ভাষা মনের ভাব প্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম। প্রাণিজগতে সকলেরই নিজস্ব ভাষা আছে। ভাষার মাধ্যমে সবাই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও ভাব বিনিময় করে থাকে। তবে অন্যান্য প্রাণী শুধু আওয়াজের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করলেও মানুষই একমাত্র জীব যারা ভাষার ক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে।
বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতিভেদে মানুষের মুখের ভাষাও আলাদা। ভাষার এই বৈচিত্র্যের ফলে বিভিন্ন ভাষার জন্ম হয়েছে, আর সেসব ভাষার চর্চা মানুষ তার বংশ পরম্পরায় করে আসছে। এভাবে ছোট থেকেই মা, বাবা, পরিবার ও অন্যদের কাছ থেকে শেখা ভাষাই হয়ে ওঠে মানুষের নিজ মুখের ভাষা। মায়ের কাছ থেকে শেখা হোক বা অন্য কারো কাছ থেকে- এটাই আমাদের কাছে মাতৃভাষা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
নিজের মাতৃভাষায় মনের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার মতো শান্তি অন্য কোনো ভাষায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিশুকাল থেকে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা মুখের ভাষার কাছে অন্যসব ভাষা যেন ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। নিজের মাতৃভাষায় কথা বলাটা যেমন স্বাচ্ছন্দ্যের, তেমনি গর্বের ব্যাপার। এখানে আব্দুল হাকিমের একটি কবিতার অংশবিশেষ না বললেই নয়,
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়
বাংলা, আমাদের মাতৃভাষা, জনসংখ্যার বিচারে যা বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বাধিক কথ্য ভাষা। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ সমগ্র পৃথিবীর প্রায় ২৬ কোটি মানুষ এই ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে থাকেন।
মনে কি প্রশ্ন জাগে? জন্মের পর থেকে যে ভাষা আমরা শুনছি, কথা বলছি, সেই বাংলা ভাষা এলো কোথা থেকে? কীভাবে হলো এর উৎপত্তি? আজকের লেখায় আপনাদের জানানো হবে কীভাবে বাংলা ভাষার জন্ম হলো, এবং কীভাবে এটি আজকের এই অবস্থানে এলো। বাংলা ভাষা আজকের অবস্থানে একদিনে আসেনি। বহু ভাষার সাথে মিশ্রণ ও বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়েই বাংলা আজকের রূপ পেয়েছে। ভাষা হলো নদীর স্রোতের মতো, যা কখনো থেমে থাকে না। নদীর স্রোত যেমন চলমান, ভাষাও তেমনি। নদী যেমন চলার পথে বিভিন্ন বাঁক নেয়, ঠিক তেমনি ভাষাও চলার পথে যুক্ত করে নতুন নতুন শব্দ। পরিবর্তন আনে নিজের মধ্যে।
ভাষার উৎপত্তি
ভাষা গবেষকদের মতে, আজ থেকে প্রায় ৫০ হাজার বা ১ লক্ষ বছর আগে মানুষ প্রথম ভাষা ব্যবহার করে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে জানা যায়, আফ্রিকার মানুষেরাই সর্বপ্রথম ভাষার ব্যবহার করেছিল। গবেষকদের ধারণা, বর্তমান পৃথিবীর যত মৃত বা জীবিত ভাষা আছে, সেসবের আদি উৎস হলো আফ্রিকার ঐসব প্রাচীন মানুষদের ভাষা। আফ্রিকা থেকে যখন মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন তাদের আদি ভাষাও বদলাতে শুরু করে। সেই ভাষা শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে জন্ম হয় আরো নতুন নতুন ভাষার। এভাবে পৃথিবীর ভাষাগুলোকে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেমন: ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী, অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠী, আফ্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠী, চীনা-তিব্বতি ভাষাগোষ্ঠী, মালয়-পলিনেশীয় ভাষাগোষ্ঠী, নাইজার-কঙ্গো ভাষাগোষ্ঠী, দ্রাবিড়ীয় ভাষাগোষ্ঠী ইত্যাদি। একটি ভাষাগোষ্ঠীর সব ভাষা এক পরিবারভুক্ত। আর সব ভাষাগোষ্ঠীই একটি মহাপরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আর তা হলো আফ্রিকার সেই আদিম ভাষা। বর্তমান বিশ্বের ভাষাগুলোর ব্যাকরণ বিশ্লেষণ করে নোয়াম চমস্কির মতো ভাষাবিদদের ধারণা, এসব ভাষার পেছনে একটি সার্বজনীন ব্যাকরণ আছে বলেই সব ভাষার মূল এক।
বাংলা ভাষার ইতিহাস জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক হাজার বছর আগে। তখন ভারতের প্রাচীন ভাষাগুলোকে বলা হতো প্রাচীন আর্য ভাষা। আনুমানিক ৪০০০ থেকে ১০০০ বছর আগে প্রোটো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলা মধ্য-এশিয়ার জনগোষ্ঠী পশ্চিম আর পূর্বদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, আর তাদের ভাষাও বিভিন্ন শাখার সৃষ্টি করে। এরই একটি শাখা হলো ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠী। আর ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর একটি শাখা ইন্দো-আর্য বা ভারতীয়-আর্য ভাষা।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর পরিধি ছিল ইউরোপ থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। মূলত, ইন্দো বলতে ভারতীয় উপমহাদেশ, এবং ইউরোপীয় বলতে ইউরোপ মহাদেশকে বোঝায়। পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এই পরিবারের ভাষাগুলোতে কথা বলে থাকে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাসহ, হিন্দি, নেপালি, ইংরেজি, গ্রিক, ল্যাটিন, ফারসি, ফরাসি, ডাচ ইত্যাদি ভাষাও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী দুটি ভূখণ্ডে বিভক্ত হওয়ার কারণে এই ভাষাগোষ্ঠীকে দুটি শাখাতে ভাগ করা হয়: শতম ও কেন্তুম। শতম শাখাটি থেকে ভারতের, আর কেন্তুম শাখা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষা এসেছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের ভাষাভাষী লোকেরা ইউরোপ ছাড়িয়ে আটলান্টিকের উপকূল এবং ভূমধ্যসাগরের উত্তর দিকে আসতে শুরু করে। পারস্য ও ভারত জয়ের মধ্য দিয়ে তারা ছড়িয়ে যায় এশিয়ার দূর এলাকাসমূহে। সমসাময়িক সিন্ধুর অধিবাসীগণও পূর্ব (গাঙ্গেয় সমভূমি), পশ্চিম এবং আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে দুটি ভাষা-শাখা, ভারতীয় আর্যভাষা (ইন্দো-আর্য) এবং ইন্দো-ইরানীয় ভাষা আলাদা হয়ে যায়।
ভারতীয় আর্যভাষা
ভারতীয় আর্যভাষার ইতিহাসে তিনটি প্রধান স্তর লক্ষ্য করা যায়। প্রথম স্তরটির নাম হলো বৈদিক ভাষা, যার সময় খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ। এই আর্যভাষা উঁচু গোত্রের মানুষদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষের কাছে বেদের ভাষা বা বৈদিক ভাষা দুর্বোধ্য মনে হতো। এছাড়া রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় প্রয়োজনে পন্ডিতরাও এটি ব্যবহার করতেন। বেদের শ্লোকগুলোও এই ভাষায় লেখা হয়েছিল।
তারপরের স্তর হলো সংস্কৃত ভাষা, যার সময় খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ পর্যন্ত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে ব্যাকরণবিদ পাণিনির হাতে এটি চূড়ান্তভাবে বিধিবদ্ধ হয়। বৈদিক ও সংস্কৃত এই দুই ভাষা হলো প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত কালিদাসের কাব্য ও নাটকের ভাষা ছিল সংস্কৃত। রামায়ণ ও মহাভারতও সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত হয়েছিল। এমনকি, এখনও সংস্কৃত ভাষা ভারতে ব্যাপকভাবে পঠিত এবং একটি পবিত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।
এর পরের স্তর প্রাকৃত ভাষা। এই ভাষাগুলো মধ্যভারতীয় আর্যভাষা হিসেবে পরিচিত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ ভাষাগুলোই কথ্য ও লিখিত ভাষা হিসেবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত থাকে। ধারণা করা হয়, প্রাচীন ভারতের প্রাকৃত ভাষাগুলোর মধ্যে পালি অন্যতম, যার জন্ম খ্রিষ্টের জন্মেরও কমপক্ষে ছয়শ বছর আগে। সংস্কৃতের সাথে এর সম্পর্ক অনেকটা বোনের মতো। পালি ছিল মধ্য বিহারের মগধ অধিবাসীদের মুখের ভাষা। সংস্কৃতের মতো পালিরও মৃত্যু ঘটেছে বহু শতাব্দী আগেই। অর্থাৎ, এখন আর এই ভাষার কোনো স্থানীয় জাতি নেই, বা সেই অর্থে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহারের মানুষ নেই; কেবল সাহিত্যিক ও ধর্মীয় ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। গৌতম বুদ্ধ এই ভাষাতেই ধর্ম প্রচার করেছিলেন। মূলত, একটি সাধারণ প্রাদেশিক ভাষা হয়েও এটি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ভাষা হয়ে উঠেছিল, যা তাকে বসিয়েছে চিরায়ত ভাষার আসনে। ফলে এই ধর্মমত সহজেই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে সক্ষম হয়।
এই প্রাকৃত ভাষাগুলো থেকে অপভ্রংশ বা বিকৃত হয়ে বিভিন্ন ভাষা, যেমন: বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবি প্রভৃতির জন্ম। সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে সর্বপ্রথম ‘অপভ্রংশ’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত কিছু অশিষ্ট শব্দকে নির্দেশ করার জন্য শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমান ভাষাবিদদের মতে, সমস্ত প্রাকৃত ভাষারই শেষ স্তর হলো অপভ্রংশ, এবং এই অপভ্রংশগুলো থেকেই সমস্ত নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার জন্ম। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব ভারতে প্রচলিত মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে পূর্বী অপভ্রংশ উদ্ভূত হয়েছিল, এবং সেই পূর্বী অপভ্রংশ থেকে মগহী, মৈথিলী ও ভোজপুরী- এই তিনটি বিহারী ভাষা এবং বাংলা, অসমীয়া ও ওড়িয়া- এই তিনটি গৌড়ীয় ভাষার উৎপত্তি ঘটে। অন্যদিকে, পশ্চিমের শৌরসেনী অপভ্রংশ থেকে হিন্দি ও অন্যান্য নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার উদ্ভব হয়।
ভাষাবিদ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকেই এসেছে বাংলা, আসামি ও ওড়িয়া ভাষা। তাই আসামি ও ওড়িয়ার সাথে বাংলার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এছাড়া মৈথিলি, মগহি, ভোজপুরিয়া ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বাংলার, কারণ সেগুলোও মাগধী অপভ্রংশের অন্য দুটি শাখা থেকে এসেছে। আরেক ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, যিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তার মতে, গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে গৌড়ীয় অপভ্রংশ হয়েই বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটে ।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে তালিকার মাধ্যমে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারা উল্লেখ করেছেন। পাঠকদের জন্য তালিকাটি নিচে দেওয়া হলো:
ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠী
(খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০-২৫০০)↓
শতম
(খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০-১২০০)↓
আর্যভাষা
(খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০-১২০০)↓
প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা
(খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০-৮০০)↓
আদিম প্রাকৃত ভাষা
(খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-৫০০)↓
প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত ভাষা এবং পালি
(খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-২০০ খ্রিষ্টাব্দ)↓
গৌড়ীয় প্রাকৃত
(২০০-৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ)↓
গৌড়ীয় অপভ্রংশ
(৪৫০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ)↓
প্রাচীন যুগ
(৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ)↓
সন্ধিযুগ
(১২০০-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ)↓
মধ্যযুগ
(১৩৫০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)↓
আধুনিক যুগ
(১৮০০- বর্তমান)
বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তন
এখানে এসে বাংলা ভাষার এই বিবর্তনকে আমরা তিনটি সময়ে ভাগ করতে পারি: প্রাচীনযুগের বাংলা, মধ্যযুগের বাংলা এবং আধুনিক যুগের বাংলা।
প্রাচীনযুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ)
চর্যাপদ
যেকোনো ভাষার ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে জানতে হলে সেটির লিখিত নমুনার দরকার হয়। এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার সর্বপ্রাচীন যে নমুনা পাওয়া গেছে, তা হলো চর্যাপদ। চর্যাপদের অন্য অনেকগুলো নামের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো চর্যাগীতিকোষ, দোহাকোষ, চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়, এবং চর্যাগীতিকা। ধারণা করা হয়, এটি পাল আমলে রচিত।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার (রয়েল লাইব্রেরি) থেকে একটি পুরোনো পুঁথি আবিষ্কার করেন। এই পুঁথিই আমাদের কাছে চর্যাপদ নামে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এই চর্যাপদ। পরে আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন- এই চর্যাপদই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। তবে এর রচনাকাল নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে এর রচনাকাল সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ), আর আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন এর রচনাকাল দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী (৯৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ)।
চর্যাপদের বাঙালি কবি ভুসুকুপা। তার লেখায় ফুটে উঠেছে বাংলার বিভিন্ন রূপবৈচিত্র। তার লেখা ৪৯ নং চর্যার পদটি হলো:
বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ ।।
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী ।।
এর আধুনিক বাংলা অনুবাদ হলো:
বজ্ররূপ নৌকায় বেয়ে পাড়ি দেই পদ্মার খাল,
দেশ লুট করে নিল অদয় বাঙ্গাল।
ভুসুকু, বাঙালি হলি আজ থেকে ওরে,
নিজের গৃহিনী গেল চাঁড়ালের ঘরে।
আবার কুক্কুরীপা ২ নং পদে একটু রসিকতা করে লিখেছেন:
দুলি দুহি পিটা ধরন ন জাই।
রুখের তেন্তুলি কুম্ভীরে খাঅ।।
এর বাংলা অনুবাদ:
মাদী কাছিম দোহন করে দুধ পাত্রে না রাখা যায়।
গাছের তেঁতুল কুমিরে খায়।
এখানে উল্লেখযোগ্য কিছু কিছু শব্দ সহজেই বোঝা যায়, কারণ এগুলো এখনও বাংলায় ব্যবহার হচ্ছে। মূলত, চর্যাপদ রচনাকারীরা ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়া, এবং তাদের অনেকেরই আদি নিবাস ছিল এই বঙ্গে। বৌদ্ধ পাল বংশের শাসনামলের অবসানে হিন্দু সেন বংশের শাসন শুরু হলে বেশিরভাগ বৌদ্ধকে নিজ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। ফলে এসব সহজিয়ারা তাদের সাথে করে চর্যাপদের সাধনসঙ্গীতগুলো নেপালে নিয়ে চলে যায়।
মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)
মুসলমানরা বাংলাদেশে আসার আগে এখানে মূলত বৌদ্ধধর্ম ও সনাতন ধর্ম ছিল। সনাতন ধর্ম আবার নানা ভাগে, যেমন- শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ইত্যাদিতে বিভক্ত ছিল। এছাড়াও ছিল বর্ণবাদ প্রথার চারটি রূপ- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। সাধারণ মানুষেরা কথোপকথনের জন্য একটি আলাদা কথ্য ভাষারীতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ধর্মাচরণের জন্য বৌদ্ধরা পালি এবং সনাতন ধর্মালম্বীরা সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার করতো।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ছিল ধর্মনির্ভর। দেব-দেবীর আরাধনা ও প্রেম-ভালোবাসা ছিল এই যুগের সাহিত্যের প্রধান উপকরণ। বাংলা সাহিত্যের আদিমধ্য যুগ, তথা প্রাক-চৈতন্য যুগে বাংলা ভাষায় লেখা সর্বপ্রথম আখ্যানকাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। বড়ু চণ্ডীদাস এর রচয়িতা। এ কাব্যের মূল উপজীব্য রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি। সমগ্র কাব্যটি তেরোটি খণ্ডে বিভক্ত। কাব্যের প্রধান তিন চরিত্র রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই। এই কাব্যে বেশ কয়েকবার উদ্ধৃত মর্মস্পর্শী একটি পদ নিচে উল্লেখ করা হলো:
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।
আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।
আরো একটি পদ হলো:
এক মুখে তোর রূপ কহিতে না পারী।
সর্বাঙ্গে সুন্দরি রাধা মোহিলী মুরারী॥
১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে নবদ্বীপে জন্ম হয় শ্রীচৈতন্যদেবের। তার প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মদর্শন প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের আকৃষ্ট করলেও অনেক সনাতন হিন্দু এই বৈষ্ণব মতকে গ্রহণ করেনি। হিন্দু ধর্মের আভ্যন্তরীণ বিভাজন সত্ত্বেও এই সকল বৈষ্ণব ভক্তরা তাদের মতামত প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের জন্য রচনা করেন বৈষ্ণব পদাবলী। বৈষ্ণব পদাবলীতে জ্ঞানদাসের একটি উক্তি হলো:
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল
বৈষ্ণব মহাজনেরা চৈতন্যদেবকে দেখেছিলেন রাধাকৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ রূপে:
রাধাকৃষ্ণ একাত্মা দুই দেহ ধরি।
অন্যোন্যে বিলাস রস আস্বাদয়ে করি।।
সেই দুই রূপ এব চৈতন্য গোসাঞি।
রস আস্বাদিতে দোঁহে হৈলা এক ঠাঁই।।
এছাড়া হিন্দুভক্ত কবিরা রচনা করেছিলেন মঙ্গলকাব্য। কিন্তু এটি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। মূলত দেব-দেবীর আরাধনা, মাহাত্ম্য-কীর্তন ও তাদের কাছে মঙ্গল কামনা করেই এই কাব্য রচিত হয়েছিল। মঙ্গলকাব্যের একটি শাখা হলো মনসামঙ্গল। এটি মঙ্গলকাব্যের প্রাচীন ধারা। বেহুলা-লক্ষীন্দরের কাহিনী অবলম্বনে এই কাব্যের সূচনা ঘটেছিল। এর আদি কবি কানা হরিদত্ত। এর কিছু অংশ নিচে দেয়া হলো:
কেহ হাসে কেহ নাচে কেহ গীত গায়
শুনিয়া চঞ্চল হইল দেবী মনসায় ||
নেতার সঙ্গে পদ্মাবতী যুক্তি করিয়া |
কপটে সোনেকার মাসী হইল আসিয়া ||
সমসাময়িক মুসলমান সাধক কবিরা তাদের মত প্রকাশ করার জন্য রচনা করেছিলেন ধর্মসাহিত্য। এছাড়া মধ্যযুগের মুসলিম কবিরা বহু রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান রচনা করেছিলেন। শাহ মুহাম্মদ সগীর তাদের মধ্যে একজন। তার লেখা ইউসুফ জোলেখা কাব্যগ্রন্থটি বহুলভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইছুফে বলিলা দুই বাধা অছে বড়।
আজিজক ভয় আর নিরঞ্জন ডর
আজিজক কৃপাণ শমন সমসর।
শিরছেদ করিয়া পাঠাইব যমঘর
ধর্মেতে বিরোধ হয় এহি আর ভয়।
পরলোকে নরকে ডুবিব অতিশয়— ইউসুফ জোলেখা
মনসামঙ্গল ছাড়াও মঙ্গলকাব্যের আরো কিছু শাখা হলো চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, ধর্ম মঙ্গল ও কালিকা মঙ্গল।
এ যুগের শেষের দিকে আবির্ভাব ঘটে লোকগীতি, পুঁথি সাহিত্য, কবিগান, নাথ সাহিত্য, লোকসাহিত্য, টপ্পাগান ও পাঁচালী গানের। এ সময়টি যুগ সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত।
মুসলমানরা বাংলায় আসার আগে বাংলা ভাষায় যেসব শব্দের প্রভাব ছিল, তা মূলত তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, অস্ট্রিক (মুণ্ডারি, সাঁওতালি) এবং দ্রাবিড় শব্দ। ১৪০০-১৮০০ সালের মধ্যে মুসলমনাদের হাত ধরেই বাংলা ভাষায় আরবি, ফারসি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার প্রচুর শব্দ প্রবেশ করেছিল। আস্তে আস্তে এই শব্দগুলো বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়া ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নামাজ, রোজা, যাকাতের মতো শব্দ ছাড়াও গোসল, কলম, আদালত, আইন, তারিখ ইত্যাদি শব্দও বাংলাতে প্রবেশ করে। কাব্যেও এর প্রভাব দেখা যায়।
ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের আগে পর্তুগিজ এবং বার্মিজের বেশ কিছু শব্দও বাংলায় প্রবেশ করেছে। এছাড়া ফরাসিদের সাথে বাণিজ্যের সূত্রেও কিছু ফরাসি শব্দ বাংলাতে যোগ হয়েছিল। তবে, ইউরোপের ভাষাগুলোর মধ্যে ইংরেজি শব্দই সবচেয়ে বেশি বাংলায় প্রবেশ করেছে, যা এখনও চলমান। তাছাড়া ইংরেজদের মাধ্যমে অন্যান্য ভাষা, যেমন- জাপানি, চীনা, জার্মানি, রুশ ইত্যাদি শব্দও বাংলায় ঢুকেছে।
আধুনিক বাংলা (১৮০১-বর্তমান)
আধুনিক বাংলা ভাষার দুটি প্রধান রূপ আছে: সাধু ও চলিত। ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলার যাত্রা শুরু। ১৮০১ সালে উইলিয়াম কেরিকে প্রধান করে এখানে বাংলা বিভাগ খোলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে উইলিয়াম কেরি ও তার সহকর্মীগণ গদ্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, এবং তাদের প্রচেষ্টায় বাংলায় গদ্যের আবির্ভাব হয়। আর এ সময়ই সাধু ভাষার আবির্ভাব ঘটে। মূলত সাধুভাষার আবির্ভাব হয়েছিল ভাষাকে একটি বিধিবদ্ধ রূপ দেয়ার প্রয়াসে।
তবে এখানেও পরিপূর্ণ সাধুভাষা পরিলক্ষিত হয় না। পরবর্তীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ দেশীয় পণ্ডিত ও কবিদের হাত ধরেই সাধু ভাষার আদর্শ রূপ তৈরি হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলা হয় বাংলা গদ্যের জনক। তার রচিত বর্ণপরিচয় আধুনিক বাংলা বর্ণমালার ভিত্তি গড়েছে। তার লেখা সাধু ভাষায় রচিত কিছু অংশ নিচে উল্লেখ করা হলো:
নদীতে স্নান করিবার সময় রাজদত্ত অঙ্গুরীয় শকুন্তলার অঞ্চলকোণ হইতে সলিলে পতিত হইয়াছিল। পতিত হইবামাত্র এক অতিবৃহৎ রোহিত মৎস্যে গ্রাস করে। সেই মৎস্য, কতিপয় দিবস পর, এক ধীবরের জালে পতিত হইল।
— শকুন্তলা: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
১৮৬৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দুর্গেশনন্দিনী দিয়ে একটি সাহিত্য বিপ্লবের সূচনা করেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ প্রমুখ কবি ও সাহিত্যিকগণ এই ভাষায় বিভিন্ন কাব্য, উপন্যাস রচনা করে এ ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।
আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলন নদীয়া অঞ্চলে কথিত উপভাষা থেকে এসেছে। এটি পরবর্তীতে চলিত রীতি হিসেবে রূপ লাভ করে। চলিত রীতির প্রথম ব্যবহার হয় উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। এরপর প্যারীচাঁদ মিত্র ও কালীপ্রসন্ন সিংহ এবং প্রমথ চৌধুরীর রচনার মাধ্যমে এর ক্রমবিকাশ ঘটে। ১৯১৪ সালের দিকে প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র পত্রিকাকে কেন্দ্র করে এ রীতি সাহিত্যিক স্বীকৃতি ও পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ প্রমুখ কবি সাধু ভাষা থেকে বের হয়ে চলিত ভাষায় লেখালিখি শুরু করেন। আর এভাবেই এ ভাষার ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চলিত ভাষার রচনার কিছু অংশ নিচ্ছে উল্লেখ করা হলো:
মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।
— সভ্যতার সংকট: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এছাড়া বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপভাষা দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এসব উপভাষাগুলোতে কথা বলে থাকে। বাক্য ও শব্দের দিক থেকে একেক অঞ্চলের ভাষা একেক রকম হয়।
বাংলা লিপির উৎপত্তি
বাংলা ভাষা নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তাহলে বাংলা বর্ণমালা নিয়েও একটু আলোচনা করা যাক। আমাদের বাংলা বর্ণমালা এসেছে প্রাচীন ভারতীয় ‘ব্রাহ্মীলিপি’ থেকে। একটি মতানুসারে, ব্রাহ্মীলিপি নামটি এসেছে পৌরাণিক হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার নাম থেকে। উপকথামতে, তিনিই ভারতবর্ষে এই প্রাচীন লিপি দিয়েছিলেন, এবং ধ্বনির সাথে মানুষকে এই লিপির শিক্ষা দান করেছিলেন। তাই তার নামানুসারে এ লিপির নামকরণ করা হয়। আবার অন্য এক মতানুসারে, বৈদিক যুগের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত ব্রাহ্মণদের দ্বারাই এই লিপি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলেই এর নাম ব্রাহ্মীলিপি।
ভারতে সৃষ্ট এই ব্রাহ্মীলিপির পেছনে ফিনিশীয় লিপির প্রভাব আছে বলে দাবী করা হয়। তবে ধারণা করা হয়, প্রাচীন ভারতেই স্বতন্ত্রভাবেই এই লিপি উদ্ভাবিত হয়েছিল, কারণ ফিনিশীয় লিপির চেয়ে এই লিপির পার্থক্য অনেক। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে ব্রাহ্মীলিপির প্রচলন ছিল। এরপর মৌর্য বংশের সম্রাট অশোকের সময়ে এটি অশোক লিপি বা মৌর্য লিপিতে বিবর্তিত হতে থাকে। এর পরে আসে কুষাণ লিপি, যা কুষাণ রাজাদের আমলে প্রচলিত ছিল। এরপর লিপিটি উত্তরী ও দক্ষিণী, এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরী লিপিগুলোর মধ্যে পূর্বদেশীয় গুপ্তলিপি উল্লেখযোগ্য, যা ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল। এই গুপ্তলিপি থেকে আবির্ভাব হয় কুটিল লিপির, যা ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কুটিল লিপি থেকে উদ্ভব হয় নাগরী লিপির। ১০ম শতকের শেষভাগে এসে প্রাচীন এই নাগরী লিপির পূর্ব শাখা থেকেই উৎপত্তি হয়েছে বাংলা লিপির। তবে ব্রাহ্মীলিপি থেকে সৃষ্ট বাংলা বর্ণমালা দেখতে কিন্তু এখনকার বর্ণমালার মতো ছিলো না। এছাড়া সময়ের পরিবর্তনে বর্ণের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। মানুষের হাতের লেখার পরিবর্তনে বাংলা লিপিতেও এসেছে বিরাট পরিবর্তন।
ব্রাহ্মীলিপির প্রথম পাঠোদ্ধার করেন প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ প্রিন্সসেপ। আমাদের দেশের সিলেটের উপভাষারও বর্ণমালা ছিলো, যা প্রায় অবিকৃত নাগরীলিপির মতো। এখন পর্যন্ত তিন ধরনের ব্রাহ্মীলিপির নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে, যাতে ৪৪টি বর্ণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে স্বরবর্ণ ৯টি, আর ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৫টি।
বাংলা, আসামি, এবং ওড়িয়া সবারই নিজস্ব লিপি রয়েছে, যা মূলত দেবনাগরী লিপি থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। পার্সিয়ান-অ্যারাবিক লিপি ব্যবহৃত হয় উর্দু, সিন্ধি (দেবনাগরীতেও লেখা হয়) এবং পাঞ্জাবি ভাষাতে। বাংলা সাহিত্যের সূচনাপর্বের দেখা মেলে আর্য ও অনার্য সমন্বয়ের পর। ফলে বৈদিক সাহিত্যের ব্যাপক প্রভাব বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শনসমূহে দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলা ও ভাষা আন্দোলন
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার নির্দেশ দিলে পূর্ব বাংলায় এ নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র ও কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকে। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার শেষপর্যন্ত নতি স্বীকারে বাধ্য হয়, এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে বাংলাকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলন, এবং ভাষার অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
ভাষা সর্বদাই পরিবর্তনশীল। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে। বর্তমানে আমরা বাংলা বাক্যের সাথে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছি। এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে বাংলা বাক্যের মাঝে মাঝে ইংরেজি বাক্যও ব্যবহার করছি। তার উপর বর্তমানে ইংরেজির কদর বেড়েই চলেছে। এভাবেই আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা ধীরে ধীরে আরো একটি পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একটি সময় বাংলা ও ইংরেজি মিলেই এটি নতুন আরেকটি ভাষার জন্ম দেবে। কিন্তু আমরা কি পারবো আমাদের বাংলাকে রক্ষা করতে?