রেড আর্মি ফ্যাকশন: জার্মানির উগ্র বামপন্থীরা

গত শতাব্দীর ষাট আর সত্তরের দশকটা ছিল ভীষণ উত্তাল একটা সময়। বিশ্বজুড়ে বামপন্থীদের সাথে লড়াই চলেছে পশ্চিমা শিবিরের। ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছে, এদিকে মার্টিন লুথার কিং খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ভীষণ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। প্যারিসে চলেছে মে বিপ্লব, ফরাসি সরকারের অবস্থা টালমাটাল, কিউবা ওদিকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, সব মিলিয়ে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি।

এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে যা হয়, দেশে দেশে যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠলো। অনেকগুলো লাতিন দেশে ঘটে গেল সামরিক অভ্যুত্থান, চে গুয়াভারা গুলি খেয়ে মরলেন, আরব সেনাবাহিনীগুলো ইজরায়েলের সামনে একদম বিধ্বস্ত হয়ে গেল, ভিয়েতনামের যুদ্ধ তীব্রতর হয়ে উঠলো।

বরাবরের মতোই যুদ্ধ আর বিপ্লবের সেই ডামাডোলে বহু তরুণ-তরুণী মেতে উঠেছিল। শুধু যে তৃতীয় বিশ্ব বা বাম ঘরানার দেশগুলোতেই এই অশান্ত সময়ের ছোঁয়া লেগেছিল তা কিন্তু নয়। খোদ পশ্চিম ইউরোপে; ইতালি, জার্মানি আর ফ্রান্সের অনেক মানুষ কোমর বেঁধে নেমেছিল পরিস্থিতি বদলাতে। তারা কতটুকু সফল বা ব্যর্থ সেটা সময় বিচার করবে, তবে এসব বিপ্লবী চেতনার মানুষের কীর্তিকাহিনী কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়।

আজ এমনই একদল জার্মানকে নিয়ে আলাপ হবে। সত্তরের দশকে ‘রেড আর্মি ফ্যাকশন’ নামের এক শহুরে গেরিলা গ্রুপ গঠন করে গোটা পশ্চিম জার্মানিতে আলোড়ন তুলেছিল তারা।

পটভূমি

১৯৪৯ সালে পশ্চিম জার্মানির ক্ষমতায় আসেন কনরাড আডেনাওয়ার। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে জার্মান যুদ্ধবন্দীদের দেশে ফেরত নিয়ে আসা বা অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু তার সরকার আর প্রশাসনের নানা পর্যায়ে নিষিদ্ধ নাৎসি পার্টির সমর্থক বা প্রাক্তন সদস্যদেরকে নিয়োগ দেওয়ায় জার্মান তরুণ সমাজ দারুণ ক্ষুব্ধ হয়। সেই আমলে জার্মান মিডিয়াও সরকারের কড়াকড়ির মধ্যে চলতো।

রেড আর্মি ফ্যাকশন লোগো; Image Source: wikimedia commons

ওদিকে গোটা বিশ্বে তখন সমাজতন্ত্রের জোয়ার লেগেছে। এর প্রভাব পড়লো জার্মানিতে। সেখানকার তরুণেরা আন্তোনিও গ্রামসি, চে গুয়েভারা, রেজিস দেব্রে, মাও সে তুং বা কার্লোস মারিঘেলার মতো তাত্ত্বিক বা দুঁদে গেরিলা যোদ্ধাদের কর্মকান্ড আর লেখনী পড়ে দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো নিজেদের রক্ষণশীল সরকারের প্রতি। ন্যাটো আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীলতা এবং ভিয়েতনামসহ অসংখ্য ফ্রন্টে পশ্চিমা সেনাদের উপস্থিতিতে এসব নয়া বামদের ঘোরতর আপত্তি ছিল। তাই ষাটের দশকটা জুড়ে জার্মান শিক্ষার্থীরা সরকারকে বিক্ষোভ-আন্দোলনে অতিষ্ঠ করে রেখেছিল।

১৯৬৭ সালে ইরানের শাহ জার্মানি সফরে এলে আন্দোলনকারী, শাহ সমর্থক এবং সরকার সমর্থকদের মধ্যে বিরাট দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়। বেনো ওনেহসোর্গ নামের এক তরুণ গুলি খেয়ে মারা গেলে গোটা জার্মানি উত্তাল হয়ে ওঠে। গুডরুন এনস্লিন আর আন্দ্রিয়াস বাদের নামের দুই তরুণ-তরুণী এসবের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে একটি শপিং মলে ছোটখাট বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

এহেন বেআইনী প্রতিবাদের জন্য জার্মান পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে, তবে দলটা প্যারোলে মুক্তি পেয়েই পালিয়ে ফ্রান্সে চলে যায়। এখানেই রেজিস দেব্রের সাথে তাদের পরিচয় হয়। দেব্রে তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ের সাথে সাথে গেরিলা যুদ্ধের পাঠ দিলেন। উল্লেখ্য, এই দেব্রেই বলিভিয়াতে চে গুয়াভারাকে সমর্থন করতে গিয়ে কারাবরণ করেছিলেন।

রেড আর্মি ফ্যাকশন/বাদের মেইনহফ গ্যাং

১৯৭০ সালে আন্দ্রিয়াস বাদেরের নেতৃত্বে রেড আর্মি ফ্যাকশন গঠিত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই বাদেরকে জার্মান পুলিশ গ্রেফতার করে। বাদেরের বান্ধবী ও রেড আর্মি ফ্যাকশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য গুডরুন এন্সলিন তখন উলরিকে মেইনহফের সাথে দেখা করেন। বামপন্থী পত্রিকা কংক্রিটের একজন লেখিকা এবং তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি বেশ সমাদৃত ছিলেন। উলরিকের সহযোগিতায় রেড আর্মি ফ্যাকশন বাদেরকে উদ্ধার করে। ডামাডোলের মধ্যে এক লাইব্রেরিয়ান গুলি খেলে উলরিকে ভয় পেয়ে যান এবং আন্দ্রিয়াস বাদেরের দলবলের সাথে আন্ডারগ্রাউন্ডে পালিয়ে যান। জার্মান মিডিয়া এই গ্রপটিকে বাদের-মেইনহফ গ্যাং বলেই বেশি পরিচিতি দিয়েছিল।

আন্দ্রিয়াস বাদের; Image Source: www.taz.de

আক্রমণ

১৯৭০ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে বাদের-মেইনহফ গ্যাং বেশ কিছু সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল ইয়ট ক্লাব, রক্ষণশীল মিডিয়া হাউজ এবং জার্মানিতে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলো। ব্যাংক লুট করে তারা টাকা জোগাড় করতো। জার্মান পুলিশ উঠেপড়ে লাগে এই শহুরে গেরিলাদের পাকড়াও করবার জন্য। গ্রুপটির শুরুর দিককার সদস্যরা জর্ডানে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের ক্যাম্পে সামরিক ট্রেনিং নিয়েছিল।

১৯৭২ সাল নাগাদ গুডরুন এনস্লিন, আন্দ্রিয়াস বাদের আর উলরিকে মেইনহফ সহ বেশ কয়েকজন সদস্য ধরা পড়ে। তাদেরকে কড়া পাহারায় ১৯৭৫ সাল নাগাদ স্টেইমহাম কারাগারে পাঠানো হয়।

উলরিকে মেইনহফ; Image Source: spiegel.de

মূল সদস্যরা ধরা পড়ায় রেড আর্মি ফ্যাকশনের অন্যান্য সদস্যরা বেশ মরিয়া হয়ে ওঠে। ঐ বছরই পশ্চিম বার্লিনের মেয়র প্রার্থী পিটার লরেঞ্জকে অপহরণ করা হয়। পরে বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে পিটার মুক্তি পান। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে গিয়ে একদল গেরিলা জার্মান দূতাবাস কব্জা করে নেন। তবে জার্মান সরকার তাদের দাবি না মেনে উল্টো ঐ দূতাবাসে অভিযান চালিয়ে দখল করে নেয়।

এরই মধ্যে আন্দ্রিয়াস বাদেরসহ বাকিদের বিচার কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। অভিযুক্তরা যেসব আইনজীবীর সাহায্য চাইলেন, তাদেরকে আদালতে ঢুকতে তো দেওয়া হলোই না, উল্টো তল্লাশী আর জেরায় তারা জেরবার হয়ে পড়লেন। বন্দী গেরিলারা নিজেদেরকে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী এবং ভিয়েতনামের পক্ষের শক্তি হিসেবে আদালতে বারবার ঘোষণা জানাতে থাকেন।

জার্মান বসন্ত

ইয়ুর্গেন পন্টো ছিলেন জার্মানির প্রধানতম ব্যাংক ড্রেসড্রেন কর্পোরেশনের প্রধান। ১৯৭৭ সালে রেড আর্মি ফ্যাকশনের লোকেরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনা দিয়েই শুরু হয় জার্মান বসন্ত। কিছুদিন পরে জার্মানির প্রধানতম শিল্পপতিদের একজন, হানস মার্টন শ্লেয়ারের গাড়িবহরে আক্রমণ করে হামলা করে এই গ্রুপের গেরিলারা। বেশ কয়েকজনকে খুন করে হানস মার্টেনকে অপহরণ করা হয়। তবে এরপরেও জার্মান সরকার কোনো রকম দুর্বলতা না দেখিয়ে বিচার চালিয়ে যেতে থাকে।

বিচার চলতে থাকে। মরিয়া হয়ে তখন গেরিলারা শেষবারের চেষ্টা চালায়। পপুলার ফ্রন্ট অব লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের আরব গেরিলাদের সাথে রেড আর্মি ফ্যাকশনের যোগাযোগ ছিল। তারা একটি জার্মান বিমান অপরহরণ করে এবং আরব ও জার্মান বন্দীদের মুক্তির দাবি জানায়।

এই উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। জার্মান কমান্ডোরা বিমানটিতে আচমকা হামলা চালিয়ে ৮৬ যাত্রীকেই উদ্ধার করে নিয়ে আসে। কেবল একজন পাইলটকে আরবরা হত্যা করে। এর কিছুদিন পরই ফ্রান্সে অপহৃত শিল্পপতিকে গেরিলারা গুলি করে হত্যা করে লাশ ফেলে যায়।

অপহৃত ও নিহত শিল্পপতি মার্টিন শ্লেয়ার; Image Source: dw.com

জার্মান বসন্তের সবথেকে চমকপ্রদ ঘটনাটি হচ্ছে, আন্দ্রিয়ার বাদেরদের যিনি বিচার করছিলেন, সেই বিচারপতি সিগফ্রিড বুবাককেও গেরিলারা গুলি করে হত্যা করে। তবে এত করেও বিচারকাজ ঠেকিয়ে রাখতে তারা ব্যর্থ হয়।

দলীয় প্রধানদের মৃত্যু

জার্মান বসন্ত চলাকালীন সময়েই উলরিকে মেইনহফকে তার সেলে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ডাক্তার একে আত্মহত্যা বলে সাব্যস্ত করেন। ওদিকে যেদিন জার্মান কমান্ডোরা অপহৃত বিমানটি উদ্ধার করে, সেদিন রাতেই আন্দ্রিয়াস বাদের আর কার্ল রাস্পকে গুলিবিদ্ধ ও মৃত অবস্থায় তাদের সেলে পড়ে থাকতে দেখা যায়। রেড আর্মি ফ্যাকশনের তাত্ত্বিক নেতা গুডরুন এনস্লিনকে পাওয়া যায় ঝুলন্ত ও মৃত অবস্থায়। মোলারকে চারবার ছুরিবিদ্ধ করা হয় বা তিনি নিজেই নিজেকে ছুরি মেরেছিলেন। যা-ই হোক, মোলার বেঁচে যান।

আদালতে আরএএফ সদস্যরা; Image Source: cabinetmagazine.org

জার্মান সরকার ঘোষণা দেয়, বন্দীরা সবাই আত্মহত্যা করেছে, কারণ বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পরে তারা আর কোনো মুক্তির আশা দেখতে পারছিল না। তবে পরবর্তীকালের তদন্তে এই সরকারী বক্তব্যের সব ছিদ্র আবিষ্কৃত হয়। বাদেরকে যে অবস্থায় আবিষ্কার করা হয়, সেভাবে আত্মহত্যা করা প্রায় অসম্ভব। তার মাথার বেশ কিছুটা পেছন থেকে গুলি করা হয়েছিল। তাছাড়া বন্দীরা যেসব বন্দুক বা ছুরি ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলোতে কোনো আঙুলের ছাপ ছিল না। একমাত্র জীবিত বন্দী মোলার জোর গলায় ঘোষণা করেন যে, তার সঙ্গীদেরকে হত্যা করা হয়েছে।

তবে জার্মান সরকার নিজেদের বক্তব্যে অটল থাকে। যদিও কিভাবে পরস্পরের সাথে কোনো যোগাযোগ করা ছাড়াই চারজন বন্দী আত্মহত্যায় রাজি হলো বা কারাগারে আগ্নেয়াস্ত্র কে বন্দীদের হাতে তুলে দিল তা নিয়ে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

এই বিমানটিকে হাইজ্যাক করা হয়েছিল; Image Source: Airliners.net

শেষ পরিণতি

সত্তরের দশক থেকেই পূর্ব জার্মানইর গোয়েন্দা সংস্থা স্তাসি রেড আর্মি ফ্যাকশনকে নানাভাবে প্রশিক্ষণ আর সাহায্য দিত। আশির দশকে বেশ কতগুলো উল্লেখযোগ্য হামলা চালায় তারা। উচ্চপদস্থ জার্মান কর্মকর্তা বা ব্যাংকের প্রধানরা ছিলেন এগুলোর লক্ষ্য। কয়েকটি হামলা সফল হলেও নব্বই পরবর্তী সময়ে রেড আর্মি ফ্যাকশনের কার্যক্রম একরকমের বন্ধ হয়ে যায়। টাকার অভাব, নতুন রিক্রুটের অভাব, আন্তর্জাতিক কোনো সাহায্যের অভাব; সব মিলিয়ে জেরবার হয়ে ১৯৯৮ সালে গ্রুপটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বাদের মেইনহফ বা রেড আর্মি ফ্যাকশন নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা বানানো হয়েছে। মোট ৩৪ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী এই জার্মান গেরিলারা আজও একত্রীকৃত জার্মানিতে মুখরোচক আলোচনার বিষয়।

ফিচার ইমেজ– The Independent

Related Articles

Exit mobile version