২৩ মে, ১৭০১ খ্রিস্টাব্দ। লন্ডন শহরের পূর্বাঞ্চলের ওয়াপ্পিং এলাকার ‘এক্সিকিউশন ডক’ নামে খ্যাত এলাকায় এক কুখ্যাত ব্যক্তির অপরাধকর্মের জন্য দণ্ড হিসেবে ফাঁসির আয়োজন হচ্ছে। সেই ব্যক্তি জলদস্যু হিসেবে সেসময় ইংল্যান্ডের সভ্য সমাজে বেশ আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
বিচারকদের মধ্যে আলোচ্য ব্যক্তির অপরাধের তীব্রতা ও তার প্রাপ্য নিয়ে মতবিরোধ তো ছিলই। আরও ছিল তাকে নিয়ে বিভিন্ন উপকথা ও কাল্পনিক উপাখ্যান। সব মিলিয়ে, সে কারো কাছে এক দুঃসাহসী নায়ক, কারো কাছে অলৌকিক ক্ষমতাধারী অভিযাত্রী, আর কারো কাছে ধনরত্নের পাহাড় জমানো নিষ্ঠুর এক জলদস্যু।
যথাসময়ে ফাঁসি দিতে গিয়েও দেখা দিল বিপত্তি। প্রথমবার ফাঁসি দিতে গিয়ে দড়ি ছিড়ে গেল! ফাঁসির মঞ্চের সামনে দাঁড়ানো অনেকেই একে দৈব ইঙ্গিত হিসেবে বলতে লাগলেন, “স্বয়ং ঈশ্বরও হয়তো চান না এই মৃত্যুদণ্ড!” কিন্তু দ্বিতীয়বার আর ভুল হলো না। অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হলো, তৈরি হলো এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
আলোচ্য ব্যক্তির নাম উইলিয়াম কিড, যিনি ক্যাপ্টেন কিড নামেই বেশি খ্যাতি পেয়েছেন। দুঃসাহসী অভিযাত্রী, নির্দয় জলদস্যু, দুরন্ত লুটেরা এসব বিশেষণই তার নামের সাথে ব্যবহৃত হয়। পরে অনেক ঐতিহাসিকই তার বিরুদ্ধে আনা জলদস্যুতার অভিযোগ খণ্ডন করতে চেয়েছেন।
উইলিয়াম কিডের জন্ম ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি এলাকায়। ছোটবেলা থেকেই দুঃসাহস তার সহচর। সাগর আর নাবিক জীবনের প্রতি আজন্ম আকর্ষণই তার দীর্ঘ ঘটনাবহুল জীবনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সৌভাগ্য খোঁজার নেশা একসময় তাকে নিয়ে আসে ব্রিটিশ শাসিত নিউ ইয়র্ক অঞ্চলে। এখানে ঔপনিবেশিক সরকারের কর্তা ছাড়াও বিভিন্ন ধনবান ও ক্ষমতাবান মানুষের সাথে তার পরিচয় হয়।
দক্ষতা আর পরিচয়ের সূত্র কাজে লাগিয়ে নাবিক জীবনের দুরন্ত অভিযানের পর্ব শুরু করলেন। ক্যারিবিয়ান সমুদ্র অঞ্চল হয়ে উঠল তার কর্মক্ষেত্র। এসময় উত্তর আমেরিকার সমুদ্রপথ নিয়ে ব্রিটিশ ও ফরাসি শক্তির মুখোমুখী সংঘর্ষে প্রাইভেটিয়ার হিসেবে সহযোগিতা করেন। ফরাসি শক্তির অন্যতম ঘাঁটি মারি গালাতেঁ আক্রমণ করে সাফল্যের সাথে দখল করলেন। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সাফল্যের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হলো।
এর মধ্যে ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ চলে এলো। উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশ প্রশাসন নিউ ইয়র্ক, ম্যাসাচুসেটস ও নিউহ্যাম্পশায়ার এলাকায় বেড়ে চলা জলদস্যুতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। এছাড়া ফরাসি শক্তির হুমকি তো ছিলই। গভর্নর রিচার্ড কুট জলদস্যুতা দমনে উইলিয়াম কিডকে নিযুক্ত হতে বললেন। এসময় তার সহকারীদের সাথে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অফিসারদের সাথে কিছু কারণে বৈরিতা তৈরি হয়। এই বৈরিতা পরবর্তীতে কখনও কমেনি, বরং অন্য কিছু অঘটনের ক্ষেত্র তৈরি করে।
১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দ। উইলিয়াম কিড ভাগ্য বদলের আশায় আফ্রিকা অঞ্চলের দিকে জাহাজ ভাসানোর সিদ্ধান্ত নেন। ভেবেছিলেন, জলদস্যুতা দমনে এই এলাকায় কিছুটা হলেও সফলতা পাবেন। কিন্তু কমোরসে আসতেই কলেরা মহামারীর প্রকোপে তার অধীনস্থদের বেশিরভাগই প্রাণ হারাল। তার জাহাজও দীর্ঘযাত্রার ফলে অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিড চোখে অন্ধকার দেখছিলেন।
ক্রমাগত ব্যর্থতা তার পিছু ছাড়ছিল না। বেশ কিছু শত্রুপক্ষীয় জাহাজ আক্রমণ করতে গিয়ে নিদারুণ দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হলেন। এদিকে সহযাত্রীদের মধ্য থেকে তার বিরুদ্ধে অনেকে গোপনে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। এক ওলন্দাজ বাণিজ্য জাহাজ আক্রমণ নিয়ে মতবিরোধের কারণে উইলিয়াম কিড তার এক অধীনস্থ নাবিককে রাগের বশে আঘাত করে বসেন, যার ফলে সেই নাবিক মৃত্যুবরণ করে।
এদিকে কিড ও তার সহযাত্রীদের নামে খোদ ইংল্যান্ডে দুর্নাম ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল। এসব কুখ্যাতির অন্যতম উৎস ছিল পালিয়ে আসা নাবিকদের বিভিন্ন অভিযোগ। বিশেষ করে তার সহকারী কর্তৃক আক্রমণকৃত জাহাজের যাত্রীদের উপর লুটতরাজ ও নির্যাতনের অভিযোগ বাতাসের গতিতে ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে। তৈরি হয় ক্যাপ্টেন কিডের দুর্ধর্ষ জলদস্যুতার অবিশ্বাস্য সব উপাখ্যান। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা এলাকায় জলদস্যুতার এক শ্বাসরুদ্ধকর ও মূর্তিমান উপকথায় পরিণত হন তিনি।
তখনকার দিনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইউরোপের উপনিবেশগুলোর সমুদ্রপথে এক অলিখিত নিয়ম ছিল। প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করা বা শত্রুপক্ষের জাহাজ জলদস্যুর মতো আক্রমণের মধ্যে পার্থক্য ছিল শুধু স্বীকৃতি আর অস্বীকৃতির। উপনিবেশের প্রভুদের বিরাগভাজন হওয়া যেকোনো নাবিকের পক্ষে খুব ক্ষতিকর ছিল। একজন প্রাইভেটিয়ার তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলতে চাইলে ভাগ্য বিরূপ হতে খুব বেশি সময় লাগত না। উইলিয়াম কিডের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল।
১৬৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে আরো একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটল। ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে মূল্যবান বাণিজ্য সামগ্রী নিয়ে আসা এক ফরাসি জাহাজ তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে এলো। এই জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিল ইংরেজ, যার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ফরাসি রাজতন্ত্রের উপর ন্যস্ত ছিল। কিডের সহযাত্রীরা এই ফরাসি জাহাজের দখল নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। কিন্তু ক্যাপ্টেন ইংরেজ হবার কারণে তিনি দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। শেষাবধি পরিস্থিতির কারণে তাকে জাহাজের দখল নিতেই হলো।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! একসময় ইংরেজ শক্তি ফরাসি আধিপত্য কমানোর জন্য উইলিয়াম কিডের বিশ্বস্ততার উপর আস্থা রেখেছিল। সেই আস্থার খাতিরে যখন তিনি আনুগত্যের ব্যবধান কমাতে চাইলেন, ঠিক তখনই জলদস্যুতার স্থায়ী মোহর তার নামের উপর আঁকা হয়ে গেল।
ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোয় ততদিনে দুর্ধর্ষ জলদস্যু হিসেবে ক্যাপ্টেন কিডের নাম পরিচিত হয়ে উঠেছিল। গভর্নরের অধীনস্থ লোকজন একেবারে হন্যে হয়ে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। নিউ ইয়র্ক, নিউ হ্যাম্পশায়ার ও ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর রিচার্ড কুট এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি ক্যাপ্টেন কিডকে আইনগত ক্ষমার বিশেষ প্রলোভন দেখালেন। গভর্নরকে বিশ্বাস করাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। ১৬৯৯ সালের ৬ জুলাই উইলিয়াম কিডকে বোস্টনে গ্রেফতার করা হলো।
প্রায় এক বছর কষ্টকর কারাভোগের পর তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন ব্রিটিশ রাজসভায় রক্ষণশীল টোরি মন্ত্রীসভা ক্ষমতাসীন ছিল। প্রতিপক্ষকে জব্দ করার এই সুযোগ তারা ছাড়তে চাইলেন না। যদিও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তাকে প্রকাশ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেও সন্তোষজনক কোনো তথ্য বের করা যায়নি। কিন্তু রাজনৈতিক কোনো সুযোগ নেওয়ার উপায় না থাকায় ক্যাপ্টেন কিডকে বিচারের জন্য ‘হাইকোর্ট অব অ্যাডমিরালটি’তে নিয়ে যাওয়া হলো। পূর্ব পরিচিতির সূত্র ধরে তিনি ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের কাছে সুবিচার প্রার্থনা করে চিঠি লিখলেন।
কিন্তু ততদিনে পরিস্থিতি অন্য খাতে চলে গেছে। ক্ষমতাসীন ও অভিজাত পরিচিতরা এককালের কাজ আদায়ের পর আর কখনো ক্যাপ্টেন কিডকে সুনজরে দেখেনি। তার বিরুদ্ধে হত্যা, জলদস্যুতা ও সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলো।
১৭০১ খ্রিস্টাব্দ। নতুন শতকের শুরু হলো। যে শতকে উইলিয়াম কিডের মতো অনেক প্রাইভেটিয়ারের অভিযানে ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতসহ অনেক মহাদেশে বিস্তৃত হবে। সেই নতুন শতকের শুরুতে ২৩ মে লন্ডন শহরের ওয়াপ্পিং এলাকায় এক্সিকিউশন ডকে উইলিয়াম কিডকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মৃত্যু হবার পরও তার মৃতদেহ টেমস নদীর ঠিক উপরে অনেকক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা হয়। এটা ছিল মূলত চলমান জলদস্যুতা ও উপনিবেশগুলোতে ব্রিটিশ প্রশাসনের মধ্যে মতবিরোধের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ।
কিড তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাবার আগে থেকেই ইংল্যান্ডে উপকথার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। বিশেষ করে জলদস্যু, তাদের গুপ্তধন ও বিভিন্ন লৌকিক অলৌকিক গল্পের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সম্প্রতি বিভিন্ন ঐতিহাসিক জলদস্যুতার অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ডকে রীতিমতো ইতিহাসের অন্যতম অবিচার বলে গণ্য করে থাকেন। তাদের মতে, জলদস্যুতা নয়, ঔপনিবেশিক ইংরেজ প্রশাসন ও প্রাইভেটিয়ারদের মধ্যে মতবিরোধ ও স্বার্থের বলি হিসেবে ক্যাপ্টেন কিডকে তার প্রাণ হারাতে হয়েছে। উপনিবেশগুলোর সমুদ্রপথে জলদস্যুতা তখনকার প্রশাসনের কার্যত সম্মতি ছাড়া একরকম অসম্ভবই ছিল। এই দিকটি বিবেচনা করে দেখলে উইলিয়াম কিডকে এক দুর্ধর্ষ জলদস্যু ছাড়াও একজন হতভাগ্য নাবিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।