যোদ্ধা কিংবা শাসক- দুই হিসেবেই তিনি ছিলেন সফল। শাসন ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ ৩৪ বছর। সুদীর্ঘকাল শাসন ক্ষমতায় থেকে যেমন আগলে রেখেছেন সাম্রাজ্য, তেমনি নিশ্চিত করেছেন সুশাসন। নিজ কৃতিত্ব, সাহস ও বীরত্বের জন্য যে কয়জন নারী পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হাউসা রাজকন্যা আমিনা। তিনি আমিনাতু, আমিনা সুখেরা এবং রানী আমিনা নামেও সমধিক পরিচিত।
জন্ম ও শৈশব
রাজকন্যা আমিনার জন্ম ১৫৩৩ সালে উত্তর-মধ্য নাইজেরিয়ার কদুনা রাজ্যের তৎকালীন জাজাও এলাকায়। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী জাজাওকে ডাকা হয় ‘জারিয়া’ নামে। আমিনার ছোট বোন জারিয়ার নামানুসারেই হয়েছে জারিয়া অঞ্চলের নামকরণ।
ছোটবেলা থেকেই আমিনা সেসময়কার আর দশটা মেয়ে শিশুর মতো ঘরের দেয়ালের ভেতর নিজেকে আড়াল করেননি। শৈশব থেকেই ছিলেন অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের। তার পিতামহ নহির ছিলেন জাজাওয়ের শাসক। সেই সুবাদে শৈশব থেকেই তার পিতামহের রাজ দরবারে আসা যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।
শৈশবের যে বয়সটিতে হাউসা মেয়েরা রান্নাবান্না শেখায় ব্যস্ত থাকতো, তখন থেকেই আমিনা রাজ্য শাসন, কূটনীতি, যুদ্ধ ইত্যাদি শেখার পেছনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রানী বাকওয়ার বড় মেয়ে হিসেবে তিনি যখন মগজিয়া (উত্তরাধিকারী) নিযুক্ত হন, তখন তার বয়স মাত্র ষোল বছর। হাউসা ঐতিহ্য অনুযায়ী এই বয়স হলেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হতো। রাজকন্যা আমিনার জন্যও যে বিয়ের প্রস্তাব আসেনি, তা নয়, কিন্তু রাজনীতি, যুদ্ধ তখন হয়ে উঠেছিল তার মনোযোগের বিষয়। তাই তিনি সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
তার পিতামহ নহিরের মৃত্যুর পর, জাজাওয়ের শাসন ক্ষমতার ভার চলে আসে আমিনার মা বাকওয়া তুরুনকুর উপর। তিনি মায়ের সাথে থেকে শাসন কার্যের খুঁটিনাটি শিখতে থাকেন। সেই সাথে তিনি গড়ে ওঠেন একজন আপাদমস্তক যোদ্ধা হিসেবে।
আমিনা তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। তার পরিবার লবণ, চামড়াজাত পণ্য, কাপড়, ঘোড়া, আমদানিকৃত ধাতব পদার্থের ব্যবসার মাধ্যমে জাজাওয়ে বেশ সম্পদশালী ছিল।
১৬ শতকের শেষ দিকে সাংহাই সাম্রাজ্যের পতনের পর সেখানে ব্যবসায়িক আধিপত্য বিস্তারকারী সাতটি হাউসা নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে অন্যতম ছিল জাজাও। হাউসা জাতিগোষ্ঠী ছিল মূলত পশ্চিম আফ্রিকার সাহল অঞ্চলের মানুষ। পরে তারা আধুনিক দিনের উত্তর নাইজেরিয়া এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় নাইজারে বসবাস করতে থাকে। মধ্যযুগে তারা উপ-সাহারান বাণিজ্য পথগুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করে আফ্রিকান রাজ্যের একটি শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ জোট গঠন করেছিল।
ক্ষমতায় আরোহণ
১৫৬৬ সালে রাজকন্যা আমিনার মা রানী বাকওয়া মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর আমিনার ছোট ভাই করামা শাসন ক্ষমতায় আসেন। এই সময়টাতেই আমিনা যোদ্ধা হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তিনি নিজেকে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ ও সমর্থ যোদ্ধা হিসেবে সেনাবাহিনীতে দাঁড় করিয়েছিলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি জাজাওয়ের অশ্বারোহী বাহিনীর ভার নিয়ে নেন। যুদ্ধের দামামা বাজলে সর্বপ্রথম যিনি হাজির হতেন, তিনি ছিলেন আমিনা। উত্তরাধিকার সূত্রে ও যুদ্ধের মাধ্যমে একজন সম্পদশালী সেনা কর্মকর্তা হিসেবেও নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন তিনি।
১৫৭৬ সালে দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তার ভাই করামা মৃত্যুবরণ করলে আমিনা জাজাওয়ের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি পূর্বেই যোদ্ধা হিসেবে জাজাওয়ের সেনাবাহিনীর সমীহ অর্জন করেছিলেন, সেই সাথে জাজাওয়ের অধিবাসীরাও তার মেধা ও যোগ্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। এ কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সকলের আনুগত্য লাভ করেন।
যদিও আমিনার মা রানী বাকওয়া শান্তিপ্রিয় শাসক হিসাবে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু আমিনা রাজনৈতিকভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। ক্ষমতার আসনে বসার তিন মাসের মধ্যেই তিনি সামরিক বাহিনীকে গুছিয়ে নিয়ে সামরিক অভিযানে মনোযোগী হন। তার শাসনামলেই জাজাওয়ের আকার তিনগুন বৃদ্ধি পেয়ে, সর্ববৃহৎ আকার লাভ করেছিল।
তবে শুধু রাজ্য বিস্তারের জন্য সামরিক অভিযান তার মূল উদ্দেশ্য ছিল না, বরং উদ্দেশ্য ছিল কেউ যাতে জাজাওয়ের ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক পথে কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে।
শাসক হিসেবে ছিলেন সফল
রাজকন্যা আমিনা শুধু শাসকই নয়, ছিলেন আপাদমস্তক একজন যোদ্ধাও। রাজনৈতিক মেধা ও বীরত্বে জাজাওয়ের শাসন ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন মৃত্যুর আগপর্যন্ত। দীর্ঘ শাসনকালে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সফল শাসক।
সে সময়টাতে জাজাও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথের কেন্দ্রে ছিল, যা উত্তর আফ্রিকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিম সুদানের সাথে যুক্ত করেছিল। আমিনা জাজাওয়ের ব্যবসা প্রসারের জন্য ও ব্যবসায়িক দিক থেকে যাতে জাজাও প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে, সেজন্য ব্যবসায়িক পথগুলোর সম্প্রসারণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
তার সেনাবাহিনীতে বিশ হাজারের অধিক নিয়মিত সৈন্য ছিল। তিনি ক্রমাগত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে তার সাম্রাজ্য আটলান্টিকের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। এবং পূর্ব পশ্চিমে মিশর এবং উত্তরে মালীসহ পশ্চিমাঞ্চলীয় সুদানকে সংযুক্ত করার সকল বাণিজ্য পথগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে সমর্থ হয়েছিলেন।
আমিনা তার সেনাবাহিনীতে লোহার শিরস্ত্রাণ, ধাতব বর্ম ও অস্ত্র চালু করেছিলেন, যাতে তার সামরিক দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। তার রাজ্যের সীমানাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন জায়গায় দুর্গ ও শহর প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করেছিলেন। তার নির্মিত কিছু দেয়াল ‘আমিনার প্রাচীর’ নামে নাইজেরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় কালের সাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান আছে এখনো।
শাসনাধীন এলাকাগুলোতে তিনি কোলা বাদাম চাষের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। এ সময় জাজাও সমৃদ্ধ নগর-রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। সেইসাথে সুশাসন ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আমিনা নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেন।
লড়াই ছিল তার মূলমন্ত্র
উনিশ শতকের শকোতোর সুলতান ও লেখক মোহাম্মদ বেলো লিখেছেন, “আমিনা কাতসিনা ও কানো রাজ্যগুলোকে সম্পূর্ণরুপে পরাজিত না করা পর্যন্ত লড়েছেন। এবং বৌচি শহরগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার রাজ্য দক্ষিণে এবং পশ্চিমে সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছায়।”
তিনি তার সৈন্যদের বলতেন, “যদি তুমি একা লড়ো, তবে তুমি হেরে যাবে। আমরা একত্রে লড়ব, ভাগ করে নেব আমাদের বিজয় ও গৌরব। যদি আমাদের প্রিয় জাজাওয়ের জন্য ধূলোকে চুম্বন করতে হয়, তবে আমরা একসাথে তা-ও করব।”
নাগরিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলতেন, “আমার রাজ্যে কোনো নারী, নারী হিসেবে জন্ম নেওয়ার জন্য অনুতপ্ত হবে না। সবার জন্য সম্মান ও মর্যাদা থাকবে সমান। যদি আমি একজনকে কিছু দিই, তবে অন্যরাও তা পাবে।” এছাড়াও তিনি ঘোষণা করেন, “আমার শাসনের অধীনে নাগরিকদের বিপদের দায়িত্ব আমার।”
রানী আমিনা আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেননি এবং সন্তানও গ্রহণ করেননি। কথিত আছে, তিনি প্রত্যেক যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকদের মধ্য থেকে একজনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতেন। আবার পরের দিন তাকে হত্যা করতেন, যাতে তার সম্পর্কে বাইরে কিছু না বলতে পারে। তবে এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
মৃত্যু
রাজকন্যা আমিনা ১৬১০ সালে নাইজেরিয়ার বিদা অঞ্চলের আতাগর নামক স্থানে সামরিক অভিযানের সময় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পরেও আমিনা তার অসামান্য কৃতিত্বের জন্য নারী প্রেরণার উৎস হয়ে আছেন, হয়ে আছেন একটি অনুকরণীয় গল্পের নায়িকা, যে গল্পে নারী হয়েও চিরাচরিত বৃত্তের বাইরে এসে প্রমাণ করেছেন নিজের অসামান্য যোগ্যতা। তার জন্মভূমি নাইজেরিয়ায় তাকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। বলা হয়, রাজকন্যা আমিনার মতো সাহসী নারী আর কখনোই পায়নি নাইজেরিয়া! তবে শুধু নাইজেরিয়ার ইতিহাসেই নয়, একজন যোদ্ধা ও শাসক হিসেবে রানী আমিনা সারা দুনিয়ার ইতিহাসেই অনন্যা।
তথ্যসূত্র
From Eve to Dawn, A History of Women in the World, Volume II, By Marilyn French
The Glory of African Kings and Queens, By Pusch Commey