‘ন্যাশন অব ইসলাম’ বা সংক্ষেপে ‘ন্যাশন’ নামে পরিচিত সংগঠন কিংবা আন্দোলনটির সাথে আপনি কতটুকু পরিচিত? এই সংগঠনটির ইতিহাস, বিশ্বাস, আদর্শ, কার্যক্রম সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে? যদি একেবারেই ধারণা না থেকে থাকে, তাহলে এক বাক্যে এর সম্পর্কে আপনার মনে কৌতূহল সৃষ্টি করা সম্ভব। প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী ম্যালকম এক্স ন্যাশনে যোগ দিয়েছিলেন, যোগ দিয়ে নিজের ধর্ম এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছিলেন, তার প্রভাবে ন্যাশনের জনপ্রিয়তা রাতারাতি বেড়ে যায়, মতবিরোধে জড়িয়ে তিনি ন্যাশন ত্যাগ করেন আর এর কিছুকাল পর আততায়ীর হাতে নিহত হন, যে হত্যার পেছনে অভিযোগ ছিল ন্যাশনের বিরুদ্ধেই। এবার নিশ্চয়ই ন্যাশন সম্পর্কে জানতে আগ্রহ বোধ করছেন?
ইতিহাসের দিকে পরে যাবো, প্রথমেই আমরা আলোচনা করবো ন্যাশনের বিশ্বাস এবং ভাবধারা নিয়ে। ন্যাশন অব ইসলাম এমন একটি সংগঠন, যার অভ্যুত্থান ঘটেছিল একটি আন্দোলন আকারে। সময়ের আবর্তে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সংগঠনে রূপ নেয়। এটি একাধারে মানবাধিকার আর ধর্মীয় সংগঠন। অনেকেই আবার ন্যাশনকে ধর্মীয় সংগঠন বলতে চান না এই যুক্তিতে যে, ন্যাশন গঠিত হয়েছিল কেবল আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের অধিকার নিয়ে কাজ করবার জন্য, তাদের ধর্ম নিয়ে নয়। তথাপি এই সংগঠনের সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান মূলনীতি, “এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই” স্পষ্টত প্রমাণ করে ন্যাশন একটি ধর্মীয় সংগঠনও বটে।
ইসলামধর্ম কেন্দ্রিক সংগঠন হলেও ন্যাশনের সাথে বৈরিতা আছে অনেক মুসলিম সংগঠনের, বিশেষ করে সুন্নি ধারার মুসলমানদের। কারণ ন্যাশনের প্রধান বিশ্বাসগুলোর একটি হলো এই যে, তাদের প্রতিষ্ঠাতা ওয়ালেস ফার্দ মুহম্মদই হচ্ছেন ইমাম মাহদি! তার রেখে যাওয়া উক্তি, শিক্ষা, দর্শনকে ‘দ্য সুপ্রিম উইজডম’ শিরোনামে সংগ্রহ করেছিলেন তার ছাত্র এলিজাহ মুহম্মদ, যে দর্শনই ন্যাশনের মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফার্দ মুহম্মদের শিক্ষার কেন্দ্রে ছিল মানুষের অজ্ঞতার দর্শন। ন্যাশনের বিশ্বাস, পৃথিবীর শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষই অজ্ঞ। এই বিরাট অজ্ঞ জনগোষ্ঠীকে মাত্র ১০ ভাগ চতুর মানুষ মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারিত করছে। আর বাকি মাত্র ৫ ভাগ মানুষ প্রকৃত সত্যের সন্ধান পেয়েছে, যাদের একত্র করাই তো ন্যাশনের কাজ!
ন্যাশন অব ইসলাম নিজেদের সুন্নি ধারার দাবি করলেও বেশ কিছু স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ন্যাশনও ইসলামের মৌলিক দিকগুলোতে সুন্নিদের সাথে একমত। নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাতের মতো ধর্মীয় রীতি-প্রথায় ন্যাশন সুন্নিদেরই অনুকরণ করে। তবে বৈপরীত্যগুলোও বেশ গুরুভার। সুন্নিদের নিকট একজন সম্মানিত নবী হযরত ইয়াকুব (আঃ) ন্যাশনের নিকট একজন কুচক্রী বিজ্ঞানী ছিলেন। আবার ন্যাশন বিশ্বাস করে, ফার্দ মুহম্মদ ছিলেন ইমাম মাহদি, যিনি এলিজাহ মুহম্মদকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেছেন।
ন্যাশন অব ইসলাম মূলত দুটি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমটি হচ্ছে তাদের বিশ্বাস, যেখানে আছে ১২টি ধারা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাদের লক্ষ্য, যেখানে আছে ১০টি ধারা। এই দুই অংশেরই পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হয়। ন্যাশনের বিশ্বাস এবং লক্ষ্য, উভয় অংশের মাঝেই ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ রয়েছে, যা তাদেরকে সমালোচনা করার সবচেয়ে বড় জায়গা। বিশেষ করে ম্যালকম এক্স যখন ন্যাশনে ছিলেন, তখন এ ধারাটি নিয়ে সর্বাধিক চর্চা হয়। ন্যাশনের এ ধারাটি এরকম যে, আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের পুনরায় আফ্রিকায় ফিরে গিয়ে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বসবাস করা উচিত। তবে ন্যাশনের আরেকজন বড় নেতা ফারাখান এই ধারণার প্রতি মানুষের ভুল ভাঙিয়েছেন। ন্যাশন প্রথমে আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের জন্য স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার আর সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে চায়। তবে যদি এই অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তারা ব্যর্থ হয় কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরুপ সহায়তা না পায়, তাহলে আসবে বিচ্ছিন্নতাবাদের চিন্তা।
সুপ্রিম উইজডমের একটি প্রধানতম শিক্ষা হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব। ফার্দ মুহম্মদের দর্শন অনুযায়ী, কৃষ্ণাঙ্গরাই ছিল পৃথিবীর আদি এবং প্রকৃত মানব। তারা শত শত বছর পৃথিবীতে শান্তি আর প্রীতির সাথে বসবাস করেছে। অতঃপর পৃথিবীতে আসে ‘শয়তান’ তথা শ্বেতাঙ্গ মানুষ! আর এই শয়তানদের তৈরি করেন ‘জ্যাকব’ নামক একজন কুচক্রী বিজ্ঞানী। বাইবেলে উল্লিখিত এই জ্যাকব সেই জ্যাকব, যাকে মুসলিমরা হযরত ইয়াকুব (আঃ) বলে জানেন! ফার্দের দাবি, জ্যাকব গ্রিসের প্যাটমস নামক একটি দ্বীপে এই শ্বেতাঙ্গ তৈরি শুরু করেন। জ্যাকব শুধু এতটুকু করেই ক্ষান্ত হননি, কীভাবে প্যাটমস দ্বীপে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা কমিয়ে শ্বেতাঙ্গের সংখ্যা বাড়ানো যায়, সে ব্যবস্থাও করে করে যান।
জ্যাকবের গঠন করা একটি গোপন সংগঠন বর্বরভাবে কৃষ্ণাঙ্গ শিশু নিধন করতো। তারা কৃষ্ণাঙ্গদের বিয়ে করতো না। যেন নতুন জন্ম লাভ করা শিশুটি শ্বেতাঙ্গই হয়। এই প্রক্রিয়া চলেছিল প্রায় ৬০০ বছর। এভাবে প্যাটমস দ্বীপে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য বাড়লে তারা ধীরে ধীরে মূল ভূখণ্ডে পা রাখতে শুরু করে। মূল ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের সহজেই গ্রহণ করে নিলে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে এবং দ্রুত নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। একসময় তারা কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াতে শুরু করে এবং কৃষ্ণাঙ্গদের উপর ধীরে ধীরে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করে নেয়।
“ধর্মের মাঝেও শ্বেত প্রভুত্ব ঢুকে গেছে। শ্বেতাঙ্গ যিশু, শ্বেতাঙ্গ দেবতা, শ্বেতাঙ্গ দেবী, সবকিছু শ্বেতাঙ্গ। কেবল নেতিবাচক বিষয়গুলো দেখানো হয় কৃষ্ণাঙ্গ!”- ম্যালকম এক্স
ন্যাশনের এসব ধারণা আর দর্শনের সাথে পরিচিত হবার পর পাঠকের মাথায় একটি প্রশ্ন অবশ্যই ঘুরপাক খাবে। সেটি হচ্ছে, অধিকার আদায়ের একটি সংগঠন শেষতক এমন উগ্র হয়ে গিয়েছিল কেন? বস্তুত, উগ্রতা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ন্যাশন অব ইসলাম তাদের শুরুর অবস্থান থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরে গিয়েছিল, বিশেষ করে ম্যালকম এক্স ন্যাশন ত্যাগ করার পর। সে প্রক্রিয়াটি মূলত তাদের গঠন ও পথচলার ইতিহাস।
১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েট শহরে গঠিত হয়েছিল ন্যাশন অব ইসলাম। প্রতিষ্ঠাতা ওয়ালেস ফার্দ মুহম্মদের উদ্দেশ্য ছিল নিপীড়িত অসহায় আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদেরকে আত্মসচেতন এবং স্বাবলম্বী করে তোলা। কিন্তু তিনি জানতেন, শত শত বছর দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী এই আফ্রিকান মুসলিমদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনাটা সহজ হবে না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ন্যাশন অব ইসলাম একইসাথে ধর্মীয়ভাবেও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে সচেতন করবে, যেন তারা ধর্মীয় সাম্য ও স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তিতে আত্মমর্যাদা ফিরে পায়। অথচ কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের জন্য লড়াই করা উদ্দেশ্যে গঠিত এই সংগঠনই একসময় তাদের দর্শনে একরকম বর্ণবাদী হয়ে পড়লো! পৃথিবীর তাবৎ শ্বেতাঙ্গরাই হলো শয়তান, এরকম উগ্র শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যে ন্যাশন গঠিত হয়নি।
ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি যে, ন্যাশনের বিশ্বাস ছিল ফার্দ মুহম্মদই ছিলেন ইমাম মাহদি। এই বিশ্বাসের পেছনেও ন্যাশনের বিশেষ কারণ রয়েছে, যার সত্যাসত্য নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ফার্দ যখন নিজের কিছু সমর্থক জোগাড় করতে সমর্থ হলেন, তিনি নিজের সংগঠনের জন্য নিজের দর্শন প্রচার করতে শুরু করলেন। নিজের সমর্থক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে এলিজাহ মুহম্মদকেই তার সবচেয়ে বেশি মনে ধরে যায়। তিনি এলিজাহকে ন্যাশনের প্রথম মন্ত্রী ঘোষণা করেন এবং প্রায় দু’বছর দিনরাত এলিজাহকে নিজের সাহচর্যে রেখে নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা দেন। এরপর ১৯৩৩ সালে রহস্যময়ভাবে তিনি উধাও হন! এলিজাহর দাবি অনুযায়ী, তাকে শেষ দেখা গিয়েছিল বিমানবন্দর থেকে একটি প্লেনে চড়তে। এরপর আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনার পর এলিজাহ ন্যাশনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বনে যান। দৃশ্যপটে আগমন ঘটে আরো কয়েকজন নেতার। তারা সকলেই সমস্বরে দাবি করেন যে, ফার্দ প্রকৃতপক্ষেই ছিলেন ইমাম মাহদি। নিজের প্রয়োজনীয় দর্শন শিষ্যদের মাঝে প্রচার করে তিনি চলে গেছেন। এখন শিষ্যদের কাজ সেগুলো সর্বসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। ফার্দের অদৃশ্য হবার মাস দুয়েক পরই এলিজাহ ‘দ্য ফাইনাল কল টু ইসলাম’ নামক পত্রিকাটি প্রকাশ করে পুরোদমে ন্যাশনের প্রচার কাজ চালাতে শুরু করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ ভাগটা জেলেই কাটিয়েছেন এলিজাহ মুহম্মদসহ ন্যাশনের অধিকাংশ নেতা। বিশ্বযুদ্ধের বছরখানেক পর এলিজাহ ছাড়া পেয়ে পুনরুদ্যমে ন্যাশনের প্রচারণা চালাতে শুরু করেন। এ সময় মূলত কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি। এর কিছুকাল পরে জেল থেকে ছাড়া পান ম্যালকম এক্স। ততদিনে তিনি ন্যাশনের ভাবাদর্শ আর নীতির প্রতি আসক্ত। তিনি ন্যাশনে যোগ দেয়ার পর থেকে সবকিছু খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। দ্রুত তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমরা এলিজাহর চেয়ে তার প্রতি আসক্ত হতে থাকে, তার অসাধারণ বাগ্মিতায় অগণিত মানুষ যোগ দিতে শুরু করে ন্যাশনে। কয়েক বছরের মধ্যে ন্যাশনের সদস্য সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়। অনেকের মতে, কেবল ম্যালকম এক্সের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ন্যাশনে যোগ দেয়া মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।
এরপরের যে ঘটনাগুলো ম্যালকম এক্সের সাথে জড়িত, সেগুলো সবিস্তারে জানতে পড়ুন ম্যালকম এক্সের জীবনী। সংক্ষেপে এ সময়কার ঘটনাগুলো এরূপ, লস এঞ্জেলসের ঘটনায় কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের উপর পুলিশী হামলা, ম্যালকম এক্সের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, ন্যাশনে বড় ধরনের প্রতিবাদের প্রস্তাব, এলিজাহর অসম্মতি, ম্যালকম অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বলে এলিজাহর আশংকা এবং উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি। এক বছরের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির আততায়ীর হাতে নিহত হওয়া নিয়ে মন্তব্য করে এলিজাহর পুরোপুরি বিরাগভাজন হন ম্যালকম, যার ধারাবাহিকতায় তিনি ন্যাশন ত্যাগও করেন। ন্যাশন ত্যাগ করে ব্যক্তিগতভাবে আরো অধিক উদার মানসিকতা নিয়ে মানবাধিকার সম্পর্কিত কাজকর্ম করে চলে ম্যালকম। তবে, দিন-রাত হুমকিধমকির মাঝে বেশিদিন টিকতে পারেননি তিনি। ১৯৬৫ সালেই আততায়ীর হাতে নিহত হন, যার প্রধান আসামীই ছিল ন্যাশনের। থমাস হেগান নামক যে ব্যক্তি ম্যালকমকে প্রথম গুলি করেন, তিনি ন্যাশনের সদস্য হলেও ন্যাশন তা অস্বীকার করে এবং তার কোনো দায়ভার নিতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশ্য ন্যাশনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন, এ ধরনের কোনো কথা হেগানও বলেননি।
যা-ই হোক, ন্যাশনের জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়ানোয় এলিজাহর চেয়ে ম্যালকমের অবদান কোনো অংশে কম ছিল না। ১৯৭৫ সালে এলিজাহ মুহম্মদের মৃত্যুর সময় পুরো আমেরিকাতে ন্যাশনের মসজিদের সংখ্যা ছিল ৭৫, যা এর জনপ্রিয়তারও পরিচায়ক বটে। এলিজাহর পর তার পুত্র দ্বীন মুহম্মদ ন্যাশনের প্রধান মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। আর তিনি ক্ষমতায় এসেই ন্যাশনকে আমূল বদলে দেন। তার তত্ত্বাবধানে ন্যাশনের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে এবং ন্যাশনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা আমেরিকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে দৃষ্টিভঙ্গিতে। ন্যাশন তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে অনেকটা উদার আচরণ করতে শুরু করে। একইসাথে সুন্নি ইসলামের অনেক নীতিও গ্রহণ করে।
এ পর্যায়ে গিয়ে বিভক্তি শুরু হয় ন্যাশনে। ফারাখান ন্যাশন থেকে বেরিয়ে গিয়ে আদি ন্যাশনের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে কাজ শুরু করেন। ফলে ন্যাশন দুটি হয়ে গেল। একটি দ্বীনের, আরেকটি ফারাখানের। দ্বীনের ন্যাশন যথারীতি বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারমূলক কাজকর্ম চালিয়ে গেল। আর ফারাখানের ন্যাশন মৌলিক নীতি আঁকড়ে ধরে থাকলো। এতে করে ন্যাশনের সমর্থক দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল এবং উভয় পক্ষই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হলো। অবশ্য পরবর্তীকালে প্রতিযোগিতায় জয় হয় ফারাখানেরই। দ্বীন মুহম্মদের অংশটি ঝিমিয়ে পড়ে এবং ন্যাশন অব ইসলাম বলতে ফারাখানের ন্যাশনই টিকে থাকে।
২০১০ সালে ফারাখান ন্যাশনের সদস্যদের মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে ডায়েনেটিকসের সূচনা করেন। ডায়েনেটিকস হলো ‘চার্চ অব সায়েন্টোলজি’র প্রতিষ্ঠাতা রন হাবার্ডের উদ্ভাবিত একটি তত্ত্ব, যেটি বিভিন্ন শারীরতাত্ত্বিক জটিলতার সমাধান করতে মানসিক সমস্যার সমাধানের উপর গুরুত্ব দেয়। এ ঘোষণার পর ন্যাশনের বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল যে ফারাখানও ন্যাশনের মৌলিক কাঠামো ভেঙে ভিন্ন পথে এগোচ্ছেন কি না।
“আমি হিটলারকে অনন্য বলেছি সে অর্থে, যে অর্থে চেঙ্গিস খানও ইতিহাসে অনন্য। সে অর্থ নেতিবাচক অর্থ।”-
হিটলারকে মহিমান্বিত করেছেন, এরকম অভিযোগের জবাবে ফারাখান
ন্যাশনের বিরুদ্ধে নানারূপ সমালোচনা ছিল তাদের জন্মলগ্ন থেকেই। বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্বালে এবং যুদ্ধ চলাকালে ন্যাশনের বিরুদ্ধে বারংবার জাপানিদের সাথে যোগাযোগের অভিযোগ এসেছে এবং রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় এলিজাহ মুহম্মদ তখন গ্রেফতারও হয়েছিলেন। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিপরীতে কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস একপ্রকার বর্ণবাদকে বাতিল করে আরেকপ্রকার বর্ণবাদ প্রতিষ্ঠারই অপর নাম। ন্যাশনের বিপক্ষে এ সমালোচনাও কখনো মুছে যাবার নয়। ন্যাশনের সবচেয়ে বড় সমালোচক হচ্ছে ‘অ্যান্টি ডিফেমেশন লিগ’ বা এডিএল। তারা বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই অভিযোগ করে আসছে যে ন্যাশন সর্বদা ইহুদিবাদের বিরোধী। এ অভিযোগ যে একেবারে মিথ্যা, তা-ও নয়। ন্যাশন বরাবরই জায়োনিজমের কট্টর সমালোচক।
৯০ বছরে পা রাখতে চলা ন্যাশন অব ইসলাম এখনো ভালোভাবেই টিকে আছে তাদের ৮৫ বছর বয়সের প্রবীণ নেতা ফারাখানের কাঁধে ভর করে। তবে ন্যাশনের আগের সেই উত্তাপ আর যে নেই, তাতে কারোই সন্দেহ থাকার কথা নয়। সম্প্রতি ন্যাশনের ‘দ্য ফাইনাল কল’ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ চালু হয়েছে। শক্তিশালী প্রতিবাদ এবং ইহুদিবাদের কঠোর সমালোচনার জন্য এ পত্রিকার ভালো জনপ্রিয়তা রয়েছে বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের মাঝে। কিছুটা ঝিমিয়ে পড়া এ সংগঠনকে নতুন করে চাঙা করে তোলার স্বপ্নই দেখছেন ফারাখান। কিছুদিন আগেই তিনি তার স্বপ্নের কিছুটা আভাসও দিয়েছেন এক বক্তৃতায়। ২০১৯ সালে তিনি তার সামালোচকদের, বিশেষত জায়োনিস্টদের দেখিয়ে দিতে চান ন্যাশনের শক্তি। কালে কালে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়া এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠন আগামীতে আরো একবার জেগে উঠবে, নাকি বর্তমান সময়ের মতো ঢিমেতালে চলতে থাকবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।