অনুমান করা হয়, সিন্ধু সভ্যতার কালপর্ব খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০ অব্দ থেকে শুরু হয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে বিস্তৃতি সাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতভেদ থাকলেও, তা সিন্ধু সভ্যতার অন্যান্য বিষয়কে তেমন প্রভাবিত করছে না। প্রাগৈতিহাসিক এই সভ্যতার কেন্দ্রস্থল ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চলের সিন্ধু অববাহিকায়। পরবর্তীতে তা বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘগ্গর নদী উপত্যকায়। ভাঙা-গড়া এবং উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে চলা সিন্ধু সভ্যতায় বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য শহর ও নগর নিয়েই এই আয়োজন।
কোট-দিজি, আম্রি এবং সোথি-সিওয়াল
আনুমানিক প্রায় ৩,৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই শহর এবং নগরগুলো গড়ে উঠেছিল হরপ্পা সভ্যতার প্রস্তুতিকালের পূর্বে। সেজন্য এগুলো প্রাক-হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত। সিন্ধু সভ্যতায় কোট-দিজি, আম্রি এবং সোথি-সিওয়াল সভ্যতার প্রভাব নিয়ে অতি অল্প সংখ্যক বিশেষজ্ঞ গবেষণা করেছেন। বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার সমগ্র অংশ- উত্তরে পোর্টওয়ার মালভূমি থেকে দক্ষিণে আম্রি পর্যন্ত পুরোটাতেই ছিল মানুষের বসবাস। কোট-দিজিয়ানের বসতি-পূর্ণ এলাকা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। কোট-দিজির শিল্পসামগ্রী ছড়িয়ে পড়েছিল বিশাল অঞ্চল জুড়ে। তাই খননকার্যে বহু কোট-দিজিয়ান মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই সংস্কৃতিতে তামাকের প্রচলন ছিল অধিক। তারা পোড়া ইটের ব্যবহার জানতো বলে ধারণা করা হয়। ইট গাঁথার পদ্ধতি হরপ্পীয় রীতির মতো লাগলেও, তাদের তৈরি দেওয়াল মহেঞ্জোদাড়োর মতো অতটা পুরু নয়।
সিন্ধু সভ্যতার অন্যান্য প্রত্নস্থানের মতো এখানেও পোড়ামাটির চাকাওয়ালা খেলনা গাড়ি পাওয়া গেছে। সন্ধান মিলেছে সরু পা, স্ফীত বক্ষদেশ এবং ফাঁপা কেশবিন্যাসসমেত পোড়ামাটির নারীমূর্তি। তারা বাটালি, হাতুড়ি ব্যবহার করে শৌখিন পণ্য উৎপাদন করত। হস্তশিল্পের প্রসারের পাশাপাশি এখানে বুনন-ধর্মী শিল্পকর্মেরও প্রমাণ মিলে গুনসুচের মাধ্যমে। এই অঞ্চলগুলোর মানুষের জীবিকা ছিল কৃষির উপর নির্ভরশীল।
লোথাল
সিন্ধু সভ্যতার সময়কার এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে ‘লোথাল’। লোথালের অবস্থান ছিল গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের সবরমতীর উপনদী ভোগাবোর উপত্যকায়। প্রাচীন বন্দর হিসেবে অতীতে লোথাল বন্দরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। লোথাল গুজরাটের প্রাচীন কাম্বে এবং বর্তমানে খাম্বাটের সন্নিকটে অবস্থিত। এর কাছাকাছি নাল সরোবর নামে একটি জলাভূমি অবস্থিত। ধারণা করা হয়, কাম্বে উপসাগর থেকে একটি খাঁড়ি মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করত। সেখান থেকে লোথালে প্রবেশের একটি জলপথ ছিল। কেন্দ্রটি পুরনো একটি নদীখাতে অবস্থিত। এই নদীখাতকে ঘিরে একটি শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। কেন্দ্রের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলকে অ্যাক্রোপলিস বলা হচ্ছে, আর বাকি অংশটুকু হলো নিম্ন-শহর। শহরের শাসকরা অ্যাক্রোপলিসে বাস করতেন। এখানে পাকা স্নানাগার, নোংরা জল ও ময়লা নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা, পানীয় জলের কূপ, গুদামঘর অবস্থিত ছিল।
নিম্ন শহর দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা। এখানে ধনী, সাধারণ ব্যবসায়ী এবং কারিগরেরা বাস করত। এখানে সন্ধানে মিলেছে একাধিক পাকা সড়কের। একসময় সিন্ধু সভ্যতার বণিকদের কোলাহলে মুখরিত থাকত এই স্থান। লোথালের প্রত্নক্ষেত্র থেকে আবিষ্কার করা পোড়ানো ইটের তৈরি ঘরবাড়িগুলো বেশ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। একটি বাড়ির ঘর থেকে একটি শঙ্খ, পাথরের শিল, একটি নোড়া উদ্ধার করা গেছে। ধারণা অনুযায়ী, এখানে পুঁতি তৈরির কারখানাও ছিল। এখানের এক বাড়িতে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সন্ধান পাওয়া গেছে। নোংরা জল বাইরের জালায় গিয়ে পড়ার ব্যবস্থাও ছিল। লোথাল ব্যবহৃত হতো উপ-বন্দর হিসেবে। বন্দর হিসেবে লোথালের আয়তন ছিল অনেক ছোট। পুরো শহরকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল কাদামাটির ইট দ্বারা নির্মিত প্রাচীর। লোথাল বন্দরের কাহিনী মৌর্য যুগের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক আলোচনায় খুঁজে পাওয়া যায়।
মহেঞ্জোদারো
তাম্রযুগে দক্ষিণ এশিয়ায় গড়ে উঠে সুপরিকল্পিত নগরী ‘মহেঞ্জোদারো’। ধারণা করা হয়, এটি ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র। এই শহরের নগর পরিকল্পনা ও প্রকৌশলের কাঠামোর কথা বিবেচনা করলে, তা তৎকালীন বিশ্বের যেকোনো শহরকে টেক্কা দেওয়া ক্ষমতা রাখত। মহেঞ্জোদারোতে ছিল বিশাল এক শস্যাগার। গম আর যব ছিল এখানকার প্রধান কৃষিজ ফসল। গ্রামাঞ্চল থেকে গরুর গাড়িতে করে শস্য এনে এই শস্যভাণ্ডারে তা সংরক্ষণ করে রাখা হতো। খাদ্যশস্য যেন অনেকদিন পর্যন্ত ভালো অবস্থায় থাকে, সেজন্য শস্যভাণ্ডারে বাতাস চলাচলের জন্যও উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল।
মহাশস্যাগারের পাশাপাশি এখানে বিশাল এক স্নানাগারের অস্তিত্ব ছিল। বাড়িঘর নির্মাণ করা হতো পোড়া মাটির ইট দিয়ে এবং অধিকাংশই ছিল দোতলা। বৃহৎ স্নানাগারের পাশাপাশি কয়েকটি বাড়িতে নিজস্ব স্নানাগারও ছিল। মহেঞ্জোদাড়োর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল বর্তমানের মতো আধুনিক। প্রত্যেক বাড়ির ময়লা যাতে শহরের নর্দমায় গিয়ে মিলিত হতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হয়েছিল তখন। এখানকার বাসিন্দারা বিভিন্ন রকমের অলঙ্কার যেমন, গলার হার, কানের দুল, আংটি, হাতের ব্রেসলেট ইত্যাদি পরিধান করত।
হরপ্পা
বর্তমান পাঞ্জাব প্রদেশের ইরাবতী নদীর তীরে গড়ে উঠা সমৃদ্ধ নগরী হরপ্পা ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রধান রাজধানী। এর স্থায়িত্বকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ অব্দ থেকে ১৯০০ অব্দ পর্যন্ত। প্রাচীন হরপ্পাবাসীর দেহগত নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সাথে দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়দের বেশ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ১৫০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই হরপ্পা নগরীতে আধুনিক নগর ব্যবস্থার যাবতীয় উপাদান ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পরিকল্পিত রাস্তাঘাট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে গৃহনির্মাণ কৌশলেও উন্নত নগর ব্যবস্থা নির্মাণেও তাদের জুড়ি মেলা ভার ছিল।
এছাড়াও এখানে ছিল বাজার, বড় বড় ভবন, কৃষি খামার এবং গো-চারণ ভূমি। সড়ক ব্যবস্থাতেও প্রভূত উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। রাস্তার পাশে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে সড়ক বাতির পাশাপাশি শহরের প্রধান রাস্তাগুলোর পাশে মূল নর্দমাগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। শাসক এবং তাদের পরিবারের লোকজন উচ্চ শহরে এবং সাধারণ মানুষেরা নিম্ন শহরে বাস করতেন।
তখনকার বাড়িগুলো নির্মাণ করা হতো পলিমাটির তৈরি ইট আর কাঠ-নলখাগড়ার উপকরণ দিয়ে। তারা প্রতিরক্ষাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিত বলে গড়ে তুলেছিল প্রাচীর। প্রাচীরের সামনে আবার খনন করা হয়েছিল গভীর পরিখা। হরপ্পাবাসীরা তাদের উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণের জন্য বিশাল শস্য-সংরক্ষণাগার গড়ে তুলেছিল। তারা মৃৎশিল্পেও দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। শুধু কৃষির উপর নির্ভরশীল না থেকে তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কও গড়ে তুলেছিল। বাণিজ্যের জন্য তারা স্থল, নৌ ও সমুদ্রপথ ব্যবহার করত। স্থলপথে একস্থান থেকে অন্যস্থানে মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য চাকাযুক্ত পশু টানা গাড়ি ব্যবহার করা হতো।
কালিবাঙ্গান
উত্তর রাজস্থানে ঘগ্গরের শুষ্ক তটে অবস্থিত প্রত্নস্থল কালিবাঙ্গান প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সাংস্কৃতিক প্রবাহের অন্যতম প্রধান অংশ বলে বিবেচিত। বর্তমান ধ্বংসস্তূপ সংস্কার করে শহরটিকে পুননির্মিত করা হয়েছে। আকারে ছোট এই শহরটি ছিল ১১.৫ হেক্টর ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। হলকর্ষণের রেখা একে পরিণত সভ্যতা বলেই প্রমাণ করে। কালিবাঙ্গানের জমিতে সমান দূরত্ব বজায় রেখে আড়াআড়িভাবে লাঙল দিয়ে হলকর্ষণসহ শস্য বপনের প্রমাণ মিলেছে। এছাড়াও মিলেছে তন্দুরসহ অন্যান্য চুল্লির অস্তিত্ব। তাই বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভারতে রুটি নির্মাণের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীনকালে এখানে প্রাচীরবেষ্টিত একটি নিম্ন শহর, দুই অংশে বিভক্ত একটি অ্যাক্রোপলিস, দুটি সুপরিকল্পিত সরণি এবং প্রায় ১.৮ মিটার প্রশস্তের একটি গলিপথ ছিল। তবে এই নগরীতে পোড়ামাটির ব্যবহার খুবই বিরল। বসবাসের জন্য নির্মিত গৃহগুলো ছিল কাদামাটির ইট দ্বারা তৈরি এবং প্রশস্ত আঙ্গিনা দ্বারা বেষ্টিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী, এখানে মানব বসতির দুটি পর্যায় চিহ্নিত করা গেছে। প্রথম পর্যায়ে বড় মাপের ইট ব্যবহার করা হলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে ইটের আয়তন হয়ে গিয়েছিল আগের চেয়ে ক্ষুদ্র। দেওয়ালগুলো তৈরি করা হয়েছিল কাচা ইট দিয়ে। দেওয়ালের ভেতর এবং বাইরের দিকে মাটির প্রলেপ দিয়ে দেওয়া হতো। এখানে শৌচাগার ছিল। তবে এর অবস্থান ছিল গৃহ থেকে দূরে। কূপের সংখ্যা মহেঞ্জোদারো বা হরপ্পার তুলনায় কম। মূলত তিন ধরনের সমাধির রীতি চালু ছিল সেসময়। ডিম্বাকৃতির সমাধিক্ষেত্রে মানুষের মৃতদেহ তার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। বাকি দুই প্রকার ছিল গোলাকৃতির এবং চতুষ্কোণাকৃতির।
সুরকোটাডা
একে খুব বড় ধরনের প্রত্নক্ষেত্র বলে বিবেচনা করা হয়নি। সুরকোটাডার কচ্ছের ভুজ থেকে ১৬০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এই কেন্দ্র খুব বিশাল ছিল না। সম্ভাব্য আয়তন হিসেবে ১৬০×১২৫ মিটার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীনকালে এখানে একটি নদী ছিল, কাল-পরিক্রমায় যা এখন এক নালায় পরিণত হয়েছে। ধারণা করা হয়, এখানে বসতি গড়ে উঠেছিল মোট তিনটি পর্যায়ে। ঘরবাড়িগুলো ছিল খুব সাধারণ পর্যায়ের। কালিবাঙ্গানের পশ্চিম অঞ্চলের নগর পরিকল্পনার সঙ্গে এখানকার বসতি ও নগর পরিকল্পনার একটা সাদৃশ্য আছে। এই নগরীর আয়ুষ্কাল প্রায় ছয়শ বছর। সুরকোটাডা ও নাগওয়াদায় বিভিন্ন সমাধিস্থল ঘেঁটে মানবদেহের খণ্ডাংশ উদ্ধার করা হয়েছে। একে ধর্মীয় সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ বলে বিবেচনা করা হয়, পরবর্তী সময়ে যা সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
সাহরি সোকতা
প্রাচীন হরপ্পীয় নগর সাহরি সোকতার অবস্থান ছিল ভারত থেকে খানিকটা দূরে, আফগানিস্তানের সন্নিকটে। প্রায় ৩,২০০ বছর পূর্বে গড়ে উঠা এই নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার তুর্কমেনিস্তান ও কান্দাহারের যোগাযোগ ছিল। সাহরি সোকতায় তৈরি সিলমোহরের সঙ্গে তুর্কমেনিস্তানের সিলমোহরের প্রভূত মিল পাওয়া যায়। তাই ধারণা করা হয়, এখানে অবস্থিত ক্ষুদ্র নদী অববাহিকা ধরে সভ্যতা বিকাশের অংশ হিসেবে দুই প্রাচীন সভ্যতার মাঝে এক বাণিজ্যিক সমঝোতা গড়ে উঠেছিল। ১৫০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই নগরী ছিল পুঁতি নির্মাণের জন্য প্রসিদ্ধ। পুঁতি ছাড়াও লাপিস-লাজেলির ওপর এদের বেশ ঝোঁক ছিল। কান্দাহারের চারপাশের অঞ্চলের সাথে সাহরি সোকতার পাহাড়ি এলাকাকে যুক্ত করতে পায়ে চলা প্রাচীন এক গ্রাম্য পথ গড়ে ওঠে, যা ছিল পশুপালকদের চলাচলের অন্যতম মাধ্যম।
উত্তর-বেলুচিস্তানে পাতলা ধার বিশিষ্ট চিত্রিত মৃৎশিল্পের সাথে তুর্কমেনিস্তান, সিস্তান ও কান্দাহার অঞ্চলের সিরামিকের মিল লক্ষ্য করা গেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের দিকে মৃৎশিল্পে উন্নতির ছোঁয়া লেগেছিল দ্রুত ঘূর্ণায়মান চাকা ব্যবহারের কারণে। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান থেকে প্রায় ৫০-১০০টির মতো ভাঁটি পাওয়া গেছে। উদ্ধারকৃত অস্থি থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে এখানকার বাসিন্দারা ভেড়া, ছাগল পালনের সাথে জড়িত ছিল। এখানে উৎপন্ন হতো বার্লি আর গম। ফল-ফলাদির মধ্যে তরমুজ ও আঙুর উল্লেখযোগ্য। শস্যদানা পেষাই করার জন্য পাথরের ঘূর্ণি ছিল। বাড়িতে ছিল আগুনের চুল্লি। বলদে টানা গাড়ির জোয়ালের অংশবিশেষের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে এখানে।
ইনামগাঁও
মহারাষ্ট্রের পুনা জেলার ঘোড় নদীর তীরে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ অব্দে দিকে পাললিক ভূমিতে বিকাশ ঘটে এক সভ্যতার। সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের এই নগরী অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত সেচ ব্যবস্থার সুবিধা থাকায় এখানে ধান, গম, যব, মসুর ইত্যাদি শস্যের চাষ হতো। বসতবাড়িতে শস্য রাখার ব্যবস্থা ছিল। সেচপ্রণালী দৈর্ঘ্যে ছিল ৪২০ মিটার এবং প্রস্থে ৬ মিটার।
সেচ প্রণালীটি উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী হয়ে সম্ভবত নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এখানে মাটির জালার পাশাপাশি গোলাতেও শস্য রাখা হতো। ইঁদুর যাতে শস্যদানা নষ্ট করতে না পারে, সে ব্যবস্থাও তারা করে রেখেছিল। এখানে যে-কয়টা বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে, তা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির অধিকারে ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা পুরোহিত হতে পারেন। তখনকার বাসিন্দাদের দানকৃত প্রাপ্ত সম্পদ তিনি ওসব ভবনে সংরক্ষণ করে রাখতেন।
ধোলাভিরা
কচ্ছের নিকট অবস্থিত এই প্রত্নস্থলটি প্রায় ১০০ হেক্টর জমির উপর দাঁড়িয়ে। নগরের মূল অংশের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৬৫০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৮০০ মিটার। পুরো অঞ্চলটি দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। ধোলাভিরাকে পুরোপুরি খনন করা সম্ভব হয়নি বিধায় বিশেষজ্ঞরা অনেক বিষয় অনুমানের উপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য চিত্র দাঁড় করিয়েছেন। ধোলাভিরার অনেক অঞ্চল অপেক্ষাকৃত নিচু। মূল দুর্গটির অবস্থান মাটি থেকে প্রায় ১৮ ফুট উঁচুতে। নিচের অংশে সাধারণ মানুষজন বসবাস করত। নগর দেওয়ালের ভিতরে প্রশস্ত খোলা জায়গার অস্তিত্ব ছিল। এখানে বৃহৎ এক কক্ষের সন্ধান মিলেছে, যেটাতে ডমরু-সদৃশ এক প্রস্তরখণ্ড পাওয়া গেছে।
কক্ষটির পাশে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। পাথরের উপর খোদাই করা লিপি চিহ্নের খোঁজ পাওয়া গেছে এখানে। এগুলো কোনো না কোনো ফলকের উপর বসানো ছিল। ধোলাভিরা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কথা বললে, এতে ‘উচ্চ’, ‘মধ্যম’ এবং ‘নিচ’– এই তিন স্তরের নগর পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, যা অন্যসকল প্রত্নস্থলে অনুপস্থিত। এছাড়াও নগর প্রাকারের ভিতর খোলা জায়গা, এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা একে অন্যান্য প্রত্নস্থল থেকে অনন্য করে তুলেছে।