১৭৫৬ সাল।
ইউরোপের বাইরে ব্রিটেন আর ফ্রান্স নিজেদের উপনিবেশ রক্ষার লড়াইতে ব্যস্ত। কিন্তু মূল রণক্ষেত্র ছিল ইউরোপ। এখানে ফ্রেডেরিক মুখোমুখি তিন পরাশক্তির- অস্ট্রিয়া, রাশিয়া আর ফ্রান্স। তাদের সাথে সুইডেন এবং কিছু জার্মান রাষ্ট্রও তাদের জোটের অধীন। ফ্রেডেরিকের দলে বলার মতো শক্তি ব্রিটেন। তারাও সরাসরি তাকে সেনাসাহায্য করবার মতো পরিস্থিতিতে নেই। এমন অবস্থায় প্রুশিয়ার তিনদিকে অবস্থান নিয়েছে বিরোধীরা। যুদ্ধ সময়ের ব্যাপার মাত্র। ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের সামনে খুব বেশি বিকল্প খোলা নেই। শত্রুদের সাথে সন্ধির চেষ্টা হবে আত্মহত্যার নামান্তর। তাদের মূল উদ্দেশ্যই ফ্রেডেরিককে পায়ের নিচে পিষ্ট করে প্রুশিয়া রাষ্ট্রকে পৃথিবী থেকে মুছে দেয়া। কাজেই ফ্রেডেরিক তার স্বভাবের সাথে সঙ্গতি রেখে আগ্রাসি নীতি গ্রহণ করলেন। প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করা হলো। এদিকে অস্ট্রিয়া হলি রোমান এম্পায়ারের জার্মান রাষ্ট্রগুলোর সম্মেলনে মিলিতভাবে ফ্রেডেরিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার চাপ দিল। ব্রান্সউইক, হ্যানোভার আর হেসে-কেসেল ছাড়া আর বাকি সবাই অস্ট্রিয়ার পক্ষে সমর্থন দেয়।
স্যাক্সোনি
২৯ অগাস্ট, ১৭৫৬।
পোল্যান্ডের রাজার অধীনস্থ স্যাক্সোনিতে মার্চ করে ঢুকে পড়ল ফ্রেডেরিকের তিন ডিভিশন সৈন্য। ফ্রেডেরিকের এই কাজে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হলো সম্ভবত ফ্রান্স। কারণ তারা অস্ট্রিয়ার সাথে চুক্তি মোতাবেক এখন প্রুশিয়ার সাথে লড়াই করতে বাধ্য। তাদের ধারণা ছিল এই চুক্তির মাধ্যমে ফ্রেডেরিককে জার্মানিতে কোনো হঠকারিতা থেকে বিরত রাখা যাবে, ফলে তারা পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবে চিরশত্রু ব্রিটিশদের শিক্ষা দিতে। ফ্রেডেরিকের স্যাক্সোনি আক্রমণ তাদের সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়। ইউরোপে আরম্ভ হলো সেভেন ইয়ার্স ওয়ার।
প্রুশিয়ানদের সংখ্যা নিয়ে কিছুটা মতবিভেদ আছে, তবে তা ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ পর্যন্ত হতে পারে। ড্রেসডেনের কাছে প্রুশিয়ানরা একত্রিত হয়। স্যাক্সোনির সেনা সংখ্যা মাত্র ১৮,০০০। তারা পির্না (Pirna) শহরের সুরক্ষিত অবস্থানে চলে গেল। ফ্রেডেরিক সেখানে অবরোধ স্থাপন করে ড্রেসডেন আর লাইপজিগ কব্জা করে নিলেন। শহর থেকে প্রচুর অর্থ ও মালামাল তার হস্তগত হলো। এরপর তিনি ব্রান্সউইকের ডিউক ফার্দিন্যান্দের নেতৃত্বে এক দল সেনা পাঠিয়ে দিলেন বোহেমিয়ার সীমান্ত বরাবর, ইচ্ছা সেখানে শীতকালীন ক্যাম্প তৈরি করবেন।
এদিকে পোলিশ রাজা তৃতীয় অগাস্টাস স্যাক্সোনির ইলেক্টর হওয়ায় তার সমর্থনে ৪০ হাজারের একটি অস্ট্রিয়ান বাহিনী মার্শাল ব্রাউনের অধীনে বোহেমিয়ার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হলো। সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের প্রারম্ভে মারিয়া থেরেসার চাওয়া ছিল একটাই- সিলিসিয়া। ফ্রেডেরিককে স্যাক্সোনিতেই শায়েস্তা করতে পারলে সিলিসিয়া চলে আসবে হাতের মুঠোয়। ফলে অস্ট্রিয়ানরা ফার্দিন্যান্দের উপর হামলা করতে প্রস্তুত হলো। ফ্রেডেরিকের কানে সেই খবর পৌঁছলে তিনি প্রথমে অতিরিক্ত সৈন্য সেদিকে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কী ভেবে ৩০ সেপ্টেম্বর নিজেই বোহেমিয়ার দিকে যাত্রা করলেন। ফার্দিন্যান্দের সাথে মিলিত হয়ে তিনি বাহিনীর কর্তৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন।
ব্যাটল অফ লোবোসিতজ
বর্তমান চেক রিপাবলিকের অন্তর্গত লোবোসিতজ শহরের কাছেই দুই বাহিনী একত্রিত হলো। প্রুশিয়ানদের সাথে ৯৭টি কামান আর প্রায় ৩০ হাজার সেনা। অস্ট্রিয়ান সাকসেশন যুদ্ধের পর থেকে অস্ট্রিয়ার সামরিক সামর্থ্য নিয়ে ফ্রেডেরিকের তাচ্ছিল্যভাব ছিল।
ব্রাউন শহরের নিকটে লোবোশ পাহাড়ে ঘাঁটি করেছিলেন। এখানে পয়লা অক্টোবর সকাল সাতটায় লড়াই শুরু হয়। সূচিত হলো তৃতীয় সিলিসিয়ান যুদ্ধ, যা এই সেভেন ইয়ার্স ওয়ারে অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়ার মধ্যকার সংঘাত নির্দেশ করে। ফ্রেডেরিকের পাঠানো অশ্বারোহীরা পাহাড়ের ঢালে অস্ট্রিয়ানদের অবস্থান পর্যবেক্ষণে গিয়ে তুমুল গোলাগুলির সম্মুখিন হলো। দ্বিতীয়বার অশ্বারোহী বাহিনীর হামলাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অস্ট্রিয়ানরা পাহাড়ি ঢালে আরো সেনা সন্নিবেশ করে প্রতিরোধ তীব্র করে। ছয়-ছয়বার আঘাত করেও প্রুশিয়ানরা প্রতিবারই অস্ট্রিয়ানদের হাতে নাকাল হয়।
সর্বশেষ একবার চার্জ করতে ফ্রেডেরিক মনস্থির করলেন। এবার কাজ হলো। প্রুশিয়ান সেনারা অস্ট্রিয়ানদের ব্যুহ ভেদ করে ফেলে। শহর থেকে তাদের উপর কামান ছোড়া হলেও তোয়াক্কা না করে ফ্রেডেরিক এই সুযোগে সদলবলে লোবোসিতজের উপর হামলে পড়লেন। শেষ অবধি অস্ট্রিয়ানরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। দুই পক্ষেরই ৩ হাজারের মতো হতাহত হয়। লোবোসিতজের যুদ্ধ ফ্রেডেরিককে অস্ট্রিয়ান সেনাসামর্থ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। তিনি বুঝতে পারলেন তারা এখন আগের থেকে অনেক বেশি সংগঠিত এবং দক্ষ।
স্যাক্সোনির পতন
লোবোসিতজের ফ্রেডেরিকের ব্যস্ততার ফাঁকে ব্রাউন কিছু সৈন্য পির্নাতে প্রেরণ করলেন। ভাবনা ছিল তাদের দেখে স্যাক্সোনির লোকের উদ্বুদ্ধ হবে প্রুশিয়ার সাথে জান-প্রাণ দিয়ে লড়াই করতে। কিন্তু ১৭ অক্টোবর স্যাক্সোনি আত্মসমর্পণ করে। ফ্রেডেরিক তাদের সেনাদের নিজ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। প্রচলিত প্রথা ছিল বিজিত সেনাদের ইউনিট ভেঙে জয়ী বিভিন্ন দলের মাঝে আলাদা আলাদা করে ছড়িয়ে দেয়া, যাতে তারা যুদ্ধ চলাকালে বিশ্বাসঘাতকতা করবার সুযোগ না পায়। কিন্তু ফ্রেডেরিক তা না করে স্যাক্সোনির ইউনিট অক্ষত রেখে একে দলে যোগ করে নেন। এটা ছিল মারাত্মক কৌশলগত ভুল, কারণ পরবর্তীতে লড়াইয়ের সময় এরা হয় পালিয়ে যেত না হয় শত্রুপক্ষে গিয়ে যোগ দিত।
পর্যবেক্ষক সেনাদল (Army of Observation)
সিলসিয়ান লড়াই শুরু হলে ভার্সাই চুক্তি মোতাবেক ফরাসিরা অস্ট্রিয়ার পক্ষে ২৪,০০০ সেনা মোতায়েনের প্রস্তুতি নিল। তারা ফয়সালা করল হ্যানোভার এবং ক্লিভস দখল করে নেবে। ফ্রেডেরিকের কাছে খবর এলো যে এই কাজে ফরাসিরা প্রায় ৫০,০০০ সৈন্য জড়ো করেছে। ফ্রেডেরিক ওয়েস্টমিনস্টার কনভেনশনের দোহাই দিয়ে ব্রিটিশ দূত স্যার অ্যান্ড্রু মিচেলের মাধ্যমে সহায়তা চেয়ে পাঠালেন। ব্রিটিশরা নিজেদের সেনা জার্মানিতে পাঠাতে চাইছিল না, তাদের কাছে আমেরিকা আর ভারতের লড়াই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ফ্রেডেরিক প্রস্তাব করলেন ব্রিটেনে শিবির করে থাকা ৩৫,০০০ হেসিয়ান (মূলত জার্মান হেসি-কেসেল এবং হেসি-হানাউ অঞ্চলের অধিবাসী) এবং হ্যানোভারিয়ান সৈন্যদের জার্মানিতে পাঠাতে, এবং ব্রিটিশ প্রভাবাধীন ব্রান্সউইক এবং স্যাক্সা-গোথা রাজ্যকে ১০,০০০ সেনা যোগান দিতে অনুরোধ করতে। এদের সাথে প্রুশিয়ান ৮,০০০-১০,০০০ লোকবল যোগ করা হলো। বাহিনীর সম্মিলিত ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নিল ব্রিটিশরা। এই বাহিনীর নামই পর্যবেক্ষক বাহিনী বা মিত্রবাহিনী।
ফরাসি অগ্রাভিযান
১ লাখ ফরাসি, অস্ট্রিয়ান এবং অনুগত জার্মান সৈন্য ১৭৫৭ সালের মার্চে যাত্রা শুরু করল। তাদের কমান্ডে প্রথমে ছিলেন সুবি, পরে তা হস্তান্তর করা হয় মার্শাল দেস্ট্রের কাছে। মিত্রবাহিনীর সংখ্যা ৪৭,০০০, তখনো হ্যানোভার থেকে তারা আরো সেনার প্রত্যাশা করছে। তাদের নেতৃত্ব অর্পণ করা হয়েছে ব্রিটিশ রাজপুত্র ডিউক অফ কাম্বারল্যান্ডের কাছে। তার উপর বাবার স্পষ্ট নির্দেশ কেবল আক্রান্ত হলেই আক্রমণ করা যাবে।
এপ্রিলে মাসে ফরাসিরা রাইন অতিক্রম করে। মে-তে দ্বিতীয় ভার্সাই চুক্তি সম্পাদিত হয়। কাম্বারল্যান্ডকে ফরাসিরা এরপর ধাওয়া করতে থাকে। জুনে কাম্বারল্যান্ড সিদ্ধান্ত নিলেন অনেক হয়েছে, এবার লড়াই করতে হবে। রাইনের উত্তরে ব্র্যাকওয়েডে তিনি মোকাবেলার জন্য ফয়সালা করেন। সুবি তার কিছু সেনাকে ঘুরপথে কাম্বারল্যান্ডের বাহিনীর পার্শ্বভাগে নিয়ে আসেন, ফলে কাম্বারল্যান্ড ঘেরাও হয়ে যাবার আশঙ্কায় পিছিয়ে গেলেন।
হ্যানোভারের পতন
২৪ জুলাই কাম্বারল্যান্ড ইউস্টেনবেক (Hastenbeck) আর ভরেমবুর্গে (Voremberg) অবস্থান নিলেন। তার ব্যুহ ছিল ইউস্টেনবেকের উত্তর থেকে পূর্বদিকে। মধ্য এবং বাম দিকে প্রচুর প্রতিরক্ষা থাকলেও ডান দিকে জলাভূমির কারণে সেদিকে সেনা কম রাখা হয়েছিল, কারণ জলাভূমি দিয়ে আক্রমণ করা প্রায় অসম্ভব।
ফরাসি বাহিনী সংখ্যায় ভারি। তাদের কামান এবং অস্ত্রশস্ত্রও ছিল মিত্রবাহিনীর তুলনায় বেশি। ফলে কাম্বারল্যান্ড প্রথম থেকেই ছিলেন চাপে। ২৭ জুলাই ভোর তিনটায় ফরাসিরা কাম্বারল্যান্ডের মধ্যভাগে আঘাত শুরু করে। সকাল আটটার ভেতরে পুরো বাহিনীই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি এমনই বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে যে ফরাসি এবং মিত্রবাহিনী কখনো কখনো নিজ সেনাদের উপরেই গুলি চালাচ্ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে এক কমান্ডার আরেক কমান্ডারের সাথে ঠিকভাবে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। ফলে সেনাদের কাছে উল্টোপাল্টা নির্দেশ যাচ্ছিল। দেস্ট্রে একবার দেখলেন অশ্বারোহীরা ফ্রন্ট থেকে সরে যাচ্ছে, যে আদেশ তিনি দেন নি। ফরাসি এবং ব্রিটিশ দুই সর্বাধিনায়কের কাছেই ভুলভাল রিপোর্ট আসতে থাকে। গোলমালের মধ্যে দুপুরের দিকে দেস্ট্রে বিরতি নেন। এসময় কাম্বারল্যান্ড পিছিয়ে যেতে থাকেন। ফলে দেস্ট্রে আবার রণক্ষেত্রে ফিরে এসে দখল বুঝে নেন। ফরাসিদের হতাহত ছিল ২ হাজারের মত, অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর প্রায় ১,৫০০।
কাম্বারল্যান্ড স্বল্প সংখ্যক সেনা নিয়ে বিরাট ফরাসি সেনাদলের মোকাবেলা করা অনর্থক মনে করলেন। ফলে তিনি হ্যানোভার রক্ষার আশা ছেড়ে দিলে কার্যত এই যুদ্ধের পর হ্যানোভার চলে যায় ফরাসিদের হাতে। তাদের নতুন কম্যান্ডার নিযুক্ত হলেন রিশেঁলিউ। সেপ্টেম্বরের আট তারিখ কাম্বারল্যান্ড ফরাসিদের সাথে ক্লস্টার-যেভেন (Kloster Zeven) কনভেনশন স্বাক্ষর করেন। শর্ত অনুযায়ী এতে হ্যানোভারের প্রতিরক্ষা বাহিনী বিলুপ্ত করার বাধ্যবাধকতা ছিল। এমন প্রতিকূল অবস্থাতেও ইংল্যান্ড জার্মানিতে নিজেদের সেনা পাঠাতে রাজি ছিল না। তারা উল্টো ফরাসি উপকূলে নৌ আক্রমণ চালায়, যার ফলে রশফাঁ এবং সেন্ট মালোর উপর হামলা করা হয়। ভাবনা ছিল এমন যে ফরাসি উপকূলে আক্রমণ হলে তারা হ্যানোভার থেকে অনেক সেনা সেদিকে সরিয়ে আনবে, এই অবসরে কাম্বারল্যান্ড তাদের উপর চড়াও হবেন।
এদিকে রিশেঁলিউ কিছু সেনা নিয়ে পশ্চিমের রণক্ষেত্রে যাত্রা করলেন। তার উদ্দেশ্য ফরাসি সেনাপতি রোঁহা (প্রিন্স অফ সুবি) এবং তাদের জার্মান মিত্রদের সাথে যোগ দেয়া। জার্মানদের দায়িত্বে আছেন স্যাক্সে-হিল্ডবার্গহাউসেন ডাচির প্রধান জোসেফ ফ্রেডেরিক উইলিয়াম। ইতোমধ্যে মার্চের ২১ তারিখেই অস্ট্রিয়া আর ফ্রান্সের সাথে সুইডেনের এক মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তারই ভিত্তিতে সেপ্টেম্বর মাসে সুইডেন প্রুশিয়ান পোমেরানিয়া আক্রমণ করে।