হান্ড্রেড ইয়ার্স ওয়্যার, বা শতবর্ষের লড়াই ইতিহাসের অন্যতম এক ঘটনা। ১৩৩৭ সাল থেকে আরম্ভ হয়ে ১৪৫৩ সাল অবধি প্রতিবেশী ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে চলে সশস্ত্র এই সংঘর্ষ, যা একশো বছরের কিছু বেশি সময়। তবে পুরোটা সময় অবিচ্ছিন্নভাবে লড়াই হয়নি, বরং মাঝে বেশ কয়েকবারই লম্বা সময়ের জন্য অস্ত্রবিরতি চলেছিল। আবার একটি নির্দিষ্ট কারণ থেকেও এর উৎপত্তি নয়, বরং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে দুই পক্ষ জড়িয়ে পড়ে শক্তি পরীক্ষায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে শতবর্ষের যুদ্ধ বলা হয় কেন? এটা আসলে আধুনিক গবেষকদের থেকে উদ্ভূত। ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী লড়াই বিশ্লেষণের সুবিধার জন্যই তারা সম্পূর্ণ সংঘাতকে একসূত্রে গেঁথেছেন।
প্রাথমিকভাবে কেন শুরু হয়েছিল যুদ্ধ? মনে রাখতে হবে, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখনও ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়নি ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স, বরং ইউরোপীয় পরাশক্তি হিসেবে কেবল মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে তারা। ইংলিশ চ্যানেলের এপাশ-ওপাশ জুড়ে দু’পক্ষই চেষ্টা করছে সাম্রাজ্য বিস্তারের। তবে সংঘাতের শেকড় খুঁজতে হয়তো আরো কিছুটা পেছনে যেতে হবে, চোখ রাখতে হবে নরম্যান্ডিতে।
আজকের নরম্যান্ডি ফ্রান্সের অংশ বটে, তবে হাজার বছর আগে তো আর এমন ছিল না। ফ্রান্সের পূর্বসূরি রাজ্যের রাজারা ভাইকিংদের উৎপাত থেকে বাঁচতে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছিলেন এই অঞ্চল। ভাইকিংদের স্থানীয়দের বলতো নর্থম্যান, যা ধীরে ধীরে বিকৃত হয়ে পরিণত হয় নরম্যানে। সেই অনুসারে অঞ্চলটি পরিচিতি পেয়ে যায় নরম্যান্ডি নামে।
নরম্যান্ডির শাসক পেতেন ডিউক উপাধি। স্বায়ত্তশাসিত হলেও রীতি অনুযায়ী তাদের প্রতিবেশী শক্তি ফ্রান্সের রাজার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে চলতে হতো। এখানকার এক ডিউক, উইলিয়াম দ্য কঙ্কারার ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসরের মৃত্যুর পর সেখানকার সিংহাসন দাবি করেন। ১০৬৬ সালে ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসে প্রতিদ্বন্দ্বী হ্যারল্ডকে পরাস্ত করে ইংল্যান্ডের মুকুট পরেন তিনি, পত্তন হয় নরম্যান শাসনের।
উইলিয়াম থেকে তার পরবর্তী শাসকেরা ইংল্যান্ডের মাটিতে সার্বভৌম রাজা হলেও সাগর পাড়ি দিয়ে নরম্যান্ডিতে পা রাখা মাত্র ডিউক হিসেবে পরিণত হতেন ফ্রান্সের রাজার আজ্ঞাবহে। এই নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা তো ছিলই। তার উপরে ১৩০৩ সালে প্যারিসের দ্বিতীয় চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের রাজপরিবারের মধ্যে বিয়ের ফলে ফ্রান্সের সিংহাসনে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের দাবি তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ১৩২৮ সালে ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ চার্লসের মৃত্যুর পর ঠিক সেরকম পরিস্থিতিই দেখা দেয়। ইংল্যান্ডের তৃতীয় এডওয়ার্ডের দাবি উপেক্ষা করে ফরাসিরা মৃত রাজার আত্মীয় ভ্যালোইস বংশের ডিউক দ্বিতীয় ফিলিপকে রাজা নির্বাচিত করেন।
ফিলিপ এবং এডওয়ার্ডের মধ্যকার উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত গড়ায় যুদ্ধে। দুই পক্ষ বেশ কিছু ইতিহাসখ্যাত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। উল্লেখযোগ্য ছিল ব্যাটল অব ক্রেসি, পয়তিয়ের্স, এজিনকোর্ট, ফর্মিওন, ক্যাস্টিলিয়ন ইত্যাদি। আর দুই পক্ষের ছোট ছোট দলের মধ্যে সংঘর্ষ তো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
মোটমাট চার ধাপে লড়াই চলে বলা যায়। প্রথম ধাপ শেষ হয় ১৩৫৮ সালে লন্ডনের দ্বিতীয় চুক্তির মধ্য দিয়ে। পয়তিয়ের্সের যুদ্ধে আটক ফরাসি রাজা জনকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে চুক্তিতে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল ইংল্যান্ড। তবে পরবর্তীতে চুক্তির অনেক ধারা বাস্তবায়নেই গড়িমসি করে ফরাসিরা, ফলশ্রুতিতে শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধ।
১৩৮৯ সালে লিউলিঙ্ঘেমে স্বাক্ষরিত অস্ত্রবিরতি যতি টানে দ্বিতীয় ধাপের। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড তখন উসমানি সাম্রাজ্যের সাথে ক্রুসেডে জড়িয়ে পড়তে আগ্রহী, ফলে নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি আপাতত বন্ধ করে তারা। তবে নিকোপোলিসে তুর্কিদের হাতে নাকাল হবার পর ধীরে ধীরে আবার উত্তেজনা শুরু হয় তাদের ভেতর। সময়ের পরিক্রমায় ইংল্যান্ডের শাসনভার দখল করে নেন পঞ্চম হেনরি, শেক্সপিয়ার যাকে অমর করে রেখেছেন হেনরি দ্য ফিফথ নামে। এজিনকোর্টে ফরাসিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন হেনরি, এরপর ট্রিটি অব ট্রয়েসের মাধ্যমে ফ্রান্সের সিংহভাগ এলাকা চলে আসে ইংল্যান্ডের অধীনে।
তবে যুবরাজ চার্লস প্রতিরোধ চালিয়ে যান। তবে হেনরির মৃত্যুর পরেও সুবিধে করে উঠতে পারছিলেন না তিনি, উল্টো তার শক্ত ঘাঁটি অর্লিয়েন্স অবরোধ করে বসে ব্রিটিশ বাহিনী। পরাজয় যখন চোখ রাঙাচ্ছে তখন অপ্রত্যাশিতভাবে ফরাসিদের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন লরেইনের কৃষক পরিবারের এক কিশোরী মেয়ে। ফরাসিরা তার নাম দেয় মেইড অব অর্লিয়েন্স, আর ব্রিটিশরা উইচ অব অর্লিয়েন্স। তবে আমরা তাকে চিনি জোয়ান অব আর্ক নামে।
জোয়ানের সাথে সাথেই আরম্ভ হয় চতুর্থ ধাপের লড়াই। নববলে বলীয়ান ফরাসিরা একের পর এক এলাকা ফিরিয়ে নিতে থাকে। জোয়ানের বন্দিত্ব ও হত্যার পরেও বজায় থাকে তাদের জয়রথ। চার্লস দ্রুতই নিজেকে ফ্রান্সের অবিসংবাদিত রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। তবে ইংল্যান্ড লড়াই চালিয়ে যায় আরো বহু বছর। শেষ পর্যন্ত ১৪৫৩ সালে ক্যাস্টিলিয়নে পতন হয় তাদের প্রধান সেনাপতি ট্যালবটের, বিশাল এক পরাজয়ের পর ফ্রান্সের বেশিরভাগ এলাকা ছেড়ে আসতে বাধ্য হয় তারা।
ক্যাস্টিলিয়নের পর বড় আকারের সংঘাত থেমে যায়। ফরাসিরা মনোযোগ দেয় ফিরিয়ে নেয়া এলাকায় নিজেদের আধিপত্য শক্ত করতে। ওদিকে ইংল্যান্ডের সিংহাসন নিয়ে ইয়র্ক আর ল্যাঙ্কাস্টার বংশের মধ্যে দুই বছরের মাথায় আরম্ভ হয়ে যায় ওয়্যার অব দ্য রোজেস । ফলে আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তি আর হয়নি, তবে পরবর্তী বছরগুলোতে দুই পক্ষ নিজেদের বিবাদ আলোচনার মধ্যে মীমাংসা করে নেয়।
শতবর্ষের যুদ্ধে সামরিক ইতিহাসেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাল-তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ চলছিল, এর মধ্যে ব্রিটিশরা নিয়ে আসে তাদের এলিট তীরন্দাজ বাহিনী বা লংবোম্যানদের। এই তীরন্দাজদের কারণে বেশ কয়েকটি বড় বড় পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয় ফরাসি নাইটদের। তাদের গর্বের জায়গা ছিল অশ্বারোহী, আর সেই অশ্বারোহীদের বাহন প্রায়ই পরিণত হতো তীরের লক্ষ্যে। পাশাপাশি বর্মের ফাঁকফোকর দিয়ে তীর ঢুকেও হতাহত হতে থাকে নাইটরা। এজিনকোর্টে হেনরির সাফল্যের পেছনে তীরন্দাজদের ভূমিকা কম নয়।
তবে যুদ্ধ যত গড়াতে থাকে, সামরিক প্রযুক্তিও উন্নত হতে থাকে, চালু হয় বারুদের ব্যবহার। এক্ষেত্রে ফরাসিরা ব্রিটিশদের থেকে দ্রুত কামানের ব্যবহার আয়ত্ত করে ফেলে, ফলে তীরন্দাজ বাহিনীর কার্যকারিতা কমে যায় একেবারেই। কামান মেরে ব্রিটিশ বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ফেলে ফরাসিরা। মূলত শতবর্ষের যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে তাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল ফরাসিদের উন্নত ও দক্ষ আর্টিলারি।
শতবর্ষের যুদ্ধ অত্যন্ত ঘটনাবহুল, এবং ইতিহাসের বহু রথী-মহারথী জড়িয়ে আছেন এর সাথে। স্বল্প সময়ে এর বিশদ বিবরণ সম্ভব নয়। আগ্রহীরা চাইলে আসন্ন বইমেলায় আফসার ব্রাদার্স থেকে দুই খন্ডে প্রকাশিতব্য শতবর্ষের যুদ্ধের সম্পূর্ণ ইতিহাস বইটি পড়ে দেখতে পারেন।