আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে তৎকালীন জার্মানির মুয়েনস্টারবার্গে বসবাস করত কার্ল ডেনকে, মানুষের কাছে যে পরিচিত ছিল এক আপাদমস্তক ভদ্রলোক হিসেবে। কিন্তু এই লোকটির ছিল এক ভয়ঙ্কর নেশা, মানুষের মাংস রান্না করে খাওয়া!
কার্ল ডেনকের জন্ম ১৮৭০ সালের ১০ আগস্টে, ওবেরকুনজেন্ডরে, আজ যেটা ক্যালিনোইস গোর্ন নামে পরিচিত। দশ বছর বয়সে সে পরিবারের সাথে মুয়েনস্টারবার্গে (আজকে যেটা পোল্যান্ডের জিয়েবিচ) চলে আসে।
ছোটবেলায় সে ছিল সরল প্রকৃতির। একই সাথে ছিল একগুঁয়ে ধরনের। কিছুদিন স্কুলে গেলেও শিক্ষকেরা তার উপর অত্যন্ত বিরক্ত ছিল। পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ কিংবা কোনো কিছু আয়ত্ত করার মতো মানসিকতাই ছিল না তার। এজন্য প্রায়ই শাস্তি দেয়া হত তাকে। বারো বছর বয়সে সে স্কুল ছেড়ে দেয়, চলে যায় বাড়ি ছেড়েও।
তার বয়স যখন পঁচিশ, তখন বাবা মারা যায়। এরপর পরিবার থেকে কিছু টাকা পেয়ে জমি কিনে চাষবাসের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়, বিক্রি করে দেয় জমি। তারপর একটা বাড়ি কিনলেও, মন্দার কারণে সেটাও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় সে।
বড় হবার পর থেকে তার মধ্যে একাকী থাকবার প্রবণতা দেখা দেয়। তার পরিবারের লোকজন জানায়, ভয় কিংবা বিরক্তি এই দুটো ব্যাপার কখনোই ডেনকের মধ্যে দেখা যায় নি। এমনকি তারা তাকে কখনো অতিমাত্রায় রাগ পর্যন্ত করতে দেখে নি। যৌবনে তো সে একাই থাকত নিজের মতো। কেবল একবার পরিবারের লোকজনের সাথে খেতে এসেছিল সে। ঐ একবারের আগমনটাই মনে রয়ে গেছে তাদের, কারণ ডেনকে সেবারে একাই সাবাড় করেছিল ১ কেজির মত মাংস।
তবে শহরের মানুষের কাছে ডেনকে পরিচিত ছিল তার ভদ্রতা, নম্রতা আর বিনয়ের জন্য। মাঝেমধ্যে মানুষকে সাহায্যের জন্যও তার সুখ্যাতি ছিল। স্থানীয় চার্চে বাদ্যযন্ত্র বাজাত সে। চমৎকার আচরণের জন্য তার একটা ডাকনামও জুটেছিল, ঠিক ধর্মীয় যাজকদের মত, ‘ফাদার ডেনকে’।
এই ভদ্রতার আড়ালের চেহারাটি প্রকাশ পাবার দিনটি ছিল ১৯২৪ সালের ডিসেম্বরের ২১ তারিখ। সেদিন বেলা ১টার দিকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে ছুটে এল এক লোক, রক্ত ঝরছিল তার শরীর থেকে। ভয়ার্ত চেহারায় সে পুলিশকে জানাল, কার্ল ডেনকে নাকি একটা কুঠার দিয়ে তাকে মারার চেষ্টা করেছে। ভিনসেনজ অলিভার নামের এই লোকটি ছিল ভ্যাগাবন্ড প্রকৃতির। ওদিকে মুয়েনস্টারবার্গের মানুষ ডেনকেকে চিনত একজন ভালো মানুষ হিসেবে। মাত্র নয় হাজার মানুষের বসবাস ছিল সেই শহরে, যেখানে মোটামুটি সবাই সবাইকে চিনত। তাই শুরুতেই পুলিশ বিশ্বাস করল না অলিভারকে।
একজন ডাক্তার অলিভারের আঘাতটা পরীক্ষা করে পুলিশকে নিশ্চিত করল যে, তাকে কোনো ভারী অস্ত্র দিয়েই আঘাত করা হয়েছে। এরপর ডেনকেকে গ্রেফতার করল পুলিশ। সে অলিভারের উপর হামলার কথা স্বীকার করল। কিন্তু অলিভারকে একজন চোর ভেবেই তার উপর আঘাত করেছে, এমনটাই দাবি করল সে। অবশ্য নিজের দাবিটা প্রমাণ করে পুলিশের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করেনি ডেনকে। তাকে থানার হাজতে আটকে রাখার কয়েক ঘণ্টা পরেই সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় তার মৃতদেহ। শহরের মানুষের কাছে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ডেনকে আত্মহত্যা করে গলায় রুমাল পেঁচিয়ে।
ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে পুলিশ যায় ডেনকের বাড়িতে। ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফ্রেডেরিখ পিয়েত্রুস্কির রিপোর্ট থেকে জানা যায় তারা কী বীভৎস দৃশ্য দেখেছিল সেখানে।
সে বাড়িতে পাওয়া গিয়েছিল টুকরো টুকরো মাংস আর হাড়। মাংসগুলো চুবানো ছিল একটা কাঠের ড্রামে লবণ মেশানো পানিতে। মাংসের রং আর প্রকৃতি দেখে তদন্তকারী বিশেষজ্ঞরা জানান, ভিকটিমদের মেরে ফেলার কয়েক ঘণ্টা পর তাদের শরীর টুকরো করার কাজ শুরু করত ডেনকে।
তিনটা পাত্রে পাওয়া গিয়েছিল রান্না করা মাংস, সাথে ছিল ক্রিম সস। একটা পাত্রের অর্ধেক পরিমাণ মাংস ছিল না। বোঝাই যাচ্ছিল, গ্রেফতার হবার আগ মুহুর্তে সেটুকু খেয়েছিল ডেনকে।
শরীর থেকে মাংস কেটে নিয়ে রান্না করে ডেনকে তো নিজে খেতই, সেগুলো বাজারেও বিক্রি করত শুকরের মাংস বলে। আর সে মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করত তার ভিকটিমদের।
সে বাড়িতে আরো পাওয়া গিয়েছিল একটা গামলা ভর্তি চর্বি। সেগুলো পরীক্ষা করেও পাওয়া গিয়েছিল মানব প্রোটিনের অস্তিত্ব, মানে ওগুলো ডেনকের হাতে খুন হওয়াদের শরীর থেকেই নেয়া।
ডেনকের বাড়িতে, বাড়ির পেছনের জলাশয়ে আর সে শহরের ধারের এক বনের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল মানব শরীরের বিভিন্ন অংশের অবশিষ্টাংশ। তার মধ্যে ছিল হাত, পা, উরু, গলা, বুকসহ মানুষের শরীরের প্রায় সমস্ত অংশের হাড়। আর পাওয়া গিয়েছিল তিনশ একান্নটি দাঁত।
দাঁতগুলো রাখা ছিল একটা টাকার থলে, দুটো টিনের বাক্স আর তিনটা কাগজের ব্যাগের ভেতরে। টাকার থলেতে রাখা ছিল কেবল মাড়ির দাঁত, আর অন্যগুলোতে ছিল বাকি দাঁত। ছয়টা ছাড়া বাকি সব দাঁতই খুব ভালোভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল ডেনকে। অন্তত ২০ জন মানুষের দাঁতের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল সব মিলিয়ে।
পরীক্ষা করে যে কজনের শরীরের অংশ আলাদা আলাদাভাবে বোঝা গেছে, বিশেষজ্ঞদের মতে, তাদের মধ্যে একজনের বয়স ষোল বছরের বেশি ছিল না, একজন ছিল ত্রিশোর্ধ, দুজন বিশোর্ধ আর বাকি চারজন ছিল চল্লিশোর্ধ। ডেনকের বাড়ি থেকে যে হাড় ও অন্যান্য অংশ পাওয়া গিয়েছিল সেগুলো অন্তত আট জন মানুষের শরীরের অংশ বলে জানা যায় পরীক্ষার পর।
ডেনকে তার খুন করা মানুষগুলোর চামড়া আর চর্বি থেকে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী বানাতো। প্যান্ট কিংবা মোজা বাঁধার জন্য বেল্টের মতো যে সাসপেন্ডার নামক লম্বা বন্ধনী ব্যবহার করা সেটা বানাতো চামড়া থেকে। এমনকি আত্মহত্যা করার সময় তার নিজের পরনেই ছিল এমন একটা সাসপেন্ডার। এছাড়াও চামড়া আর চুল দিয়ে দড়ি বানাত ডেনকে। চর্বি থেকে সাবান বানানোর চেষ্টার নমুনাও পাওয়া গেছে তার ঘর থেকে।
সে ঘরে আরো পাওয়া যায় একসাথে বেঁধে রাখা অবস্থায় একচল্লিশটি পুরনো কাপড়ের পুটলি। বিভিন্ন মানুষের পরিচয়পত্র আর নানাবিধ কাগজও ছিল। ডেনকে ভিকটিমদের এই ব্যক্তিগত কাগজপত্রগুলো যত্ন করে সংরক্ষণ করেছিল।
কয়েকটা কাগজে ডেনকের হাতে লেখা ৩০ জন মানুষের নাম পাওয়া যায়। সেখানে নারী পুরুষ উভয়ের নামই ছিল। কোনো কোনো নামের পাশে সে মানুষটির কিছু তথ্যও লেখা ছিল। সেই লিখিত নামের তালিকার কিছু লোকের পরিচয়পত্রও পাওয়া যায় ঘরে। অর্থাৎ সেই তালিকার সবাই যে ডেনকের হাতে মারা পড়ে তার পেটে গিয়েছিল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ধারণা করা হয়, অন্তত চল্লিশ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল ডেনকে।
নরঘাতক ডেনকের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া যা কিছু সে ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল তার মধ্যে ছিল তিনটা কুঠার, একটা বড় কাঠ কাটার করাত, একটা গাছ কাটার করাত, একটা পিকেক্স বা দুদিকেই ধারালো কুঠার আর তিনটা ছুরি। এই পিকেক্সটা দিয়েই অলিভারের উপর হামলা করেছিল ডেনকে।
সবার কাছে এমন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ডেনকে কেন যে এই ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে পুলিশ এবং বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। মানুষের যে স্বাভাবিক নৈতিকতা বোধ থাকে, এই লোকটার মধ্যে হয়ত তেমন কোনো বোধের অস্তিত্বই ছিল না। প্রচণ্ড রকমের স্বার্থপরতা কাজ করত তার ভেতরে। এমনিতে মানুষের ক্ষতি করার ইচ্ছে না থাকলেও, এমন নৃশংস কাজ সে হয়ত করেছে মূলত খাবারের চাহিদার কারণে। আর দশটা মানুষের মতো খাদ্যাভ্যাস তার ছিল না। অনেক বেশি পরিমাণ খাবারের চাহিদা থাকায় সেটা মেটানোর আর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে এই বীভৎস কাজে নেমে পড়েছিল সে।
স্কুলে সে মার খেত বোকা বলে। চাষবাসের চেষ্টা করেও পারে নি। ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। শৈশব কৈশোর আর যৌবনের গোটা সময় এমন সব ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে অর্থোপার্জনের আর কোনো পথই বাকি ছিল না তার কাছে। তাই খাবার যোগাড় আর টাকা আয়ের জন্য রেলস্টেশন থেকে অপরিচিত মানুষ বাসায় নিয়ে এসে খুন করার কাজ বেছে নিয়েছিল ডেনকে।
স্টেশনটা ছিল তার বাসার একেবারে কাছেই। আর তার বাসাটাও শহরের একদম বাইরের দিকে হবার কারণে, কেউ দেখে ফেলারও সুযোগ ছিল না। ছন্নছাড়া, ভিক্ষুক, স্টেশনে আসা অন্য শহরের যাত্রী- ডেনকে এমন মানুষদেরই অতিথি হিসেবে আপ্যায়ন করার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যেত নিজের বাসায়। ভ্যাগাবন্ড কিংবা অপরিচিতদের আর কে-ইবা বাসায় নিয়ে খাওয়াতে চায়। সহজেই তাই ডেনকের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তারা পা দিত নিজেদের মৃত্যুফাঁদে।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হল এটাই, একটানা ১৫ বছর ধরে কীভাবে ডেনকে চালিয়ে গেল একের পর এক লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড? মুয়েনস্টারবার্গের একটি মানুষও জানতে পারল না, কীভাবে তাদের পছন্দের মানুষ ফাদার ডেনকে দিনের পর দিন তাদের বোকা বানিয়ে, মানুষের মাংস থেকে খাবার আর চামড়া থেকে জুতার ফিতা বানিয়ে বিক্রি করছিল তাদের কাছেই। এমনকি তার প্রতিবেশীরাও টের পায় নি তাদের ঘরের পাশেই কীভাবে চলছিল এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।
ভিনসেনজ অলিভারকে আক্রমণের আগে মাত্র দুবার এমন ঘটনা ঘটেছিল, ডেনকের হাত গলে পালিয়ে গিয়েছিল ভিকটিম, যদিও সেগুলো পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় নি। একবার এক লোককে সারা গায়ে রক্ত মাখা অবস্থায় দৌড়ে ডেনকের বাড়ি থেকে বের হতে দেখা গিয়েছিল, যাকে এরপর আর কখনো পাওয়া যায় নি। কেউ সেটা পুলিশকে জানানোরও দরকার বোধ করে নি।
এর কিছুদিন পরেই আরেকজন লোক ডেনকের প্রতিবেশীদের জানায়, তাকে ডেনকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু সে তার চেয়ে শক্তিশালী হবার কারণে নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে পেরেছিল। কেন জানি ঘটনাটা কেউ গুরুত্বের সাথে নেয় নি। এই ঘটনার কথা সাথে সাথে পুলিশকে জানালে হয়ত ঠেকানো যেত আরও কিছু নিরপরাধ প্রাণের মৃত্যু।
তবে ডেনকের প্রতিবেশীরা সবসময় তার বাসা থেকে একটা বিশ্রী রকমের কড়া গন্ধ পেত। কিন্তু কেউ কখনো ভেতরে ঢুকে দেখার আগ্রহ বোধ করেনি কী হচ্ছে তা দেখার। অবশ্য তারা একটু আশ্চর্য হত এই ভেবে যে, দুর্মূল্যের বাজারেও কীভাবে ডেনকের কাছে এত মাংসের মজুদ থাকে। তারা ধরে নিয়েছিল বাজারে মাংসের দাম চড়া হলে ডেনকে হয়ত কালোবাজার থেকে কুকুরের মাংস কিনে খেত। গভীর রাতে তার বাসা থেকে হাতুড়ি পেটানো আর করাত দিয়ে কী জানি কাটার শব্দ শোনা যেত। তখন তারা ভাবত, সে হয়ত পর দিন সকালে বাজারে বিক্রির জন্য খাবার তৈরির কাজ করছে। এই ভেবে ভেবেই তারা কখনও পাত্তা দেয় নি ডেনকের গভীর রাতের কাজকর্মকে।
শহরের মানুষের নিস্পৃহতার কারণেই ডেনকের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল দিনের পর দিন এই জঘন্য কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া। সে রাতের বেলা ভারী বস্তা নিয়ে কোথায় যেত, আর কেনইবা খালি হাতে ফিরে আসত সেটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা হয় নি। এত রাতে তার কী কাজ, সেই বস্তাতে কী ছিল, কেন শুধু রাতেই নিয়ে যেত সেগুলো, এসব প্রশ্নও কেউ করে নি। সে যেসব পুরনো জামা-জুতা বিক্রি করত বাজারে, সেগুলোই বা কোথা থেকে আসত সেটা নিয়েও কারো মনে সন্দেহ জাগে নি।
আসলে ব্যাপারটা হলো, কারো কারো মনে ডেনকের চলাফেরা নিয়ে একটু সন্দেহ থাকলেও, সে যেহেতু শহরের অধিবাসীদের কারো ক্ষতি করে নি, তাই সেটা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্যও হয় নি। এ সুযোগে ডেনকে তার নৃশংস নরভোজ চালিয়ে গিয়েছিল বছরের পর বছর।