গবাদি পশুর খাদ্যের জন্য ওকপাতা সংগ্রহ করতে গিয়েছিল ওরা- দুপুরের খানিক আগে। সব মিলিয়ে জনাকুড়ি মহিলা ও বালিকা ছিল দলটাতে। গ্রাম থেকে আধ মাইল দূরে গিয়ে তারা যে যার মতো গাছে চড়ে পাতা কাটতে থাকে।
ফুট-চারেক গভীর একটি খাদের কিনারে অবস্থিত একটা গাছে চড়েছিল তাদেরই তিনজন সঙ্গী। পাতা সংগ্রহ শেষে গাছ থেকে নামতে শুরু করে দুর্ভাগা মেয়েটি। সে টেরও পায়নি, কী ভীষণ বিভীষিকা তারই অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে ছিল ওই গাছেরই নিচে! আর যখন টের পেল, তখন তার একটি পা কুখ্যাত চম্পাবতের মানুষখেকোর নরমাংস-লালায়িত মুখে!
এই ঘটনার পাঁচদিন পর ঘটনাস্থল অর্থাৎ উত্তরাখন্ডের পালিগ্রামে এসে পৌঁছলেন জগদ্বিখ্যাত শিকারি জিম করবেট- ত্রাস সৃষ্টিকারী এই বিভীষিকাকে নরক দর্শন করাতে!
আইরিশ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক জিম করবেটের পূর্ণ নাম এডওয়ার্ড জেমস করবেট। সাবেক মিলিটারি সদস্য ক্রিস্টোফার উইলিয়াম করবেট ও মেরি জেনের অষ্টম সন্তান তিনি। উইলিয়াম মিলিটারিতে ইস্তফা দিয়ে ১৮৬২ সালে নৈনিতালের কলাধুঙ্গিতে একটি বাড়ি কিনে সেখানেই সপরিবারে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানকার পোস্টমাস্টার বনে যান। এই বাড়িতেই ১৮৭৫ সালের ২৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন কিংবদন্তি শিকারি জিম করবেট।
করবেট ভাইবোনেরা কলাধুঙ্গির বন্য পরিবেশে হেসে খেলে বেড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু সত্বর এই হাসি-আনন্দে ছেদ পড়ে যখন পরিবারের একমাত্র আয়ক্ষম ব্যক্তি উইলিয়ামের ভবলীলা সাঙ্গ হয়। গৃহস্থালির তাগিদে খোদ বিধবা মেরি জেনই নেমে পড়েন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় এবং অনতিবিলম্বে নৈনিতালের অন্যতম একজন সফল ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
কিছুকাল বাদে করবেটের বড় ভাই পিতার পোস্টমাস্টারের চাকরিতে বহাল হন। ততদিনে তাদের গ্রামের আশপাশের বন্য প্রকৃতি ও জন্তু-জানোয়ারেরা প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে শুরু করেছে অল্পবয়সী জিম করবেটকে।
নিজের গরজে ও স্বভাবসুলভ উৎসাহে খুব অল্প বয়সেই তিনি বন আর বন্য প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু শিখে ফেলেন। পশুপাখিদের ডাক ও শব্দ শুনে তাদের শনাক্ত করা থেকে শুরু করে জন্তু-জানোয়ারদের গমনপথ অনুসরণ করে অবস্থান নির্ণয়- সব বিদ্যেই তার নখদর্পণে চলে আসে। এবং এসব দক্ষতাই পরবর্তীকালে ভীষণ সব নরখাদক-সংহারে তাকে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
করবেট উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বেশি সময় ব্যয় করেননি। শেরউড কলেজে ভর্তি হলেও, ওক ওপেনিং স্কুল থেকে পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে তার নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে। জীবিকার প্রয়োজনে ফুয়েল ইন্সপেক্টর হিসেবে বেঙ্গল ও নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে যোগদান করে তিনি সত্বর অর্থোপার্জনে ব্রতী হন।
তরুণ বয়সে জিমের ছিল প্রচণ্ড রকম মাছ ধরা ও শিকারের নেশা। পরবর্তীকালে অবশ্য বন্দুকের চেয়ে ক্যামেরার প্রয়োগ করতেই তিনি অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। যদিও মানুষখেকো বাঘ ও চিতা নিধনে তার বন্দুক সর্বদাই গর্জে উঠত।
১৯১১ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে জিম করবেট ডজনখানেক মানুষখেকোকে যমলোকে পাঠান- যারা প্রায় ১৫০০ মানুষের প্রাণনাশ করেছিল। আর এই সকল শিকারে মারাত্মক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি একাই যেতেন- কোনো মনুষ্য সহকর্মী বা সহায়ক তার ছিল না! কেবলমাত্র রবিন নামক ছোট্ট একটি বিশ্বস্ত সারমেয় ক্বচিৎ তার সঙ্গ নিত।
ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন বইতে করবেটের এই ক্ষুদে সহচর সম্পর্কে অনেক তথ্যই পাওয়া যায়। ভারতের তুমুল জনপ্রিয় রেডিও স্টেশন রেডিও মির্চির অন্যতম বহুলশ্রুত শো সানডে সাসপেন্স-এ এই রবিনকে নিয়ে খোদ জিম করবেটের একটি লেখা প্রচারিত হয়েছে।
উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের তৎকালীন স্থানীয় সরকারের তলবে প্রায়ই মনুষ্যসংহারী বাঘ ও চিতা বধ করে তাকে জনমানসে শান্তি পুনঃস্থাপন করতে হতো। এই কারণেই কখনো কখনো তাকে ‘মানবতাবাদী শিকারি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, আর স্মরণ করা হয় গভীর শ্রদ্ধায়।
তার প্রথম শিকারকৃত নরখাদকের পরিচিতি ছিল চম্পাবতের মানুষখেকো বাঘ নামে। কিন্তু করবেট তার সুদক্ষ তদন্তশক্তির মাধ্যমে বুঝতে পারেন, সেই মনুষ্যসংহারী বিভীষিকাটি মূলত একটি বাঘিনী- যার নির্দয় পাশবিকতায় ৪৩৪ জনের মতো মানুষের ইহলীলা সাঙ্গ হয়। আর লেখার শুরুতে এই কুখ্যাত বাঘিনীটিরই অন্যতম এক কুকীর্তির আভাস দেওয়া হয়েছে।
বাঘিনীটির নরসংহারী জীবনের সূচনা হয় নেপালে এবং সেখানে প্রায় ২০০ জন মানুষকে হত্যা করে নেপালি আর্মির তাড়া খেয়ে সে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়। সীমান্ত পেরিয়েও তার হত্যালীলায় কোনো ভাটা পড়েনি।
উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুনে সে রীতিমতো তাণ্ডব শুরু করে। উন্মুক্ত দিবালোকে বাঘিনীটি একটি ষোল বছরের মেয়েকে হত্যা করে- যেমনটি সে আগেও করেছে। করবেটে তার লেখনীতে বলেছেন, এই বাঘিনী বাদে অন্য কোনো নরখাদক যে দিনের আলোয় এমনিভাবে মানুষ মেরেছে, এমনটা তিনি কখনো শোনেনইনি- দেখা তো দূরের কথা!
১৯০৭ সালে যখন মেয়েটি বাঘিনীর শিকার হয়, তখন করবেট অসাধারণ নিপুণতায় রক্তের দাগ অনুসরণ করে তার অবস্থান নির্ণয় করেন। এই দুঃসাহসিক কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রায় নিজের প্রাণটাই খোয়াতে বসেছিলেন। পরের দিন প্রায় ৩০০ গ্রামবাসী নিয়ে ঝোপজঙ্গলে বিট দিয়ে তিনি বাঘিনী সংহারে নেমে পড়েন এবং নরখাদকটির বুকে, কাঁধে ও পরিশেষে পায়ে গুলি করে তাকে নরক দর্শন করান।
নরভক্ষক চিতা শিকারে করবেটের হাতেখড়ি হয় আরো বছর তিনেক পর আলমোড়াতে। পানারের সেই ত্রাস সঞ্চারি মানুষখেকো ৪০০-এর ওপরে নরহত্যা করে আলমোড়া অঞ্চলে ব্যাপক ত্রাস সৃষ্টি করেছিল।
এছাড়া কেদারনাথ ও বদ্রীনাথের দুর্গম ও বিপদসংকুল তীর্থপথে ৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওঁৎ পেতে থাকা বহুল পরিচিত রুদ্রপ্রয়াগের চিতা, গবাদি পশু সাবাড়ে ওস্তাদ বাঘ পাওয়ালগড়ের কুমার সাহেব সহ মোট ৩৩ টি বাঘ ও চিতা নিধন করে তিনি প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
তার লেখা ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন ভারত, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায় এবং ২৭ টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়। করবেটের অন্যান্য বিখ্যাত শিকারনামার ভেতরে টাইগার্স অব চৌগড়, দ্য মুক্তেশ্বর ম্যান ইটার, তল্লাদেশ ম্যান ইটার, দ্য থাক ম্যান ইটার এবং দ্য মোহন ম্যান ইটার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অদ্বিতীয় শিকারি হওয়া সত্ত্বেও করবেট জীবনভর মনেপ্রাণে একজন পশুপ্রেমী ছিলেন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বন্য প্রাণীর গুরুত্ব তিনি প্রবলভাবে অনুভব করেছিলেন এবং এই বিষয়ে জনমানসে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি বহুসংখ্যক বক্তৃতা দিয়েছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বোদ্ধা মহলে সরবরাহ করেছেন বিচিত্রসব তথ্য।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও জিম করবেট আমাদের মহাদেশের একজন অগ্রদূত। ১৯৩৬-এ তারই আন্তরিক সহায়তায় নির্মিত হয় নৈনিতালের দ্য হেইলি ন্যাশনাল পার্ক, যেটি কি না এশিয়ারই প্রথম ন্যাশনাল পার্ক।
পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সালে এই পার্কের নাম পরিবর্তন করে ‘জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক’ রাখা হয়- এই মহান মানুষটির সম্মানে। দ্য ইন্দোচাইনিজ টাইগার নামক এক জাতের বিলুপ্তপ্রায় বাঘের নামও ‘করবেট’স টাইগার’ রাখা হয় ১৯৬৮-তে।
ইন্ডিয়ান পাবলিক সার্ভিসে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কায়সার-ই-হিন্দ’ মেডেলে সম্মানিত, আজীবন অকৃতদার এই মানুষটি ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে ১৯৪৭ সালে বোন ম্যাগির সাথে কেনিয়াতে চলে যান। সেখানে তিনি তার সারাজীবনের দুর্ধর্ষ সব অভিযানের রোমাঞ্চগাথা মলাটবদ্ধ করতে থাকেন। অবশেষে ১৯৫৫ সালের ১৯ এপ্রিল, ট্রি টপস বইটি লেখার কিছুদিন পরে, করবেট পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
১৯৪৮ সালে ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন শিরোনামে পরিচালক বায়রন হাসকিন হলিউডে নির্মান করেন প্রথম এবং একমাত্র জিম করবেট ফিল্ম। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে, গোটা সিনেমাটির কোনো দৃশ্যই করবেটের বই থেকে নেওয়া হয়নি- পুরো চিত্রনাট্যটাই ছিল নির্মাতার কল্পনাপ্রসূত। পরবর্তীতকালে জিম করবেটের কীর্তি অবলম্বনে ১৯৮৬ ও ২০০৫ সালে যথাক্রমে ম্যান ইটার্স অব ইন্ডিয়া নামে একটি ডকুমেন্টারি ড্রামা এবং দ্য ম্যান ইটিং লেপার্ড অব রুদ্রপ্রয়াগ শিরোনামে একটি টিভি চলচ্চিত্র তৈরি হয়।