রোমের সাথে চুক্তির মাধ্যমে প্রায় পনের বছর চলা যুদ্ধের সাময়িক ইতি টানলেও কার্থেজের কপালে আরো যুদ্ধ লেখা ছিল। এই চুক্তির পর রোম বেশ কয়েকবছর শান্তিপূর্ণ সময় পার করছিল। এ সময় তারা কোষাগার পূর্ণ করা ও সামরিক বাহিনীর উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হয়। কিন্তু কার্থেজ জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয় অন্য এক লড়াইয়ে।
রোমের সাথে যখন লড়াই চলছিল তখন কার্থেজের সেনাবাহিনীর এক বড় অংশই ছিল ভাড়াটে যোদ্ধা বা মার্সেনারি। যুদ্ধের পর রোমকে ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে কার্থেজ মার্সেনারিদের শর্ত মোতাবেক পূর্বনির্ধারিত অর্থ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এতে মার্সেনারিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। টালমাটাল এই সময়ে তাদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলো লিবিয়ান ম্যাথো ও ইটালিয়ান স্পেন্ডিয়াস।
ম্যাথো ও স্পেন্ডিয়াসের যৌথ বাহিনী অনভিজ্ঞ কার্থেজিনিয়ান জেনারেলদের কয়েকবারই পরাজিত করে। চুক্তিমতো টাকা পাওয়াই তাদের মূল উদ্দেশ্য হলেও কার্থেজের বিরুদ্ধে সামরিক সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা কার্থেজ দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। ইত্যবসরে কর্সিকা এবং সার্ডিনিয়াতে অবস্থানকারী মার্সেনারিরাও কার্থেজের বিরুদ্ধে বিদ্রহ করে।
উটিকা অবরোধ
মার্সেনারি বাহিনী উটিকা অবরোধ করলে কার্থেজ থেকে হ্যানো এলেন হামলা করে তাদের হটিয়ে দেয়ার জন্য। সাথে থাকা হাতি ব্যবহার করে তিনি মার্সেনারিদের প্রভুত ক্ষতিসাধন করলেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই তিনি যখন জয়োল্লাসে মত্ত, তখন অতর্কিত হামলা করে মার্সেনারিরা তাকে পরাস্ত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হ্যামিলকার বার্কাকে সেনাবাহিনীর সহ-অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু দুই জেনারেলের রেষারেষি কার্থেজের ঝামেলা শুধুই বাড়াচ্ছিল।
এদিকে কার্থেজকে দুর্বল ধরে নিয়ে তাদের অধীনে থাকা অনেকগুলো রাজ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। কর্সিকা ও সার্ডিনিয়া বিদ্রোহ করে। এমনকি উটিকাও রোমান সিনেটে পত্র পাঠিয়ে রোমান অধীনস্থ অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবার অনুরোধ জানায়। চুক্তির বরখেলাপ হবে মনে করে সিনেট এতে সাড়া দেয়নি। বরঞ্চ রোম ও সিরাকিউজ দুই পক্ষই কার্থেজকে এই সময় প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করেছিল। শুধু তা-ই না, রোমান সিনেট তাদের অধীনস্থ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের মার্সেনারিদের কাছে কোনো কিছু বিক্রি না করার আদেশ দেয়।
কার্থেজ অবরোধ ও ব্যাটল অফ বাগ্রাডেস
এর মধ্যে মার্সেনারিরা সাগর থেকে কার্থেজে আসার প্রণালী অবরোধ করে বসল। তাদের সাথে যোগ দিল নুমিডিয়ান এক গোত্রপ্রধান নাভারাস ও তার দল। কার্থেজ পৌঁছে গিয়েছিল পতনের দ্বারপ্রান্তে। এমন সময় ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হলেন হ্যামিলকার বার্কা। তিনি তখন উটিকাতে অবরুদ্ধ। তার সাথে থাকা ১০,০০০ পদাতিক মার্সেনারি বাহিনীর তুলনায় অপ্রতুল। তবে তার সাথে ছিল হস্তিবাহিনী ও অশ্বারোহী বাহিনী, যা তাকে কিছু সুবিধা এনে দিয়েছিল।
উটিকার অবরোধ ভেঙে বের হয়ে আসতে হ্যামিলকার এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করলেন। তিনি বাগ্রাডেস নদী পার হয়ে বাইরে থেকে মার্সেনারিদের উপর আঘাত হানার পরিকল্পনা করলেন। তখন পর্যন্ত বাগ্রাডেস নদীকে পারাপারের অযোগ্য মনে করা হতো বলে মার্সেনারিরা নদীর তীরে কোনো পাহারা বসায়নি। কিন্তু হ্যামিলকার লক্ষ্য করেছিলেন, তীব্র বাতাসের সময় নদিতে প্রচুরে পলি জমে তা অগভীর হয়ে যায়, তখন সেখান দিয়ে পার হওয়া সম্ভব। খ্রিস্টপূর্ব ২৪০ অব্দের শেষে বা ২৩৯ অব্দের শুরুতে এক রাতে তিনি তার বাহিনী নিয়ে মার্সেনারিদের অগোচরে নদী পার হয়ে তাদের আক্রমণ করলেন। উটিকার অবরোধ ভেঙে গেল।
হ্যামিলকার পরাজিত মার্সেনারিদের তাড়া করে দক্ষিণ-পশ্চিমের পার্বত্য এলাকাতে গিয়ে পৌঁছলেন। এখানে তার হঠকারিতার কারণে কার্থেজের সেনারা শত্রুদের দিয়ে বেষ্টিত হয়ে পড়ে। ধ্বংস যখন সন্নিকটে তখন নাভারাস পাশার ছক পাল্টে দেন। হ্যামিলকারের সাথে তার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল এবং ঐতিহাসিকগণ মনে করেন নাভারাস কার্থেজিনিয়ান সেনাপতির গুণমুগ্ধ ছিলেন। নাভারাস দলত্যাগ করে হ্যামিলকারের সাথে গাঁটছড়া বাঁধলেন। তার সাহায্যে কার্থেজ বাহিনী শত্রুবেষ্টনী ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারল।
নাভারাসের দলত্যাগের পর মার্সেনারি নেতা ম্যাথো ও স্পেন্ডিয়াস এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে চাইলেন। যদি আর কেউ দলত্যাগের চেষ্টা করে তাদের কী পরিণতি হবে তা দেখাতে তারা তাদের সঙ্গে থাকা প্রায় ৭০০ কার্থেজিনিয়ান যুদ্ধবন্দিকে প্রকাশ্যে নির্যাতন করে হত্যা করলেন। প্রতিশোধ নিতে হ্যামিলকারও বিপক্ষ দলের বন্দিদের একইভাবে হত্যা করেন। পলিবিয়াসের মতে, এই ঘটনার পর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধি অসম্ভব হয়ে পড়ে (The Truceless War)।
ব্যাটল অফ দ্য স’
নাভারস এবং তার নুমিডিয়ান অশ্বারোহী দলের সহায়তা নিয়ে হ্যামিলকার কার্থেজ অবরোধ করে বসে থাকা মার্সেনারিদের রসদ সরবরাহের রাস্তায় ক্রমাগত হামলা চালাতে থাকলেন। বাধ্য হয়ে তারা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়। হ্যামিল কার তাদের তাড়া করে নিয়ে যান এক পার্বত্য রাস্তা পর্যন্ত, যার নাম ছিল ‘দ্য স’। এখানে তিনি শত্রুদের ঘিরে ফেললেন। হ্যামিলকারের অবস্থান ছিল দুর্ভেদ্য। সেটি ভেদ করে পালিয়ে যাওয়া ৪০,০০০ মার্সেনারি যোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না।
ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মার্সেনারি বাহিনীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠলে স্পেন্ডিয়াস সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এলেন। হ্যামিলকার প্রথমে খুব নমনীয় আচরণ করলেন। তিনি দশজন বন্দির বিনিময়ে মার্সেনারিদের একবস্ত্রে ছেড়ে দেয়ার অঙ্গীকার করলেন। এসবই ছিল তার কূটচাল। স্পেন্ডিয়াস যখন দশজন বন্দিসহ তার কাছে এলো, তিনি তখন ঠুনকো কিছু যুক্তির অবতারণা করে প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের সবাইকে গ্রেফতার করলেন। হ্যামিলকারের সেনারা বেশিরভাগ মার্সেনারিকে হত্যা করে, যদিও ম্যাথো পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। স্পেন্ডিয়াস ও অন্যান্য বন্দিদের কার্থেজে নিয়ে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হলো।
ব্যাটল অফ লেপ্টিস
হ্যামিলকার উটিকা ছেড়ে আসার পর তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ব্যাটল অফ দ্য স’য়ের পর মার্সেনারি নেতা ম্যাথোকে তারা শহরে স্থান দেয়। ২৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের হ্যামিলকার উটিকা অবরোধ করলেন। কার্থেজ থেকে তাকে সহায়তার জন্য পাঠান হলো হ্যানিবাল নামে এক অযোগ্য জেনারেলকে। ম্যাথো অতর্কিতে তার উপর হামলা করলে হ্যানিবালের নেতৃত্বাধীন সেনারা পরাজিত হয়য়। বন্দি হ্যানিবাল ও তার অন্যান্য কার্থেজিনিয়ান অফিসারকে মার্সেনারিরা সবার সামনে ক্রুশবিদ্ধ করে।
হ্যানিবালের বিপর্যয়ের পর কার্থেজ অনেকটাই হতোদ্যম হয়ে পড়ে। শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা সামরিক দায়িত্ব পালনের যোগ্য সকল কার্থেজিনিয়ান নাগরিককে হ্যামিলকারের সাথে যোগ দিতে পাঠায় এবং সেনাবাহিনীর সহ-অধিনায়ক করে জেনারেল হ্যানোকে দায়িত্ব প্রদান করে।
২৩৮, মতান্তরে ২৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিউনিসের কাছাকাছি লেপ্টিসের প্রান্তরে হ্যানো ও হ্যামিলকারের মিলিত বাহিনী ম্যাথোর নেতৃত্বে থাকা মার্সেনারিদের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধে কার্থেজ জয়ী হয়। মার্সেনারি বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং বেশিরভাগ সেনা নিহত হয়। ম্যাথোকে হ্যামিলকার বন্দি করেন। তাকে কার্থেজে নিয়ে সবার সামনে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।
মার্সেনারি বিদ্রোহ দমনের মাধ্যমে কার্থেজ প্রথম পিউনিক যুদ্ধে হারানো আত্মবিশ্বাসের অনেকখানি ফিরে পায়। হ্যামিলকারের মধ্যে তারা খুঁজে পায় এক দক্ষ ও অভিজ্ঞ সেনানায়ক। তারা এবার প্রস্তুতি নিতে থাকে বিদ্রোহীদের দমন করে কর্সিকা ও সার্ডিনিয়া আবার তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার। এজন্য তারা তাদের নৌবাহিনীকে ঢেলে সাজাতে থাকে।
সার্ডিনিয়ার ক্রাইসিস (২৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
কর্সিকা ও সার্ডিনিয়াতে থাকা মার্সেনারি বাহিনী ২৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই কার্থেজের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে আসছিল। এসময় কার্থেজ সামরিক দিক থেকে দুর্বল থাকায় তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। রোমের সামনে সুযোগ ছিল তখন এই দ্বীপগুলো দখল করে নেয়ার। কিন্তু কাগজে-কলমে এদের উপর কার্থেজের তখনও নিয়ন্ত্রণ থাকায় চুক্তি অনুযায়ী সিনেট এসময় সেখানে হস্তক্ষেপ করেনি।
২৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সার্ডিনিয়ার আদি অধিবাসীরা মার্সেনারিদের বিতাড়িত করে। তৎকালীন বিধি অনুযায়ী রোমান সিনেট তখন সার্ডিনিয়াকে স্বাধীন রাজ্য বলে গণ্য করে, যা আর কার্থেজের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।তদুপরি কার্থেজের শক্তিবৃদ্ধি ও নৌবহর পুনর্নির্মাণের পদক্ষেপকে রোমানরা তাদের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ বলে মনে করে, যা প্রথম পিউনিক যুদ্ধের শেষে সম্পাদিত চুক্তির বিরোধী ছিল। তারা কার্থেজের কাছে এজন্য ক্ষতিপূরণ দাবী করে। কার্থেজ তখনও রোমের সাথে পাল্লা দেয়ার মতো সামরিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। কাজেই রোমের দাবী মেনে নেয়া ছাড়া তাদের সামনে যুদ্ধ এড়ানোর আর কোনো উপায় ছিল না। সুতরাং পিউনিক যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের সাথে আরো অর্থ তারা রোমকে দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু কার্থেজ এই অপমান মুখ বুজে সহ্য করতে পারেনি। তারা তাদের ব্যয় ও ইতালিতে হারানো অঞ্চলের ক্ষতি পূরণ করার স্বার্থে হ্যামিলকার বার্কাকে স্পেনে প্রেরণ করে। তিনি সেখানে স্থানীয় শাসকদের পরাজিত করে কার্থেজের উপনিবেশ গড়ে তোলেন। সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ আর সামুদ্রিক বাণিজ্যের সুবাদে কার্থেজ তার হারানো সম্পদ ও শক্তি দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে থাকে। রোমের জন্য কার্থেজের সমৃদ্ধি অশনি সঙ্কেত হয়ে দেখা দেয়। দুই শক্তি এগিয়ে যেতে থাকে নতুন আরেকটি রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে, যেখানে উত্থান ঘটবে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম জেনারেলদের একজনের, হ্যানিবাল বার্কা।