মেসন জার। আমাদের এদিকে খুব একটা সুপরিচিত না হলেও পাশ্চাত্যের হেঁশেলে প্রায় অত্যাবশ্যকীয় এক উপাদান। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই সত্য যে, বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত মেসন জার শুরু থেকেই পাকঘরের অত্যাবশ্যকীয় কিছু ছিল না। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উদ্দেশ্য (প্রাথমিকভাবে কৃষিকাজ) ব্যবহৃত হওয়া থেকে কী করে রন্ধনশিল্পের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে গেল মেসন জার, তা নিয়েই আজকের আয়োজন।
যেকোনো খাবার জিনিস প্রস্তুত হওয়া মাত্রই নষ্ট হওয়া শুরু করে। অর্থাৎ, এর পুষ্টিগুণ ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। খাবার প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পন্থার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। লবণ দেওয়া, আচার বানানো, শুকিয়ে রাখা, ফ্রিজে সংরক্ষণ ইত্যাদির মতো ক্যানে খাবার সংরক্ষণ করার মূল উদ্দেশ্য একই- খাবারের পুষ্টিগুণকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা। গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে সাধারণত দু’টি কৌশল অবলম্বন করা হয়- ওয়াটার বাথ এবং উচ্চ চাপ। ফল, আচার, জ্যাম ইত্যাদি অত্যধিক অম্লীয় খাবারের জন্য ওয়াটার বাথ পদ্ধতিটি অনুসরণ করা হয়। অন্যদিকে শাকসবজি, মাংস, দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে উচ্চ চাপ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যেখানে খাবারটিকে ২৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা হয়।
খাবার সংরক্ষণের এ প্রক্রিয়ার সাথে মেসন জার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৮৫৮ সালে মেসন জার আবিষ্কার করেন জন ল্যান্ডিস মেসন। বংশানুক্রমিকভাবে তিনি নিউ জার্সির অধিবাসী। হিট বেজড ক্যানিং, অর্থাৎ উচ্চ তাপমাত্রায় খাদ্যদ্রব্যকে উত্তপ্ত করে ক্যানে সংরক্ষণ করার পদ্ধতিটি ১৮০৬ সালের দিকে সর্বপ্রথম চালু হয় এবং ব্যাপক হারে জনপ্রিয় হয় নিকোলাস অ্যাপার্টের বদৌলতে। ফরাসি রন্ধনশিল্পী নিকোলাস মূলত দীর্ঘদিন যাবত খাবার সংরক্ষণের উপায় খুঁজছিলেন। তার এ কাজে অনুপ্রেরণা দান করে নেপোলিয়নের বিভিন্ন যুদ্ধ। ‘পিকলড, পটেড অ্যান্ড ক্যানড’ বইয়ে লেখিকা সিউ শেফার্ড ব্যাখ্যা করেছেন, নিকোলাসের সমস্যা ছিল, তিনি তার পাত্রগুলোকে বায়ুরোধী করতে পারছিলেন না। নিকোলাস অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্যাম্পেনের বোতল ব্যবহার করতেন, যেগুলো তিনি আটকে দিতেন পনির এবং লাইমের মিশ্রণ (সন্দেহাতীতভাবে একটি উদ্ভট পন্থা) দিয়ে।
শ্যাম্পেনের বোতল আটকে দিতে মিশ্রণটি খুব একটা কাজে দিচ্ছিল না বিধায় তিনি শ্যাম্পেনের বোতলের পরিবর্তে গ্লাস (প্রশস্ত গলাবিশিষ্ট) ব্যবহার করা শুরু করলেন। ১৮০৩ সাল নাগাদ তার সিলকৃত ক্যানগুলো সফলভাবে ফরাসি নৌবাহিনীতে বিতরণ করা হতে থাকে। তিনি এবারের জারের নকশায় রিবড নেক (জারের গলার দিকে কিছুটা বাঁক) এবং স্ক্রু সম্বলিত ছিপি জুড়ে দিলেন। এতে করে জারগুলো আগের চেয়ে আরও বেশি বায়ুরোধী হয়ে উঠল। এ নকশা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে জন মেসন অধুনা মেসন জারের প্রচলন শুরু করেন। তবে তিনি সবচেয়ে চমকপ্রদ কাজটি করেছিলেন জারে স্বচ্ছ কাঁচ ব্যবহার করে। স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে জারের মাঝে থাকা খাদ্যদ্রব্য দেখতে এতটাই আকর্ষণীয় লাগত যে মেসন জার ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
‘স্টিয়ার ইট আপ: হোম ইকোনমিক্স ইন অ্যামেরিকান কালচার’ বইয়ে মেগান জে ইলিয়াস বলেন,
যুক্তরাষ্ট্রের রন্ধনশিল্পের ইতিহাসে মেসন জার এক অনন্য সংযোজন। ম্যাংগানিজ ব্লিচিংয়ের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাতকৃত কাঁচ থেকে মেসন জার তৈরি হয়। একজন রাঁধুনি বা ক্রেতা জার হাতে নিয়েই দেখতে পাচ্ছেন, এতে কী আছে এবং ভেতরে কী চলছে; বিষয়টি এক অসাধারণ তৃপ্তি এনে দেয়।
১৮৫৮ সালে ২৬ বছর বয়সী জন মেসন তার আবিষ্কারের প্যাটেন্ট করালেন। পরবর্তীকালে উন্নত মানের কাঁচ দিয়ে তৈরি হলেও একদম শুরুর দিকে এই জারগুলো তৈরি করা হতো অ্যাকুয়া কাঁচ থেকে, যাকে তখনকার সময়ে ক্রলিটাউন গ্লাস বলা হতো। গবেষকদের অনেকেই বলে থাকেন যে, নিউ জার্সির ক্রলিটাউন গ্রামে উৎপন্ন হতো বলেই গ্লাসের এ নাম প্রচলিত ছিল। আবিষ্কারক হলেও মেসন একটি মারাত্মক খামখেয়ালী করে ফেলেছিলেন তার পরবর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তন বা সংযোজনের বিষয়গুলো প্যাটেন্ট না করে। মেসন জারের কাঁচের অংশের উপর ধাতব ঢাকনা ব্যবহার হয়। এর সাথে রাবারের একটি সুরক্ষা বলয় জন মেসন কিছুকাল পরে যুক্ত করেন।
এই বিষয়টির প্যাটেন্ট না করানোতে তাকে প্রায় সকল পরিশ্রম জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল। ততদিনে মেসন জার বেশ অনেক জায়গাতেই প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে। নিজের কাজের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে জন মেসন যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন, তবে সফল হতে পারেননি শেষ অবধি। বেশ কিছু মামলা মোকদ্দমা লড়ে, কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যর্থ অংশীদারিত্ব করে শেষমেশ তিনি বাজার থেকে ছিটকে যান চিরতরে। টাকার পাহাড় যিনি গড়তে পারতেন নিজের উদ্ভাবন থেকে, সেই মানুষ ১৯০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন সম্পূর্ণ কপর্দকহীন হয়ে।
এরপর মেসন জার মেসনকে ছাড়াই তার নিজের অপ্রতিরোধ্য যাত্রা শুরু করে। ব্যক্তির কাজ সারা বিশ্ব জুড়ে ব্যপকভাবে সমাদৃত হলেও ব্যক্তি হারিয়ে গেলেন মহাকালের গহ্বরে; অনেকটা রবিঠাকুরের সোনার তরী কবিতার মতো যেন।
১৮৮০ সাল। জন ল্যান্ডিস মেসনের প্যাটেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক এক বছর পর। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ ঘটল বল ব্রাদার্সের। ফ্র্যাংক, এডমান্ড, জর্জ, লুশিয়াস এবং উইলিয়াম- এই পাঁচ ভাই তাদের এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ২০০ ডলার ধার করে নিউ ইয়র্কের উডেন জ্যাকেট ক্যান কোম্পানি অভ বাফেলো কিনে নেন। বল ব্রাদার্স শুরুর দিকে কাঠ দ্বারা আবৃত টিনের কন্টেইনার উৎপাদন করত। শীঘ্রই তারা কাঁচের জার তৈরির দিকে মনোনিবেশ করে। কিছুদিনের মধ্যেই তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন বল ব্রাদার্স ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানী। চমৎকার, সাহসী এবং বাস্তববাদী পদক্ষেপ হিসেবে এবারে তারা ইন্ডিয়ানায় নিজেদের শাখা চালু করলেন। কারণ কী? ইন্ডিয়ানায় তখন প্রাকৃতিক গ্যাস প্রতিষ্ঠানগুলো গ্লাসব্লোয়িংয়ের জন্য প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি সরবরাহ করছিল আর এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই প্রচুর মুনাফার মুখ দেখে পাঁচ ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান। এভাবে করেই সে সময় তারা যুক্তরাষ্ট্রে মেসন জারের সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মেসন জারের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে চিরকাল। মেসন জারের ক্রমবর্ধমান উৎপাদনকে আরও উসকে দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র সরকার যোদ্ধাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা চালু করল, যাতে নির্দিষ্ট কিছু খাবার এবং সেগুলো সংরক্ষণের জন্য টিনের ক্যান বরাদ্দ ছিল। এর পাশাপাশি সরকার দেশের সকল জনগণকে ভিক্টোরি গার্ডেন করার পরামর্শ দিল। এ পদক্ষেপের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মাঝে ব্যপকহারে নিজেদের ঘরের পাশে ক্ষুদ্র বা মাঝারি পরিসরে বাগান করার চর্চা শুরু হল এবং উৎপাদিত সকল ফল, শাক সবজি তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করত ভবিষ্যতের জন্য।
এই একই উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশের সকল পাবলিক পার্কগুলোও বাগানে পরিণত হলো। স্বাভাবিকভাবেই এত বিপুল পরিমাণ খাদ্য সংরক্ষণের জন্য পাত্রও তো চাই। সমাধান কী হতে পারে? মেসন জার! ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৯ এই এক দশকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই তিন মিলিয়ন মেসন জার বিক্রি হয়। তবে যুদ্ধোত্তর সময়ে মেসন জারের এই তুমুল জনপ্রিয়তা বহুলাংশেই হ্রাস পায়, যেহেতু ততদিনে মানুষ ফ্রিজ ব্যবহারের সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে।
কাঁচের পাত্রের দুনিয়ায় একটি কথা প্রায়ই ব্যবহার হয়ে থাকে। মেসন জার আর গ্লাস জার শিল্প একই। অর্থাৎ, গ্লাস জার নিয়ে অদ্যাবধি যত কাজ হয়েছে, তাতে সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে মেসন জারের হাত ধরেই।