খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৯-১২১৩ অব্দ। মিশরে তখন চলছে ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্ব। একদিন তিনি ভাবলেন, প্রাচীন এই শহরজুড়ে গোড়াপত্তন করবেন এক সমৃদ্ধ রাজধানীর। যেমন ভাবনা তেমন আদেশ। শুরু হলো নির্মাণকাজ। দৃষ্টিনন্দন রাজধানীর নির্মাণে রামেসিস ব্যয় করতে লাগলেন প্রচুর পরিমাণ সম্পদ। বড় বড় অট্টালিকার পাশাপাশি নির্মিত হলো সৌন্দর্যমন্ডিত ভাস্কর্য, কারুকার্যখচিত স্মৃতিস্তম্ভ ও তৎকালীন মিশরীয় দেবতা আমুনের অসংখ্য মন্দির। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে খোদাই করা হলো রামেসিসের ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। তৈরি হলো এক অনুপম নৈসর্গিক শহর পিরামাস।
মনের আনন্দে রামেসিস নিজ হাতে গড়া রাজ্য পরিচালনায় মনোনিবেশ করলেন। দিন যায়, বয়সের ভারে তিনিও বৃদ্ধ প্রায়! একদিন অকস্মাৎ তিনিও চলে গেলেন মৃতদের দুনিয়ায়। তার মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পর একসময় ইতিহাসের পাতা থেকে বিলুপ্তি ঘটে এককালের এই সমৃদ্ধ নগরীর। হারিয়ে যায় নানা জল্পনা-কল্পনা ও লোককথার অন্তরালে। যেন ত্রিশ লক্ষ মানুষের এ শহরের কখনো কোনো অস্তিত্বই ছিল না! বিলীন হয়ে যায় নীরবে-নিভৃতে, অদ্ভুতভাবে! আজকের এ লেখায় আমরা জানবো হারিয়ে যাওয়া এই রহস্য-রোমাঞ্চকর নগরীরই পুনরাবিষ্কারের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের গল্প নিয়ে।
প্রাথমিক অনুসন্ধান
বিংশ শতাব্দীর শুরুর কথা, প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি ছোট্ট দল আলোচনা করছিল পিরামাসের রহস্যজনক হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। কেউ বা আনমনেই ভাবছিলেন- পিরামাস নামে কি আদৌ কোনো শহর ছিল? নাকি এটা কেবলই জনশ্রুতি? এমন ভাবনার মূল কারণ ততদিনে মিশরের অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানই আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। বাকি আছে কেবল পিরামাসই! তবে বিভিন্ন নথিপত্র অনুসারে, পিরামাসের অস্তিত্ব কোনো জনশ্রুতি নয়। বরং সত্যিকার অর্থেই ছিল এমন এক জাদুর শহর। তবে, কোথায় হারিয়ে গেছে এটি? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে একদিন এক প্রত্নতাত্ত্বিক নেমেই পড়লেন এর রহস্যের সুরাহাকরণে।
১৯৩০ সাল; বিখ্যাত ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ পিয়েরে মন্ট প্রথমবারের মতো পিরামাসের রহস্য সমাধানে এগিয়ে আসেন। কিছুদিন পর তিনি নীল নদের শুকিয়ে যাওয়া টাইটনিক শাখার টানিস এলাকায় আবিষ্কারও করে ফেলেন গুটিকতক ধ্বংসাবশেষ। এসব ধ্বংসাবশেষে পাওয়া গেল রামেসিসের ব্যক্তিগত সেসব প্রতীকের চিহ্ন। তখনই পিরামাসের অস্তিত্বের প্রশ্নে জোরেশোরেই লাগলো ধাক্কা। রীতিমতো অবাক প্রত্নতাত্ত্বিক মহল। তবে, মন্টের আবিষ্কৃত স্থানে পিরামাসের কোনো হদিসই পাওয়া গেল না। ধারণা করা হয়, ঢেউয়ের ধাক্কায় হয়তো নিদর্শনগুলো ভেসে এসেছিল নীল ডেল্টার এই প্রাচীন পথে। সঙ্গে সঙ্গে রহস্য মোড় নিল নতুন দিকে!
বিটেকের অনুসন্ধান কাজ
তার ঠিক ৩৬ বছর পর, মন্টের এই আবিষ্কার কড়া নাড়ে অস্ট্রিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদ ম্যানফ্রেড বিটেকের ভাবনার দ্বারে। ১৯৬৬ সালে বিটেক নীল ডেল্টার গতিপথ পরিবর্তনের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে লেগে পড়েন। তিনি দেখতে পান, দ্বিতীয় রামেসিসের মৃত্যুর পর নীল ডেল্টার শাখা-প্রশাখাগুলো অসংখ্যবার তাদের গতিপথে পরিবর্তন এনেছে।
হুট করেই নড়েচড়ে বসলেন তিনি। লেগে পড়লেন বিভিন্ন সময়ে তৈরি ও বিলুপ্ত হওয়া নীলের এই শাখাগুলোর নকশা অংকনে। সাহায্য নিলেন সেসময় খুঁজে পাওয়া মৃৎশিল্পের ধ্বংসাবশেষের। এদের কার্বন ডেটিংয়ের পর রীতিমতো তাজ্জব বনে গেলেন তিনি! বের করে ফেললেন দ্বিতীয় রামেসিসের সময় নীলের সক্রিয় শাখারও হদিস। এটি ছিল পলুজিয়াক শাখা। তিনি ধারণা করেন, প্রাচীন এই শাখারই কোনো তীরে অবস্থান করছে রহস্যময় পিরামাস নগরী!
পুশ-বিটেক অনুসন্ধান অভিযান
এর কিছুকাল পর, বিখ্যাত জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ এডগার পুশকে বিটেক তার কাজে সঙ্গী হতে আমন্ত্রণ জানান। পুশও সাজসরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়েন মিশরের উদ্দেশ্যে। রহস্য উদঘাটনে নেমে পড়েন উভয়েই। একপর্যায়ে তারা আবিষ্কার করেন নীল নদের পলুজিয়াক শাখার তীরে গড়ে ওঠা বর্তমান কন্তির শহরই ছিল সেসময় সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ। আর তাই ছোট্ট এক দলকে অবলম্বন করে দুজনই নেমে পড়লেন কন্তিরের খননকাজে। দিন তিনেক পর, ভিন্ন এক জায়গায় মাত্র ১০ সেন্টিমিটার খননের পরই শিউরে ওঠেন তারা। একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে ধ্বংসপ্রাপ্ত নিদর্শন, রামেসিসের হাতি ও ঘোড়াশাল, এবং বিচিত্র এক সামরিক ঘাঁটির একাংশ!
তবে, কন্তিরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অল্প খননেই থমকে দাঁড়ায় কাজ। অতঃপর, ভিন্ন এক পন্থার দ্বারস্থ হন দুই প্রত্নতাত্ত্বিক। সাহায্য নেন সদ্য আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্ক্যানারের। যার সাহায্যে জানা যাবে কন্তিরের নীচে থাকা মাটির ভেতরকার রহস্য। স্ক্যানারও মাটির নীচ থেকে জানান দেয়, কন্তিরের সমগ্র এলাকাতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ভাস্কর্য, মন্দির ও স্মৃতিচিহ্ন! ঠিক যেমনটা উল্লেখ ছিল প্রাচীন নথিপত্রে। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল দ্বিতীয় রামেসিসের রাজধানী। যদিও প্রশ্ন থেকে যায়, টানিস ও কন্তিরের উভয়স্থানে পিরামাস আবিষ্কারের অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে।
স্থান পরিবর্তনের রহস্য!
কন্তিরে আবিষ্কৃত পিরামাসের গঠনশৈলী ছিল অনেকটা ভেনিস শহরের মতো। নীলনদ অববাহিকার পানিই ছিল রাজধানীর একমাত্র জীবনীশক্তি। আর এখানেই বাধে মূল বিপত্তি। রামেসিসের মৃত্যুর পর নীল ডেল্টার পলুজিয়াক শাখা শুকিয়ে গেলে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে পিরামাস শহর। অন্যদিকে জন্ম হয় নতুন শাখা টাইটনিকের। সেসময় নগরীর বাসিন্দারা পিরামাস শহরকে টাইটনিক শাখার তীরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে, এর তীরবর্তী শহর টানিসে পুনর্নির্মিত হয় পিরামাস নগরী। যেখানে প্রত্নতত্ত্ববিদ পিয়েরে মন্টে খুঁজে পেয়েছিলেন পিরামাসের প্রাথমিক ধ্বংসাবশেষ।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের হাড়ভাঙা খাটুনি, ধৈর্যশীলতা ও সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে সমাধান হয় সুদীর্ঘ এই জল্পনা-কল্পনার। খুঁজে পাওয়া যায় হারিয়ে যাওয়া ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের রহস্যময় পিরামাস নগরী। কল্পবিজ্ঞানের যুগ পেরিয়ে এলেও হারিয়ে যাওয়া এ নগরীর পুনরুদ্ধার প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে।