ড্যানিশদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই ফার্নিচার শিল্প, বিয়ার, কিংবা নানান স্বাদের পেস্ট্রির গল্প উঠে আসার কথা ছিল। কিন্তু সব ছাপিয়ে দেশটির সবচাইতে জনপ্রিয় রপ্তানিযোগ্য পণ্যটি হলো ছোট ছোট টয় ব্রিক, যেগুলো ব্যবহার করে খুব সহজেই নিজের কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাড়ি, গাড়ি, প্লেন, মানুষ সহ নানান ধরনের খেলনা তৈরি করা যায়। ‘লেগো’ নামে পরিচিত জনপ্রিয় খেলনা তৈরির কোম্পানিটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৯ সাল থেকে ‘অটোমেটিক বাইন্ডিং ব্রিক’ নামে প্লাস্টিকের খেলনা তৈরি এবং বিক্রি শুরু করলেও শুরুটা ছিল করুণ; অনেকগুলো দুর্ঘটনা এবং সঙ্কটের সমষ্টি। অবশ্য অনেকের মতে, শুরুর দিকের দুর্ঘটনা, সংকটপূর্ণ মুহূর্তগুলো না আসলে, লেগো কখনই এত বড় কোম্পানি হয়ে উঠতে পারতো না!
‘লেগো’ গল্পের শুরুটা হয় বিললুন্ড নামের অখ্যাত একটি গ্রামের সাধারণ, কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী কাঠমিস্ত্রি অলি ক্রিক ক্রিশচিয়ানসেন এর হাত ধরে। তরুণ বয়সে কাঠের সামগ্রী তৈরির প্রতি অলি ক্রিকের গভীর আসক্তি তাকে কাঠের তৈজসপত্র বানানোর ব্যবসার দিকে আগ্রহী করে তুলে। সেই সুবাদে ১৯১৬ সালে তিনি একটি দোকানও প্রতিষ্ঠা করেন, প্রাথমিক অবস্থায় যেখানে মই, চৌকি এবং ইস্ত্রির বোর্ডের মতো সাধারণ কাঠের জিনিসগুলো তৈরি হতো। বেশ কয়েক বছর ধরে সবকিছু বেশ ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু ১৯২৪ সালে যখন তিনি ব্যবসা বাড়ানোর কথা ভাবছিলেন, ঠিক ঐ সময়ে দুর্ঘটনাবশত ঘটা অগ্নিকাণ্ডের ফলে পরিবারের থাকার জায়গা সহ দোকানটি ধ্বংস হয়ে যায়।
এমতবস্থায় অন্য কেউ হলে হয়তো ভেঙ্গে পড়তো। কিন্তু অলি ক্রিক পুরো ব্যাপারটিকে দুর্ঘটনা হিসেবে না দেখে, নতুন করে বড় ধরনের কারখানা তৈরির সুযোগ হিসেবে নেন। কিন্তু দুর্দশা তার পিছু ছাড়তে নারাজ। ১৯২৯ সালের আমেরিকার স্টক মার্কেটের ধ্বস সবার মতো তাকেও আর্থিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ঠিক তিন বছর পরে, ১৯৩২ সালে স্ত্রীর মৃত্যু তাকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে দেয়। আর্থিক এবং মানসিক বিপর্যয়ের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে বেশ কয়েকদিন তিনি নিজের পছন্দের কাজ থেকে দূরে থাকেন এবং কারখানার অধিকাংশ সরঞ্জাম বিক্রি করে দেন।
কিছু দিন পর শোক কাটিয়ে উঠে অলি ক্রিক অল্প দামের কাঠের খেলনা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের পছন্দের কাজে ফিরে আসেন। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, সে সময় এই ধরনের সিদ্ধান্ত পাগলামো ছাড়া কিছুই ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ‘লেগো’ নামের বিশাল ব্যবসা সফল সাম্রাজ্যটির মূল ভিত্তিই ছিল অলি ক্রিকের ঐ সিদ্ধান্ত।
প্রাথমিক অবস্থায় তার এই সিদ্ধান্ত তেমন ভালো কোনো ফলাফল বয়ে নিয়ে আসেনি। উল্টো তিনি দেউলিয়া হয়ে পড়েন। কিন্তু এতসব অভাব অনটনের মধ্যেও কাঠের খেলনা তৈরির প্রতি তার ভালোবাসা সে সময় একটুও কমেনি। বরং নতুন উদ্যমে সব শুরু করার জন্য তিনি তার কোম্পানির নাম দেন ‘LEG GODT’ বা ‘Play Well’। LEG GODT শব্দগুলোর প্রথম দুটি অক্ষর মিলিত হয়েই মূলত ‘LEGO’ নামটির উদ্ভব।
সবাই যখন ব্যাংক, বীমাগুলো থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন রকমের ব্যবসা দিয়ে নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে ব্যস্ত, সে সময় অলি ক্রিক পুরো সময়টাই খেলনার প্রোটোটাইপ তৈরি করে কাটাতেন। খাবারের বিনিময়ে খেলনা আদানপ্রদান করতেন। গ্রামে গ্রামে হেঁটে নিজেই দোকানে দোকানে খেলনা পৌঁছে দিতেন। ধীরে ধীরে তার তৈরি খেলনাগুলো শিশু-কিশোরদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে। তার তৈরি গাড়ি, পশু-পাখিসহ বিভিন্ন ধরনের খেলনার মডেলগুলো এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, ১৯৪০ এর দিকে পুরো ডেনমার্কব্যাপী খেলনাগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সেই সময় অলি ক্রিকের তৈরি সবচাইতে জনপ্রিয় এবং বেশি বিক্রীত খেলনাটি ছিল চার চাকা বিশিষ্ট মুখ নড়াচড়া করতে পারা কাঠের হাস।
১৯৪২ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মানরা ডেনমার্ক দখল করে নেয়। অলি ক্রিকের কারখানাটি আবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে পুরো কারখানাটি ধ্বংস হয়ে যায়। তবে সেবার অলি ক্রিক আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল হয়ে উঠেছিলেন। অগ্নিকাণ্ডটি তার সামনে অগ্রসর হওয়াকে থামাতে পারেনি, বরং কোম্পানিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তৈজসপত্র তৈরির কাঁচামালের ঘাটতি এবং সরঞ্জাম সহ অন্যান্য জিনিসের চওড়া দামের ফলে কম দামী পণ্য তৈরির উদ্দেশ্যে অনেকেই প্লাস্টিকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেসময় প্লাস্টিক ব্যবহার করে বিভিন্ন জিনিস তৈরির সবচাইতে জনপ্রিয় মাধ্যমটি ছিল ‘প্লাস্টিক ইনজেকশন মল্ডিং’। কিন্তু কাঁচামালের সংকটের ফলে ১৯৪৭ পর্যন্ত ড্যানিশ সরকার বাণিজ্যিকভাবে প্লাস্টিকের পণ্য তৈরির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অলি ক্রিক ১৯৪৬ সালে ডেনমার্কের প্রথম প্লাস্টিক ইনজেকশন মল্ডিং মেশিনটি ক্রয় করেন এবং তার তৈরি খেলনার প্রোটোটাইপগুলোর প্লাস্টিকের সংস্করণ তৈরির মাধ্যমে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে থাকেন। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর কাঠের খেলনার পাশাপাশি কোম্পানিটি প্লাস্টিকের খেলনাও বিক্রি শুরু করে এবং ১৯৪৯ সালে অটোমেটিক বাইন্ডিং ব্রিক নামের একটি খেলনার মডেল বাজারে ছাড়ে।
অটোমেটিক বাইন্ডিং ব্রিকের মডেলটি মূলত ‘কিডিক্রাফট‘ নামের একটি ব্রিটিশ কোম্পানির উদ্ভাবন। কিডিক্রাফট তাদের মডেলটি অলি ক্রিকের খেলনায় ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পর সে এবং তার ছেলে গডফ্রেড এটিকে আরো উন্নত করে ব্যবহার শুরু করে। অবশ্য পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে লেগো কিডিক্রাফটের অধিকারসত্ত্ব কিনে নেয়।
১৯৫৩ সালে অটোমেটিক বাইন্ডিং ব্রিক থেকে কোম্পানিটি ‘লেগো’ নামে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৭ সালে গডফ্রেড ক্রিক ক্রিশ্চিয়ানসেন লেগোর পরিচালক প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং লেগো ব্রিকগুলোকে কাজে লাগিয়ে ‘সিস্টেম অফ প্লে’ নামের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যেখানে বাইন্ডিং ব্রিকগুলোর প্রত্যেকটি অংশ একটির সাথে আরেকটি পাশাপাশি সংযুক্ত করে নতুন নতুন মনগড়া খেলনা তৈরি করা যাবে। সিস্টেম অফ প্লে-ই মূলত আধুনিক লেগোর ভিত্তি। ১৯৫৮ সালে অলি ক্রিকের মৃত্যু পর লেগোকে অগ্রগামী করার কাজটি পুরোপুরি তার বড় ছেলে গডফ্রেডের উপর বর্তায়।
সিস্টেম অফ প্লে’র উদ্ভাবনের ঠিক তিন বছর পর, ১৯৬০ সালে কোম্পানিটি তৃতীয়বারের মতো অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতও হয় ঠিক পূর্বের মতো, কাঠের খেলনা সামগ্রীগুলোর মাধ্যমে। তাই গডফ্রেড সিদ্ধান্ত নেন, লেগোকে পুরোপুরি প্লাস্টিক নির্ভর কোম্পানি করে তোলার। কিন্তু বাদ সাধে গডফ্রেডের দুই ভাই কার্ল জর্জ এবং গেয়ারহার্ড। তারা লেগো থেকে নিজেদের প্রাপ্ত অংশ নিয়ে ‘বিলোফিক্স’ নামের নতুন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে লেগোর মতো প্লাস্টিকের ব্রিক তৈরির সাথে সাথে কাঠের খেলনা সামগ্রীও তৈরি করা হতো। যদিও কোম্পানিটি লেগোর মতো তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি।
১৯৬০ এর পর লেগো সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স সহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বাড়াতে থাকে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে লেগো ব্রিকগুলো পৃথিবীব্যাপী প্রায় ১৪০ এরও বেশি দেশে বিক্রি হয়। ১৯৬৪ সালে প্রথম লেগো ব্রিক সেটগুলো ভোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে কোম্পানিটি পাঁচ বছরেরও কম বয়সের বাচ্চাদের জন্য ডুপলো (DUPLO) সিরিজ লেগো ব্রিক সেট প্রবর্তন করে, যেগুলো সাধারণ লেগো ব্রিকগুলোর থেকে আকারে অনেকটা বড়। ধীরে ধীরে লেগো সেটগুলো বিভিন্ন থিম নির্ভর হয়ে উঠে। লেগোর থিম সেটগুলোতে নির্দিষ্ট কিছু ব্রিক থাকে, যেগুলো দিয়ে শহর, দুর্গ, মহাশূন্য, ওয়েস্টার্ন, স্টার ওয়ার্স, হ্যারি পটার সহ নানা ধরনের থিম তৈরি করা যায়। ৫,৯২২টি অংশ নিয়ে তৈরির লেগোর সবচাইতে বড় থিম সেটটি দিল্লির তাজ মহলের থিম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
৮৩ বছরের কোম্পানিটি এখন পর্যন্ত প্রায় ছয়শ বিলিয়নেরও বেশি লেগো ব্রিক উৎপাদন করেছে, যার মাত্র চল্লিশ বিলিয়ন ব্যবহার করে পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত ৩,৮৪,৪০০ কিলোমিটারের লম্বা স্তম্ভ তৈরি করা সম্ভব। ২০০৯ সালে ব্রিটিশ টিভি উপস্থাপক জেমস মে, ৩.৩ মিলিয়ন লেগো ব্রিক কাজে লাগিয়ে পুরোপুরি বসবাসযোগ্য একটি বাড়ি তৈরি করে বিশ্বব্যাপী হইচই ফেলে দিয়েছিলেন।
২০১৪ সালে পৃথিবীর সবচাইতে বড় খেলনা তৈরির কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া লেগো যে শুধু খেলনা ব্রিক বানানোর কাজেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছে তা নয়, ভিডিও গেম থেকে শুরু করে মিডিয়া পাড়ায়ও নিজেদের জনপ্রিয়তা বেশ বীরত্বের সাথেই ধরে রাখছে। ‘লেগো মিডিয়া ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড’ এর আওতায় ১৯৯৭ সালে মাইন্ডস্কেপের সহযোগিতায় প্রথম গেম ‘লেগো আইসল্যান্ড’ রিলিজ করে। পর পর ‘লেগো ক্রিয়েটস’ এবং ‘লেগো রেসারস’ রিলিজ করার পর লেগো নিজেদের মিডিয়া কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয় এবং গেম ডেভেলপার কোম্পানি ‘ট্রাভেলারস টেলস’ এর সাথে যৌথ প্রযোজনায় লেগো স্টার ওয়ার্স, লেগো ইন্ডিয়ানা জোনস, লেগো ব্যাটম্যান সহ মার্ভেলের সুপার হিরোদের উপর ভিত্তি করে আরো কয়েকটি গেইম বাজারে ছাড়ে।
গেমের সাথে সাথে কোম্পানিটি অ্যানিমেটেড সিনেমা, সিরিজ তৈরিতেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শুরুটা হয় ২০১০ সালে ‘লেগো: দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ ক্লাচ পাওয়ার্স’ এর মাধ্যমে। এর পরের বছরেই ‘লেগো নিনজাগো: মাস্টার্স অফ স্পিনজিতজু’ নামের অ্যানিমেটেড সিরিজ রিলিজ করে। তবে সবচাইতে ব্যবসাসফল সিনেমাটি ২০১৪ সালে রিলিজ হওয়া ‘দ্য লেগো স্টোরি’। মাত্র ৬০ মিলিয়ন বাজেটের সিনেমাটি বক্স-অফিস থেকে আয় করে প্রায় ৪৬৯.১ মিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালে রিলিজ হওয়া ‘লেগো ব্যাটম্যান’ সিনেমাটিও বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
ডেনমার্কের সেই অখ্যাত গ্রাম বিললুন্ডের ছোট কারখানায় শুরু হওয়া ‘লেগো’ বর্তমানে পৃথিবীর সবচাইতে ব্যবসাসফল কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিললুন্ড এখন ডেনমার্কের সবচাইতে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু ‘অ্যাপল অফ টয়’ খ্যাত কোম্পানিটির এ পর্যায়ে আসাটা কখনোই সম্ভব হতো না, যদি না অলি ক্রিক ক্রিশ্চিয়ানসেনের মতো সপ্রতিভ একজন মানুষ এতসব দুর্ঘটনা, দুর্দশার মধ্যেও নিজের স্বপ্নের পিছনে না ছুটতেন।
ফিচার ছবি: wallpapercave.com