একটি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাজারে অসংখ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকে। প্রতিটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করে বাজার যাতে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, এটি করতে গিয়ে তাদেরকে অপরাপর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়। একটি পণ্য যখন বাজারে আনা হয়, তখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করে যেন দাম অনুযায়ী পণ্যটি ক্রেতাকে সন্তুষ্ট করতে পারে, অন্যথায় বাজারে তাদের পণ্যের চাহিদা কমে যাবে, আর চাহিদা কমে গেলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের যে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য, তা ব্যাহত হবে। স্মার্টফোনের কথাই ধরা যাক। আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা প্রতিবছর বিশাল অংকের অর্থ খরচ করে গবেষণার পেছনে, যাতে উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে আরও আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের পণ্য বাজারে আনা যায়। এতে করে তাদের পণ্যের চাহিদা ঠিক থাকবে ও নতুন চাহিদা তৈরি হবে, প্রতিষ্ঠানের যে পরিমাণ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য, তা অর্জিত হবে।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যেহেতু বাজারে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা বিদ্যমান, তাই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দুরদর্শিতা অনেক বড় একটি বিষয়, কেননা একটি সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে কিনা, এর উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। দেখা যায়, অনেক সময় অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির হয়, আবার অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি মুনাফা অর্জিত হতে পারে, প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারণের মতোও বাড়তি অর্থ হাতে এসে পৌঁছেছে। গত শতাব্দীর কথাই ধরা যাক। আমেরিকায় তখন ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার চাহিদা তৈরি হয়েছে, তাই মার্কিন উদ্যোক্তারাও সমাজের চাহিদা মেটাতে একের পর এক গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছিলেন। উইলিয়াম সি. ডুরান্ট নামের একজন মার্কিন উদ্যোক্তা সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে সেসময় জেনারেল মোটর্স নামের এক গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
জেনারেল মোটর্স প্রতিষ্ঠার পর ডুরান্টের মাথায় আরও গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান কেনার নেশা চেপে বসে। তৎকালীন মার্কিন বাজারে অন্যান্য যেসব ছোট পরিসরের গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছিল, সেগুলো একের পর এক কিনতে থাকেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল, প্রতিদ্বন্দ্বী বিখ্যাত ফোর্ড কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে হবে তাকে। ফোর্ড যেখানে এক ধরনেরই গাড়ি উৎপাদন করে, সেখানে তিনি বিভিন্ন আয়ের ক্রেতার কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন দামের গাড়ি তৈরি করবেন। দেখা গেল, জেনারেল মোটর্স প্রতিষ্ঠার পর পরবর্তী আঠারো মাসে প্রায় ত্রিশটি গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান কিনে ফেললেন ডুরান্ট। এটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত, কারণ এতগুলো প্রতিষ্ঠান থেকে যদি কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জিত না হয়, তাহলে পরবর্তীতে বিশাল সংকটে পড়বেন– এমনটাই ধরে নেয়া হচ্ছিল। যা ধারণা করা হয়েছিল, তা-ই হলো। তিনি তার ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের আগপাছ নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা না করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেসব গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান কিনলেও পরবর্তীতে যখন যথেষ্ট মুনাফা অর্জিত হলো না সেসব প্রতিষ্ঠান, তখন তাকে ঋণদাতা ব্যাংকগুলো তার প্রতিষ্ঠান থেকে সরে যেতে বাধ্য করল।
ডুরান্টের ক্ষেত্রে যা হয়েছিল, তার সাথে আরেক বিখ্যাত প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপল-এর কর্ণধার স্টিভ জবসের অনেক মিল রয়েছে। যেভাবে জেনারেল মোটর্সের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম ডুরান্টকে তার প্রতিষ্ঠিত একটি গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হলো, তেমনই ‘অ্যাপল’ প্রতিষ্ঠার পর জবসকে একসময় তারই প্রতিষ্ঠান থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু স্টিভ জবসের প্রস্থানের পর অ্যাপলের তৎকালীন ডিরেক্টরদের অসংখ্য ভুল সিদ্ধান্ত ও যুগের পরিবর্তনে সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটি এক দশকের মধ্যেই প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মুনাফা হাতছাড়া করে, উল্টো ঋণে জর্জরিত হয়ে যায়। এরপর নাটকীয়ভাবে জবস আবার তার কোম্পানিতে ফিরে আসেন, অ্যাপল পৃথিবীর সবচেয়ে সফল প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। জেনারেল মোটর্সের ক্ষেত্রে কর্ণধার ডুরান্ট পরবর্তীতে আবার তার প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসলেও ব্যর্থতার মুখে আবারও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
কোম্পানির লোকসান, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধকল ইত্যাদি কাটিয়ে ওঠার পর পূর্ণোদ্দমে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯২৩ সালে আলফ্রেড স্লোয়ান নামে একজন প্রকৌশলীকে প্রতিষ্ঠানটির ‘প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা’ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী একজন মানুষ। তৎকালীন গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে পাল্লা দেয়ার জন্য উদ্ভাবনী শক্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। যেহেতু তিনি নিজেই প্রকৌশলী ছিলেন, তার অধীনে কোম্পানির বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হতো। তার বেশ কিছু যুগোপযোগী উদ্ভাবনের কারণে জেনারেল মোটর্সের গাড়ির বেশ চাহিদা তৈরি হয়। তিনি দেখতে পেলেন, তার কোম্পানির অধীনে অসংখ্য গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা মার্কিন সমাজের বিভিন্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে ভিন্ন ভিন্ন দামের গাড়ি বাজার আনতে প্রস্তুত। তিনি এর উপর জোর দিলেন। নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য পন্টিয়াক, মধ্যবিত্তের জন্য অডসমোবাইল, ধনীদের জন্য ক্যাডিয়াক– এরকম চিন্তাভাবনা নিয়ে অগ্রসর হলেন তিনি। ফলাফল মিলল হাতেনাতে। ১৯৫৬ সালে যখন তিনি অবসর নেন, তখন শুধু আমেরিকায় নয়, পুরো বিশ্বে জেনারেল মোটর্স এক শক্তিশালী গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। আমেরিকায় তখন প্রতি দুটি গাড়ির একটিতে জেনারেল মোটর্সের মনোগ্রাম লাগানো ছিল!
আলফ্রেড স্লোয়ানের মাধ্যমে জেনারেল মোটর্সের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চরম উৎকর্ষ লাভ করলেও প্রথমদিকে এই প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার সংগ্রাম এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন জেনারেল মোটর্সের মূল দায়িত্ব ছিল মার্কিন সামরিক বাহিনীকে অব্যাহতভাবে গাড়ি সরবরাহ করা। এরপর ১৯৩০ সালের দিকে মার্কিন অর্থনীতিতে হানা দেয় ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা ‘মহামন্দা’। এই সময় মার্কিন সমাজের এতটাই খারাপ অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে, অসংখ্য মার্কিন প্রতিষ্ঠান চাহিদার অভাবে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আবার দেউলিয়া হয়ে বাজার থেকে হারিয়ে যায়। এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ও স্লোয়ান জেনারেল মোটর্সকে সফলতার সাথে টিকিয়ে রেখেছিলেন। মহামন্দা শেষ হওয়ার পর জেনারেল মোটর্সের ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল পূর্ণোদ্দমে।
১৯৮০ সালের পর থেকে জেনারেল মোটর্সের পতন শুরু হয়। মূলত যুগের পরিবর্তনের ফলে ক্রেতাদের চাহিদারও পরিবর্তন শুরু হয়েছিল, যা জেনারেল মোটর্সের তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এছাড়া ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা মার্কিন শ্রমিকদের জন্য যে দাবিগুলো পেশ করেছিলেন, সেগুলো পূরণ করতে গিয়ে জেনারেল মোটর্সের প্রতিটি গাড়ির উৎপাদনের খরচ বেড়ে যায়। দেখা গিয়েছিল, মার্কিন বাজারে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান (যেমন: টয়োটা) সস্তা শ্রম কাজে লাগিয়ে যে গাড়ি তৈরি করতে পারছিল, অতটা সস্তায় সেই গাড়ি উৎপাদন করা জেনারেল মোটর্সের পক্ষে সম্ভব ছিল না, যেহেতু মার্কিন সমাজে সস্তা শ্রমের যোগান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আরেকটি কারণ হলো, জেনারেল মোটর্সের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের গাড়ির মধ্যে একধরনের গাড়ির বিশাল চাহিদা অন্য ধরনের গাড়ির বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল। হার্ভার্ড বিজনেজ রিভিউ জার্নালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, যে লক্ষ্যে (মুনাফা অর্জন করা) একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়, সেই লক্ষ্য থেকে জেনারেল মোটর্স সরে গিয়েছিল।
২০০৮ সালে যখন বিশ্বে আবার মহামন্দা শুরু হয়, তখন জেনারেল মোটর্সের অবস্থা একেবারেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই ভাল যাচ্ছিল না, এর উপর মহামন্দার ধাক্কা ‘ডুবন্ত জাহাজে ফুটো করা’র মতোই ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল গাড়িনির্মাতা এই প্রতিষ্ঠানের জন্য। দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে কোনোমতে রক্ষা পেয়ে এখনও বহাল তবিয়তে টিকে আছে জেনারেল মোটর্স, কিন্তু আগের মতো আর শক্ত অবস্থান নেই তাদের। যুগের সাথে তাল মেলাতে না পারলে যে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা যায় না, তার অন্যতম উদাহরণ এই মার্কিন গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ক্রেতাদের কাছে জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত গাড়ির চাহিদা দিনে দিনে কমছে, সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে বৈদ্যুতিক গাড়ি। বর্তমানে প্রায় সব বহুজাতিক গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে বিশাল বিনিয়োগ করছে, জেনারেল মোটর্সও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে জেনারেল মোটর্সকে পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা পথ, যে পথ সফলভাবে পাড়ি দেয়া মোটেও সহজ নয়।