শরতের এক ঝলমলে রৌদ্রদগ্ধ সকালে কাশবনের মাঝখান দিয়ে বিলি কেটে কালো ধোয়াঁর কুন্ডুলী পাকিয়ে হিস হিস করে বাঁশি বাজিয়ে ধেঁয়ে আসছে এক বাষ্পশকট। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। বিস্ময়কর এই দৃশ্য দেখতে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে দুই ভাইবোন দুর্গা আর অপু। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে বাংলার বুক চিরে আধুনিকতার আগমনী বার্তা নিয়ে এগিয়ে আসছে ট্রেন। আর সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর দুর্গা-অপুরা একরাশ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে সেদিকে। সেই রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আজও এই যন্ত্রদানবের প্রতি চেয়ে থাকে হাজারও দুর্গা-অপুরা।
বাংলায় প্রথম দিনের ট্রেন যাত্রা নিয়ে কিছু মজার ঘটনা প্রকাশিত হয় তৎকালীন ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকায়। সেদিন কলকাতা থেকে ট্রেনে ওঠেন রূপচাঁদ ঘোষ নামক এক ব্যবসায়ী। স্টেশনে নেমে তিনি কিছুতেই বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, এত তাড়াতাড়ি সত্যিই হুগলি পৌঁছেছেন কি না। হুগলি স্টেশনে নামার পর তিনি জনে জনে জায়গার নাম জিজ্ঞেস করে বেড়াচ্ছিলেন। পণ্ডিত রাধালঙ্কার ব্যানার্জি নামক এক জ্যোতিষী ট্রেনে উঠেছিলেন পাঁজি-পুঁথি বিচার করে। হুগলিতে নেমেই মন্ত্রপাঠ শুরু করে দেন। শুধু তা-ই নয়, আগুনে গাড়িতে আয়ু কমে যাবে, এই অজুহাতে আর ট্রেনে ফেরেননি তিনি। এর আগে মিস্টার জোন্স নামে এক ব্রিটিশ ভেবেছিলেন তার ঘোড়ার গাড়ি ট্রেনের সঙ্গে ছুটতে পারে। লাইনের ধার দিয়ে ট্রেনের সঙ্গে পর পর তিন দিন প্রতিযোগিতা করেন তিনি। ক্রমাগত চাবুক মারতে মারতে শেষপ্রান্ত ঘোড়াকে মেরেই ফেলেন বেচারা। কিন্তু ট্রেনের সাথে ছুটতে পারার সাধ আর তার পূর্ণ হলো না।
ভারতবর্ষের রেলওয়ের আগমনের পর বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে রেল পরিষেবার সূচনা হতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। কারণ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং ভৌগলিক দিক বিবেচনায় ব্রিটিশদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। যদিও বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে রেলপথ স্থাপনের পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ঊনিশ শতকের প্রথমভাগেই। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে প্রায় এক যুগেও এ পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখতে পায়নি।
ব্রিটিশ পিরিয়ডে রেলওয়ে ব্যবস্থা সরকারি কোনো সেবা ছিল না। সে সময় রেলওয়ে ছিল বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির অধীনে। তবে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় যে এসব কোম্পানি গড়ে উঠেছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। কোম্পানিগুলো ব্যবসায়িক স্বার্থে এবং বাণিজ্যিক সুবিধাদি বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতেই রেলপথ নির্মাণ করতে থাকে। এসব বাণিজ্যিক রেলপথ নির্মাণের জন্য ঊনিশ শতকে অসংখ্য রেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব কোম্পানির অধিকাংশই আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লন্ডনে। এমন অনেক কোম্পানি ছিল যারা শুধুমাত্র ছোট একটা রেলপথ নির্মাণের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কোম্পানির বাইরে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় রেললাইন স্থাপনের ইতিহাসও ভারতবর্ষে রয়েছে। আবার সব কোম্পানিই যে ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত ছিল তা কিন্তু নয়, ভারতবর্ষেও অনেক কোম্পানি রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
রেল বিপ্লব চলাকালে ১৮৪২ সালে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান এক ভারতীয় বাঙালি উদ্যোক্তা। সেখানে বাষ্প-শকটের এই অত্যাধুনিক গতি-দানব দেখে তিনি বিমোহিত হয়ে পড়লেন। এবং ভাবতে লাগলেন, ভবিষ্যতে ভারতের ভাগ্য লেখা আছে এই যন্ত্রদানবের সঙ্গেই। দেশে জাহাজ, ব্যাংক, বীমা এবং নীল ব্যবসার বদৌলতে সেই ব্যক্তির হাতে তখন ছিল প্রচুর অর্থ। যে-ই ভাবা সে-ই কাজ। দেশে ফিরেই ১৮৪৩ সালে প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন ‘গ্রেট ওয়েস্টার্ন অব বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি’। দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরা তখন সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে থাকলো। পরে তিনি এই কোম্পানিটিকে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করান। এতক্ষণ যে বাঙালি উদ্যোক্তার কথা বলা হলো তিনি আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।
রেলপথ নির্মাণকারী সকল কোম্পানিই একটা বিষয় বিবেচনায় রেখে কাজ শুরু করত। আর তা হলো তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ। যেমন- কোনো স্থানে রেলপথ নির্মাণের আগেই সমীক্ষা চলিয়ে দেখত যে ঐ অঞ্চলে রেলপথ নির্মিত হলে কোম্পানি লাভবান হবে কি না। এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে তারা কোনো অনুদান পেত না। পরে অবশ্য অধিকাংশ কোম্পানিই সরকারিকরণ করে নেওয়া হয়। বাংলাদেশে রেলপথ নির্মাণ করেছিল এমন কিছু কোম্পানির মধ্যে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে, নর্দান বেঙ্গল রেলওয়ে, ঢাকা স্টেট রেলওয়ে, এবং আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ছিল অন্যতম।
ব্রিটিশ ভারতে সর্বপ্রথম রেলওয়ের আগমন ঘটে ১৮৫৩ সালে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে কোম্পানির হাত ধরে। মুম্বাই থেকে থানে এর মধ্যে ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে ভারতবর্ষের রেলওয়ে পরিষেবার সূচনা ঘটে। অপরদিকে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত রেল পরিষেবার সূচনা ঘটে ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির হাত ধরে।
এ সময় ট্রেন ভ্রমণে মানুষকে উৎসাহী করার জন্য ব্রিটিশরা পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়াসহ ব্যাপক প্রচারণা চালায়। মজার ব্যাপার হলো, হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ট্রেন নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগেই ছেড়ে গিয়েছিল। কারণ এত পরিমাণ মানুষের ভিড় জমে ছিল যে এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আবেদন পড়ে প্রায় তিন হাজার। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র কয়েকশ মানুষই ট্রেনে জায়গা করে নিতে পারেন। ট্রেনটিতে তিনটি শ্রেণী ছিল। প্রথম শ্রেণীর ভাড়া ছিল ৩ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর ১ টাকা ২ আনা এবং তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়া ছিল ৭ আনা। এটা ছিল ব্রিটিশ বাংলার প্রথম ট্রেন চলাচল।
অতঃপর ১৫ নভেম্বর ১৮৬২ সালে আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রেলপথ উন্মুক্ত করা হয়। অর্থাৎ, ব্রিটিশ ভারতে রেলের আগমনের ৯ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রেলওয়ে পরিষেবার সূচনা ঘটে। আর এই রেল পরিষেবার সূচনা করে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি।
ব্রিটিশরা বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। যেমন- বাংলাদেশ সেসময় পাট শিল্প, বস্ত্রশিল্প, চা শিল্প এবং খাদ্য সামগ্রীর জন্য বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত ছিল। বাণিজ্যিক কারণে ব্রিটিশরা চেয়েছিল এ অঞ্চলে প্রথমদিকেই রেল পরিষেবা শুরু করতে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, আসাম ও ত্রিপুরা জেলাগুলো পাট, বস্ত্র, চা এবং কয়লা সমৃদ্ধ ছিল। অর্থনৈতিক সুবিধা এবং ব্যবসা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ার কারণে। তাছাড়া মাঝখানে প্রমত্তা পদ্মা ও যমুনা যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ছিল সবচেয়ে বড় বাধা। অবস্থা এমন হয়েছিল যে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা করতে না পারলে তাদের লোকসানের পরিমাণ খুব বেড়ে যাবে। যেহেতু ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ ভারতের অনেক অঞ্চলই রেলওয়ের সুবিধা পেতে শুরু করেছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব তারা এ অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করতে থাকে।
বাংলাদেশ ভূখন্ডে রেলওয়ের আগমন
আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম সুনির্দিষ্ট রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় ১৮৫২ সালে। ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল জে পি কেনেডি তার সামরিক সুবিধা বিবেচনায় ব্রিটিশ সরকারের কাছে গঙ্গা নদীর পূর্ব তীর ধরে সুন্দরবন হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রেলপথ বসানোর প্রস্তাব দেন। তার এই প্রস্তাব ব্রিটিশ সরকার বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই গ্রহণ করে। কিন্তু এরই মধ্যে ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ সরকার মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) দখল করে নেয়। ব্রিটিশ সরকার চেয়েছিল মিয়ানমারকে ভারতীয় উপনিবেশের সাথে সংযুক্ত করতে। রাজনৈতিক এবং কৌশলগত সুবিধার কারণে মিয়ানমারের রাজধানী রেঙ্গুন থেকে কলকাতা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের প্রশ্ন তখন প্রকট হয়ে ওঠে। চাপা পড়ে যায় কর্নেল কেনেডির দেয়া প্রস্তাব।
এর ১৮৫৫ সালে বাংলায় নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের মেজর অ্যাবার ক্রমবি মাঠ পর্যায়ের একটি জরিপ পরিচালনা করেন। এতে তিনি ভূপ্রকৃতি যাচাই, রেলপথ নির্মাণের সম্ভব্য খরচ, বাণিজ্যিক সুবিধাদি ইত্যাদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তাছাড়া পর্যবেক্ষণে রাখা হয় সামরিক সুবিধাদিও। এই পর্যবেক্ষণানুযায়ী তিনি একটি রিপোর্ট পেশ করেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। ব্রিটিশ সরকার তার এই প্রস্তাবনা এবং প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে বাংলায় রেলপথ স্থাপন করা হবে। এতে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামে একটি রেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা উল্লেখ করা হয়। অনেক যাচাই-বাছাই এবং সমীক্ষার জটিলতা শেষ হতেই দু’বছর কেটে যায়। অবশেষে ১৮৫৭ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। ব্রিটিশ প্রবীণ রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার ওয়েলিংটন পার্ডান-এর তত্ত্বাবধানে বাস্তবে রূপ নেয় এই প্রকল্পটি।
কলকাতা- রানাঘাট-জগতী রেল সেকশন
ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার পর তাদের সর্বপ্রথম সফল কাজ ছিল কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রেল সেকশন উন্মোচন। ১৮৫৮ সালের ৩০ জুলাই কলকাতার হুগলি নদীর পূর্ব পাড় থেকে (বর্তমানে শিয়ালদহ স্টেশন) রানাঘাট, দর্শনা, পোড়াদহ হয়ে কুষ্টিয়ার জগতি (বর্তমান বাংলাদেশ) পর্যন্ত একটি ব্রডগেজ (৫ ফুট ৬ ইঞ্চি) রেলপথ নির্মাণের জন্য ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রস্তাবিত এ লাইনের দৈর্ঘ্য ছিল ১১০ মাইল। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল তৎকালীন ১ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং।
এর মধ্যেই ভারতবর্ষে শুরু হয়ে গেল সিপাহী বিদ্রোহ। সে কারণে রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রম কিছুটা থমকে যায়। অবশেষে বিদ্রোহের অবসান ঘটলে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি পুরোদমে কাজ শুরু করে দেয়। ভূমির সম্ভাব্যতা যাচাই এবং জমি অধিগ্রহণ শেষে মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়। ইস্টান বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি রেলপথ নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করে। এতে করে মেসার্স ব্রেসী ও পেক্স অ্যান্ড ওয়াইটেস নামক দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা কলকাতা আসেন। শুরু হয়ে যায় এক এলাহী কর্মযজ্ঞ।
প্রস্তাবিত এই ১১০ মাইল লাইন নির্মাণের অংশ হিসেবে কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যায় আগেই। সেসময় অবশ্য জগতি পর্যন্ত লাইন নির্মাণের কার্যক্রমও চলমান ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাদের ব্যবসায়িক সুবিধা বিবেচনায় সম্পূর্ণ লাইন নির্মাণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলেন না। নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ায় কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত সেকশনে ট্রেন চলাচল শুরু করতে চাইল। অবস্থা তখন এমন হয়েছিল যে তারা যেন আর একটি দিনও অপেক্ষা করতে পারবে না।
১৮৬২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে রানাঘাট সেকশনটি উদ্বোধন করা হয়। এই সেকশন দিয়ে সেদিন থেকেই ট্রেন চলাচল শুরু হয়ে যায়। তার কয়েক মাসের মধ্যেই রানাঘাট থেকে জগতি পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজও সমাপ্ত হয়। ফলে সেবছরই ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর রানাঘাট থেকে দর্শনা হয়ে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ উন্মোচন করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে রেল পরিষেবার সূচনা ঘটে আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। এই রেলপথের শেষ স্টেশন জগতিকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন। যদিও এই সেকশনে জগতি ছাড়াও পোড়াদহ, চুয়াডাঙ্গা এবং দর্শনাও একই দিনে উদ্বোধন করা হয়।
নদীবিধৌত পূর্ববঙ্গের নরম মাটি বাষ্প-শকটের সদম্ভ পদভারে প্রকম্পিত হতে লাগল। অবহেলিত বাঙালিরা তাকিয়ে থাকল নতুন যুগের এই বার্তাবাহকের দিকে। দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলায় খাদ্য নিরাপত্তা অনেকটা সুসংহত হলো। অন্যদিকে আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল ব্রিটিশ শাসনের নিগড়। প্রথম যেদিন ট্রেন এলো পূর্ব বাংলায়, একরাশ ভয় ও বিস্ময় গ্রাস করল বাঙালিকে। কারণ ইতিপূর্বে বাঙালি ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে চলা বাষ্প-শকট চালিত এই গতিদানব দেখা তো দূরের কথা, এমন যান যে পৃথিবীতে আছে তা কল্পনাও করতে পারেনি।
কয়লা পুড়িয়ে ধোয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝকঝকে রব তুলে যখন জগতি স্টেশনে ট্রেন এসে থামত, তখন রেলগাড়ি দেখার একরাশ কৌতূহল নিয়ে আশপাশের এলাকায় অগণিত মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। কয়লার ট্রেন থেকে হয়েছে ডিজেল চালিত ট্রেন, ডিজেল থেকে হয়েছে বৈদ্যুতিক ট্রেন- কত কিছুই পরিবর্তন ঘটেছে কালের পরিক্রমায়, কিন্তু মানুষের মধ্যে রেলগাড়ির সেই কৌতূহল যেন আজও শেষ হয়ে যায়নি।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকেই নীল চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল কুষ্টিয়া। নীলচাষী ও নীলকরদের আগমনের পরই কুষ্টিয়ার নগরায়ন শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া বস্ত্র শিল্পের জন্য কুষ্টিয়া বরাবরই বিখ্যাত ছিল। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে এখানে একটি নদী বন্দর স্থাপিত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই বন্দরটি ব্যবহার করত। বিশেষত নীলকররা এবং নীল ব্যবসায়ীদের দখলে থাকতো এই বন্দরটি। কুষ্টিয়া ছিল নদীয়া জেলার একটি মহাকুমা। পরে কোম্পানি শাসনামলে এটি যশোর জেলার অধীনে চলে আসে। রেল যোগাযোগ স্থাপনের পর অত্রাঞ্চলে নগরায়নের সুবাতাস বইতে থাকে। তারই রেশ ধরে ১৮৬৯ সালে কুষ্টিয়া পৌরসভা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
“একটা প্রযুক্তি পুরো একটা সমাজকে বদলে দেবে”, কার্ল মার্ক্সের সেই ভবিষ্যদ্বাণী বিফলে যায়নি। কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চাকা সচল হতে শুরু করে। কুষ্টিয়ায় স্থাপিত হতে থাকে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। আনাগোনা দেখা দেয় ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের। ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মোহিনী মিল’ যা ছিল তৎকালীন সময়ে সমগ্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় কাপড়ের কারখানা। তাছাড়া ১৮৯৬ সালে যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস রেনউইক এবং ১৯০৪ সালে যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং নামে দুটি শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর দর্শনায় প্রতিষ্ঠিত হয় ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘কেরু এন্ড কোং’। এটি ছিল ঐ অঞ্চলের মধ্যে তৎকালীন সবচেয়ে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। এভাবেই শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে এ অঞ্চলের আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে।
জগতি-গোয়ালন্দ ঘাট রেল সেকশন
জগতি রেল স্টেশনের অবস্থান ছিল কুষ্টিয়া শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। কলকাতা থেকে জগতি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের পর ব্রিটিশ সরকার ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও সহজ করতে চাইল। যদিও পদ্মার এপারে তখনও রেললাইন স্থাপন করা হয়নি। তাছাড়া মাঝখানে প্রমত্তা পদ্মা এ যোগাযোগ স্থাপনের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ালো। এতদসত্ত্বেও পদ্মার পাড় পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন রেল ব্যবস্থা স্থাপন করলে বাণিজ্যিক সুবিধা হবে, এই বিবেচনায় ব্রিটিশ সরকার পদ্মা এবং যমুনার সংযোগস্থল গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করে।
যেহেতু জগতি পর্যন্ত রেলপথ রয়েছে, কাজেই সেখান থেকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ করলেই পদ্মার পাড় পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব। এই সেকশনেও রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নিল ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। কাজ শুরু হয়ে গেল ১৮৬৯ সালের শুরুতেই। জগতি থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন বর্ধিতকরণ কাজ সমাপ্ত হয় ১৮৭১ সালে। সে বছরই ১ জানুয়ারি ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে জগতি থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত রেল সেকশনটি উদ্বোধন করা হয়। কলকাতা থেকে জগতি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের প্রায় ১০ বছর পর কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হলো। উদ্বোধনের দিন থেকেই ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস নামের একটি ট্রেন কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত নিয়মিত চলাচল করত।
সেসময় মানুষ কলকাতা থেকে ট্রেনে করে জগতি পার হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে এসে নামত। স্টিমারে করে পদ্মা নদী পার হয়ে চলে আসত ঢাকায়। পদ্মার এ পাড়ে তখনও রেললাইন নির্মিত হয়নি। জগতি থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত রেল সেকশনের মধ্যবর্তী স্টেশনগুলো হলো কুষ্টিয়া, কুষ্টিয়া কোর্ট, চড়াইকল কুমারখালী, খোকসা, মাছপাড়া, পাংশা, কালুখালী জংশন, বেলগাছি, ও সূর্যনগর গোয়ালন্দ বাজার।
১৮৮৪ সালে ঢাকা স্টেট রেলওয়ে কোম্পানি নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করে। এতে কলকাতার সাথে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার এক নতুন যুগের সূচনা হয়। রাতের ট্রেনে কলকাতা থেকে যাত্রা করে সকাল নাগাদ এসে পৌঁছানো যেত গোয়ালন্দ ঘাটে। সেখান থেকে স্টিমারে করে নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ স্টেশন থেকে ট্রেনে করে ঢাকা পৌঁছানো যেত দুপুরের আগেই। তিন দিনের দীর্ঘ যাত্রাপথ নেমে এলো মাত্র ১৭ ঘন্টায়।
১৮৭৫ সালের ১০ই জানুয়ারি সাধারণীর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল-
পূর্ব্বে গোয়ালন্দ একটি যৎসামান্য গ্রাম ছিল। এখন রেলওয়ে ষ্টেশন হইয়া অতি বিখ্যাত স্থান হইয়াছে। উত্তর, পূর্ব্ব-বাঙ্গালা ও আসাম অঞ্চলের লোকদিগকে কলিকাতা অঞ্চলে যাইতে হইলে এস্থানে আসিয়া রেল গাড়ীতে উঠিতে হয়। বাণিজ্য উপলক্ষে বহুতর বণিক মহাজনের এখানে সমাগম হইয়া থাকে।’ যাত্রীসংখ্যা এতই বৃদ্ধি পায় যে, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ১৮৭৪ সালে শুধু তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা রুটে রিটার্ন টিকেট প্রবর্তন করে।
আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রেল এসেছিল এদেশের মানুষের ভাগ্য ফেরাতে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করে ব্রিটিশ সরকারের অর্থনীতির চাকা সচল রাখলেও নদীবিধৌত পূর্ববাংলা সবসময়ই ছিল অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। রেলপথ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও গুরুত্ব পায় পূর্ববংলার বাঙালিরা। সাথে কিছু আধুনিক সুযোগ-সুবিধাও পেতে থাকে। ব্রিটিশদের আনাগোনায় মুখরিত হতে থাকে বাংলাদেশ। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যেও উন্নতি করতে থাকে দেশীয় ব্যবসায়ীরা।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
[আরো বিস্তারিত জানতে ‘পূর্ববাংলার রেলওয়ের ইতিহাস‘ বইটি সংগ্রহ করতে পারেন রকমারিতে থেকে।]