উত্তর বুলগেরিয়ার এক শহর। নাম তার গ্যাব্রোভো (Gabrovo/ Габрово)। গ্যাব্রোভো প্রদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র এ শহরটাই। কিন্তু এ শহরটি খ্যাত সম্পূর্ণ ভিন্ন আর অদ্ভুত এক কারণে, আর সেটি হলো এ শহরের অধিবাসীদের রসিকতা! তাদের কৃপণতা নিয়ে অদ্ভুত সব কৌতুক আর কাজকর্ম রয়েছে, আর সেগুলোই তাদের জন্য বয়ে এনেছে সুনাম। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক গ্যাব্রোভোবাসীদের রসিকতা নিয়ে।
এক সময় ষষ্ঠ শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যবইতে পাঠ্য ছিল মুহম্মদ এনামুল হকের লেখা একটা চমৎকার প্রবন্ধ ‘গ্যাব্রোভোবাসীদের রস-রসিকতা’। গ্যাব্রোভো নিয়ে জ্ঞানের হাতেখড়ি অনেকেরই সেখান থেকেই।
বলকান পর্বতমালার কোলের শহর গ্যাব্রোভো, পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইয়ান্ত্রা (Yantra) নদী। বুলগেরিয়ার দীর্ঘতম শহরও বটে এটি, প্রায় ২৫ কিলোমিটার লম্বা! কিন্তু এমন অনেক জায়গাই আছে শহরের যেখানে প্রশস্ততা যেন কষ্ট করে মাত্র এক কিলোমিটারে গিয়ে ঠেকেছে। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে আড়াইশ লোকের বাস ২৩৩ বর্গ কিলোমিটারের এ শহরে। তবে বিশ্বব্যাপী এর খ্যাতি হলো রসিকতা আর স্যাটায়ারের আন্তর্জাতিক রাজধানী নামে।
পাশের শহর সেভলিয়েভোর সাথে গ্যাব্রোভোর আছে এক ঐতিহ্যগত শত্রুতা। এটিও উত্তর বুলগেরিয়ার শহর, কিন্তু একইসাথে সে দেশের সবচেয়ে ধনবান শহরের একটি। ক্ষেত্রফলের দিক থেকে গ্যাব্রোভো থেকে অনেক ছোট, মাত্র ৪৭ বর্গ কিলোমিটার, কিন্তু প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৫১০ লোকের বাস। আর জনসংখ্যা চব্বিশ হাজার, গ্যাব্রোভোর এক-তৃতীয়াংশ। এ শহরের সাথে গ্যাব্রোভোর শত্রুতা নিয়েও রয়েছে অনেক কৌতুক।
দরদাম করা আর ব্যবসার কাজে গ্যাব্রোভোর মানুষদের কোনো জুড়ি নেই। তাদের রসিকতা ব্যবহার করেই বরং তারা খদ্দের বাড়ান আর ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নত রাখেন। ধীরে ধীরে গ্যাব্রোভোর অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে শহরের রসিকতার কাহিনীগুলোও ছড়িয়ে যেতে থাকে। গ্যাব্রোভোবাসীদের স্থানীয় ভাষায় নাম হলো গ্যাব্রোৎস্কি (Gabrovtsi)।
গ্যাব্রোভোবাসীদের নিয়ে প্রচলিত চুটকিগুলো শোনার পালা এখন:
- গ্যাব্রোভোবাসীরা নাকি এতই ব্যবসায় পারদর্শী যে দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তেই নতুন কোনো ব্যবসায়িক শিরোনাম আপনার চোখে পড়ুক না কেন, সেটা নিশ্চিতভাবেই আগে থেকেই গ্যাব্রোভোবাসীরা করে ফেলেছে।
- চিমনি পরিষ্কারের ঝামেলায় গ্যাব্রোভোবাসীরা যায় না। তারা কী করে জানেন? তারা বরং তাদের বিড়াল চিমনিতে ফেলে দেয় যেন চিমনি পরিষ্কার হয়ে যায়।
- গ্যাব্রোভোবাসীরা যে কৃপণ সেটা তো বিশ্ববিদিত। তাই বলে এতই কৃপণ যে, তারা তাদের ছুরিগুলো অনেক গরম করে রাখে যেন অতিথি এলে চা পানের সময় ছুরি দিয়ে মাখন মাখাতে না পারে।
- কামারের কাজ করবার সময় যেমন ঘামা হয়, গ্যাব্রোভোবাসীরা ব্যবসার দরদাম করবার সময় সেরকমই ঘামে।
- গ্যাব্রোভোবাসীরা গাধাদের পরায় সবুজ কাচের চশমা। কেন জানেন? যেন, গাধাগুলো ঘাস মনে করে খড়ই খেয়ে ফেলে।
- ঘড়ি যেন তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে না যায় সেজন্য তারা ঘুমুতে যাবার আগে রাতের বেলায় ঘড়ি বন্ধ রাখে। ও হ্যাঁ, গ্যাব্রোভোবাসীরা কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ে সূর্যাস্তের পরপরই।
- ডিমের সাথে গ্যাব্রোভোবাসী নল লাগিয়ে রাখে যেন সুপ বানাবার জন্য ঠিক যতটুকু দরকার, ততটুকুই কুসুম বের করে আনা যায়। বাকিটা ব্যবহার করবে পরের বারের জন্য। আবার বিয়ার পরিবেশনের সময় তারা ডিমের খোলসে পরিবেশন করে, যেন নেশা না ধরে। নেশা ধরলে যে বিয়ার বেশি খরচ হবে!
- শীতের দিনে ভেতরের গরমটা বাঁচিয়ে রাখবার জন্য দরজা যত কম সময় খোলা যায় ততই ভাল। এজন্য গ্যাব্রোভোবাসীরা তাদের বিড়ালের লেজ কেটে দেয় যেন, বিড়াল বের হয়ে যাবার সময় দরজা তাড়াতাড়ি লাগিয়ে দেয়া যায়!
- এক গ্যাব্রোভোবাসী একদিন পার্টি দিল। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল যে, অনেক মানুষ এসে হাজির। অনেক বলতে ১৫ জন। কিন্তু সে আয়োজন করেছে মাত্র ১০ জনের। তো সে কী করবে এখন? দৌড়ে চলে গেল প্রতিবেশীর কাছে। গিয়ে বলল, “হেই! আমি তো বিশাল সমস্যায় পড়েছি! ১৫ জন অতিথি এসেছে, কিন্তু আমার কাছে তো আছে মাত্র ১০টি চেয়ার! তোমার কাছে কি অতিরিক্ত চেয়ার আছে?” উত্তরে প্রতিবেশী জানালো, “হ্যাঁ, আমার বাচ্চারা কলেজে গেছে, আমার এক জোড়া চেয়ার আছে যেগুলো এ মুহূর্তে ব্যবহার করছি না।” এটা শুনে সেই গ্যাব্রোভোবাসী বলে বসলো, “চমৎকার! আমি আমার বাসা থেকে পাঁচজন অতিথি তবে এখানেই পাঠিয়ে দিচ্ছি।“
- গ্যাব্রোভোবাসীরা কেন ফ্রিজ কেনে না? কারণ, তারা নিশ্চিত হতে পারে না যে ফ্রিজের দরজা লাগালে আসলেই ভেতরের আলো নিভেছে। ভেতরের আলো তারা কেন অপচয় করবে?
- গ্যাব্রোভোবাসীরা কেন বিয়েতে মোজা পরে নাচে? কারণ, তারা সেভলিয়েভো শহরের মিউজিক শোনে।
- কেন গ্যাব্রোভোবাসীরা বই পড়বার সময় বারবার ল্যাম্পের সুইচ অন ও অফ করে? কারণ, তারা পাতা উল্টাবার সময়টুকুতেও আলো জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ অপচয় করে না।
- চুলে কলপ লাগাবার জন্য গ্যাব্রোভোবাসীরা কী করে? তারা ব্যবহার করে হাঁড়ির নিচের কালো কালি আর সূর্যমুখীর তেল। এজন্য তাদের এক বোতল তেল কিনলেও কোনদিন ফুরোতে দেখা যায় না!
- যুদ্ধে বন্ধুত্ব হয়েছিল দুই সেনার। একজন আবার গ্যাব্রোভোবাসী। বহুদিন পর অন্য বন্ধু গ্যাব্রোভো দেখতে এলো, হলো দুই বন্ধুর মিলন। গ্যাব্রোভোবাসী বন্ধুটি শহর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো। এরপর খাবার সময় হলে এক রেস্টুরেন্টে ঢুকলো তারা। বন্ধুটিকে বসিয়ে গ্যাব্রোভোবাসী বলল, “বন্ধু, এখানে তুমি অনেক কম দামে খাবার পাবে। এক কাজ করো, খেয়ে ফেলো বরং, এই ফাঁকে আমি ঘর থেকে একটু পেটে কিছু দিয়ে আসি, কেমন?“
- ঘরের দরজা মেরামত করবার জন্য এক দৌড়ে পাশের বাড়ি থেকে ছেলেকে একটা হাতুড়ি নিয়ে আসতে বললো এক গ্যাব্রোভোবাসী। ছেলে পাশের বাড়িতে জিজ্ঞেস করলে তাকে মিথ্যে বলা হলো, কোনো হাতুড়ি নেই। ছেলে ফিরে এলে বাবা বললো, “কিপ্টের কিপ্টে লোকটা, জানতাম! থাক বাছা, চিলেকোঠা থেকে আমাদের হাতুড়িটাই নিয়ে আয় বরং!“
- এক গ্যাব্রোভোবাসীকে জিজ্ঞেস করছে একজন, “তোমরা তো জমজ দু’ভাই শুনেছি। তো, তোমাদের ছবি আছে একসাথে?” উত্তরে সে নিজের ছবি দেখালে ঐ লোকটি বলল, “কিন্তু এ তো মাত্র একজন!” তখন গ্যাব্রোভোবাসী বলল, “হ্যাঁ। দুজনেই দেখতে এক রকম। তাই একজনের ছবিই যথেষ্ট।”
- ছুটির দিনে এক গ্যাব্রোভোবাসী সুপের সাথে ডিম খেতে ইচ্ছে করলো। তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করল, “ডিম কতটুকু দেব?” তখন লোকটি উত্তর দিল, “আচ্ছা… আজ তো ছুটির দিন, এক কাজ করো, অর্ধেকটাই ডিমই না হয় দাও!“
এরকম শত শত চুটকি রয়েছে গ্যাব্রোভোবাসীদের। এদের খুব ছোট একটা অংশই GABROVO ANECDOTES নামের পুস্তিকা আকারে অনুবাদ হয়েছে ২০টিরও বেশি ভাষায় এবং ৪৩টি সংস্করণে। তবে অনেক কৌতুক আসলে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি প্রসঙ্গে হওয়ায় বহিরাগতরা ধরতে পারেন না।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গ্যাব্রোভোর সাংস্কৃতিক একটি কেন্দ্র হলো House of Humour and Satire বা রসিকতাবাস। এখানে আছে একটি জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি। এর মূল বক্তব্য হলো, “পৃথিবী এখনো টিকে আছে কারণ আজও পৃথিবী হাসে।” হাস্যরস নিয়ে নানা প্রতিযোগিতার আয়োজনও এখানে করা হয়, হয় নানা উৎসব।
আর্ট কালেকশনে আছে ৫১,৬২০টিরও বেশি চিত্র, এঁকেছেন ১৭৩টি দেশের ৯,০০০ এরও বেশি শিল্পী। এর মাঝে ২২,০০০ ক্যারিকেচার, ৩,০০০ স্যাটায়ারিকাল, ১,০০০ ছবি, ১,০০০ পেইন্টিং, ৯,৫০০ ছবি, ২০০ পোস্টার এবং ৩০০ এরও বেশি কার্নিভাল মুখোশ ও কস্টিউম রয়েছে। আর মিউজিয়ামের সংগ্রহে আছে লাইব্রেরি, যেখানে রয়েছে ২৫,০০০ বই এবং ৩৫টি ভাষার ১,০০০ খণ্ডের সাময়িকী। বেশিরভাগই মিউজিয়ামে দান করা হয়েছে। এই কেন্দ্রটি ১৯৭২ সালের ১ এপ্রিল বানানো হয়েছিল এক পুরাতন ট্যানারির জায়গায়। আর এ মিউজিয়ামের প্রতীক হলো গোলকাকৃতির পৃথিবীর ওপর বিড়ালের চোখ আর কান, যার মানে পৃথিবীর হাস্যরসগুলো ‘শোনা ও দেখা হচ্ছে’। উল্লেখ্য, গ্যাব্রোভোর মাস্কট হলো সেই বিড়াল।
মধ্যযুগের গ্যাব্রোভো মোটে ১০০ ঘরের এক গ্রাম ছিল। ১৮৭৮ সালে বুলগেরিয়া স্বাধীনতা লাভের আগেই অটোম্যান শাসনের সময়েই সেই ১৮৬০ সালে নগর হিসেবে পরিচিত পায় গ্যাব্রোভো। প্রতি বছরের ২১ মে যে সপ্তাহে পড়ে, সে সপ্তাহের শনিবার গ্যাব্রোভোতে রসিকতার কার্নিভাল বা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সারা শহরের রাস্তা জুড়ে সেদিন রঙ-বেরঙের পোশাক পরা মাস্কেটিয়ার, শামান, জিপসি ইত্যাদির দেখা মেলে। বলকান গানের তালে তালে মুখরিত থাকে গ্যাব্রোভো, সে এক দেখার মতো দৃশ্য!
এ কঠিন বাস্তবতার পৃথিবীতে এখনো হাস্যরসকে বুকে ধরে বেঁচে আছে বুলগেরিয়ার বুকে বলকান পর্বতমালার পাদদেশের গ্যাব্রোভো শহরটি!
ফিচার ইমেজ: Fest-bg.com