১৯৯০–এর দশকে দক্ষিণ–পূর্ব ইউরোপে সংঘটিত একটি নৃশংস যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা লাভ করেছিল। এই যুদ্ধটি ‘বসনীয় যুদ্ধ’ নামে পরিচিত, যদিও ঐ অঞ্চলে যুদ্ধটি ‘বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার যুদ্ধ’ নামেই বেশি পরিচিত। বসনিয়া–হার্জেগোভিনাসহ প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়া জুড়ে চলমান হিংস্র জাতিগত সংঘাত, নৃশংস গণহত্যা, সুপরিকল্পিত ধর্ষণযজ্ঞ, বেসামরিক জনসাধারণকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চরম ব্যর্থতা, ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বসনীয় সার্বদের সম্মুখে প্রায় নিরস্ত্র জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের অসহায়ত্ব– এই চিত্রগুলো সামগ্রিকভাবে স্নায়ুযুদ্ধ–পরবর্তী বিশ্বের একটি ডিস্টোপিয়ান চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছিল।
১৯৯০–এর দশকে বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাতের যে নগ্ন চিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছিল, সেটির ঐতিহাসিক ভিত্তি অনেক পুরনো। কিন্তু এই বিস্তৃত ইতিহাস বর্তমান লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান বসনিয়া–হার্জেগোভিনার ভূমি নবগঠিত রাষ্ট্র যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুগোস্লাভিয়া একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়, এবং বসনিয়া–হার্জেগোভিনা যুগোস্লাভিয়ার ৬টি প্রজাতন্ত্রের একটিতে পরিণত হয়। মার্শাল জোসিপ ব্রোজ টিটোর নেতৃত্বাধীন যুগোস্লাভিয়ায় জাতিগত বা ধর্মীয় উগ্রতার কোনো স্থান ছিল না। ‘ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য’ মূলমন্ত্রের অধীনে যুগোস্লাভিয়া ছিল বৃহত্তর ‘দক্ষিণ স্লাভ’ জাতির অন্তর্ভুক্ত ৬টি জাতির (সার্ব, ক্রোট, বসনিয়াক, মেসিডোনীয়, স্লোভেন ও মন্টেনিগ্রিন) একটি ফেডারেশন।
১৯৮০ সালে মৃত্যুর আগে মার্শাল টিটো তার রাষ্ট্রের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য যুগোস্লাভিয়ার ভবিষ্যৎ শাসনপ্রণালী সম্পর্কে বিস্তৃত পরিকল্পনা রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু টিটোর মৃত্যুর পর যুগোস্লাভিয়া জুড়ে জাতিগত ও ধর্মীয় উগ্রতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, এবং বিভিন্ন জাতির রাজনীতিবিদরা নিজস্ব ক্ষমতার ভিত্তি শক্ত করার জন্য জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এমতাবস্থায় যুগোস্লাভিয়ায় কমিউনিজমের পতন ঘটে, এবং যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্গত প্রজাতন্ত্রগুলো একে একে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে শুরু করে।
১৯৯২ সালে বসনিয়া–হার্জেগোভিনা ছিল একটি বহুজাতিক প্রজাতন্ত্র। প্রজাতন্ত্রটির অধিবাসীদের মধ্যে ৪৪% ছিল বসনিয়াক, ৩২.৫% ছিল সার্ব, ১৭% ছিল ক্রোট এবং বাকিরা অন্যান্য জাতিভুক্ত। সাধারণভাবে, বসনিয়াকরা ইসলাম ধর্মের অনুসারী, সার্বরা অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের অনুসারী এবং ক্রোটরা ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। এসময় প্রজাতন্ত্রটির রাষ্ট্রপতি ছিলেন আলিয়া ইজেতবেগোভিচ, একজন বসনিয়াক মুসলিম। ১৯৯২ সালের প্রথমদিকেই স্লোভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়া যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, এবং সার্ব–নিয়ন্ত্রিত যুগোস্লাভিয়ার অংশ হিসেবে থাকার কোনো ইচ্ছে ইজেতবেগোভিচের ছিল না। ফলে তিনি স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় একটি গণভোটের আয়োজন করেন। গণভোটে অংশগ্রহণকারীদের সিংহভাগ স্বাধীনতার পক্ষে ভোটদান করে, কিন্তু বসনীয় সার্ব জনসাধারণ এই গণভোট বর্জন করে।
ইজেতবেগোভিচ বসনিয়া–হার্জেগোভিনাকে একটি বহুজাতিক ও এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বসনীয় সার্ব নেতারা বসনিয়াকদের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি ছিলেন না, এবং সার্ব–নিয়ন্ত্রিত যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি স্লোবোদান মিলোসেভিচ বসনীয় সার্বদের বসনিয়া–হার্জেগোভিনা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিলেন। এসময় প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়া জুড়ে জাতিগত ও ধর্মীয় উগ্রবাদ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, ফলে উভয় পক্ষ কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৯২ সালের এপ্রিলে বসনীয় সরকার এবং বসনীয় সার্বদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বসনীয় সার্বরা বসনিয়া–হার্জেগোভিনার ভূমিতে ‘রিপাবলিকা স্রপস্কা’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে, এবং যত বেশি সম্ভব ভূমি দখলের প্রচেষ্টা চালায়। গৃহযুদ্ধ শুরুর পরপরই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় অস্ত্র সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
এসময় বসনিয়া–হার্জেগোভিনার সশস্ত্রবাহিনী ছিল দুর্বল, এবং জাতিসংঘ কর্তৃক আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা অস্ত্র আমদানি করতে অক্ষম ছিল। অন্যদিকে, বসনীয় সার্বরা বসনিয়া–হার্জেগোভিনা থেকে প্রত্যাহারকৃত যুগোস্লাভ সশস্ত্রবাহিনীর রেখে যাওয়া প্রচুর ভারী অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে, এবং সার্ব–নিয়ন্ত্রিত যুগোস্লাভিয়াও তাদেরকে সার্বিকভাবে সহায়তা করে। এমতাবস্থায় বসনীয় সার্বরা বসনিয়া–হার্জেগোভিনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নেয়, এবং বসনিয়াক মুসলিমদের বিরুদ্ধে এক নৃশংস গণহত্যা আরম্ভ করে। পরবর্তীতে বসনীয় সার্বদের সহায়তায় বসনিয়া–হার্জেগোভিনার পশ্চিমাঞ্চলে ‘পশ্চিম বসনিয়া স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, যারা বসনীয় সার্বদের পক্ষে এবং বসনীয় সরকারের বিপক্ষে যুদ্ধ করে।
বসনীয় ক্রোটরা প্রাথমিকভাবে বসনীয় সরকারের পক্ষে ছিল, কিন্তু ১৯৯২ সালের অক্টোবর থেকে তারা বসনিয়া–হার্জেগোভিনার ভূমিতে ‘হার্জেগ–বসনিয়া ক্রোয়েশীয় প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়, এবং বসনীয় সরকার ও বসনীয় সার্ব উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করে। ক্রোয়েশিয়া বসনীয় ক্রোটদের সার্বিকভাবে সহায়তা করে। অবশ্য ১৯৯৪ সালে বসনীয় সরকার (মূলত বসনিয়াক–নিয়ন্ত্রিত) ও বসনীয় ক্রোটদের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়, এবং তারা সম্মিলিতভাবে রিপাবলিকা স্রপস্কা ও পশ্চিম বসনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
বসনীয় যুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত হয় মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়– বসনীয় গণহত্যা। বসনীয় গণহত্যার ফলে ৩১,৫৮৩ জন বসনিয়াক, ৪,১৭৯ জন বসনীয় সার্ব ও ২,৪৮৪ জন বসনীয় ক্রোট বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়, এবং প্রায় ১২,০০০ থেকে ২০,০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। বসনীয় গণহত্যার জন্য মূলত দায়ী ছিল বসনীয় সার্বরা, যারা প্রধানত মুসলিম বসনিয়াকদের বিরুদ্ধে এবং আংশিকভাবে বসনীয় ক্রোটদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালায়৷ অবশ্য, বসনীয় সরকার বসনীয় সার্ব ও বসনীয় ক্রোটদের বিরুদ্ধে এবং বসনীয় ক্রোটরা মুসলিম বসনিয়াক ও বসনীয় সার্বদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধ করেছিল।
বসনীয় যুদ্ধ শুরুর পর প্রাথমিকভাবে বসনিয়া–হার্জেগোভিনার সরকার কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছিল। বসনীয় সার্ব ও ক্রোটরা তাদের নিজ নিজ স্বজাতীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে অস্ত্র সহায়তা পাচ্ছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটি ঠেকানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ বসনীয় সরকার অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার কারণে অতি প্রয়োজনীয় অস্ত্র আমদানি করতে পারছিল না। এমতাবস্থায় ইজেতবেগোভিচ প্রথমে পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে সহায়তা লাভের চেষ্টা করেন, কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে তিনি মুসলিম বিশ্বের কাছে সামরিক সহায়তার জন্য আবেদন করেন। এসময় বসনিয়াক মুসলিমদের ওপর চলমান গণহত্যার কারণে মুসলিম বিশ্বে বসনীয় সরকারের প্রতি ব্যাপক সহানুভূতি ছিল। তাছাড়া, দক্ষিণ–পূর্ব ইউরোপে নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের জন্যও তারা উৎসাহী ছিল, এবং এজন্য মুসলিম–অধ্যুষিত বসনিয়া–হার্জেগোভিনাকে তারা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে ইচ্ছুক ছিল। ফলে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বসনিয়া–হার্জেগোভিনার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল সৌদি আরব, পাকিস্তান, তুরস্ক এবং ইরান।
গণহত্যার শিকার বসনিয়াক মুসলিমদের সহায়তা করার নৈতিক দায়িত্ববোধ এবং দক্ষিণ–পূর্ব ইউরোপে প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় হস্তক্ষেপের পেছনে ইরানের আরেকটি কারণ ছিল। বসনিয়া–হার্জেগোভিনার রাষ্ট্রপতি আলিয়া ইজেতবেগোভিচ ছিলেন একজন ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ, যিনি তার রাজনৈতিক ও আদর্শিক ভিন্নমতের কারণে কমিউনিস্ট শাসনামলে কারাভোগ করেছিলেন। ইজেতবেগোভিচ ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত ‘ইসলামি বিপ্লবে’র প্রশংসা করেন এবং ১৯৮২ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসলামি বিপ্লব পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইরানি সরকারের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি তার সমর্থনকে ইরান নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, এবং এটি বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় প্রভাব বিস্তারের জন্য মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ইরানকে বিশেষ সুবিধা দিতে পারত।
ইজেতবেগোভিচের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইরান জাতিসংঘ কর্তৃক আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় অস্ত্র প্রেরণ করতে শুরু করে। এসময় তারা ক্রোয়েশিয়ার মাধ্যমে বসনিয়া–হার্জেগোভিনাকে অস্ত্র সরবরাহ করছিল। কিন্তু এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব চলছিল, এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ ইরান কর্তৃক বসনীয় সরকারকে অস্ত্র সরবরাহের তীব্র বিরোধী ছিলেন। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রোয়েশীয় সরকারের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানায়, এবং ক্রোয়েশিয়া বাধ্য হয়ে একটি ইরানি অস্ত্রবাহী বিমান ও বিমানটিতে থাকা অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরান গোপনে বসনিয়া–হার্জেগোভিনার নিকট অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখে।
পরবর্তীতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন মার্কিন সরকারের নীতিতে পরিবর্তন আনেন, এবং প্রকাশ্যে ইরান কর্তৃক বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় অস্ত্র প্রেরণের বিরোধিতা করলেও গোপনে এটিকে সমর্থন করেন ও এই অস্ত্র সরবরাহে কোনো প্রকার বাধা প্রদান থেকে বিরত থাকেন। এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ–পূর্ব ইউরোপে ইরানি প্রভাব বিস্তারের চেয়ে বসনীয় সার্বদের নিকট বসনীয় সরকারের পতন এবং এর ফলে রাশিয়া ও সার্বিয়ার নেতৃত্বে দক্ষিণ–পূর্ব ইউরোপ জুড়ে প্যান–স্লাভ জাতীয়তাবাদের বিস্তারের সম্ভাবনাকে নিজেদের স্বার্থের জন্য বেশি বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। এজন্য তারা বসনীয় সার্বদের পরিপূর্ণ বিজয়ের বিরুদ্ধে ছিল, এবং এক্ষেত্রে ইরান কর্তৃক বসনীয় সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ তাদের স্বার্থের অনুকূলে ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এসময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ–ও গোপনে বসনিয়া–হার্জেগোভিনাকে সহায়তা প্রদান করতে আরম্ভ করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৌন সমর্থনের ফলে বসনিয়া–হার্জেগোভিনার প্রতি ইরানি সমর্থনের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইরানি সশস্ত্রবাহিনীর অন্তর্গত ‘ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী’ (Islamic Revolutionary Guard Corps, ‘IRGC’) এবং এটির অন্তর্গত বিশেষ বাহিনী ‘কুদস ফোর্সে’র প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ইরান থেকে প্রচুর পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় প্রেরণ করা হয়। বসনীয় যুদ্ধ চলাকালে বসনীয় সরকার ইরানের কাছ থেকে ১৪,০০০ টনেরও বেশি পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র লাভ করে। এসব সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে ছিল রাইফেল, গোলাবারুদ, উর্দি, ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এক হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধ চলাকালে বসনীয় সরকারি বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের ৩০% ইরান সরবরাহ করে। এই সাহায্যের পুরোটাই দেয়া হয়েছিল বিনামূল্যে। ইরান কর্তৃক সরবরাহকৃত এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বসনীয় সার্বদের বিরুদ্ধে বসনীয় সরকারি বাহিনীকে টিকে থাকতে সহায়তা করে।
সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের পাশাপাশি জনবল সরবরাহের মাধ্যমেও ইরান বসনিয়া–হার্জেগোভিনাকে সহায়তা করে। বসনীয় সশস্ত্রবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও অন্যান্য সহায়তা প্রদানের জন্য ইরান ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর প্রায় ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ সদস্যকে প্রশিক্ষক ও উপদেষ্টা হিসেবে বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় প্রেরণ করে। ইরানি সামরিক উপদেষ্টারা প্রায়ই বসনীয় সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সামরিক অভিযানগুলোর পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকতেন। এর পাশাপাশি ইরানের ‘মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স’–এর কয়েক ডজন কর্মকর্তা বসনীয় ইন্টেলিজেন্সে কর্মরত ছিলেন এবং যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তারা বসনিয়া–হার্জেগোভিনা জুড়ে বিস্তৃত একটি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।
ইরানি ‘ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী’র অন্তর্গত বিশেষ বাহিনী ‘কুদস ফোর্স’ও বসনীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, এবং বিভিন্ন সামরিক অভিযানে কুদস ফোর্স সদস্যরা বসনীয় সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি সরাসরি যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করে। ধারণা করা হয়, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে প্রখ্যাত ইরানি সমরনায়ক জেনারেল কাসেম সুলেইমানিও কুদস ফোর্সের অংশ হিসেবে বসনিয়া–হার্জেগোভিনার পক্ষে যুদ্ধ করেছেন। উল্লেখ্য, সুলেইমানি পরবর্তীতে কুদস ফোর্সের কমান্ডার নিযুক্ত হন এবং ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইরাকে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হন।
ইরানের পাশাপাশি ইরান–সমর্থিত লেবাননভিত্তিক শিয়া গ্রুপ ‘হিজবুল্লাহ’ও বসনীয় যুদ্ধ চলাকালে বসনিয়া–হার্জেগোভিনার পক্ষে যুদ্ধ করে। বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের প্রেরণের সঙ্গে ইরান সরাসরি জড়িত ছিল, এবং প্রায় ৪০০ হিজবুল্লাহ যোদ্ধা এই যুদ্ধের সময় বসনীয় সরকারি বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করে। বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় প্রেরিত হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের কমান্ডার ছিলেন আলী আহমাদ ফায়াদ। উল্লেখ্য, ফায়াদ ২০১৬ সালে সিরিয়ার আলেপ্পোয় সিরীয় সরকারি বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধরত অবস্থায় নিহত হন।
বসনিয়া–হার্জেগোভিনার প্রতি ইরানি সহায়তা কেবল সামরিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বসনিয়া–হার্জেগোভিনার সমর্থনে প্রচারণা চালানোর উদ্দেশ্যে ইরানি সরকার বসনীয় ভাষায় ‘সাহার’ (বাংলা প্রতিশব্দ ‘ভোর’) নামক একটি রেডিও স্টেশন স্থাপন করে, যেটি পরবর্তীতে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে পরিণত হয়। এছাড়া, বসনীয় শরণার্থীদের জন্য ইরান মানবিক সহায়তা প্রেরণ করে। ইরানি রেড ক্রিসেন্টও বসনীয় শরণার্থীদের সহায়তা প্রদানের সঙ্গে জড়িত ছিল। ধারণা করা হয়, ইরানি সরকার বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় ইরানি রেড ক্রিসেন্টের কার্যক্রমকে বসনিয়ায় ইরানি ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের প্রেরণের কাজে ব্যবহার করে। বহুসংখ্যক ইরানি ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধাকে ইরানি রেড ক্রিসেন্টের কর্মীর ছদ্মবেশে বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় প্রেরণ করা হয়েছিল।
বসনীয় সার্ব ও ক্রোটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পাশাপাশি ইরানিরা বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা বসনিয়া–হার্জেগোভিনা জুড়ে একটি বিস্তৃত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে, এবং বিভিন্ন ইরানি দাতব্য সংস্থা দেশটিতে মানবিক সহায়তামূলক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সেখানে ইরানি ‘সফট পাওয়ারে’র বিস্তার ঘটায়। বস্তুত বসনীয় যুদ্ধ চলাকালে বসনিয়াকদের মধ্যে ইরানের ভাবমূর্তি এতটাই উজ্জ্বল হয়েছিল যে, মার্কিন বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৯৫ সালে যদি বসনিয়াকদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হত, তাদের সিংহভাগই নির্দ্বিধায় ইরানকে বেছে নিত। বসনীয় যুদ্ধের অবসানের পরপরই বসনিয়াকদের মধ্যে পরিচালিত একটি জরিপ অনুযায়ী, বসনিয়াক জনসাধারণের ৮৬% ইরানের প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষণ করত।
এর পাশাপাশি বসনীয় যুদ্ধ চলাকালে ইরান তাদের মার্কিনবিরোধী কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। যুদ্ধের সময় ইরানি ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা ক্রোয়েশিয়া হয়ে বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় পৌঁছাত, এবং এটিকে তারা মার্কিনিদের ওপর নজরদারির জন্য ব্যবহার করে। হিজবুল্লাহ সদস্যরা ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগরেবে মার্কিন কূটনীতিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নজরদারি করত। ১৯৯৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সিআইএ বসনিয়া–হার্জেগোভিনার রাজধানী সারায়েভোয় তাদের নতুন স্টেশন চিফ নিযুক্ত করে। কিন্তু তার বসনীয় সহকর্মীরা তার পরিচিতি ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ফাঁস করে দেয়। এরপর ইরানিরা তাকে খুন করার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু এই চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় বসনিয়া–হার্জেগোভিনার বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে ডেটন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং এর মধ্য দিয়ে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে। চুক্তি অনুযায়ী বসনিয়া–হার্জেগোভিনাকে জাতিগত ভিত্তিতে দুইটি ভাগে বিভক্ত করা হয়– বসনিয়াক ও বসনীয় ক্রোটদের সমন্বয়ে গঠিত ‘বসনিয়া–হার্জেগোভিনা ফেডারেশন’ এবং বসনীয় সার্বদের সমন্বয়ে গঠিত ‘রিপাবলিকা স্রপস্কা’। বসনিয়া–হার্জেগোভিনার জন্য একটি জটিল শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়, এবং শান্তিরক্ষার জন্য সেখানে ন্যাটোর সৈন্যদল মোতায়েন করা হয়।
যুদ্ধ শেষ হওয়ায় বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় ইরানি সামরিক উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়, এবং ইরান সেখান থেকে তাদের সামরিক উপস্থিতি হ্রাস করে। কিন্তু যুদ্ধ চলাকালে বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় প্রভাব বিস্তারের জন্য তারা যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল, সেটি প্রায় অক্ষত থাকে। বর্তমানেও বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় ইরানি ইন্টেলিজেন্স বিশেষভাবে সক্রিয় বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করে থাকেন।