একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। একদা জিউসের পুত্র হারকিউলিস তার প্রণয়িনী তাইরাসের সাথে সমুদ্রের পাড়ে হাওয়া খাচ্ছিলেন। হারকিউলিসের সাথে সেদিন তার পোষা কুকুরও ঘুরতে বেরিয়েছিলো। কুকুরটা সৈকতে খাবার সন্ধান করতে গিয়ে একটি ঝিনুকের সন্ধান পেলো। কুকুরটি কিছু না বুঝে খপ করে সেই ঝিনুকে কামড় বসিয়ে দিলো। আর সাথে সাথে সেই ঝিনুক ফেঁটে এক অদ্ভুত রঙ নির্গত হয়ে কুকুরের সারা শরীর মাখিয়ে দিলো। প্রভু হারকিউলিস তার কুকুরের এই অবস্থা দেখে রেগে উঠলেন। কিন্তু তাইরাস হারকিউলিসকে শান্ত করলো। কারণ, তার কাছে এই উজ্জ্বল রঙ বেশ পছন্দ হয়েছে। সে হারকিউলিসের কাছে বায়না ধরলো, তাকে যেন বিয়ের সময় ঠিক এই রঙের একটি জামা বানিয়ে দেওয়া হয়। হারকিউলিস তাইরাসের কথা ফেলতে পারেননি। তার নির্দেশে হাজার হাজার ঝিনুক জড়ো করা হয়। শক্ত হাতে ঝিনুক ভেঙে তিনি তৈরি করেন সেই রঙ। সেই জামায় গড়ে উঠলো এক অনবদ্য পোশাক।
হারকিউলিস সেদিন যে রঙ তৈরি করেছেন, সেটা হচ্ছে বর্তমান যুগের পার্পল বা রক্তবেগুনি। প্রাচীন গ্রিক পুঁথিতে রক্তবেগুনির জন্ম নিয়ে এই কাল্পনিক গল্পটি লিপিবদ্ধ করা আছে। ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে প্রতিষ্ঠিত পরাক্রমশালী গ্রিক সাম্রাজ্যের অনেকে হয়তো জানতোও না, এই রঙের আসল কারিগররা বাস করে সাগরের অপর তীরে। এই রঙের উৎপত্তির সাথে মিল রেখে গ্রিক বণিকরা সেই স্থানের নাম রেখেছিলো ‘ফিনিশিয়া’, যার অর্থ দাঁড়ায় পার্পল বণিক। রক্তবেগুনি রঙ ছাড়াও আরো নানা বস্তুর জন্ম দিয়েছিলো এই ফিনিশিয়রা। চলুন, আজকের আলোচনায় তাদের গল্প শোনা যাক।
ভূমধ্যসাগর পাড়ে
ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে অবস্থিত বেশ বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে বসবাস করে ‘কানান’ জাতি। কানান শব্দের অর্থ হচ্ছে বণিক সম্প্রদায়। নামের সাথে এই জাতির কাজেরও অনেক মিল। এরা বেশ দক্ষতার সাথে সাগর তীরবর্তী সাম্রাজ্যগুলোতে বাণিজ্য করতো। বর্তমান পৃথিবীর লেবানন, ইসরাইল, জর্ডান, ফিলিস্তিন এবং সিরিয়া অঞ্চলজুড়ে গড়ে উঠেছিলো এই কানান জাতির সাম্রাজ্য। নিজেদের কানান নামে পরিচয় দিলেও সাগরের ওপারের বণিকদের নিকট এদের নাম ফিনিশিয়া। খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ থেকে ৩০০ অব্দ পর্যন্ত এই ফিনিশিয়া ছিল ইউরোপের বাণিজ্যিক পরাশক্তি। প্রাচীন হিব্রু পাণ্ডুলিপি মতে, হযরত মুসা (আ) ইসরাইলীদেরকে মিশর থেকে মুক্ত করে যেখানে নতুন নিবাস গড়ে তুলেছিলেন, সেটাই ফিনিশিয়া। যদিও জশুয়া এবং এক্সোডাসের পাণ্ডুলিপিগুলোতে এই নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। ইতিহাসবিদ রিচার্ড মাইলসের মতে, উগারিত, আভ্রাদ, আরাদুস, ত্রিপলি, বিব্লস, বেরিতাস (বৈরুত), সিদন এবং তাইর- এই কয়টি বড় শহর মিলে গড়ে উঠেছিলো প্রাচীনযুগের অন্যতম ফিনিশিয় সভ্যতা।
বর্ণমালার গোড়াপত্তন
বর্ণমালা ঠিক কখন, কারা আবিষ্কার করেছেন, তা নিয়ে কিঞ্চিৎ বিতর্ক থাকলেও বর্ণমালার বিস্তৃত ব্যবহার এবং তা অন্য সভ্যতার মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে ফিনিশিয়রা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অনুমান করা হয়, ফিনিশিয় সভ্যতা শুরু হওয়ার কয়েক শতাব্দী পূর্বে দক্ষিণ লেভান্ত অঞ্চলে কিছু আদি সেমিটিক বর্ণমালার চল ছিল। এই বর্ণমালা থেকে উদ্ভূত হয় ফিনিশিয় লিপি। এই বর্ণমালা ব্যবহারের সাথে মিশরীয় হায়ারোগ্লিফের মিল পাওয়া গেছে। ফিনিশিয়দের এই বিখ্যাত লিপির সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায় রাজা বিব্লসের সমাধিক্ষেত্র থেকে (খ্রিস্টপূর্ব ১১শ শতাব্দী)।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবাদে এই বর্ণমালা ধীরে ধীরে ভূমধ্যসাগর অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসের জনক হেরোডোটাসের মতে, ফিনিশিয় লিপি খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকে প্রাচীন গ্রিসে এসে পৌঁছায়। এরপর এই লিপি পরিমার্জিত হয়ে এবং স্বরবর্ণের সংযোজনের মাধ্যমে গ্রিক লিপিতে রূপান্তরিত হয়েছে। মূলত, ইউরোপের বেশিরভাগ লিপির পেছনে এই ফিনিশিয় লিপির প্রভাব রয়েছে। ফিনিশিয় লিপি থেকে উদ্ভূত লিপির আরো পরিমার্জনের মাধ্যমে জন্ম নেয় আরবি, আরামিক ও হিব্রু লিপি।
কানান মানে বণিক
ফিনিশিয়দের বাণিজ্যিক সাফল্যের পেছনে মূল কারণ ছিল এরা বেশ দক্ষ নাবিক। এরা ইতিহাসে সর্বপ্রথম বাই-রিম জাহাজ ব্যবহার করা শুরু করে। এদের নাবিকরা এতটাই দক্ষ ছিল যে, ভূমধ্যসাগরের বৈরি আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে এরা নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারতো। এর ফলে সারাবছর এরা বাণিজ্য করতে পারতো। বিব্লস, সিদন, তাইর, আভ্রাদ এবং বৈরুত অঞ্চলের কারিগররা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন বিলাসবহুল দ্রব্য তৈরি করতো, যা পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সাইপ্রাস, রোডস, সাইক্লেডস, গ্রিস, ক্রিট, লিবিয়া, মিশর, মেসোপটেমিয়া, নিকট প্রাচ্য, এমনকি ব্রিটেন পর্যন্ত রপ্তানি করা হতো।
এদের প্রধান বাণিজ্যদ্রব্য ছিল তাইর অঞ্চলে তৈরিকৃত বিখ্যাত রক্তবেগুনি রঙের গুঁড়ো। মেসোপটেমিয়া, মিশর এবং রোমান সাম্রাজ্যে এই রঙের তৈরি পোশাক আভিজাত্যের প্রতীকরূপে সমাদৃত ছিল। ইউরোপে এই রঙ বাণিজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি ছিল ফিনিশিয়রা। তবে এদের রাজ্যগুলোর মাঝে রঙ উৎপাদনে প্রতিযোগিতা চলতো। এই কারণে প্রতিবছর রঙের মান বৃদ্ধি পেতো এবং এর দামও বাড়তো সমান তালে। রঙ ছাড়াও ফিনিশিয়রা কাঁচের জন্য বিখ্যাত ছিল। সিদন অঞ্চলের কাচ এত উঁচু মানের ছিল যে, প্রাচীন মানুষ ভাবতো সিদনিরাই কাচের আসল আবিষ্কর্তা। এছাড়া তারা ব্রোঞ্জের কাজ ভালো পারতো। মিশরের বিভিন্ন স্থাপনার ব্রোঞ্জের কারুকার্যে ফিনিশিয়দের ছাপ পাওয়া গেছে। ফিনিশিয়রা তাদের বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্যান্য সভ্যতার কৃষ্টিতে নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করেছিলো। এই কারণে বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের কাছে ফিনিশিয়া হচ্ছে প্রাচীন সংস্কৃতির ‘দালাল’।
ফিনিশিয়রা তাদের বাণিজ্যিক দাপটের কারণে সব রাজ্য দ্বারা সমাদৃত হতো। অন্য রাজারা প্রতিবেশি দেশ আক্রমণকালে ফিনিশিয়া অঞ্চল এড়িয়ে চলতো। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, কেউ ফিনিশিয়া আক্রমণ করতে ইচ্ছুক ছিল না। বরং অনেক দেশই ফিনিশিয়ার ধন-দৌলতের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল। যার প্রমাণ আমরা একটু পরেই পাবো।
রাজনৈতিক অবকাঠামো
ফিনিশিয়া অঞ্চলে ছোট বড় অনেকগুলো নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। নগর রাজ্যের কর্তা হিসেবে থাকতেন একজন সম্রাট। প্রতিটি রাজ্য সামরিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী ছিল। নগর বিভক্ত ফিনিশিয়া কখনো একজোট হয়ে কাজ করেছে কি না, তা নিশ্চিত হয়ে জানা যায়নি। ফিনিশিয়া সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে কিছুটা সুযোগের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে। প্রাচীন মিশর এবং হিট্টাইটরা ইউরোপের ফিনিশিয়া অঞ্চল শাসন করতো। কিন্তু ক্রমাগত যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে তাদের সামরিক শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। বিশেষ করে বিখ্যাত ‘দ্য সি পিপল’দের আক্রমণের পর মিশরীয়রা একদম দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ১২শ শতাব্দীর দিকে ফিনিশিয়রা মিশরীয়দের হটিয়ে এই অঞ্চলের ক্ষমতা দখল করে।
ফিনিশিয়ার ক্ষমতা কাঠামো তিন স্তরে বিভক্ত ছিল- রাজা, মন্দির ও পুরোহিত এবং উপদেষ্টা পরিষদ। এই তিন স্তরের ব্যক্তিবর্গ ফিনিশিয়ার সকল কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতো। ফিনিশিয়া অঞ্চলে কাগজে কলমে কোনো নির্দিষ্ট রাজধানী ছিল না। তবে বিব্লস অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এদের বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এখান থেকে বণিকরা ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরে জাহাজ ভাসিয়ে বাণিজ্য করতে যেত। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতে বিব্লসের স্থান দখল করে তাইর। তাইরের রাজা ও পুরোহিত ইথোবাল বেশ দাপটের সাথে ফিনিশিয়ার উত্তরাঞ্চল শাসন করতে থাকেন। তাইর অঞ্চলের শাসকরা ৮১৪ খ্রিস্টপূর্বে কারথ্যাজ বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। এই বন্দর থেকে পরবর্তীতে গড়ে উঠে কারথ্যাজ সভ্যতা। পরবর্তীতে তাইরের শাসকরা দুর্বল হয়ে পড়লে সিদনিরা ফিনিশিয়ার অধিকর্তার মসনদে আসীন হয়েছিল। এভাবে একেক সময়ে একেক নগর রাজ্য ফিনিশিয়ার ক্ষমতা দখল করেছিল।
ফিনিশিয়ার পরাধীনতা
ফিনিশিয়া কখনোই সংঘবদ্ধ সাম্রাজ্য ছিল না। তাই স্বতন্ত্র নগর রাজ্যগুলো শক্তিশালী হলেও বাইরের কোনো আক্রমণ প্রতিহত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী তারা ছিল না। তবে বাণিজ্যের খাতিরে অনেক সাম্রাজ্য ফিনিশিয়াকে ছাড় দিলেও সেটা মেনে নিতে পারেননি দিগ্বিজয়ী সম্রাট মহামতি সাইরাস। পারস্যের এই সম্রাট ফিনিশিয়ার দাপটে ঈর্ষান্বিত হয়ে ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বে একে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। সাইরাস, যার সামনে পৃথিবীর বহু শক্তিধর রাজ্য, ঐক্যজোট পরাজয় বরণ করেছে, তার কাছে ফিনিশিয়া দখল ছিল পানির মতো সহজ কাজ। ফিনিশিয়রা পারসীদের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করলো। সাইরাস ফিনিশিয়াকে পারস্যের অন্তর্ভূক্ত করার পর চারটি রাজ্যে বিভক্ত করেন- সিদন, তাইর, আরওয়াদ এবং বিব্লস।
পরাধীন ফিনিশিয়া পারস্যের অধীনে আগের মতোই উন্নতি করতে থাকে। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। এর ফলে ফিনিশিয়ার বাণিজ্যিক প্রতিপত্তি পূর্বের চেয়ে দুর্বল হয়ে যায়। এর পেছনে কারণ হিসেবে ধরা যায়, পারস্য আক্রমণে ভীত হয়ে ফিনিশিয়দের রাজ্য ত্যাগ করে কারথ্যাজ আশ্রয় নেওয়াকে।
আলেকজাণ্ডারের ফিনিশিয়া অধিকার
আলেকজাণ্ডার দ্য গ্রেটের নাম শোনেনি, এমন মানুষ হাতে গোনা যায়। পুরো পৃথিবী শাসন করার নেশায় বিভোর এই সেনাপতি দখল করেছেন পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি। ইউরোপের বাণিজ্যিক রাজধানী ফিনিশিয়াও সেই তালিকা আছে। আলেকজাণ্ডার ফিনিশিয়া দখল করার উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৪ অব্দে। সর্বপ্রথম তিনি ফিনিশিয়ার বালবেক অঞ্চল দখল করেন। বালবেক যুদ্ধে আলেকজাণ্ডারের শক্তিশালী বাহিনী দেখে ফিনিশিয়ার অন্যান্য রাজ্য ভয় পেয়ে যায়। যার ফলে পরবর্তীতে বিব্লস এবং সিদন বিনা রক্তপাতে আলেকজাণ্ডারের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এসব রাজ্য খুব সহজে জয় করা সম্ভব হলেও তিনি জানতেন, তার আসল পরীক্ষা অপেক্ষা করছে তাইরের প্রান্তরে।
পারস্য সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তিশালী নৌ বন্দর ছিল তাইর। আলেকজাণ্ডার জানতেন, যদি এই অঞ্চলের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে তাইর দখল করার বিকল্প নেই। অপরদিকে সামরিক দিক থেকে ফিনিশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য ছিল তাইর। মূলভূমি থেকে আলাদা তাইর মূলত একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। এর প্রবেশদ্বার হাজার হাজার সৈনিক দ্বারা সুরক্ষিত। বীর আলেকজাণ্ডার তাইর প্রবেশ করার এক অভিনব উপায় বের করলেন। তিনি হারকিউলের সমকক্ষ ফিনিশিয় দেবতা মেলকার্তের মন্দিরে পূজা দেওয়ার আবেদন জানিয়ে তাইরের সম্রাটের নিকট দূত প্রেরণ করেন। সম্রাট এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। আলেকজাণ্ডার এবার চটে যান। তিনি তাইরের আত্মসমর্পণের দাবি জানিয়ে পুনরায় দূত প্রেরণ করেন। এই হুমকিতে তাইরিরা খেপে যায়। তারা আলেকজাণ্ডারের দূতকে হত্যা করে নগর দেয়ালে মরদেহ ঝুলিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর আর দেরি করা যায় না। আলেকজাণ্ডার তার সমস্ত সৈন্যবল নিয়ে তাইর আক্রমণ করে বসেন। কিন্তু আলেকজাণ্ডারের কোনো শক্তিশালী নৌবাহিনী না থাকায় এই দ্বীপ আক্রমণ করে তেমন সুবিধা করতে পারলেন না।
আলেকজাণ্ডার এবার তার প্রকৌশলীদের তলব করলেন। দ্বীপে প্রবেশ করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে কাঠের সরু সেতু তৈরি করার নির্দেশ দিলেন তিনি। ওদিকে তিনি সাইপ্রাসে দূত প্রেরণ করলেন যুদ্ধজাহাজের আবেদন জানিয়ে। যুদ্ধজাহাজ আসার পূর্ব পর্যন্ত তাইরিরা ক্রমাগত আক্রমণ করে আলেকজাণ্ডারের সেতু নির্মাণ প্রকল্প ভেস্তে দিতো। কিন্তু সাইপ্রাসের যুদ্ধজাহাজ তাইর পৌঁছানোর পর যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। আলেকজাণ্ডার এবার শক্ত হাতে তাইরের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে নগরে প্রবেশ করেন। দীর্ঘ সাত মাস ব্যাপী চলা এই অবরোধের অবসান ঘটে তাইরিদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। নিজ দূত হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে আলেকজাণ্ডার প্রায় দশ হাজার তাইরিকে খোলা আকাশের নিচে হত্যা করেন। প্রায় ৩০ হাজার তাইরিকে বিভিন্ন রাজ্যে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। আলেকজাণ্ডার এভাবে একে একে ফিনিশিয়ার সকল রাজ্য দখল করেন।
ফিনিশিয়ার শেষটুকু
আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর ফিনিশিয়ার ক্ষমতার ভার নেন তার উত্তরসূরি সেলেসিদ। কিন্তু আরেক উত্তরসূরি টলেমির সাথে প্রায়ই তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এর ফলে ফিনিশিয়া ধীরে ধীরে তার মূল প্রতিপত্তির কেন্দ্র থেকে সরে যেতে থাকে। নিজস্ব পরিচয় ভুলে ফিনিশিয়রা তখন হেলেনিক কৃষ্টি রপ্ত করতে থাকে। অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ফিনিশিয়া দখলে এগিয়ে আসে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য- রোম। ১৬৪ খ্রিস্টপূর্বে পিউনিক যুদ্ধে ফিনিশিয়া অঞ্চল রোমানদের হাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর তারা ফিনিশিয়া দখল অভিযান চালায় আরো একশত বছর পরে।
৬৪ খ্রিস্টপূর্বে ফিনিশিয়ার মাটিতে রোমানদের পদার্পণ ঘটে। ১৫ খ্রিস্টপূর্বে ফিনিশিয়াকে রোমান সাম্রাজ্যের একটি কলোনি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফিনিশিয়ায় হেলোপলিসের দেবতা জুপিটারের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা রোমানদের অন্যতম তীর্থস্থানরূপে আবির্ভূত হয়। কিন্তু ততদিনে ফিনিশিয়া আর ফিনিশিয়া নেই। তা হয়ে গেছে রোমান সভ্যতার অংশ। এভাবে এককালের প্রতাপশালী বাণিজ্যিক রাষ্ট্র ফিনিশিয়ার পতন ঘটে।
ফিনিশিয়া সাম্রাজ্যের গল্প এখানে শেষ হলেও এর অবদান কখনো হারিয়ে যাওয়ার নয়। শব্দকে অভিনব কায়দায় প্যাপিরাস পাতায় আবদ্ধ করার যে পদ্ধতি তারা আবিষ্কার করেছিলো, তা এখন পুরো পৃথিবীতে প্রতিটি ভাষায় স্বতন্ত্ররূপে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর নানান সভ্যতার আবির্ভাব ঘটেছে। বিশ্ব ক্ষমতার পালা বদলে অনেক সভ্যতা হারিয়েও গেছে। কিন্তু ফিনিশিয়রা বেঁচে আছে তাদের কর্মের মাধ্যমে। পৃথিবীর ইতিহাস যতদিন পঠিত হবে, ততদিন ফিনিশিয়দের এই কর্ম বেঁচে থাকবে।