মুঘল ইতিহাস বরাবরই ক্ষমতা ও রক্তপাতের ইতিহাস। মুঘল বংশে বেশ কিছু হতভাগ্য শাহাজাদার জন্ম হয়েছিল, যাদের জীবন প্রবাহিত হয়েছিল করুণ পরিণতির দিকে। এর মধ্যে সবচেয়ে হতভাগ্য বলা যায় শাহজাদা খসরুকে। খসরু মির্জা ছিলেন সম্রাট আকবরের নাতি ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র, পরবর্তী সম্রাট শাহজাহান (খুররম) ছিলেন তার আপন ভাই। ভাগ্য খসরুর অনুকূলে থাকলে তার নামটি আজ ইতিহাসের তলানীতে না থেকে অন্যান্য মুঘল সম্রাটদের নামের সাথে গৌরবের সাথে উচ্চারিত হতো। পিতামহ আর অভিজাতদের উস্কানীতে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এক রক্তাক্ত পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল খসরুকে।
জাহাঙ্গীরের প্রথম স্ত্রী ছিলেন তার আপন মামা, অম্বরের রাণা রাজা ভগবান দাসের কন্যা মনাবাঈ। ১৫৮৫ সালে হিন্দু ও মুসলিম রীতির সমন্বয়ে বিপুল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে জাহাঙ্গীরের বিয়ে হয়। ১৫৮৭ সালের ১৬ আগস্ট তাদের ঘরে জন্ম হয় শাহজাদা খসরুর। জাহাঙ্গীর ছিলেন একই সাথে উচ্চাভিলাষী ও দায়িত্ববিমুখ। উচ্ছৃংখল আচরণের জন্য তিনি কারোই প্রিয়ভাজন ছিলেন না। তার মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রেও তিনি পারদর্শিতা দেখাতে ব্যর্থ হন। মেবারের বিরুদ্ধে আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। এরকম অবস্থায় আকবরের ঘনিষ্ঠজনরা উত্তরাধিকার হিসেবে জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই দানিয়েলকেই বিবেচনা করতে শুরু করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৬০১ সালে জাহাঙ্গীর পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এলাহাবাদে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বিদ্রোহের এই সময়ে মানসিংহের মতো প্রভাবশালী অমাত্যরা এমনকি স্বয়ং সম্রাট আকবরও উত্তরাধিকার হিসেবে জাহাঙ্গীরের পুত্র খসরুকে মনোনীত করার চেষ্টা করেন। এর যথেষ্ট কারণও ছিল। মুঘল দরবারের এক পাদ্রী এডওয়ার্ড টেরির মতে, “১৮ বছর বয়সে খসরু সে সব কিছু ছিলেন, যা তার পিতা ছিলেন না; ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সাহসী, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিভাবান সেনাপ্রধান।” এই সিদ্ধান্তে বাধ্য হয়ে জাহাঙ্গীর পিতার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আকবর যদিও জাহাঙ্গীরের বিদ্রোহ সামলাতে সক্ষম হন, কিন্তু তার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। তার এক পুত্র মুরাদ অতিরিক্ত মদ্যপানে আগেই মারা গিয়েছিলেন, আরেক পুত্র দানিয়েলও কম বয়সেই মারা গেলে শোকাহত সম্রাট জাহাঙ্গীরকে ক্ষমা করে দেন আর মৃত্যুর আগে মুঘল বংশের উত্তরাধিকার মনোনীত করে যান।
কিন্তু মই নিয়ে হাঁটা দেওয়া ব্যক্তিরা তখন কেউই খবর রাখেননি গাছে উঠিয়ে দেয়া খসরুর অবস্থার। খসরুর নিজের সিংহাসনের প্রতি তেমন আকর্ষণ ছিলনা। পরিস্থিতির শিকার হয়ে সম্রাট আকবর, এমনকি মানসিংহ, ভগবান দাস, খান-এ-খানার মতো প্রভাবশালী অমাত্যবর্গ, এমনকি জাহাঙ্গীরের সৎ মাতা রুকাইয়াহ বেগম ও সেলিমা বেগম পর্যন্ত খসরুকে সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন। গুরুস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের এমন সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণায় শাহজাদা খসরুর মনেও উচ্চাভিলাষ জেগে ওঠে।
সম্রাট আকবরের জীবন সায়াহ্নে মুঘল দরবারের অভিজাতবর্গ উত্তরাধিকার প্রশ্নে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একদল ছিলেন জাহাঙ্গীরের সমর্থক, আরেক দল ছিলেন খসরুর সমর্থক। ১৬০৫ সালের ২৫ অক্টোবর আকবরের মৃত্যু হলে সিংহাসনে চূড়ান্তভাবে বসেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। শুরুতে তিনি তার বিদ্রোহীদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার মনস্থ করেন। সিংহাসনে বসার পর মানসিংহ সহ অনেক খসরু সমর্থকই জাহাঙ্গীরের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করেন। খসরু ছিলেন সম্পর্কে মানসিংহের ভাগ্নে। মানসিংহ চেয়েছিলেন খসরুকে নিজের সাথে বাংলায় নিয়ে যেতে। তিনি ভেবেছিলেন সম্রাজ্যের দূরবর্তী এই অঞ্চলে সিংহাসনে বসাতে পারলে খসরু প্রায় স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে পারবেন। কিন্তু সাবধানী জাহাঙ্গীর খসরুকে রাজধানী ছাড়ার অনুমতি দেননি। শাহজাদা খসরু প্রায় বন্দী জীবন কাটাতে বাধ্য হন। আগ্রার দুর্গে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারলেও দুর্গের বাইরে যাবার অনুমতি তার ছিল না। তাকে সামান্য কিছু সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, রাজদরবারে সম্মানিত পদও তিনি লাভ করেন। কিন্তু যার অন্তরে স্বয়ং আকবরের জ্বালানো উচ্চাভিলাষের আগুন জ্বলছিল, তার জন্য এই সোনার খাঁচা কখনোই আরামপ্রদ হওয়া সম্ভব ছিল না। ক্রমে বন্দীদশা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কৌশল করতে শুরু করেন খসরু। এ কাজে তাকে সাহায্য করেন তৎকালীন অন্যতম বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব মির্জা শাহরুখের পুত্র মির্জা হাসান।
সেকেন্দ্রাতে পিতামহ আকবরের সমাধি দেখার অনুমতি নিয়ে ১৬০৬ সালের ৬ এপ্রিল ৩৫০ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন খসরু। এরপর তিনি অগ্রসর হন মথুরার দিকে। সেখানে হুসেন বেগ ৩,০০০ ঘোড়সওয়ার নিয়ে তার সাথে যোগ দেন। এবার খসরুর সম্মিলিত বাহিনী অগ্রসর হয় লাহোরের দিকে। পানিপথে তাদের সাক্ষাৎ হয় লাহোরের দিউয়ান আবদুর রহিমের সাথে। আবদুর রহিম এ সময় সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আগ্রা যাচ্ছিলেন। তিনি খসরুর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং খসরু তাকে নিজের উজির নিযুক্ত করেন।
লাহোরে খসরুর সমর্থক আরও বার হাজার মানুষ অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুগত লাহোরের শাসক দিলওয়ার খান প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি নগরীর প্রধান ফটক বন্ধ করে দেন। খসরু এবার লাহোর দুর্গ অবরোধ করেন। নয় দিন ধরে এই অবরধ চলতে থাকে। বাধ্য হয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরকে এবার দৃষ্টি দিতে হয় লাহোরের দিকে। তিনি সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সশরীরে উপস্থিত হন খসরুকে প্রতিহত করতে। প্রথমে তিনি খসরুকে আহবান জানান আত্মসমর্পন করতে। কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল থাকায় খসরু যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের স্থানে অটল থাকেন। বাধ্য হয়ে শেখ ফরিদের নেতৃত্বে সম্রাটে জাহাঙ্গীরের বাহিনী বিদ্রোহীদের উপর আক্রমণ চালায়। খসরুর অধীনে বার হাজারের বেশি সৈন্য থাকলেও এরা না ছিল যথেষ্ট দক্ষ, না ছিল এদের মধ্যে পর্যাপ্ত শৃঙ্খলা। সম্রাটের প্রশিক্ষিত বাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হতে থাকে খসরুর বিদ্রোহী সেনাদল।
আরেক অদূরদর্শী হুসেন বেগ এই অবস্থায় খসরুকে কাবুল অধিকার করে দিল্লী আক্রমণের পরামর্শ দেন। অবস্থার চাপে পড়া খসরুও আগ-পিছ বিবেচনা না করে তা-ই করতে রওনা হন। এরকম সময়ে এই সিদ্ধান্ত যে কতোটা হঠকারী ছিল, তা যে কেউ উপলব্ধি করতে সক্ষম। আসলে উচ্চাকাঙ্খী ও স্বাধীনতাকামী খসরুর জন্য পুনরায় বন্দীদশায় ফেরার চাইতে যেকোনো ন্যূনতম সুযোগ গ্রহণ করাই হয়তো বেশি সহজ ছিল। চেনাব নদী পার হওয়ার সময় নিজের লোকের হাতেই খসরু বন্দী হন।
বন্দী শাহজাদা ও তার অনুগামীদের লাহোরে নিয়ে আসা হয়। এবার জাহাঙ্গীর বিদ্রোহীদের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করেন। খসরুর প্রধান সমর্থক হুসেন বেগ ও আবদুর রহিমের গায়ে যথাক্রমে গরু ও গাধার চামড়া পরিয়ে দেয়া হয়। তারপর তাদের পেছনমুখো করে গাধার পিঠে চড়িয়ে সারা নগরী পরিক্রমণ করানো হয়। বার ঘন্টার এই পরিক্রমণের ধকল না সইতে পেরে হুসেন বেগ মৃত্যুবরণ করেন। খসরুর বিশ্বাসী সমর্থকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। শাহজাদাকে হাতির পিঠে চড়িয়ে সে দৃশ্য দেখানো হয়। শাহজাদা খসরু ছিলেন কোমল মনের মানুষ। তিনি এই দৃশ্য দেখে ভেঙ্গে পড়েন। এরপরে খসরুর চোখে লোহার তার ঢুকিয়ে তাকে আংশিক অন্ধ করে দেয়া হয়। খসরুকে সাহায্য করেছিলেন অর্জুন সিং নামে এক শিখ গুরু। এই গুরুর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে ১৬০৮ সালে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এক মাসের মধ্যে বিদ্রোহীদের সম্পূর্ণরুপে দমন করে জাহাঙ্গীর আগ্রায় ফিরে যান। খসরুর এই বিদ্রোহের রাজনৈতিক তাৎপর্যের কথা যদি বলতে হয়, এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ছিল মুঘল সম্রাজ্যে পারস্যের হস্তক্ষেপ। মুঘলদের অভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে পারস্যের শাহ কান্দাহার দুর্গ দখল করে নেন।
খসরুর জনপ্রিয়তা নিঃসন্দেহে তার ভাই খুররম (শাহজাহান) এর জন্য বড় হুমকি ছিলো। তাই খসরুকে হত্যা করাই তার জন্য বেশি জরুরী হয়ে পড়েছিল। ১৬২২ সালের জানুয়ারী মাসের এক রাতে খুররম রাজা বাহাদুর নামে এক ভৃত্যকে পাঠিয়ে প্রায় অন্ধ ভাইকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করান। হত্যার পরে তার দেহ বিছানায় এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয় যাতে তার মৃত্যু স্বাভাবিক বলে মনে হয়। খসরুর মৃত্যুতে জনতা আক্রোশে ফেটে পড়ে।
মুঘল সম্রাজ্যের ইতিহাসের পাতায় পাতায় পরিহাসের খেলা। যে জাহাঙ্গীর নিজে একদিন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, তিনিও নিজ পুত্রের বিদ্রোহের শিকার হলেন; আবার পুত্রের সেই বিদ্রোহের একেবারে পেছনের কারণটাও কিন্তু ছিল এককালে তার নিজের পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। যে সিংহাসনের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ছিল, সে অন্ধ, অসহায় অবস্থায় হত্যার শিকার হলো। আর যে তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলো, সেই খুররম, ইতিহাসে প্রেমের সমাধি বানিয়ে সুবিখ্যাত প্রেমিক শাহজাহান নামে পরিচিত হলো। তার কথা না হয় অন্য এক লেখায় হবে।
তথ্যসূত্রঃ ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস- মধ্যযুগঃ মোগল পর্ব – এ কে এম শাহনেওয়াজ