বিখ্যাত ব্রুকলিন ব্রিজ নির্মাণের পেছনের কাহিনী

আমেরিকায় গিয়ে যদি কখনও নিউ ইয়র্কে যাওয়ার সৌভাগ্য না হয়, তাহলে বলতেই হবে যে আপনার আমেরিকাভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর খুব কম শহরই নিউ ইয়র্কের মতো এতটা বৈচিত্র্যময়। নিউ ইয়র্ক সম্পর্কে বলা হয়, “এই শহটি কখনও ঘুমায় না।” শহরের মানুষের জন্য মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে যেসব যানবাহন দেয়া হয়েছে, সেগুলো শহরের বিখ্যাত চওড়া রাস্তাগুলোতে চব্বিশ ঘন্টাই চলতে থাকে। নিউ ইয়র্ক শহরে যত বেশি সংস্কৃতির মানুষের দেখা পাওয়া যায়, পৃথিবীর কোথাও এমনটা পাওয়া যায় না। পুরো বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় অসংখ্য কর্পোরেট কোম্পানির সদর দপ্তর এই শহরে অবস্থিত। আমেরিকায় প্রচলিত আছে, যদি আপনার কোনো বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা থাকে, তবে নিউ ইয়র্ক আপনাকে খুঁজে বের করে নেবে! এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খাবারের সহজলভ্যতার জন্যও এই শহরের খ্যাতি রয়েছে। আকাশছোঁয়া অসংখ্য ভবন ও উচ্চমাত্রার প্রযুক্তির যান্ত্রিকতার মধ্যেও এখানকার মানুষ অনেক বেশি সৃজনশীল। সেই সাথে ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত ঘটনার সাক্ষী এই শহর।

মআকগকনলব
বলা হয়ে থাকে, ‘নিউ ইয়র্ক কখনও ঘুমায় না’; image source: travelandleisure.com

তবে নিউ ইয়র্ক আরেকটি কারণে পৃথিবীর মধ্যে অনন্য স্থান দখল করে আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত শহরগুলোর একটি হয়ে থাকা এই শহরকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন বাইরে থেকে আসা মানুষরাই। শুধু এই শহরই নয়, আসলে আধুনিক আমেরিকা বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বাইরে থেকে আসা মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারণে। আমেরিকায় শিল্পবিপ্লব হওয়ার পর নিউ ইয়র্কে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশের মানুষ অভিবাসী হিসেবে উন্নত জীবিকা, স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আশায় শহরটিতে পাড়ি জমানো শুরু করেন। ১৭৯০ সালে শহরটিতে অধিবাসীর সংখ্যা ছিল মোটে ৪৯ হাজার, সেখানে ১৮৭০ সালে এখানেই মোট অধিবাসীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৭৮ হাজারে। জনসংখ্যার এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণ বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসীদের আগমন। একসময় এই অভিবাসীরাই আমেরিকার নাগরিক হয়ে যান এবং নিউ ইয়র্ক মূলত বিখ্যাত হয়ে ওঠে তাদের দ্বারাই। এখনও নিউ ইয়র্কে যারা বসবাস করেন, তাদের বেশিরভাগেরই পূর্বপুরুষ বাইরের দেশ থেকে এসেছিলেন।

বাইরে থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষের আগমনের ফলে স্বাভাবিকভাবে শহরটিতে বাড়তি চাপ পড়ে। তখনকার সময়ে পরিবহনব্যবস্থা আজকের মতো এত উন্নত ছিল না। যদি কখনও নিউ ইয়র্কে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়, তাহলে দেখতে পাবেন হাডসন ও ইস্ট নদীর উপর দিয়ে অসংখ্য সেতু রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে অনায়াসে নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এই সেতুগুলো কিন্তু আগে থেকে ছিল না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে, পরিবহনব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, চওড়া নদীর উপর দিয়ে টেকসই সেতু বানানোর প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে, এরপর নিউ ইয়র্কের নদীগুলোর উপর দিয়ে সেতু তৈরি হয়েছে। টেকসই সেতু নির্মাণের আগে নদীর এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে যাওয়ার মূল উপায় ছিল ফেরি। কিন্তু এর মাধ্যমে খুব দ্রুত যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। ফেরিগুলো মানুষ ও যানবাহন দ্বারা পূ্র্ণ হওয়ার আগপর্যন্ত অপেক্ষায় থাকত। এরপর ধীরে ধীরে এক পাড় থেকে থেকে অন্য পাড়ে যেত। অনেক সময় অস্বাভাবিক স্রোতে ফেরিগুলো দুর্ঘটনারও শিকার হতো। স্বাভাবিকভাবেই ১৮৭০ সালের দিকে হাডসন ও ইস্ট নদীর উপর দিয়ে টেকসই ব্রিজ বানানোর প্রয়োজন দেখা দেয়।

জতলহলন
পুরো নিউ ইয়র্ক শহরে অসংখ্য ব্রিজ রয়েছে; image source: rachelsruminations.com

নিউ ইয়র্কের অনেক অধিবাসীর মতোই রোবলিং পরিবার জার্মানি থেকে পাড়ি জমায় শহরটিতে। রোবলিং পরিবারের বড় ছেলে জোনাথন অগাস্টাস রোবলিং একসময় নিজেকে নিউ ইয়র্কের স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে চমৎকার সব সেতু ও স্থাপত্য নির্মাণের মাধ্যমে তিনি প্রতিভার পরিচয় দেন। এরই মধ্যে আবার শুরু হয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধ। সেসময় জোনাথন ভেবেছিলেন, নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন ও ম্যানহাটন এলাকা দুটো যুক্ত করতে হবে। কিন্তু স্রোতস্বিনী ইস্ট নদীর উপর টেকসই সেতু নির্মাণ মোটেও সহজ কাজ ছিল না। আবার, শুধুমাত্র ফেরি পারাপারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ যে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছিল, এটি তার পক্ষে মেনে নেয়া কষ্টকর ছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নেন- নিউ ইয়র্কের মানুষের জন্য তিনি কিছু করবেন। শেষপর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার জোনাথন রোবলিং ম্যানহাটন এবং ব্রুকলিনকে এক করার উদ্দেশ্যে একটি টেকসই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

জোনাথন রোবলিং এই পরিকল্পনা নিয়ে তৎকালীন আমেরিকার অন্য ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে আলোচনা করেন। কিন্তু প্রায় সবাই এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিতে বলে। তাদের ধারণা ছিল, রোবলিং সেতুর যে অভূতপূর্ব মডেল হাজির করেছিলেন, সেটি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা শূন্য। বলে রাখা ভাল, জোনাথন রোবলিং ইস্ট নদীর উপর যে ব্রিজ নির্মাণের মডেল তৈরি করেছিলেন, সেই মডেল অনুযায়ী এর আগে পৃথিবীতে কোনো ব্রিজ নির্মাণ করা হয়নি। রোবলিংকে অনেকে এটাও বলেছিলেন, “তোমার পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিজ নির্মাণ করার কাজ যখন মাঝপথে থাকবে, তখন এটা ইস্ট নদীতে ভেঙে পড়বে।” চারদিক থেকে তীব্র সমালোচনার পরও রোবলিং মোটেও দমে যাননি। তিনি জানতেন, তিনি যে মডেল তৈরি করেছেন, সেটি পৃথিবীতে আগে কেউ দেখেনি। এজন্য তারা সমালোচনা করছে। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে স্বীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সফল হবেন এবং ইস্ট নদীর দুই পাড়ের মানুষের কষ্ট লাঘব হবে।

িতকগকন
জন রোবলিং, ব্রুকলিন ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা প্রথম যার মাথায় এসেছিল; image source: thoughtco.com

১৮৭০ সালের দিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়। ইঞ্জিনিয়ার রোবলিং যে সেতু নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, সেটি ছিল সাসপেনশন ব্রিজ। পুরো সেতু ধরে রাখার জন্য দুটো বড় আকৃতির পিলার নির্মাণের কাজ ছিল সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি পিলারগুলো সঠিকভাবে নদীর বুকে গেঁথে দেয়া না হতো এবং পাশাপাশি শত শত টন ভার বইবার ক্ষমতা না থাকত, তাহলে সেগুলো নদীতে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা ছিল। এছাড়া, নদীতে নেমে পিলারগুলোর ভিত্তি স্থাপনের জন্য যথাযথ খননকাজ পরিচালনা করাও অনেক কঠিন ছিল। কারণ, পানির নিচে প্রচুর চাপ সহ্য করে কাজ করতে হয় এবং যারা পানির নিচে কাজ করেন তাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। জোনাথন রোবলিং সেতু নির্মাণের জন্য যে পুরু ধাতুর তার দরকার হয়, সেগুলো তৈরির ক্ষেত্রে তামা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সাধারণত তখনকার সময়ে সেতু নির্মাণ করতে লোহা ব্যবহার করা হতো। এবং ইঞ্জিনিয়ার রোবলিংয়ের ভয় ছিল যদি ব্রুকলিন সেতু নির্মাণে লোহা ব্যবহার করা হয়, তাহলে মরিচার কারণে একসময় সেতুটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে জোনাথন রোবলিং তার পরিকল্পিত সেতু উদ্বোধনের আগেই মারা যান। ব্রিজের প্রধান দুটি পিলারের জায়গা নির্বাচনের জন্য যখন ইস্ট নদীর তীরে কাজ করছিলেন রোবলিং, তখন দুর্ঘটনাবশত এ কটি ফেরি এসে তাকে আঘাত করে এবং তিনি পায়ে প্রচন্ড আঘাত পান। আঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য তড়িঘড়ি শুরু হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ‘ওয়াটার থেরাপি’ নেয়ার প্রস্তাব দেন। এই চিকিৎসাপদ্ধতিতে ক্ষতস্থানে ক্রমাগত পরিষ্কার ও ঠান্ডা পানি ঢালা হয়। জোনাথন রোবলিং এই পদ্ধতিতে আর সুস্থতা হননি এবং তিন সপ্তাহ পর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার ছেলে, যিনি নিজেও ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার, নাম ওয়াশিংটন অগাস্টাস রোবলিং, ব্রুকলিন ব্রিজ নির্মাণের প্রধান ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ব্রিজ নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই তিনি পঙ্গুত্ব বরণ করেন।

বাবার মৃত্যুর পর ছেলে ওয়াশিংটন রোবলিং সেতু নির্মাণশ্রমিকদের প্রতিটি কাজ সূক্ষ্মভাবে তদারকি করতেন। এজন্য তাকে প্রায়ই টিউবের মাধ্যমে পানির নিচে যেতে হতো। মূলত, পানির নিচে কাজ করার জন্যই তার শরীরের একপাশ অবশ হয়ে গিয়েছিল, এবং তিনি পঙ্গুত্ব বরণ করেন। অবশ্য সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করার জন্য তার স্ত্রী তাকে সহায়তা করেন। এমিলি ওয়ারেন রোবলিং তার স্বামীর পঙ্গুত্ব বরণের পর নিজে সেতুর সাথে জড়িত বিষয়গুলো বোঝার জন্য ব্যাপক পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই সেতুটির অবশিষ্ট নির্মাণকাজ সমাপ্তির প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে ১৮৮৩ সালে প্রায় ১৪ বছর নির্মাণকাজ চালানোর পর সেতুটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। শুরুতে অনেক মানুষের ভয় ছিল, হয়তো সেতুটি দুর্বল এবং খুব বেশি ভর দিলে হয়তো একসময় এটি ভেঙে পড়বে। সেতুর সক্ষমতা প্রমাণের জন্য প্রায় বিশটি হাতিকে একসাথে সেতুটির ওপর উঠানো হয়। তারপর দেখা যায়- সেতুটির অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তখন সাধারণ মানুষের ধারণা পরিবর্তন হয়।

জগকবকবকব্
ব্রুকলিন ব্রিজের কাজ চলছে; image source: thoughtco.com

বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় এক লক্ষ গাড়ি, ত্রিশ হাজার সাইকেল এই সেতুর উপর দিয়ে যাতায়াত করে। প্রতিদিন প্রায় দশ হাজার পথচারী এই সেতু ব্যবহার করেন। শুরুতেই বলা হয়েছে, যারা নিউ ইয়র্ক ভ্রমণে যান, তারা একবার হলেও ব্রিজটি দেখতে আসেন। সেতুর নির্মাণকাজে ইঞ্জিনিয়ার ওয়াশিংটন রোবলিংয়ের স্ত্রী এমিলি ওয়ারেন রোবলিংয়ের সংযুক্তি নির্মাণকে অনন্য মাত্রা দান করেছে। সেই সময় পুরো সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছিল ১ কোটি ৫৫ লক্ষ ডলার, আজকের দিনের হিসাবে সেটি দাঁড়াত প্রায় ৪১ কোটি ৬৬ লক্ষ ডলারে। এছাড়া নির্মাণকাজ চলাকালে ২৫ জন শ্রমিক নদীতে ডুবে মারাও যান। শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ে নিউ ইয়র্কে।

Related Articles

Exit mobile version