শিল্পবিপ্লবের পর ইউরোপের অনেক দেশে শিল্পপণ্যের উৎপাদন বেড়ে যায় অনেক গুণ। নিজ দেশের ব্যবসায়ীদের চাপে নিজেদের বাড়তি শিল্পপণ্য রপ্তানির জন্য বাইরের দেশে নজর দিতে থাকে এই দেশগুলো। কারণ বাড়তি শিল্পপণ্য যদি বাইরের দেশে রপ্তানি করা না যায়, তাহলে শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যেত এবং ফলশ্রুতিতে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতো। বাড়তি পণ্যের বাজারের জন্য হন্যে হয়ে থাকা ব্যবসায়ীরা প্রথমদিকে কোনো দেশে ব্যবসার জন্য আসলেও পরর্বতীতে নিজেরা সেসব দুর্ভাগা দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে নেয় এবং ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন ঘটায়। ভারতবর্ষের কথাই ধরুন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এসেছিল ব্যবসা করতে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজ্যগুলোর অনৈক্য এবং নিজেদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য একসময় তারা পুরো ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়। আফ্রিকা শত শত বছর ধরে পৃথিবীবাসীর কাছে পরিচিত ছিল ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ’ হিসেবে। ১৮৫০ সালের পর থেকে আফ্রিকা মহাদেশের অঞ্চলগুলো কে কার আগে দখল করতে পারে– তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে আগেই শিল্পবিপ্লব হয়ে যাওয়ায় তারা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গিয়েছিল। উপনিবেশগুলো ছিল তুলনামূলক অনুন্নত ও সেকেলে। আফ্রিকার উপনিবেশগুলোতে তখনও মানুষ হাজার হাজার বছরের পুরনো চর্চাগুলো ধরে রেখেছিল, যেগুলো দেখে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো অবাক হয়ে যায়। উপনিবেশগুলোর এহেন অবস্থা দেখে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন স্টেরিওটাইপ প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। যেমন- ভারতবর্ষ ইংল্যান্ডের মানুষের কাছে পরিচিত ছিল ‘অপরাধীদের অভয়ারণ্য’ হিসেবে। আফ্রিকার মানুষদের সম্পর্কে ইউরোপে বলা হতো, “এরা অসভ্য ও বর্বর। এখনও সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি।” উপনিবেশের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা এ ধরনের বর্ণবাদী ধারণাগুলো মাথায় রেখেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করত। উপনিবেশের নাগরিকরা যখন শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ভ্রমণ করতেন, তারা বিভিন্ন বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতেন। কারণ সেই শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল যে- উপনিবেশে যারা বসবাস করে, তারা শিল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের তুলনায় সবদিক থেকে পিছিয়ে আছে এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব হলো তাদের আধুনিকতার মুখ দেখানো। আধুনিক যুগে এভাবেই বর্ণবাদ প্রকটাকার ধারণ করে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার কিংবা মোটরসাইকেল আরোহীরা মাঝেমধ্যে বেধে দেয়া গতিসীমা অতিক্রম করে ফেলেন। কখনও হয়তো এটা হয় ইচ্ছাকৃতভাবে, কখনও অনিচ্ছাকৃত। যেসব দেশে আইন কড়া, সেসব দেশে সাধারণত পুলিশ গতিসীমা অতিক্রম করা বাহনগুলোকে প্রথমে থামার নির্দেশ দেয়। এরপরও যদি বাহনগুলো না থামে, তাহলে পুলিশও নিজেদের বাহন নিয়ে এগুলোর পেছনে ছোটে। গতিসীমা অমান্যকারী বাহনের আরোহীরা খামোখা মামলা কিংবা জরিমানার হাত থেকে বাঁচতে অনেক সময় ট্রাফিক পুলিশের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গাড়ি চালানো অব্যাহত রাখেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা, কারণ পুলিশের সাথে সাধারণ মানুষের পক্ষে পাল্লা দেয়া সম্ভব না। আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসের আফ্রো-আমেরিকান ট্যাক্সি ড্রাইভার রোডনি কিংয়ের ক্ষেত্রেও ঘটে একই ঘটনা। গতিসীমা ভঙ্গ করায় পুলিশ তাকে গাড়ি থামাতে বললে তিনি গাড়ি চালানো অব্যাহত রাখেন। হয়তো তার ভয় ছিল, সাধারণ যা উপার্জন করেছেন তা জরিমানার খপ্পরে পড়ে একেবারে দিয়ে দিতে হতে পারে।
কিং পুলিশের আদেশ অমান্য করায় পুলিশও তাকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে লস অ্যাঞ্জেলসের রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ বনাম কিংয়ের প্রতিযোগিতা চলে। শেষপর্যন্ত তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় কিং ট্যাক্সি থামাতে বাধ্য হন। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। চার পুলিশ সদস্য তাদের হাতে থাকা বিশেষ লাঠি দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকেন। পুলিশবাহিনীর যেসব সদস্য কিংকে মারছিলেন, তাদের সবাই ছিল শ্বেতাঙ্গ, অপরদিকে রোডনি কিং ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণেই বোধহয় পুলিশের কাছে আরও বেশি করে মার খান তিনি। পঞ্চাশেরও বেশিবার আঘাত করা হয় তার গায়ে। তার শরীরে অসংখ্য জখম সৃষ্টি হয় এবং ছয় জায়গায় হাড় ভেঙে যায়, মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং খুলিতে ফাটল ধরে।
তবে রোডনি কিংয়ের পুলিশের হাতে মার খাওয়ার এই ঘটনা বোধহয় খুব বেশি আলোচনায় থাকত না, যদি না লস অ্যাঞ্জেলসের একজন অধিবাসী ঘটনাটি ক্যামেরায় ধারণা না করতেন। কিংয়ের ঘটনাটি যেখানে ঘটছিল, তার পাশেই ছিল জর্জ হলিডে নামের সেই ভিডিও ধারণকারীর বাসা। কিং যখন মার খাচ্ছিলেন, তখন তিনি তার অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় বসে ছিলেন। হলিডে ঘটনাটি ক্যামেরায় ধারণের পরদিন স্থানীয় এক গণমাধ্যমে ভিডিওটি হস্তান্তর করেন। তিনি নিজে শ্বেতাঙ্গ ছিলেন, কিন্তু তার মনে হয়েছিল কিংয়ের সাথে যা ঘটছে তা পুরোপুরি অন্যায় এবং বর্ণবাদী আচরণ। তাই তিনি এই কাজ করেন। পরদিন যখন স্থানীয় টিভি চ্যানেলে ভিডিওটি প্রচারিত হয়, তখন লস অ্যাঞ্জেলসে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মানুষ হতবাক হয়ে যায় কীভাবে বিচার ছাড়াই পুলিশ একজন নাগরিকের উপর এত বলপ্রয়োগ করতে পারে– এটা ভেবে।
গণমাধ্যমে রোডনি কিংয়ের মার খাওয়ার ভিডিও টেপ সম্প্রচারিত হওয়ার পর যে চারজন পুলিশ রোডনি কিংকে মারছিল, তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগে মামলা করা হয়। লরেন্স পাওয়েল, থিওডোর ব্রিসেনো, টিমোথি উইন্ড ও স্ট্যাসি কুনকে লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ ডিপার্টমেন্ট গ্রেফতার এবং আদালতে হাজির করে। এই ঘটনায় এত বেশি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, কর্তৃপক্ষ এই মামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সিমি ভ্যালি নামের এক জায়গায় মামলা স্থানান্তর করে। আশ্চর্যজনকভাবে, ১৯৯২ সালের ২৯ এপ্রিল দেয়া আদালতের সেই রায়ে চার পুলিশই নির্দোষ সাব্যস্ত হন এবং তাদেরকে মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়। একেবারে স্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও আদালতের এহেন রায়ে লস অ্যাঞ্জেলসের নাগরিকরা হতবাক হয়ে পড়েন। কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় আদালতের এই রায়ে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং লস অ্যাঞ্জেলসের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দাঙ্গা শুরু হয়।
রোডনি কিংয়ের মামলায় আদালতের দেয়া রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে দাঙ্গা শুরু হয়, ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে সেটি ছিল আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দাঙ্গাগুলোর একটি। দাঙ্গা শেষে দেখা যায়- ৬৩ জন মারা গিয়েছেন, আহত হয়েছেন ২ হাজারেরও বেশি, এবং পুলিশের হাতে গ্রেফতার প্রায় ১২ হাজার। দাঙ্গা চলাকালে প্রায় এগারোশ বাড়িঘর লুটপাট করা হয়। ধারণা করা হয়, পুরো দাঙ্গায় লস অ্যাঞ্জেলসে ক্ষতি হয় প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রধান এই ঘটনার পর পদত্যাগ করেন। দাঙ্গা শুরু হওয়ার জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। দেশজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর পুলিশি নির্মমতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।
আমেরিকায় শুধু কৃষ্ণাঙ্গরাই নন, এশিয়ার অন্যান্য জাতির ব্যক্তিরাও পুলিশি নির্মমতার শিকার হতেন। লস অ্যাঞ্জেলসের এই দাঙ্গার পর কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় পুলিশের কাছে এক পরিষ্কার বার্তা পাঠায়। এই ঘটনার পর আমেরিকায় পুলিশ বাহিনীতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। যদিও এখনও কৃষ্ণাঙ্গরা পুলিশি নির্মমতার শিকার হয়ে আসছে, তারপরও লস অ্যাঞ্জেলসের দাঙ্গা আমেরিকার পুলিশবাহিনীকে কিছুটা সংযত হতে বাধ্য করেছে।