিত হয়েছে। তার বই ‘ফিয়ার অ্যান্ড লোথিং ইন লাস ভেগাস’ এর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন জনি ডেপ, ব্যক্তিগত জীবনেও তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
ডেনিস কুসিনিচ
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর এই রাজনীতিবিদ ১৯৭৭-৭৯ সাল পর্যন্ত ক্লেভল্যান্ডের মেয়র ছিলেন। ২০০৪ এবং ২০০৮ নির্বাচনে তিনি ডেমোক্র্যাটিক দলের হয়ে প্রেসিন্ডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর মনোনয়নের আবেদন করে ব্যর্থ হন। একাধিকবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে বিভিন্ন বিষয়ে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করার চেষ্টা করে গেছেন তিনি, এমনকি গ্রেপ্তারের হুমকিও দিয়েছেন।
শুধু এটুকু করেই থেমে থাকেননি তিনি, বারবার বুশ প্রশাসনকে সতর্ক করেছেন এই ব্যাপারে। গ্রেপ্তার হবার পরে আসামিদেরকে যেই ‘মিরান্ডা রাইটস’ শোনানো হয়, সেই সম্পর্কেও ভালোমতো জেনে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যান্য প্রতিশ্রুতিকে ছাপিয়ে তার এই বিষয়টিই হয়ে উঠেছিল তার ক্যাম্পেইনের মূল প্ল্যাটফর্ম।
অ্যান্ডি ক্যাফ্রে
এই রাজনীতিবিদ ২০১২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার কংগ্রেসের পদপ্রার্থী ছিলেন। মূলত পরিবেশ দূষণ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল তার। তবে একবার সভায় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসেন যে, নির্বাচনে জিতলে ক্যাপিটল হিলে সবার সামনে মারিজুয়ানা সেবন করবেন। মুখ ফসকে বলা কোনো কথা ছিল না সেটা, কারণ তার কিছুদিন পরের আরেক সভায় তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন।
স্থানীয় মিডিয়ায় সাড়া পড়ে যায় দ্বিতীয় কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্ট নির্বাচন নিয়ে। ক্যাফ্রে পরে স্বীকার করেন ,এটাই তার উদ্দেশ্য ছিল। জাতীয় পর্যায়ে মেডিকেল মারিজুয়ানার বৈধতাকরণের ইচ্ছাও ছিল তার। নিজেদের এই অধিকার আদায়ের জন্য জেল খাটতেও রাজি ছিলেন তিনি, সেখান থেকেই কথা প্রসঙ্গে এই কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসেন। দুর্ভাগ্যবশত ভোটারদের মন জয় করতে পারেননি তিনি।
জন এডওয়ার্ডস
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার সিনেটর জন এডওয়ার্ডস রাজনীতিতে আসার আগে আইনী পেশার সাথে ভালোভাবেই জড়িত ছিলেন। তবে ডাক্তারিবিদ্যার ক্ষেত্রে তার কোনো অভিজ্ঞতা আছে বলে জানা যায় না। তারপরও যখন তিনি ডেমোক্রেট দলের হয়ে জন কেরির পাশাপাশি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, তখন জনগণকে ডায়াবেটিস, আলঝেইমার এবং পারকিনসন্সের মতো দুরারোগ্য রোগ নিরাময়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনে জন কেরির রানিং মেট হিসেবে এক ক্যাম্পেইনে এই কথা বলে বিতর্কিতও হয়েছিলেন দারুণভাবে।
মূলত, এমব্রায়োনিক স্টেম সেল বিষয়ক গবেষণার পেছনে অর্থ লগ্নির বিষয়ে জোর দিতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেছিলেন। তার মতে, যদি জন কেরিকে নির্বাচিত করা হয়, প্রাক্তন সুপারম্যান অভিনেতা ক্রিস্টোফার রিভ থেকে শুরু করে কোনো মানুষকেই আর হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হবে না। এই কথার মাধ্যমে হাসির পাত্র হবার পাশাপাশি এই অসুখের ভুক্তভোগীদেরকে খাটো চোখে দেখার জন্য তাকে ভীষণ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। পরে জন কেরি একসময় বলেন, জন এডওয়ার্ডসকে রানিং মেট হিসেবে বেছে নেয়া একটি বড় ভুল ছিল।
হারম্যান কেইন
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার এই রাজনীতিবিদ ছিলেন একাধারে রেডিও উপস্থাপক, ব্যবসায়ী এবং কলাম লেখক। সবগুলো পেশাতেই তর্কবাগীশ হওয়া প্রয়োজন, তবে হারম্যান কেইন কম কথাতেই কাজ শেষ করতে পছন্দ করতেন। সেকারণেই তিনি নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে বলেন, ৩ পৃষ্ঠার থেকে লম্বা কোনো বিল তিনি সংসদে পাশ করতে দেবেন না!
আইওয়াতে প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনে গিয়ে তিনি বলেন,
জনগণের সময়কে ভালোভাবে কাজে লাগানো উচিত। ২,৭০০ পৃষ্ঠা লম্বা কোনো বিল পাশ করা একেবারেই উচিত না, যারা এই বিল পাশ করে, তারা নিজেরাও এটা ভালো করে পড়ে দেখে না! আমাদের কারোরই এত কিছু পড়ার সময় নেই। নিজেদের জীবনযাপন, বাচ্চা-কাচ্চাকে স্কুল থেকে আনা, এরকম হাজারটা কাজ থাকে আমাদের। সেই কারণেই আমি ৩ পৃষ্ঠার থেকে বেশি কোনো বিল পাশ করবো না।
পরবর্তীতে অবশ্য যৌন হয়রানি বিষয়ক বিতর্কিত কিছু কারণে তাকে রিপাবলিক পার্টি থেকে অস্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল।