দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফিলিস্তিনের বুকে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণাটি ইউরোপ জুড়ে জনপ্রিয় হচ্ছিল। ফিলিস্তিনের ইহুদী সম্প্রদায়ের নেতা ডেভিড বেন গুরিয়নও (David Ben-Gurion) বুঝতে পারছিলেন, শীঘ্রই তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেতে যাচ্ছেন, যার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাদেরকে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। ফলে তখন থেকেই তিনি গোপনে অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি আরব গোত্রগুলোর নেতাদেরকে হত্যার ব্যাপারে ইহুদীদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংগঠন হাগানাকে (Haganah) নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার উপর আলোচনা করা হয়েছিল আমাদের এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বে।
কিন্তু হাগানাই ইহুদীদের একমাত্র গুপ্ত সংগঠন ছিল না। যদিও হাগানা নিজেই যথেষ্ট উগ্রপন্থী একটি সংগঠন ছিল, যারা বিভিন্ন সময় প্রচুর গুপ্তহত্যা এবং সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটিয়েছিল, কিন্তু তারপরও বিভিন্ন সময় তাদেরকে মধ্যপন্থী হিসেবে অভিযোগ করে বেশ কিছু চরমপন্থী সদস্য বেরিয়ে গিয়েছিল এবং গঠন করেছিল ইরগুন (Irgun) ও লেহি (Lehi) নামের দুটি অধিকতর সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের উপর একের পর এক আক্রমণ করে তাদেরকে যত দ্রুত সম্ভব ফিলিস্তিন ছাড়তে বাধ্য করা, যেন ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত হয়।
সে সময় লেহির কমান্ডার ছিলেন ইৎজাক শামির (Yitzhak Shamir)। লেহি আগে থেকেই ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্রশাসনের সিআইডি অফিসারদেরকে হত্যা করে আসছিল, যেরকম একটি হত্যাকান্ডের কথা আমরা বর্ণনা করেছিলাম এই সিরিজের প্রথম পর্বে। ব্রিটিশ পুলিশের সাধারণ অফিসার ছাড়াও লেহির সদস্যরা জেরুজালেমের পুলিশ প্রধান মাইকেল জোসেফ ম্যাককনেল (Michael Joseph McConnell) এবং ফিলিস্তিনে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার হ্যারল্ড ম্যাকমাইকেলকে (Harold MacMichael) হত্যা করার একাধিকবার চেষ্টা চালিয়েছিল। শুধু তা-ই না, তারা ফিলিস্তিনের বাইরে অন্যান্য দেশে অবস্থিত ব্রিটিশ কর্মকর্তাদেরকেও তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাদেরকে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক নিয়োগ করে।
এরকম একজন কর্মকর্তা ছিলেন কায়রোতে অবস্থিত ব্রিটিশ রেসিডেন্ট মিনিস্টার ওয়াল্টার এডওয়ার্ড গিনেস (Walter Edward Guinness), যিনি লর্ড মোয়েন (Lord Moyne) নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। লর্ড মোয়েন ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার আনুপাতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদীদের গণহারে ফিলিস্তিনে অভিবাসনের উপর কড়াকড়ি আরোপ করেছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকায় ইহুদী অভিবাসনের জন্য একটি বার্ষিক কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, যা ছিল ইহুদীদের প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। তার এ সিদ্ধান্তের কারণে ফিলিস্তিনের ইহুদীরা তাকে ‘অ্যান্টি সেমাইট’ বা ‘ইহুদী বিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ইৎজাক শামির তাকে হত্যার নির্দেশ জারি করেন।
শামিরের নির্দেশে লর্ড মোয়েনকে হত্যার জন্য নিয়োগ করা হয় লেহির দুজন সদস্য এলিয়াহু হাকিম (Eliyahu Hakim) এবং এলিয়াহু বেত-জুরিকে (Eliyahu Bet-Zuri)। হাকিম এবং বেত-জুরি ফিলিস্তিন থেকে কায়রোতে গিয়ে কয়েকদিন নজরদারি করার পর ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর লর্ড মোয়েনের বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়। লর্ড মোয়েন যখন সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তার গাড়িতে ওঠেন, তখন পেছন থেকে ছুটে আসে হাকিম এবং বেত-জুরি। তাদের একজন জানালা দিয়ে পিস্তল ঢুকিয়ে দেয় এবং লর্ড মোয়েনের মাথা লক্ষ্য করে পরপর ৩টি গুলি করে। লর্ড মোয়েন নিজের গলা চেপে ধরে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্ত বন্ধ করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু পরমুহূর্তেই ঢলে পড়েন সামনের দিকে।
শামিরের নির্দেশ ছিলো লর্ড মোয়েনকে হত্যার পরপরই হত্যাকারীরা যেন গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। কিন্তু অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে গাড়ির জোগাড় না হওয়ায় হাকিম এবং বেত-জুরি সাইকেলে করে পালানোর চেষ্টা করে। ব্রিটিশ মন্ত্রীকে হত্যার ঘটনাটি আর দশটি সাধারণ হত্যাকান্ডের মতো ছিল না। কায়রোর ব্রিটিশ পুলিশ হত্যাকারীদেরকে গ্রেপ্তারের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে তৎপরতা শুরু করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদেরকে ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। পুলিশ তাদেরকে আদালাতে তোলে, বিচার শেষে তাদের মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হয় এবং ছয় মাস পরে তা কার্যকর হয়।
সন্ত্রাসী আক্রমণ যে সবসময় ভালো ফলাফল বয়ে আনে না, লেহির এই অপারেশনটি ছিল তার অন্যতম উদাহরণ। লেহির উদ্দেশ্য ছিলো সন্ত্রাসী হামলাগুলোর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার গতি ত্বরান্বিত করা। কিন্তু বাস্তবে এই হামলার ফলাফল হয়েছিল হিতে বিপরীত। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল (Winston Churchill) নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্তও ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার জন্য তার মন্ত্রীসভাকে রাজি করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি লর্ড মোয়েনসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকেও তার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে যাচ্ছিলেন।
ধারণা করা হচ্ছিল, আসন্ন ইয়াল্টা সম্মেলনে চার্চিল যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী অন্য দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও জোসেফ স্ট্যালিনের সাথে একত্রিত হবেন, তখন তিনি হয়তো ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রাস্তাবনা উত্থাপন করবেন। কিন্তু এক ইহুদী সংগঠনের হাতে ব্রিটিশ মন্ত্রী হত্যার ঘটনা চার্চিলকে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প থেকে ফিরে আসতে বাধ্য করে। তিনি লেহিকে ‘একটি নতুন গ্যাংস্টার গ্রুপ’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং ঘোষণা করেন, ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি তার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছেন।
এই ঘটনার পরও লেহি তাদের গুপ্তহত্যার কর্মসূচী থেকে বিরত থাকেনি। আর শুধু লেহি একা না, একই সময়ে একই উদ্দেশ্যে একই রকম গুপ্তহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল আরেকটি গুপ্ত সংগঠন ইরগুন। সে সময় ইরগুনের প্রধান ছিলেন মেনাখেম বেগিন (Menachem Begin)। ১৯৪৬ সালের ২২ জুলাই বেগিনের নির্দেশে ইরগুনের সদস্যরা জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলে ৩৫০ কেজির বিস্ফোরক রেখে আসে। এই হোটেলের একাংশেই ছিল ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্রশাসনের হেডকোয়ার্টার এবং ব্রিটিশ সশস্ত্রবাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগের অফিসগুলো। প্রচন্ড বিস্ফোরণে হোটেলের একাংশ সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ে। নিহত হয় ৯১ জন, আহত হয় আরো অন্তত ৪৫ জন।
কিং ডেভিড বোমা হামলা ছিলো পরিষ্কারভাবেই একটি সন্ত্রাসী হামলা। এতে নিহতদের অনেকেই ছিল বেসামরিক নাগরিক। এমনকি এতে আহতদের মধ্যে অনেক ইহুদীও ছিল। ফলে এই হামলায় ফিলিস্তিনের ইহুদী সম্প্রদায় তথা ইশুভের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ডেভিড বেন গুরিয়ন তাৎক্ষণিকভাবে এই হামলার নিন্দা জানান এবং ইরগুনকে ইহুদী জনগণের শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু তার নিন্দার পরও থামেনি ইরগুন। লেহির মতোই তারাও একের একের গুপ্তহত্যা এবং সন্ত্রাসী আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে।
কিং ডেভিড হোটেলে বোমা হামলার তিন মাস পর, ১৯৪৬ সালের ৩১ অক্টোবর লেহির একটি দল ইতালির রাজধানী রোমে অবস্থিত ব্রিটিশ দূতাবাসে বোমা হামলা করে। এই হামলাটিও পরিচালিত হয়েছিল হাগানা এবং বেন গুরিয়নের অনুমতি ছাড়া এবং তাদের অজান্তে। বোমার আঘাতে দূতাবাস ভবন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদিও হামলাটি রাতের বেলা পরিচালিত হওয়ায় এতে কেউ নিহত হয়নি। শুধুমাত্র একজন নিরাপত্তা রক্ষী এবং দুজন ইতালিয়ান পথচারী সামান্য আহত হয়েছিল এতে।
এর পরপরই লেহি লন্ডনে অবস্থিত ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার প্রত্যেক সদস্যের কাছে চিঠির খামে করে বোমা প্রেরণ করে। এই অপারেশনটিকে একদিক থেকে ব্যর্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এর একটি বোমাও বিস্ফোরিত হয়নি। কিন্তু অন্যদিকে এর মাধ্যমে লেহি তাদের শক্তি, সামর্থ্য এবং বিস্তৃত নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানান দিতে সক্ষম হয়। প্রায় একই সময় ইরগুনের ব্রিটেন শাখাও প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারাও একই রকম অপারেশন শুরু করে। এমনকি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি (Clement Attlee) এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্নেস্ট বেভিনও (Ernest Bevin) ছিলেন তাদের হত্যা তালিকায়।
ব্রিটেনের নিরাপত্তা সংস্থা এমআই৫ (MI5) এর নথি থেকে জানা যায়, সে সময় জায়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে ব্রিটেনের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি বিবেচনা করা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বাস্তবতায় ব্রিটেন এমনিতেই বিভিন্ন দেশে অবস্থিত তাদের উপনিবেশগুলো ছেড়ে দেশগুলোকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হচ্ছিল। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রেও হয়তো তারা স্বাভাবিকভাবেই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতো, কিন্তু ইহুদী গুপ্ত সংগঠনগুলোর একের পর এক আক্রমণ তাদেরকে সময়ের অনেক আগেই সেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল।
১৯৪৭ সালের শেষদিকে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের নিকট জমা দেওয়া এমআই৫ এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু এর পূর্ববর্তী দুই বছরেই ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর হাতে নিহত হয়েছিল ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের ১৭৬ জন অফিসার এবং বেসামরিক নাগরিক। জেরুজালেমের ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের ইহুদী বিভাগের কমান্ডার টম উইলকিনকে হত্যা করা লেহির সদস্য ডেভিড শমরনের ভাষায়, এই হত্যাকান্ডগুলোই ব্রিটিশদেরকে ফিলিস্তিন ত্যাগে বাধ্য করেছিল। তার মতে, আভ্রাহাম স্টার্ন যদি লেহি প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু না করতো, তাহলে হয়তো ইসরায়েলের সৃষ্টিই হতো না।
ডেভিড শমরনের সাথে হয়তো সবাই পুরোপুরি একমত না-ও হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুদিন পরে যখন সত্যি সত্যিই ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর প্রধানদেরকেই ইসরায়েল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। হাগানাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স। হাগানার প্রধান ডেভিড বেন গুরিয়ন হন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। আর ইরগুনের প্রধান মেনাখেন বেগিন এবং লেহির প্রধান ইৎজাক শামির পরবর্তীতে হন যথাক্রমে ইসরায়েলের ষষ্ঠ ও সপ্তম প্রধানমন্ত্রী। তাদের নির্দেশে সরাসরি বিভিন্ন গুপ্ত হত্যা এবং সন্ত্রাসী হামলায় অংশগ্রহণকারী সদস্যদেরকে নিয়েই গঠিত হয় মোসাদ, শিন বেত এবং আমানসহ ইসরায়েলের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
তথ্যসূত্র: Rise and Kill First: The Secret History of Israel’s Targeted Assassinations
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো:
(১) সন্ত্রাসী সংগঠন লেহি’র গুপ্তহত্যা, (২) উগ্র জায়নবাদের উত্থান, (৩) ইহুদীদের নৈশ প্রহরী হাশোমারের ইতিহাস, (৪) আইডিএফের পূর্বসূরি হাগানার উত্থান, (৫) নাৎসিদের উপর ইহুদী ব্রিগেডের প্রতিশোধ, (৬) ফিলিস্তিন থেকে জার্মানদের উচ্ছেদ, (৮) হাসান সালামা হত্যাপ্রচেষ্টা
ফিচার ইমেজ: Haaretz