মাদমোজেল ব্লাশ মন্যিয়ের: অন্ধকার কামরায় বন্দী ২৫ বছর

যদি প্রশ্ন করা হয়, মানুষের সবথেকে কাছের, নিরাপদ আশ্রয় কী? সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আমরা কোথায়, কাদের কাছে গিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারি? এ প্রশ্নের উত্তরে সাধারণত মানুষ তার পরিবারের কথাই বলবে- মাতা, পিতা, ভাই-বোন। বিশেষ করে মায়ের কোলের চেয়ে উষ্ণতর আশ্রয়ের নাম কি জানা আছে কারও? তবে অনেকের ভাগ্যে এই সুযোগ মেলে না, অনেকেই হয়তো পরিবারের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত, কারো হয়ত সেই পরিবার থেকেও নেই।

আবার কারো কারো বেলায় সেই পরিবারই সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সেই চরম হতভাগ্যদের একজন হলেন ব্লাশ মন্যিয়ের।

ব্লাশ মন্যিয়ের; Source: wordpress.com

হারিয়ে যান ব্লাশ

সময়টা তখন ১৮৭৬ সাল। ফ্রান্সের পইতিয়েরস শহরের অন্যতম সম্ভ্রান্ত এক পরিবারের সন্তান ছিলেন মাদমোজেল ব্লাশ মন্যিয়ের। রূপবতী এবং গুণী ২৫ বছর বয়সী ব্লাশের জন্য তখন বিবাহযোগ্য পাত্র খোঁজা হচ্ছিল। বনেদি পরিবারের মেয়ে বলে কথা, দূর-দূরান্ত থেকে ব্লাশের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে এগিয়ে এসেছিল অনেকেই।

কিন্তু এরই মাঝে, হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যান ব্লাশ। গোটা ফ্রান্স তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। হঠাৎ যেন হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যান এই তরুণী। ব্লাশের জন্য শোকে কাতর হন তার মা, ভাই।

কিন্তু কোনো সূত্র ছাড়া আর কতদিনই বা খোঁজ চালিয়ে যাওয়া যায়? একপর্যায়ে তাকে ফিরে পাবার আশাই ছেড়ে দেয় মানুষ। সকলে তাদের নিত্যদিনের জীবনে ফিরে যায়, ভুলে যায় ব্লাশকে।

সেই রহস্যময় চিঠি; Source: altereddimension.net

একটি রহস্যময় চিঠি

তারপর দিন পেরিয়ে মাস হলো, মাস পেরিয়ে বছর, বছর পেরিয়ে যুগ– সময় স্রোতের মতোই বয়ে চললো। আর দেখতে দেখতে পঁচিশটা বছর কেটে গেল। ততদিইনে ব্লাশ মন্যিয়ের বলে যে কেউ এককালে ছিলেন, সে কথাই ভুলে গেছে মানুষ। এমনই সময় এই অস্তিত্বহীন মানুষটির খোঁজ পাওয়া গেল, তাও আবার একটি উড়োচিঠির মাধ্যমে।

১৯০১ সালের এক সকালে ফ্রান্সের অ্যাটোর্নি জেনারেলের অফিসে একটি চিঠি এসে পৌঁছায়। সে চিঠিতে প্রেরকের নাম বা ঠিকানা, কোনোটাই দেয়া ছিলো না। সংক্ষিপ্ত এই চিঠির প্রথম কয়েকটা লাইন পড়েই আঁতকে উঠার উপক্রম হয় উপস্থিত মানুষের। চিঠিটার শুরুটা হল এরকম-

“Monsieur Attorney General: I have the honor to inform you of an exceptionally serious occurrence. I speak of a spinster who is locked up in Madame Monnier’s house, half starved, and living on a putrid litter for the past twenty-five years – in a word, in her own filth.”

যার অর্থ দাঁড়ায়-

“মস্যিয়ে অ্যাটোর্নি জেনারেল: আপনাকে একটি অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা সম্পর্কে অবগত করার সুযোগ আমার হয়েছে । আমি এমনই এক তরুণীর কথা বলছি, যে কিনা মাদাম মন্যিয়ের এর বাড়িতে গত ২৫ বছর ধরে বন্দী আছে। অনাহারে থাকা এই কুমারী এতকাল ধরে এক কথায় নিজের বিষ্ঠার মাঝে বাস করছে।”

চিঠিটা পড়ার পর অধিকাংশই বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ মন্যিয়ের পরিবার ছিল ফ্রান্সের সবচেয়ে বনেদি পরিবারগুলোর অন্যতম। পইতিয়েরস শহরের উন্নয়নের জন্য প্রচুর অনুদান দেন স্বয়ং মাদাম মন্যিয়ের নিজে। তাদের দ্বারা এহেন ভয়ংকর কাজ কীভাবে সম্ভব!

তবুও সন্দেহ দূর করতে যখন কর্তৃপক্ষ মন্যিয়ের বাড়িতে পরিদর্শনের জন্য আসে, তখনো তারা জানত না যে তারা কী এক ভয়াবহতা আবিষ্কার করতে যাচ্ছে।

পত্রিকায় ব্লাশের করুণ অবস্থার সংবাদ; Source: mandatory.com

২৫ বছর, একটি কামরা এবং হাড্ডিসার এক নারী

মন্যিয়ের এস্টেটে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমেই তাদের বাধা দেয়া হয়, এতে তাদের সন্দেহ বাড়লে কয়েকজন অফিসার জোরপূর্বক বাড়িতে প্রবেশ করেন। খুঁজতে খুঁজতে তারা উপরতলায় চলে আসলে একটি তালাবদ্ধ ঘর তাদের নজরে আসে। ভেতরে হয়তো কোনো মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীকে আটকে রাখা হয়েছে- এরূপ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তারা দরজার তালা ভেঙ্গে সেই বদ্ধ ঘরে প্রবেশ করেন।

ঘুটঘুটে অন্ধকার এবং দুর্গন্ধযুক্ত ঘরটিতে প্রবেশ করে তারা প্রথমেই ঘরটির জানালা খোলার ব্যবস্থা নেন। কিন্তু কাজটা বেশ কঠিন ছিল, কারণ জানালার গাঢ় পর্দাগুলো ছিলো ধূলোয় ধূসরিত এবং প্রচন্ড ভারি, যেন গত ২৫ বছরে একবারও পর্দাগুলো সরানো হয়নি। পর্দা সরানোর পর জানালার শাটার খোলার সময় দেখা গেল যে সেগুলো ঠিকভাবে খুলছে না, একপর্যায়ে শাটারের প্রতিটি পাত আলাদা করে খোলার ব্যবস্থা করতে হয়। অবশেষে যখন জানালা দিয়ে সূর্যালোক অন্ধকার ঘরটিতে প্রবেশ করলো, তখন ঘরটির আসল চেহারা দেখে শিউরে উঠে উপস্থিত সবাই।

ঘরের এক কোণায় বিছানার উপরে, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়, ভয়ে কাঁপছে অত্যন্ত শীর্ণ দেহের এক নারী।

নষ্ট হয়ে যাওয়া জাজিমের উপর শুয়ে থাকা এ নারীর সারা দেহ ছিল বিষ্ঠা এবং পচে যাওয়া খাবারে মাখা, বিছানার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পোকামাকড় এবং খাবারের উচ্ছিষ্ট।

তিনিই ২৫ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সেই নারী, ব্লাশ মন্যিয়ের।

হতভাগ্য এই নারীর শারীরিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ, অপুষ্টির শিকার ব্লাশের ওজন ছিল মাত্র ৫৫ পাউন্ড (২৪.৯৫ কেজি)। তাকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল, তাতে পচে যাওয়া খাবার এবং বিষ্ঠার ফলে দুর্গন্ধ এতটাই প্রকট ছিল যে সেখানে পরিদর্শন করার মতো সময় পর্যন্ত কেউ দিতে চাচ্ছিলেন না। কোনোমতে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে পারলে যেন তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।

উদ্ধারকর্মীরা এরপর রুগ্ন ব্লাশকে চাদরে আবৃত করে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। দীর্ঘ বন্দিজীবনের দরুন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন ব্লাশ, ঠিকমতো কথাও বলতে পারছিলেন না তিনি। দীর্ঘ ২৫ বছর অন্ধকারে থাকা ব্লাশকে যখন বাড়ির বাইরে নিয়ে আসা হলো, সূর্যালোকের সাথে অভ্যস্ত হতে তার লেগেছিল অনেকটা সময়।

কারাগারে পরিণত হওয়া কামরাটির সারা দেয়াল জুড়ে অজস্রবার লেখা ছিল একটি মাত্র শব্দ, ‘Liberte’, যার অর্থ ‘মুক্তি’।

বন্দীজীবনের বিভীষিকার মাঝে নিজের মনুষ্যত্ব রক্ষার শেষ চেষ্টা কি ছিল এটি?

ব্লাশের বন্দিদশার খবর ছড়িয়ে পরেছিল গোটা ফ্রান্সে; Source: blogspot.com

কিন্তু কেন এই বন্দীজীবন?

এরপর প্রশ্ন আসতেই পারে, কী কারণে ব্লাশকে এতগুলো বছর ধরে এভাবে বন্দী করে রাখা হল, এতটা নিষ্ঠুরভাবে?

১৮৭৯ সালে ব্লাশ মন্যিয়েরের পিতা এমিল মন্যিয়ের এর মৃত্যুর পর তার মা পরিবারের প্রধান হন। পরিবারের ধারা বজায় রাখতে স্বভাবতই ব্লাশের উচিত হবে উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করা এবং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। একসময় ব্লাশ খুঁজেও পান তার মনের মানুষ, একজন আইনজীবীকে। কিন্তু সেই আইনজীবীর সাথে তার বয়সের ব্যবধান ছিল একটু বেশি, তার চেয়ে বড় বিষয় ছিল যে সেই আইনজীবী ছিল দরিদ্র। মাদাম মন্যিয়ের তাই ব্লাশের এ প্রণয়কে মেনে নিতে পারেননি, ব্লাশও তার সিদ্ধান্তে অটল। ভালোবাসার জন্য যেকোনো বাধা মোকাবেলা করতে রাজি ছিলেন ব্লাশ।

কথিত আছে, সে সময় ব্লাশ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন, যা তৎকালীন সমাজের জন্য ছিল ভীষণ কলঙ্কের বিষয়। ব্লাশ ঘোষণা দেন যে, তিনি তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাবেন। ক্রুদ্ধ মাদাম মন্যিয়ের তখন তাকে বেছে নিতে বলেন, হয় তার প্রেমিককে ত্যাগ করতে নতুবা আজীবন বন্দিদশাকে বেছে নিতে।

ব্লাশ ভালোবাসাকে বেছে নিয়েছিলেন আর তার জন্য তাকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল।

আরো করুণ বিষয় হলো, নিখোঁজ ব্লাশকে খুঁজতে থাকা সেই প্রেমিকের মৃত্যু হয় ১৮৮৫ সালে। অথচ তার পরও ব্লাশকে আটকে রাখা হয়।

মন্যিয়ের পরিবারের সকল বিষয়ের উপর চরম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন মাদাম মন্যিয়ের। তার কথামতোই সবকিছু চলত, ব্লাশ তার আদেশ অমান্য করায় তাকে এহেন কঠিন শাস্তি পেতে হয়েছিল।

যদিও ব্লাশের ভাই মার্সেল একসময় বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মায়ের আদেশের অমান্য তিনি করতে পারেননি, করার চেষ্টাও করেননি। মায়ের সাথে বোন ব্লাশের অস্তিত্বকে মুছে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন তিনি।

মাদাম লুইস মন্যিয়ের, যিনি তার আপন কন্যাকে আটকে রেখেছিলেন ২৫টি বছর; Source-mundoincrivel.org

আটকের দু’সপ্তাহের মাথায় মাদামের মৃত্যু

১৯০১ সালে যখন ব্লাশকে উদ্ধার করা হয়, সে সময়ে মাদাম মন্যিয়ের ছিলেন শারীরিকভাবে দুর্বল। বার্ধক্য, হৃদরোগে আক্রান্ত মাদাম মন্যিয়েরকে কারাগারে নেবার সাথে সাথেই হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়। এসময় তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।

আটকের ১৫ দিনের মাথায় মাদাম মন্যিয়ের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বলা হয়ে থাকে, মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার অন্যায় স্বীকার করেন এবং নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেন। ‘La Séquestrée de Poitiers: Une affaire sans précédent’ (The Sequestered Woman of Poitiers: An Unprecedented Affair) নামের একটি বইয়ে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পূর্বে মাদাম মন্যিয়ের তার উইল বদলে ফেলেন এবং তার সকল সম্পদ তিনি ব্লাশের চিকিৎসা খাতে দান করে দিয়ে যান।

কথিত আছে, তার শেষ উক্তি ছিল- “ওহ আমার ব্লাশ!”

মুক্তি পায় তার ভাইও

মাদাম মন্যিয়েরের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পূর্বে তার মৃত্যু হবার কারণে শুধু মার্সেলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছিল। মার্সেলকে মাদাম মন্যিয়েরে সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। আত্মপক্ষ সমর্থনের মার্সেল বলেন যে, তিনি চেষ্টা করেছিলেন ব্লাশকে সাহায্য করার কিন্তু তিনি তার মায়ের ভয়ে তা করতে পারেননি। আদালত মার্সেলকে ১৫ মাসের কারাদণ্ড দিলেও মার্সেল নিজে একজন আইনব্যবসায়ী হওয়ায় আপিলের সময় আইনের ফাঁক গলে তিনি বেরিয়ে যান। আপিলে তাকে নির্দোষ বলে রায় দেয় আদালত।

ধুলোয় মিশে যায় মন্যিয়ের পরিবার

মন্যিয়ের পরিবার ছিল ফ্রান্সের সবচেয়ে বনেদি পরিবারের অন্যতম। ব্লাশের পিতা এমিল মন্যিয়ের একটি চারুকলা অনুষদের প্রধান। মা মাদাম লুইস মন্যিয়ের শহরের উন্নয়নের খাতে অনুদানের জন্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। ব্লাশের ভাই মার্সেল মন্যিয়ের ছিলেন একজন স্বনামধন্য আইনজীবী, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পরিবার গড়েছিলেন তিনি। ছিলেন ব্লাশও- সুন্দরী, গুণী, জনপ্রিয় এই তরুণী, যিনি ১৮৭৬ সালে হারিয়ে যান, নিজের গৃহেই বন্দী হয়ে।

মার্সেল আইনের কাছ থেকে মুক্তি পেলেও জনরোষের কবল থেকে মুক্তি পাননি। ততদিনে গোটা ফ্রান্স ব্লাশ মন্যিয়েরের বন্দীজীবন সম্পর্কে জেনে ফেলেছিল। এবং ফ্রান্সের জনতা তাদের ক্রোধ এবং ঘৃণা সম্পর্কে মার্সেলকে জানাতে ভোলেনি।

জনরোষ থেকে বাঁচতে মার্সেলের পরিবারকে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে পালিয়ে যেতে হয়।

তারপর?

দীর্ঘদিনের বন্দীজীবনের কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ব্লাশ। তাই স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরত যেতে পারেননি এই হতভাগা নারী। ২৫ বছরে প্রথমবারের মতো সূর্যালোক দেখে স্মিত হাসি দেয়া এই নারী তার জীবনের বাকিটা সময় কাটান হাসপাতালেই।

এরপর ১৯১৩ সালে, এক হাসপাতালেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার মৃত্যুর সাথে  সাথে ইতি ঘটে মন্যিয়ের পরিবারের। সেই সাথে ইতি ঘটে ফ্রান্সের ইতিহাসের অন্যতম চাঞ্চল্যকর ঘটনার একটির।

ফিচার ছবি- mandatory.com

Related Articles

Exit mobile version