৭ ডিসেম্বর, ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ। ঐতিহাসিকদের মতে, এই দিনেই কিয়েভান রুশ জয় করে নেয় মঙ্গোলবাহিনী। তবে তার ঠিক আগমুহূর্তে এই কিয়েভ জয় করেছিল ‘গ্যালিসিয়া–ভলিনিয়া’র প্রিন্স ড্যানিলো (Danylo, Daniel)। তার পর পরই মঙ্গোলদের কাছে হেরে কিয়েভ হারায় সে। কিয়েভসহ ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল তখন মঙ্গোলদের অধীনে থাকলেও গ্যালিসিয়া এবং ভলিনিয়ার শাসনভার তখনও ড্যানিলোর কাছেই ছিল। কিয়েভান রুশের পতনের পরও ঠিক ১০০ পর্যন্ত বছর ইউক্রেনের এই দুটি অঞ্চল বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না।
গ্যালিসিয়া এবং ভলিনিয়া ইউক্রেনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। এদের পূর্ব দিকে কিয়েভের অবস্থান। ভলিনিয়াতে মূলত বসবাস করত ক্রোয়েশিয়ান এবং ডুলিবিয়ানরা। গ্যালিসিয়াতে এদের পাশাপাশি টাইভারশিয়ান উপজাতিরও আবাস ছিল। অবস্থানগত দিক থেকে এ অঞ্চলদ্বয় কৃষ্ণ সাগরের সাথে হওয়ায় এদের গুরুত্ব যেমন ছিল তুলনামূলক বেশি, তেমনি শত্রুর আঘাত থেকেও এরা অনেকটাই নিরাপদ ছিল। পাশাপাশি, সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় লবণ উৎপাদন হতো এখানে, যা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।
গ্যালিসিয়া এবং ভলিনিয়া ৯৮০ খ্রিস্টাব্দের আগপর্যন্ত পোল্যান্ডের অধীনে ছিল। ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে কিয়েভান রুশের নেতৃত্বে আসা ভলোদিমির দ্য গ্রেট তার শাসনামলের প্রথম ১০ বছরের মধ্যেই কোনো একসময় পোল্যান্ডের থেকে ছিনিয়ে নেন এই দুটি অঞ্চল, যুক্ত করেন কিয়েভান রুশের সাথে, এবং শাসনভার দেন নিজ বংশধরদের। আয়ারোস্ল্যাভ দ্য ওয়াইজের বংশধর রসটিস্ল্যাভিচি (Rostyslavychi) পরিবারের নিয়ন্ত্রণে গ্যালিসিয়া এবং ভলোদিমির মনোমাখের ছেলের পরিবারের (Mstyslav Family) নিয়ন্ত্রণে ভলিনিয়া এগোতে থাকে। ভলোদিমির ভলিনিয়াতে নিজের নামে দ্য সিটি অফ ভলোদিমির (The City of Volodymyr) প্রতিষ্ঠা করে সেটাকে ভলিনিয়ার রাজধানী করেন। গ্যালিসিয়ার রাজধানী ছিলো হ্যালিচ (Halych)।
কিয়েভান রুশ থেকে প্রথম আলাদা হওয়া অঞ্চল এই গ্যালিসিয়া। ভলোদিমিরকোর (Volodymyrko) শাসনামলে (১১২৩–৫৩) তিনি কিয়েভান রুশ থেকে গ্যালিসিয়াকে পৃথক করে নিতে সক্ষম হন। তার মৃত্যুর পর থেকে তার ছেলে আয়ারোস্ল্যাভ অসমোমিশল (Iaroslav Osmomysl) ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সফলভাবে গ্যালিসিয়াকে পরিচালনা করেন। এ সময় একদিকে তিনি গালিসিয়ার সীমানা বর্ধিত করে মলদোভা পর্যন্ত নিয়ে যান, এবং অন্যদিকে হাঙ্গেরি ও জার্মানির প্রথম ফ্রেডেরিক (Frederich I) এর সাথে সম্পর্ক ভালো করার দিকে জোর দেন এবং সফল হন। আয়ারোস্ল্যাভ সম্পর্কে প্রাচীন উপাখ্যান ‘The Tale of the Host of Ihor’ এ বলা হয়েছে,
O Iaroslav Osmomysl of Halych! You sit tall on your golden throne, propping up the Hungarians mountains with your iron regiments blocking the way to its king, closing the gates of Danube… Your raths rolls over the earth.
১১৮৭ সালে আয়ারোস্ল্যাভের মৃত্যু হলে তার ছেলে ভলোদিমির বলিয়ারদের (Bolyar, Boyars) কারণে গ্যালিসিয়ার সিংহাসনে বসতে ব্যর্থ হয়ে হাঙ্গেরিতে আশ্রয় নেন। সেসময় হাঙ্গেরির রাজা অ্যান্ড্রু ভলোদিমিরকে গ্যালিসিয়ার কর্তৃত্ব ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও সুযোগ পেয়ে সে নিজেই গ্যালিসিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি সাধারণ জনগণ বাইরের লোকদের নিজেদের শাসক হিসেবে না চাওয়াতে বলিয়ারদের সাথে ভলোদিমিরের বনিবনা হয় এবং নিজেই সফলভাবে গ্যালিসিয়ার সিংহাসনে বসেন। তবে এ সময় থেকে বলিয়ারদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হতে হয় তাকে। এরপর থেকে অনেকগুলো বছর এভাবেই কেটেছে গ্যালিসিয়ার, ভলোদিমিরের মৃত্যুর পরও।
নভগর্ডিয়ানদের দ্বারা ১১৬৮ সালে মিস্তিস্ল্যাভিচ (Mstyslavyc) পরিবারের রোমান দ্য গ্রেট যাকে ‘Autocrat of all Rus’ বলা হয়ে থাকে, তাকে ভলিনিয়ার প্রিন্স হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তবে বলিয়ারদের কারণে তাকে ভালোই বেগ পেতে হয়েছে। অবশেষে ১১৯৯ সালে রোমান গ্যালিসিয়াতে ফিরতে সক্ষম হয়েই ভলিনিয়া এবং গ্যালিসিয়াকে একই শাসকের অধীনে আনে। রোমান দ্য গ্রেট সুপরিচিত অন্য এক কারণে। শুধু গ্যালিসিয়া এবং ভলিনিয়া না, সে ১২০৩ সালে কিয়েভ আক্রমণ করে প্রথমবারের মতো পুরো অঞ্চল নিজের অধীনে নিয়ে আসে। ‘ইউক্রেনের ইতিহাস’-এর দ্বিতীয় পর্বে যাকে রাজনৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পুরো ইউক্রেন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েও ক্ষান্ত হননি রোমান। লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ডের দিকেও এগোতে থাকেন তিনি, এবং পোলিশদের সাথে লড়াই করতে গিয়েই ১২০৫ সালে মারা যান রোমান দ্য গ্রেট। রোমান দ্য গ্রেটের একটি বিখ্যাত বাণী ছিল:
You cannot enjoy the honey without killing the bees.
রোমান যখন মারা যান তখন তার দুই ছেলে ড্যানিলো এবং ভ্যাসিলকোর বয়স ছিল মাত্র ৪ এবং ২ বছর। স্বাভাবিকভাবেই রোমান পরিবারের কেউ ক্ষমতায় আসতে পারেনি তখন, সাথে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে বসে গ্যালিসিয়া–ভলিনিয়া। এর মাঝে আবার দুই ভাইয়ের অধিকার রক্ষার অজুহাতে গ্যালিসিয়া ভাগাভাগি করে নেয় হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ড।
১২২১ খ্রিস্টাব্দে ২০ বছর বয়সে ড্যানিলো ভলিনিয়াতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করত সক্ষম হন, এবং সবাই তাকে মেনেও নয়। ১২৩৮ সালে ড্যানিলো হারিয়ে ফেলা গ্যালিসিয়ার হ্যালিচসহ কিছু অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এরপর বাবা রোমানের মতো পুরো ইউক্রেনকে এক শাসনের নিচে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে কিয়েভ আক্রমণ করে জয় করেন। তবে তার ঠিক পরেই মঙ্গোলদের কাছে হেরে বসেন ড্যানিলো। ১২৪১ সালে মঙ্গোলরা গ্যালিসিয়া–ভলিনিয়া অতিক্রম করে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই। ১২৪৫ সালে আবার ড্যানিলো কিয়েভ আক্রমণ করেন এবং ১২৪৬ সালে তিনি নিজের উপর মঙ্গোলদের (বাতু খানের) কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হন। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, ড্যানিলো কখনোই পুরোপুরি বশ্যতা স্বীকার করেননি।
১২৪৬ সালে পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট (Pope Innocent IV)-এর এক প্রতিনিধি কিয়েভ অতিক্রম করেন। তিনি এ বিষয়ে বলেন, “When we were journeying through that land, we came across countless skulls and bones of dead men lying about on the ground.”
ড্যালিনো অর্থোডক্সের অনুসারী ছিলেন, মঙ্গোলরা ছিল ভিন্নধর্মী। যদিও মঙ্গোলরা কখনোই ড্যানিলোকে নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে বলেনি, তবুও ড্যানিলো পোপের কাছে ক্রুসেড শুরুর অনুমতি চান। অন্যদিকে, পোলান্ড এবং হাঙ্গেরির সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরিতেও জোর দেন তিনি। অবশেষে ১২৫৪ সালে ড্যানিলো আবার মঙ্গোলদের হাত থেকে কিয়েভ উদ্ধার করতে কাজ শুরু করেন, এবং এবারও ব্যর্থ হন। ফলশ্রুতিতে ১২৫৯ সালে মঙ্গোল বাহিনী গ্যালিসিয়া–ভলিনিয়াতে হঠাৎ করে প্রবেশ করে বসে, এবং ড্যানিলোর সামনে দুটি অপশন দেয়।
১. গ্যালিসিয়া–ভলিনিয়ার সকল নিরাপত্তা প্রাচীর ধ্বংস করে দিয়ে মঙ্গোলদের ইচ্ছার ওপর নিজেদের ছেড়ে দিতে হবে।
২. তৎক্ষণাত মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের ধ্বংস নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে। ড্যানিলো বাধ্য হয়ে প্রথম অপশন বেছে নেন।
মঙ্গোলদের সাথে হারলেও ইউরোপে ড্যানিলোর গ্রহনযোগ্যতা বা সম্মান কোনোটিই কমেনি তখনও। বরং এই সময় ড্যানিলো পুরো ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকদের ছেলে, মেয়ে কিংবা নাতি–নাতনীদের সাথে নিজের বংশধরের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে থাকেন। ইউরোপের সে সময়ের সব থেকে আলোচিত শাসকদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে ড্যানিলো। ৬০ বছরের দীর্ঘ শাসনকাল শেষ হয় ১২৬৪ সালে তার মৃত্যুর মাধ্যমে। এর অনেক আগেই গ্যালিসিয়া নিজে রেখে ভলিনিয়ার শাসনভার ড্যানিলো তার ভাই ভ্যাসিলকোকে দিয়েছিলেন। যদিও গ্যালিসিয়া এবং ভলিনিয়া একসাথেই ছিল। দুই সহোদরের মৃত্যুর পর তাদের ছেলেরা (Lev এবং Volodymyr) গ্যালিসিয়া এবং ভলিনিয়াতে সফলভাবেই শাসন করে যান। লেভ এক্ষেত্রে যুদ্ধ-বিগ্রহ, সীমানা বর্ধিত করার দিকে মনোযোগ দিলেও ভলোদিমির তার অধীনে থাকা ভলিনিয়ার সামগ্রিক উন্নয়নের দিকেই মনোযোগ দেন। ভলোদিমির অবসর সময়ে বই পড়া এবং লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতেন। ১২৮৯ সালে ভলোদিমিরের মৃত্যু হলে তারপর থেকে ১৩৪০ সাল পর্যন্ত ওই অঞ্চলে ঠিক কী কী ঘটেছিল তা আর সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না।
তবে যতটুকু জানা যায় তা থেকে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন যে, লেভের মৃত্যুর পর তার ছেলে দুটি অঞ্চলই শাসন করে। তার মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে অ্যান্ড্রি এবং লেভ ‘রমানোভিচ’ পরিবারের শেষ দুই সদস্য হিসেবে জীবিত থাকে এবং অনেকটা অস্পষ্ট হলেও অনেকেই বলে থাকেন তারা দুজনেই মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মারা যান। এরপর ১৩২৩ সালে অ্যান্ড্রু এবং লেভের পোলিশ কাজিন বলেস্লো-কে (Boleslaw of Mazowia) এই অঞ্চলের মানুষ প্রিন্স হিসেবে নির্বাচিত করে। তিনি তার ধর্ম পরিবর্তন করে অর্থোডক্স মতবাদ গ্রহণ করে গ্যালিসিয়া–ভলিনিয়ার পূর্বসূরিদের অনুসরণ করে শাসন চালাতে থাকেন। অস্পষ্ট ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৩৪০ সালে বলিয়াররা তাকে ক্যাথোলিক মতবাদের দিকে ঝুঁকে যাওয়া এবং ভিনদেশিদের সহায়তার মিথ্যা দোষে দোষী করে বিষপান করিয়ে হত্যা করে। এর মাধ্যমেই কিয়েভান রুশের পতনের একশো বছর পর ইউক্রেন তার নিজ ভূমির শেষ শাসককে হারায়। ইউক্রেন পুরোপুরি চলে যায় বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে।