প্রাক্তন আমেরিকান ফার্স্ট-লেডি জ্যাকি ওনাসিস তার দুই সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন পার্কে। বাইসাইকেল চালাতে চালাতে গল্প জুড়েছিলেন তারা। আচমকা তাদের সাইকেলের সামনে লাফিয়ে পড়লেন এক ব্যক্তি। জ্যাকি ও তার সন্তানরা হকচকিয়ে গেলেন। কিন্তু লোকটির কোনো গ্রাহ্য নেই তাতে। হাতের ক্যামেরা দিয়ে একের পর এক ছবি তুলেই যাচ্ছেন তিনি।
এমন ঘটনা যে এবারই প্রথম তা নয়। একবার জ্যাকি সাঁতার কাটছিলেন, সেখানে নৌকা নিয়ে এসে হাজির এই ভদ্রলোক। উদ্দেশ্য সাঁতাররত অবস্থায় তার ছবি তোলা। একবার তো জ্যাকিকে অনুসরণ করতে করতে তিনি চলে গিয়েছিলেন গ্রিসে। সেখানে গ্রিক নাবিকের ছদ্মবেশ নিয়ে ঘাপটি মেরে ছিলেন বিকিনি পরিহিতা জ্যাকির ছবি তোলার জন্য। এভাবে প্রতিনিয়ত জ্যাকির পেছনে ছায়ার মত লেগে থাকতেন তিনি। শুধু জ্যাকিই নয়, তার সন্তানদের স্কুলেও প্রায়ই হানা দিতেন এই বক্তি।
এই পাগলাটে ব্যক্তির নাম রোনাল্ড গ্যালেলা। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ও সবচেয়ে বিতর্কিত তারকা-ফটোগ্রাফার বলা হয় থাকে তাকে। ‘Paparazzo Extraordinaire’ ও ‘The Godfather of U.S paparazzi culture’ এর মতো চটকদার অনেক খেতাবও ঝুটেছে তার কপালে। অপ্রস্তত অবস্থায় তারকাদের ছবি ক্যামেরাবন্দী করাই ছিল তার নেশা। ছবি তোলা নিয়ে গ্যালেলার কান্ড-কীর্তি কিংবদন্তি তুল্য।
শ্রাইন অডিটরিয়ামে মাইকেল জ্যাকসন ও ব্রুক শিল্ডসের সেই বিখ্যাত ছবি থেকে শুরু করে বিকিনিতে ব্রিজিটি বার্ডোর ছবি সহ অনেক তারকাকেই তিনি ধরেছিলেন তার ক্যামেরায়। এ নিয়ে তাকে ঝামেলাও কম পোহাতে হয়নি। মার্লোন ব্র্যান্ডো তো তার চোয়ালই ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। পাঁচটি দাঁত হারাতে হয়েছিল তাকে। আর জ্যাকি ওনাসিস সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট লাগিয়ে দিয়েছিলেন তার ক্যামেরা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। বিষয়টি গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্ত। সে গল্পে আসছি পরে।
এ পর্যায়ে জ্যাকির পুরো পরিচয়টা একটু দেয়া যাক। তার পুরো নাম জ্যাকুলিন কেনেডি। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির স্ত্রী ছিলেন। কেনেডির মৃত্যুর পর বিয়ে করেন গ্রিক ধনকুবের এরিষ্টটল ওনাসিসকে। এরপর জ্যাকি ওনাসিস নামেই অধিক পরিচিত হয়ে উঠেন তিনি। জ্যাকি স্রেফ একজন ফার্স্ট-লেডিই ছিলেন না। সেসময়ের সংস্কৃতিতে তার প্রভাব ছিল অনন্য। তার আকর্ষণীয় পোশাক সচেতনতা ও স্টাইলের কারণে পরিণত হয়েছিলেন লাখো মানুষের ফ্যাশন আইকনে।
আর এসবই টেনেছিল রন গ্যালেলাকে। প্রাণবন্ত জ্যাকি ওনাসিসের উচ্ছলতা ক্যামেরায় বন্দী করতে পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিলেন রন। একটি তথ্য দিলেই বুঝতে পারবেন তার এই পাগলামির মাত্রা কেমন ছিল। রনের তোলা জ্যাকির ছবির সংখ্যা কত হবে? রনের মতে প্রায় মিলিয়নের কোটা ছাড়িয়ে যেতে পারে এ সংখ্যা। এর কোনোটিই কিন্তু জ্যাকির অনুমতি নিয়ে প্রস্তুত অবস্থায় তোলা ছবি নয়। সবই জ্যাকির পিছু নিয়ে, লুকিয়ে চুপিয়ে তোলা ছবি।
কিন্তু কাহাতক আর সহ্য করা যায়? প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির পরিবার হিসেবে জ্যাকি ও তার সন্তানদের প্রতিরক্ষায় সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট নিয়োজিত ছিল। পার্কে সাইকেলের সামনে লাফিয়ে পড়ার ঘটনার পর জ্যাকির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। জ্যাকি সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টদের বললেন রনের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে। এজেন্টরা রনের ক্যামেরা না ভাঙলেও তাকে গ্রেফতার করে ও ফিল্ম কেড়ে নিতে চাইলো।
রনও কম যান না। তিনি কোর্টে মামলা করে বসলেন জ্যাকি ও সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টদের বিরুদ্ধে, তার কাজে বাঁধা দেওয়া ও হয়রানি করার জন্যে। পাল্টা অভিযোগ করলেন জ্যাকিও। তার এবং তার সন্তানদের হয়রানি ও তাদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করার অভিযোগ আনলেন রনের বিরুদ্ধে। কোর্টে অনেক আইনি লড়াইয়ের শেষে গ্যালেলা ছাড়া পেলেন। তবে বিধিনিষেধ আরোপিত হলো তার ওপর।
তাকে আদেশ করা হলো জ্যাকির কাছ থেকে কমপক্ষে পঞ্চাশ গজ ও তার বাসার কাছ থেকে একশ গজ দূরে থাকতে। গ্যালেলা আপিল করলেন এ রায়ের বিরুদ্ধে। অবশেষে তিনি অনুমতি পেলেন জ্যাকির পঁচিশ ফুটের দূরত্বে আসার। এ ঘটনা নিয়ে ২০১০ সালে নির্মিত হয়েছে ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘Smash his camera’। তবে এ ঘটনার পরও রন গ্যালেলা থেমে থাকেননি। যেন অদ্ভুত কোনো নেশার ঘোরে পড়ে লেগেছিলেন জ্যাকির পেছনে।
তার তোলা জ্যাকির শ্রেষ্ঠ ছবিটির গল্প বলা যাক, যেটিকে রন তার ‘মোনালিসা’ বলে আখ্যা দেন। ‘উইন্ডব্লোউন জ্যাকি’ নামে ছবিটি পরবর্তীতে তুমুল বিখ্যাত একটি ছবি হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের কথা। জ্যাকির সাথে রনের কোর্ট-কাচারী হওয়ারও বছরখানেক আগে। জয়েস স্মিথ নামের একজন মডেল পোর্ট-ফোলিও ছবি তুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন রন গ্যালেলাকে। রন গ্যালেলা এরকম অনুরোধ সচরাচর ফেলতে পারেন না। সুন্দরের পূজারী বলে কথা। ফ্রীতেই করে দেন এ ধরনের কাজ। তার ওপর স্মিথের বাসা আবার জ্যাকির বাসার কাছে। গ্যালেলা স্মিথকে নিয়ে সেন্ট্রাল পার্কে চলে গেলেন। তার মনে আশা ছিল হয়তো বিকেলের দিকে জগিং করতে আসা জ্যাকির দেখা মিলতেও পারে।
পার্কে স্মিথের বেশ কিছু ছবি তুলে দেওয়ার পর, তারা পার্ক থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ছবি তুলতে লাগলেন। এর উলটো পাশেই জ্যাকির বাসা। কিছুক্ষণ পরই জ্যাকি বেরিয়ে এলেন। রন আর স্মিথ লুকিয়ে তার পিছু করতে শুরু করলেন। একপর্যায়ে জ্যাকি রাস্তার মোড় ঘুরলে রন একটি ট্যাক্সি নিয়ে নেন। ট্যাক্সিতে লুকিয়ে তিনি জ্যাকিকে অনুসরণ করতে থাকেন। এতে করে তার পক্ষে জ্যাকির দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সম্ভব হয়।
এ সময় একটা অসাধারণ ব্যাপার ঘটে যায়। ট্যাক্সিচালক জ্যাকির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ট্যাক্সির হর্ণ বাজিয়ে বসলেন। রন তাকে বলেনও নি হর্ণ বাজাতে। হর্ণের আওয়াজে উৎসুক হয়ে জ্যাকি ঘুরে তাকালেন। বাতাসে তার চুল উড়ছে, রোদচশমাটি হাতে ধরা, চোখে, ঠোঁটে যেন এক চিলতে হাসি প্রস্ফুটিত হওয়ার অপেক্ষায়। রন গ্যালেলার শাটারে ক্লিক পড়ল। জন্ম হলো পাপারাজ্জি জগতের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিটির। রন পেয়ে গেলেন তার মোনালিসাকে। আর জ্যাকি ওনাসিস হয়ে উঠলেন ‘উইন্ডব্লোউন জ্যাকি’।
রণের মুখের উপর ক্যামেরা ধরা থাকায় জ্যাকি প্রথমে চিনতে পারেননি তাকে। চিনতে পেরেই অন্যদিকে ফিরে রোদচশমাটি চোখে লাগিয়ে নিলেন। কিন্তু রন গ্যালেলা তো থামার পাত্র নয়। তিনি ক্যামেরা হাতে নিয়ে জ্যাকির পেছনে চলতে লাগলেন। আরেকটি ক্যামেরা ধরিয়ে দিলেন জয়েস স্মিথের হাতে যাতে জ্যাকির পেছনে ভাগতে থাকা তার ছবি তুলতে পারে। জয়েস ছবি তুললেন। পাপারাজ্জি সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা অসাধারণ কিছু ছবি উঠে আসলো।
কিন্তু সেখানে জ্যাকির পরিস্থিতিটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন। তিনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, একজন পাগলের মতো তার পেছন পেছন দৌড়ে ছবি তুলছে। আরেকটি মেয়ে সামনে থেকে তাদের ছবি তুলছে আর খিলখিল করে হাসছে। জ্যাকি প্রচন্ড ক্ষেপে গেলেন। রন গ্যালেলার সামনে গিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন তিনি, “Are you pleased with yourself?” রন বিচলিত হলেন না। হাসিমুখে “Yes! I am” বলে চলে এলেন। কারণ তার জীবনের সবচেয়ে সেরা ছবিটি যে তুলে ফেলেছেন সেদিন।
জ্যাকির পেছনে রন প্রায় বিশ বছরের মতো লেগেছিলেন। তুলেছেন প্রায় মিলিয়নের মতো ছবি। রনের মতে তিনি তার ক্যামেরা দিয়ে কবিতা লিখতেন। ফ্রেমে বন্দী করতেন সত্যিকারের অনুভূতিকে। ফটোগ্রাফারের জন্য প্রস্তুত হয়ে দেয়া মেকি হাসির প্রতি কোনো আগ্রহ ছিলো না তার। এ ছবিগুলোর মূল্য সত্যিকার অর্থেই অনেক বেশী। রনের অদ্ভুত নেশার মতো এই লেগে থাকা সবার মনেই অবাক বিস্ময়ের জন্ম দেয়। কিন্তু একটি বড়সড় প্রশ্ন থেকে যায়, নৈতিক দিক থেকে এটি কতটা যুক্তিযুক্ত?
রনের মতে যখন আপনি তারকা হয়ে যান তখন আপনার এই হুজ্জৎ সহ্য করতেই হবে। তার মতে জ্যাকি একজন তারকা ছিলেন, তাই তার ব্যক্তিগত দুনিয়ায় হানা দেয়ার অধিকার তার ছিল। তার কাছে জ্যাকি ছিলেন ‘Fare game’। আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি, কেউ যত বড় তারকা-ই হন না কেন, তিনিও একজন মানুষ। অন্য সবার মতো তারও ব্যক্তিগত জীবন আছে, গোপনীয়তা আছে। তার সীমালঙ্ঘন করা, তাকে হয়রানি করা শুধুমাত্র অশোভনই নয়, নৈতিক দিক থেকে রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
পরবর্তীতে পাপারাজ্জিরা এমন আরো অনেক কীর্তি কান্ড করেছেন। প্রিন্সেস ডায়নার প্রাণ তো গেল এক পাপারাজ্জির হাত থেকে বাঁচতে গিয়েই। তবে এসবের শুরু করেছিল রনই। তার ‘গোল্ডেন গার্ল’ জ্যাকি ওনাসিসের মাধ্যমে। জ্যাকির বাছাই করা ছবি নিয়ে তিনি একটি বইও বের করেছিলেন, ‘Jackie: My obsession‘ নামে। সব মিলিয়ে রন গ্যালেলার কীর্তি-কান্ড অদ্ভুত এক ধাঁধাঁয় ফেলে। একদিকে রনের তোলা জ্যাকির ছবিগুলো যেমন মুগ্ধ করে, অন্যদিকে রনের জ্যাকিকে হয়রানি করার বিষয়টিও পীড়া দেয়।