রাহাব তাদের দুজনকে দ্রুত নিয়ে গেল ছাদে, এরপর তাদেরকে শুয়ে পড়তে বলল। কিছু ভেজা পাতা আর ডাঁটা শুকোতে দিয়েছিল সে, সেগুলো দিয়ে তাদের ঢেকে দিল, যেন দেখে বোঝাই না যায় যে এর নিচে কিছু আছে।
দৌড়ে দরজা খুলল সে। সৈন্যরা বলল, “তোমার ঘরে যারা ঢুকেছে তাদের বের করে আনো এখুনি।”
রাহাব বলল, “জ্বি, লোকগুলো এখানে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু কোথা থেকে এসেছে তা তো জানি না। সন্ধ্যাবেলায় শহরের দরজা বন্ধ করার আগেই তারা চলে গেছে। কোন পথ দিয়ে গেছে তা বলতে পারি না। আপনারা এখনই পেছন পেছন গেলে হয়তো তাদের ধরতে পারবেন।”
সৈন্যগুলো বিশ্বাস করলো রাহাবের কথায়। তারা তখনই ছুটে গেল গুপ্তচরদের ধরতে। কিন্তু ধরতে না পেরে পাহারা বসালো শহরের বাহিরেও।
সেদিন রাত্রে ঘুমাবার সময় ঘনিয়ে এলে ওপর তলার ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে দড়ি দিয়ে তাদের দুজনকে নিচে নামিয়ে দিল রাহাব, যেন সামনের দরজা দিয়ে কারও বের হওয়া চোখে না পড়ে।
তারা দুজন সেখান থেকে ছদ্মবেশে পাহাড়ে চলে গেল। তিন দিন সেখানে থাকল তারা। যারা তাদের ধরতে বেরিয়েছিল তারা তাদের খুঁজে না পেয়ে ফেরত এলো তিন দিন বাদে। এরপরেই গুপ্তচর দুজন ফিরে গেল। ক্যাম্পে ফিরে অপেক্ষমান ইউশা (আ)-কে সব কিছু খুলে বলল।
পরদিন ভোরবেলা ইউশা (আ) উঠে পুরো কাফেলাকে জাগালেন। এরপর রওনা দিলেন জর্দান নদীর দিকে। জেরিকো পৌঁছাতে হলে সবাইকে আগে পার হতে হবে এই নদী।
কাফেলার সামনে পবিত্র সিন্দুক আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট বহন করে এগিয়ে যেতে লাগল ইমামেরা। নদীর তীরে পৌঁছানোর পর ইউশা (আ) বললেন, “এখন আমি তোমাদের এমন কিছু করতে বলব যা মাবুদ আল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন তোমাদেরকে করতে বলতে। তোমাদের বারোটি গোত্র থেকে একজন করে বাছাই কর, এবং সেই ১২ জন এগিয়ে আসো। এরপর ইমামদের সাথে সিন্দুকটা বহন কর এবং পানিতে গিয়ে দাঁড়াও।”
বিশাল জর্ডান নদী এই ফসল কাটবার সময় পানিতে টুইটুম্বুর। স্রোতের তোড়ে সব ভেসে যাচ্ছে। এ নদী পার হওয়া অসম্ভব।
সিন্দুক নিয়ে তারা তীরের পানিতে পা রাখা মাত্রই যা ঘটল তা অকল্পনীয় ছিল। ভাটার দিক থেকে বয়ে আসা পানির স্রোত থমকে গেল। এরপর পানি সরে যেতে লাগল, সরতে সরতে ‘সর্তন’ নামের শহরের কাছাকাছি ‘আদম’ নামের গ্রামের সামনে পর্যন্ত গিয়ে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে গেল। মরু-সাগরের দিকে বয়ে যাওয়া পানি পুরোই বন্ধ হয়ে গেল।
ইসরাইল জাতি নদী পার হওয়া শুরু করল, নদী তো না, শুকনো মাটি তখন। সবাই পার না হওয়া পর্যন্ত ইমামেরা সেখানেই আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
ইউশা (আ) সেই ১২ জনকে ডেকে বললেন, “তোমরা ঐ সিন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা থেকে ১২টি পাথর নাও, এরপর আজ যেখানে ঘুমোবে, সেই জায়গায় পাথরগুলো স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিবে, যেন বহু বছর পরেও মানুষ মনে রাখে আজকের এই অলৌকিক ঘটনা।”
সবাই নদী পার হয়ে গেলে, সিন্দুক সহ উঠে আসলেন ইমামেরা ওপারে। আর সাথে সাথে পানি নেমে এসে আগের মতো হয়ে গেল। সাগরের দিকে বয়ে চলল।
রাত্রে ঘুমাবার সময় পাথরগুলো সেখানে রেখে দিল তারা। সেটা ছিল জেরিকোর পুব সীমানায় ‘গিলগল’ নামের এক জায়গা।
সেখানে ঈদ উদযাপন করল ইসরাইল। উদ্ধার-ঈদ বা পাসোভার (Passover)। সে দেশের খাবার প্রথমবারের মতো খেলো তারা। আর তার পরদিন থেকে আসমানি খাবার ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’ আসা বন্ধ হয়ে গেল তাদের জন্য, আর কোনোদিন আসেনি!
জেরিকো নগরীর একদম ঠিক কাছে পৌঁছে গেল তারা। একদম সামনে ছিলেন ইউশা (আ)। হঠাৎ তিনি দেখলেন সামনে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে খোলা তলোয়ার। ইউশা তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কার পক্ষের লোক, আমাদের নাকি শত্রুপক্ষের?”
“আমি কারো পক্ষেরই নই, আমি মাবুদের সৈন্যদলের সেনাপতি।”
এ কথা শুনে ইউশা সাথে সাথে মাটিতে উবু হয়ে পড়ে তাকে সম্মান করলেন। (মাবুদের সেনাপতি বলতে ফেরেশতা মাইকেল বা মিকাইল (আ)-কে বোঝানো হয়]
ইউশা বললেন, “আমার প্রভু কি তার গোলামকে কিছু বলতে চান?”
“তোমার পায়ের জুতো খুলে ফেলো, কারণ ঠিক যে জায়গাটাতে তুমি দাঁড়িয়ে আছো সেটা খুব পবিত্র।”
ইউশা (আ) তা-ই করলেন, এবং মাথা তুলে তাকাতেই দেখলেন সামনে কেউ নেই।
যা-ই হোক, বিনা জাহাজ বা নৌকায় পুরো ইজরায়েল জাতির জর্ডান নদী পেরিয়ে আসবার কাহিনী ছড়িয়ে পড়ায় আশপাশে সবাই ভীত হয়ে পড়ে। জেরিকো নগরীর সকল দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কেউ ঢুকবেও না, বেরোবেও না।
তখন মাবুদ আল্লাহ ইউশা (আ)-কে কিছু আদেশ দিলেন, যা যা বলবেন তাই তাই যেন লোকদের দিয়ে করানো হয়। (ইউশা, ৬:১-২৭)
ইউশা (আ) ইমামদের ডেকে বললেন, “আপনারা সিন্দুকটা তুলে নিন কাঁধে, আর সাতজন ইমাম সাতটি শিঙ্গা নিয়ে সিন্দুকের আগে আগে যান। এরপর পুরো শহরকে একবার প্রদক্ষিণ করুন।” এরপর তিনি সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, “তোমরা সিন্দুকের আগে আগে যেতে থাকো। তবে সাবধান, কেউ কোনো শব্দ করবে না, কোনো চিৎকার করবে না। আমি না বলা পর্যন্ত।”
তাই করল তারা, সিন্দুকের সামনে পেছনে সেনাদল। পুরো শহর ঘুরে আসল তারা। রাত হয়ে গেছে ততক্ষণে। এরপর সকলে ঘুমাতে গেল।
পরেরদিন একই কাজ করালেন ইউশা। আরেকবার ঘুরে এলো পুরো শহর বাইরে থেকে।
তার পরের দিনও একই কাহিনী। এভাবে চলল ছয়দিন।
সপ্তম দিন। ভোর হতেই ঘোরা শুরু করল। তবে এবার একবার নয়, দ্রুত পায়ে সাতবার ঘুরল। সপ্তমবার ঘুরবার সময় ইমামেরা শিঙ্গাতে জোরে ফুঁ দিল।
ইউশা (আ) নির্দেশ করলেন, “শিঙ্গার আওয়াজের সাথে সাথে তোমরা সবাই জোরে চিৎকার কর!”
সবাই জোরে চিৎকার করে উঠল। কান ফাটানো চিৎকার। আর সবাই এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবারো বিস্মিত হলো। দেখল, জেরিকো নগরীর দুর্ভেদ্য প্রাচীর, সেই দেয়াল পুরোটা ধ্বসে মাটিতে পড়ে গিয়েছে!
এরপর ইসরাইলি সেনাবাহিনী ঢুকে পড়লো জেরিকো শহরে। আর সেই গুপ্তচর দুজন আগে আগে গিয়ে রাহাবকে তার পরিবারসহ বের করে আনলো। রাহাব এরপর থেকে ইসরাইলের সাথেই বসবাস করতে লাগল। বিয়ে করেছিল ‘সালমন’ নামের এক ইসরাইলিকে। তারই বংশধারায় জন্ম নেন যীশু খ্রিস্ট বা হযরত ঈসা (আ)।
জেরিকো নগরী ধ্বংসের পর তাদের মনোবল আরো বেড়ে গেল, এরপর তারা আরেকটি বড় নগরী ‘অয়’ দখল করে নিল। এখানে উল্লেখ করা যায়, প্রাচীন জেরিকো নগরীর ধ্বংসাবশেষ এখন যে জায়গায় সেটা “তেলেস-সুলতান” নামে পরিচিত। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা মতে, জেরিকোর দেয়ালের উচ্চতা প্রায় ১৭ ফুট, পুরুত্ব ছিল সাড়ে ৬ ফুট। প্রায় ১০ হাজার বছর আগে এ দেয়াল প্রথম বানানো হয়, ধ্বংস হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত টিকে ছিল। জেরিকোকে বলা হয় প্রাচীনতম শহর। শহরের চারপাশে ২৭ ফুট চওড়া ৯ ফুট গভীর পরিখাও ছিল।
১৮৬৮ সালে চার্লস ওয়ারেন আবিষ্কার করেন, এ এলাকাটিই জেরিকো ছিল। আর ১৯৩০-১৯৩৬ সালে আবিষ্কৃত হয় ধ্বসে যাওয়া দেয়াল, ধ্বসে যাবার তারিখ নির্ধারণ করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ সাল, যেটা ইউশার (আ) জেরিকো অভিযানের বাইবেলের তারিখের সাথে মিলে যায়। তবে ঠিক কী কারণে এরকম শক্তিশালী দেয়াল ধ্বসে পড়ে তা প্রত্নতত্ত্ব গবেষণায় বের করা যায়নি।
আর “অয়” শহরের ধ্বংসাবশেষের বর্তমান নাম “এত-তেল”। এটাও জনপ্রিয় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার এলাকা।
জেরিকো আর অয়-এর দশা দেখবার পর আশাপাশের রাজারা ভয় পেয়ে গেল খুবই। হিট্টিয়, আমোরিয়, কেনানীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় এবং যিবূষীয়দের বাদশাহরা একজোট হয়ে গেল ইসরাইলের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে হিব্বীয় বলা হত গিবিয়োন শহরের বাসিন্দাদের।
তারা একটা ফন্দি করল। একদল লোক নিয়ে তারা রওনা হল। তারা কিছু পুরনো তালি দেয়া ফাটা আঙুর রস রাখবার থলে আর কিছু রুটির টুকরো নিয়ে গেল।
জায়গামতো পৌঁছে তারা ইউশা (আ)-কে বলল, “আমরা অনেক দূর দেশ থেকে এসেছি। আমরা চাই আপনাদের সাথে সন্ধি করতে।”
ইউশা (আ) বললেন, “কিন্তু মনে হচ্ছে আপনারা আশপাশেরই লোক। তাহলে কীভাবে সন্ধি করব? আপনারা কারা? কোথা থেকে এসেছেন?”
“আমরা আপনার গোলাম, আপনাদের সুনাম শুনে অনেক দূরদেশ থেকে এসেছি। দেখুন বের হবার সময় যে রুটি আর আঙুর রসের থলে নিয়ে বেরিয়েছিলাম, সেগুলোর এখন কী করুণ দশা, এতটা সময় পেরিয়ে গেছে এখানে পৌঁছুতে! আমাদের জুতো আর কাপড়ও পুরনো হয়ে গেছে!”
বনী-ইস্রাইলিরা তাদের কথা মেনে নিল। আর্ক অফ কোভেন্যান্টের কাছে গিয়ে মাবুদ আল্লাহর কাছে কিছু জানার চিন্তাও আসলো না মাথায়। তারা আল্লাহর নামে কসম করে বললেন, বনী ইসরাইল তাদের কোনদিন আক্রমণ করবে না। এরপর তারা চলে গেলো।
তিন দিন পর ইউশা জানতে পারলেন, তারা আসলে তাদেরই পাশের রাজ্যের। তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের শায়েস্তা করতে রওনা হলেন। সেখানে পৌঁছে তাদের কাছে কৈফিয়ত চাইলেন, তারা বলল তারা ভয়ে এ কাজ করেছে যেন তারা ইসরায়েলের হাতে মারা না পড়ে। তার উপর, এখন তো ইসরায়েল জাতি তাদের প্রভুর নামে কসম করে ফেলেছে, আর তো মারতে পারবে না।
ইউশা (আ) ফিরে গেলেন, কারণ এই কসম ভাঙা যাবে না। তিনি তাদের সাথে কোনো শত্রুতা করলেন না।
এই ছলচাতুরি করা গিবিয়োন শহরটা ছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া “অয়” শহরের মতোই বড়। জেরিকো নগরীর ধ্বংস আর গিবিয়োনবাসীদের সন্ধির খবর যখন পৌঁছাল, তখন জেরুজালেমের বাদশাহ অদোনীসিদ্দিক প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি আর পাঁচ রাজ্যের রাজাদের সাথে নিয়ে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে গিবিয়োন আক্রমণ করলেন। ওদিকে গিবিয়োনবাসী ইউশার কাছে সাহায্য চাইলো, সন্ধিমাফিক তারা যে ইসরায়েলের মিত্র!
ইউশা (আ) ইসরায়েলের সেনাবাহিনী নিয়ে হাজির হলেন গিবিয়োনে। মাবুদ ওহী নাজিল করলেন, “তুমি তাদের ভয় করো না। তারা কেউ তোমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না।”
ইউশা (আ) অতর্কিতে আক্রমণ করলেন। ফলাফলস্বরূপ অনেকে মারা পড়ল, আর বেশিরভাগ পালিয়ে গেল। পালিয়ে যাওয়া সেনাবাহিনীর উপর হঠাৎ করে আকাশ থেকে প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি নামা শুরু হলো। সেই শিলাতে মারা পড়ল আরো বেশি। পালিয়ে যাওয়া শত্রু পাঁচ রাজাকেও খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়। ইসরাইলি বিশ্বাসে, সেদিন যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েল বাহিনী জয়লাভ না করে ততক্ষণ সূর্য ডোবেনি, আকাশে স্থির হয়ে ছিল প্রায় একদিন।
এরপর থেকে কেবল চলতে থাকে আশপাশের রাজ্য দখলের খেলা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ইসরাইলের সীমানা। আর ওদিকে অনেক বুড়ো হয়ে গেলেন ইউশা (আ)।
শেষ বিশাল একটা ভাষণ দেন তিনি, যার শেষ দিকে তিনি বললেন, “তোমরা যদি মাবুদকে ত্যাগ করে দেবদেবীর পূজা কর তবে তিনি তোমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, যদিও এতদিন তিনি তোমাদের মেহেরবানি করেছেন। তিনি তোমাদের উপর গজব দিয়ে শেষ করে দেবেন।”
– “আমরা মাবুদেরই উপাসনা করব।”
– “তোমরা সাক্ষী রইলে, যে, মাবুদকেই তোমরা উপাসনা করবার জন্য বেছে নিয়েছ।”
– “জ্বি, আমরা সাক্ষী রইলাম।”
ইউশা (আ) সমস্ত কিছু কিতাবে লিপিবদ্ধ করে গেলেন।
১১০ বছর বয়সে ইউশা ইবনে নুন (আ) মারা গেলেন। লোকেরা তাকে আফ্রাহিমের পাহাড়ি অঞ্চলে দাফন করল। কাছেই শিখিমে তারা দাফন করল মিসর থেকে পালিয়ে আসবার সময় নিয়ে আসা হযরত ইউসুফ (আ) এর কফিন।
ইউশা (আ) মারা যাবার পর এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হলো। পুরো ইসরাইলকে নেতৃত্ব দেবার মতো তেমন কেউ রইল না। তাই বলে এমন না যে, ইসরায়েল জাতির পতন শুরু হলো। তারা টিকে রইল বটে। কিন্তু এই নতুন দেশে এসে প্রায় সময়ই তারা তাদের ওয়াদার বরখেলাপ করে ঠিকই স্থানীয় দেবদেবীদের উপাসনা শুরু করে দিল। অদৃশ্য সর্বশক্তিমান উপাস্যের উপাসনা করা তারা বেশিদিন চালাতে পারত না, তাদের দরকার হতো সামনে থাকা কোনো উপাস্য।
পরের ৩২৫ বছর কোনো বড় নেতার আবির্ভাব হয়নি। এ সময় ইসরায়েলের ১২ গোত্রের আলাদা আলাদা করে শাসনকর্তা ছিলেন, এদেরকে শাসক বা কাজি (Judge) বলা হত। তারাই বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন। ফলে, ইসরায়েলের পরিসীমা বাড়তে থাকল।
নবী (Prophet) বলতে তৎকালীন ইসরাইলে তাদেরকেই বোঝানে হত যারা পূর্ববর্তী কিতাবের বিশ্বাসগুলো প্রচার করে যেতেন, কেউ ছোট নবী, কেউ বা বড় নবী। আর পারিভাষিকভাবে, রাসুল (Messenger) হলেন নবীদের উর্ধ্বে, কারণ তাদের উপর নতুন কিতাব আসতো, তাদের সংখ্যা কম। একজন মানুষ নবী কি না সেটা প্রমাণ হত তিনি ভবিষ্যৎবাণী করতে পারতেন কি না, এবং সেটা মিলত কি না তার উপর। কারণ, সেগুলো মাবুদের পক্ষ থেকে হত। Prophet নামটাই এসেছে Prophecy (ভবিষ্যৎবাণী) থেকে। মূল হিব্রু নাবী (נְבִי) মানে ‘ঈশ্বরের দূত’।
এ পর্যায়ে ইসরাইল জাতি খুব বেশি রকমের দেবদেবী পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে শাস্তিস্বরূপ, মাবুদ তাদেরকে চল্লিশ বছরের জন্য সেই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা তাদের শত্রু ফিলিস্তিন সাম্রাজ্যের অধীনস্ত করে দেন। হ্যাঁ, পবিত্র ভূমির আদি বাসিন্দা এই ফিলিস্তিনিরাই।
এরকম সময়, ইসরায়েলের ‘সরা’ গ্রামে মানোহ নামের এক লোক ছিলেন। তার স্ত্রী ছিলেন বন্ধ্যা।
একদিন হঠাৎ এক ফেরেশতা সেই স্ত্রীর কাছে এলেন আর বললেন, “তুমি বন্ধ্যা বলে এতদিন তোমার সন্তান হয়নি, কিন্ত তুমি গর্ভবতী হবে। তোমার একটি ছেলে হবে। সে ফিলিস্তিনিদের হাত থেকে ইসরাইলকে পরিত্রাণ করবে। তবে, সে যেন কখনো মদ স্পর্শও না করে, কোনদিন মাথার চুল না কাটে।”
এই অদ্ভুত শর্তগুলো তখন প্রচলিত ছিল ইসরায়েলে। যারা এটা মেনে চলত তাদের নাজরীয় (נזיר) বলা হত। (ওল্ড টেস্টামেন্ট, জাজেস ১৩-১৬)
ফেরেশতা চলে গেলে স্ত্রী ছুটে গিয়ে স্বামীকে জানালো যে, একজন লোক এসে তাকে এসব বলেছে। স্বামী তখন মাবুদের দরবারে ধন্যবাদ জানালো। পরে একদিন আবারো সেই ফেরেশতা এলে স্ত্রী ছুটে গিয়ে স্বামীকে ক্ষেত থেকে নিয়ে এল। স্বামী মানোয়া জিজ্ঞেস করল, “আপনিই সেই লোক যার সাথে আমার স্ত্রী কথা বলেছিল?”
“হ্যাঁ, আমিই সে।”
“আপনি একটু বসুন, আমি ছাগলের বাচ্চার গোশত রান্না করি আপনার জন্য।”
“আমাকে ধরে রাখলেও আমি খাব না। তবে তোমরা চাইলে মাবুদের নামে কোরবানি করতে পার।”
তারা কেউই বুঝল না এ লোক যে মাবুদের ফেরেশতা।
“আপনার নাম কী? আপনার ভবিষ্যৎবাণী মিলে গেলে তখন আমরা আপনার নাম নিয়ে সম্মান করতে চাই, মানুষকে জানাতে চাই।”
“তুমি কেন আমার নাম জিজ্ঞেস করছ? আমার নাম কেউ বুঝতে পারবে না।”
মানোয়া যখন কোরবানি প্রস্তুত করল, তখন অচেনা লোকটি তার হাতের দণ্ড দিয়ে স্পর্শ করল সেটা। সাথে সাথে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো, তখন সেই আগুনের শিখা আকাশের দিকে উঠতে লাগল, সেই শিখার সাথে সাথে অচেনা লোকটি তাদের চোখের সামনে উপরে উঠে গেলেন। এটা দেখে তারা দুজন সেজদায় পড়ে গেলেন মাটিতে। সেই লোক আর কোনোদিন ফিরে আসেননি।
যথাসময়ে স্ত্রীলোকটির সন্তান হলো। ছেলের নাম রাখা হলো শামাউন/সামশুন বা শিমশুন (שִׁמְשׁוֹן), যার মানে ‘সূর্যের মতো পুরুষ’। ইংরেজিতে তিনি স্যামসন (Samson) নামে বেশি পরিচিত।
স্যামসন যখন বড় হয়ে উঠলেন, তিনি প্রায়ই শিকারে যেতেন। স্যামসনের চুল কিন্তু কোনদিন কাটা হয়নি। এবং তার দেহে ছিল প্রচণ্ড শক্তি। পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থে বলা আছে, আল্লাহ্প্রদত্ত শক্তি তার উপর ভর করত এবং তিনি ঐশ্বরিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতেন।
তরুণ বয়সে তিনি তার পাহাড়ি এলাকা ত্যাগ করে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লেন। ফিলিস্তিনি শহর। সেখানে গিয়ে তিনি প্রেমে পড়ে গেলেন, বেশ বড়সড় প্রেম। মেয়েটির নাম ছিল তিমনাহ। তিনি তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু বাবা-মা কোনোভাবেই সেটা মানবেন না, কারণ একজন ইসরাইলি হয়ে কখনও কোনো জেন্টাইলকে বিয়ে করা যাবে না। জেন্টাইল অর্থ অইহুদী।
যেদিন তিনি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মেয়ের কাছে যাচ্ছিলেন, তখন পথিমধ্যে এক বিকট আকারের হিংস্র সিংহ তাকে আক্রমণ করে বসে। ঠিক তখনই ঐশ্বরিক শক্তি এসে ভর করে তার ওপর। তিনি খুব সহজভাবেই সিংহটিকে আঁকড়ে ধরলেন এবং এক টানে ছিড়ে ফেললেন তার দেহ। কিন্তু এই ঘটনা আপাতত কাউকে বললেন না তিনি। মেয়েটিকেও না, বাবা-মাকেও না।
কিন্তু তার জন্য সামনে বিশ্বাসঘাতকতা অপেক্ষা করছিল।
সপ্তদশ পর্ব: এক নতুন যুগের সূচনা
এ সিরিজের পর্বগুলো হলো:
প্রথম পর্ব: ইহুদী জাতির ইতিহাস: সূচনা পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব: মিশরে যাবার আগে কেমন ছিল বনি ইসরাইল?
তৃতীয় পর্ব: হযরত ইউসুফ (আ): দাসবালক থেকে মিসরের উজির- ইহুদী জাতির ইতিহাস
চতুর্থ পর্ব: ইউসুফ-জুলেখার কাহিনীর জানা অজানা অধ্যায়
পঞ্চম পর্ব: মসজিদুল আকসা আর বাইতুল মুকাদ্দাসের ইতিবৃত্ত
ষষ্ঠ পর্ব: দাসবন্দী বনী ইসরাইল এবং হযরত মুসা (আ:) এর জন্ম
সপ্তম পর্ব: মিসরের রাজপ্রাসাদ থেকে সিনাই পর্বত
অষ্টম পর্ব: সিনাই পর্বত থেকে ফারাওয়ের রাজদরবার
নবম পর্ব: মিসরের অভিশাপ
দশম পর্ব: দ্বিখণ্ডিত লোহিত সাগর, এক্সোডাসের সূচনা
একাদশ পর্ব: মরিস বুকাইলি আর ফিরাউনের সেই মমি
দ্বাদশ পর্ব: তূর পর্বতে ঐশ্বরিক সঙ্গ এবং তাওরাত লাভ
ত্রয়োদশ পর্ব: ইসরাইলের বাছুর পূজা এবং একজন সামেরির ইতিবৃত্ত
চতুর্দশ পর্ব: জীবন সায়াহ্নে দুই নবী
পঞ্চদশ পর্ব: রাহাব ও দুই গুপ্তচরের কাহিনী
ষোড়শ পর্ব: জেরিকোর পতন এবং স্যামসনের অলৌকিকতা
সপ্তদশ পর্ব: এক নতুন যুগের সূচনা
বোনাস প্রাসঙ্গিক আর্টিকেল:
দ্য ফার্স্ট মুসলিম: একজন ইহুদীর চোখে মহানুভব হযরত মুহাম্মাদ (সা)