মানুষ বৈশিষ্ট্যগতভাবে স্থলভাগে চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমাদের পূর্বপুরুষগণও স্থলভাগেই জীবন যাপন করেছেন, এখানেই রাজ্য ভাঙা-গড়া, যুদ্ধ, হার-জিত হয়েছে, মাটির বুকেই প্রজাগণ সেবা করে গিয়েছেন। বহু মূল্যবান পাথর থেকে শুরু করে অদ্ভুতাকৃতির স্মৃতিস্তম্ভ পর্যন্ত যত ইতিহাসের খনি তাতে এসব রত্নই আবিস্কৃত হয়েছে।
কিন্তু জলভাগের ব্যাপারটা কেমন? পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অংশে কী ঘটেছিলো বা তার কতটুকু আসলে উদঘাটিত হয়েছে? সেখানেই যদি পাওয়া যায় কোনো বাসস্থান অথবা মূল্যবান শিল্পের সন্ধান? যদি সেখানে পাওয়া যায় বিরাট জাহাজ, মন্দির, পিরামিড অথবা শহর? এই অজানা রোমাঞ্চকর অংশ নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
১. রোমান সাম্রাজ্যের হস্তশিল্প
২০১৪ সালের অক্টোবরে ডুবুরিগণ ইটালির সমুদ্রোপকূলে একটি জাহাজের ভাঙা অবশিষ্টাশের সন্ধান পান। যদিও বাকি অংশ পানির নিচেই পাওয়া গিয়েছিলো, তবুও এই উপকূলে পাওয়া অংশই তাদের আবিষ্কারকে পূর্ণতা দান করে। এটা ছিলো ২,০০০ বছরের পুরনো রোমান জাহাজের অংশ! জাহাজটি ১৫ মিটার (৫০ ফুট) লম্বা ছিলো এবং ধারণা করা হয় এটা কোনো ব্যবসায়িক বা সামরিক জাহাজ ছিলো। মাটির টেরাকোটা পাত্র সেখানে পাওয়া যায় যা থেকে বোঝা যায় এতে জলপাইয়ের তেল এবং ওয়াইন ছিলো। জাহাজটি রোম এবং কার্থেজের মধ্যে ২১৮-২১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বেশ সক্রিয়ভাবে চলাচল করতো। পানারীয় (III) নামের এই জাহাজটি ভূমধ্যসাগরীয় প্রাচীন বাণিজ্যের গতিশীলতা এবং তৎকালীন দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রদান করে।
২. থুলিয়স-হারকিউলিয়ান এবং ক্যানোপাস এর মিশরীয় হস্তশিল্প
ইউরোপীয় জলতত্ত্ব এবং প্রত্নতত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ফ্র্যাংক গডিও ২০০০ সালে একটি চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার করেন। তখন তিনি পশ্চিমাঞ্চলের নাইল ডেলটায় একটি স্থানে কাজ করছিলেন। গডিও এবং তার সহযোগীরা ভূমধ্যসাগরে ২৫০টির মতো মিশরীয় হস্তশিল্প খুঁজে পান যা ক্যানোপাস এবং থুলিয়স এর সাথে সম্পৃক্ত। ওই শিল্পগুলো এই শহরগুলোর তাৎপর্য বহন করে। শহরগুলো ৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্রে তলিয়ে যায়। মিশরীয় সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং পৌরাণিক ঈশ্বর ওসাইরিস সম্পর্কে অনেক কিছুই এই শিল্পগুলো থেকে ধারণা করা যায়। পরবর্তী তদন্তে আরো ধারণা করা হয় যে, প্রাচীন শহর আলেকজান্দ্রিয়ার সাথে থুলিয়স-হারকিউলিয়ান এবং ক্যানোপাস এর একটি খালের সাহায্যে সংযুক্তি ছিলো। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত শিল্পগুলো প্যারিসে প্রদর্শিত হয়।
৩. দারকা শহরের শিল্প
ভারতীয় ইতিহাস এবং পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তমূলক শহরগুলোর মধ্যে দারকা শহর (স্বর্গের প্রবেশদ্বার নামে পরিচিত) অন্যতম। এই শহর পশ্চিম ভারতের উপকূলে ডুবে গিয়েছিলো। বিশ্বাস করা হয়, দারকা শহর দেবতা কৃষ্ণ বিশ্বকর্মের (নির্মাণের দেবতা) সাহায্যে নির্মাণ করেন। কৃষ্ণ হলেন বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। তিনি মানবজাতিকে শান্তি দিতে এবং সমস্যার সমাধান করতে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন বলে বিশ্বাস করা হয়। এই নিমজ্জিত শহরটির চারপাশে খ্রিস্টপূর্ব ১৫-১৬ শতকে মানুষের বসতি ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ ধারণা করেছেন। পৌরাণিক কাহিনীমতে, কৃষ্ণের মৃত্যুর সাথে ভীষণ বন্যা হয়ে এই শহরটি ভারত মহাসাগরে ডুবে যায়। এখন পর্যন্ত এই শিল্পগুলো হিন্দু ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আকর্ষণ করে থাকে।
৪. প্রাচীনতম-সুপরিচিত জলমগ্ন শহর
প্রাচীন শহর পাভলোপেট্রি, পরিচিত জলমগ্ন শহরটি বেশ কিছু জীবন্ত শিল্প ধারণ করে আছে। ১৯৬৮ সালে ডক্টর নিক ফ্লেমিং এবং তার সহযোগীরা এই শহরটিকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বের ব্রোঞ্জ যুগের সময়কার বলে আখ্যায়িত করেন। এই স্থানের গুরুত্ব এর প্রায় ৪০ বছর পরেও অপরিদৃষ্ট থেকে যায়। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পরবর্তীতে গবেষণা করে জানা যায় যে, উক্ত স্থানটি প্রায় ৫০০০-৬০০০ বছরের পুরনো। গ্রীসের দক্ষিণে ল্যাকোনিক উপকূলে ডুবে যাওয়া শহরটি নিওথিলিক পাত্রের মাধ্যমে সবার নজরে আসে। প্রাকৃতিকভাবেই এত বছর ধরে এই স্থানের রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে আসছে। পাভলোপেট্রির অনেক গবেষক এখনও নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন।
৫. গন্ডোয়ানার অবশেষ
২০১১ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে গন্ডোয়ানা মহাদেশের একটি বিরাট অংশ সমুদ্রের নিচে পাওয়া যায়। গন্ডওয়ানা হলো ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং অ্যান্টার্কটিকার সমন্বয়ে গঠিত একটি মহাদেশ। এই মহাদেশ আসলে ভূখণ্ডের বর্তমান আকার এবং অবস্থান গ্রহণের সময় গঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে এর সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়, তাই সমুদ্রের গভীরে অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানের সময় বিজ্ঞানীরা কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান যা কেবলমাত্র মহাদেশীয় অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এগুলোর মধ্যে ছিলো গ্রানাইট, নিসিক এবং বেলেপাথর। গন্ডোয়ানা থেকে পাওয়া ফসিলগুলোও ভূখণ্ডের সাথে এর সরাসরি সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে। যদিও মহাদেশীয় অংশটি গন্ডোয়ানার সাথে সংযুক্ত ছিল, তবুও ১৩০ মিলিয়ন বছর আগের এই রহস্যের অনেকটাই উদঘাটিত হয়নি।
৬. অ্যান্টিকিথেরার জাহাজের অবশিষ্টাংশ
গ্রীসের অ্যান্টিকিথেরার উপকূলে আরেকটি রোমান জাহাজের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। সমুদ্রের ৫৫ মিটার (১৮০ ফুট) গভীরে জাহাজটি বেশ শান্তিতেই বিশ্রাম নিচ্ছিলো। কিন্তু ২০১৫ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ ২০৫০ বছর বয়সী এই জাহাজের সন্ধান পেয়ে যান এবং অনেক নতুন তথ্য উদ্ভাবন করেন। প্রায় ৪০ ঘণ্টা পর ডুবুরিগণ একটি তামার বর্ম, একটি প্রাচীন বোর্ড গেম, বিলাসবহুল সিরামিকের পাত্র এবং একটি হাড়ের বাঁশি খুঁজে পান। এখানে ঘড়ির মতো আরেকটি জটিল যন্ত্র পাওয়া যায় যা বায়ুর সাহায্যে জ্যোতির্বিদ্যার ফলাফল বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হত।
৭. ‘হ্যালাইক’- হারিয়ে যাওয়া শহর
গ্রীক সভ্যতা সাংস্কৃতিক, একাডেমিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং অলিম্পিক গেমসে অসামান্য জয়ের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। গ্রীসের বিখ্যাত শহরগুলোর মধ্যে হ্যালাইক এমন একটি শহর যা অনেকেরই নজর এড়িয়ে যায়। পেলোপোনেশিয়ান উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে আর্কিয়াতে অবস্থিত প্রাচীন নেতৃস্থানীয় শহরগুলোর মধ্যে হ্যালাইক অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৩ এ এই শহর প্রাকৃতিকভাবে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৯ বা ২০ শতকে এটি আবার পুনরুদ্ধার করা হয়। করিন্থ উপসাগরে এর অস্তিত্ব নিয়েও অনেক মতবাদ রয়েছে। ২০০১ সালে একটি উপহ্রদের পলিমাটির এক স্তর নিচে হ্যালাইক খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১২ সালে ওই পলিমাটির ক্ষয়ে হ্যালাইকের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়। কিন্তু এখনও লোকমুখে চলে আসছে যে এই শহর প্যাট্রন এবং পোসাইডন দেবতার যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
৮. মহাবালিপুরামের সাতটি প্যাগোডা
মহাবালিপুরামের মন্দিরগুলোর মধ্যে একটি ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত তামিলনাড়ু উপকূলে অবস্থিত। ভারতীয় পুরাকথা বলে যে, সেখানে ৭টি মন্দির ছিলো এবং সেগুলোকে একত্রে মহাবালিপুরামের সাত প্যাগোডা বলা হত। সেখানে এত বিলাসীতা এবং জাঁকজমকতা ছিলো যে ঈশ্বর তার সৃষ্টির উপর হিংসা করতে লাগলেন। তাই ঈশ্বর সেখানে সুনামি হানলেন এবং ছয়টি মন্দির ধ্বংস করে দিলেন। বিখ্যাত লেখক গ্রাহাম হ্যাঙ্ককের নেতৃত্বে চলা একটি অভিযানে হারিয়ে যাওয়া ছয়টি মন্দিরের একটিকে খুঁজে পাওয়া যায়। ভিত্তি, ভাঙা কিছু স্তম্ভ, কিছু ধাপ এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরগুলো বৃহৎ একটি স্থানের অস্তিত্ব নির্দেশ করে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারের একটি হলো মহাবালিপুরামের প্যাগোডা। এতদিন ধরে মুখে মুখে চলে আসা গল্পের সত্যতা এর মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়।
৯. উপহ্রদ টিটিকাকায় জলমগ্ন মন্দির
বলিভিয়া এবং পেরুর মধ্যবর্তী আন্দেশে লালিত টিটিকাকা হ্রদ ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহনকারী একটি স্থান। ২০০০ সালে একদল প্রত্নতাত্ত্বিক ডুবুরি জলমগ্ন এক মন্দিরের সন্ধান পায়। সমুদ্রের সাড়ে ছ’শ ফিট গভীরে থাকা এই মন্দিরের বয়স প্রায় এক থেকে দেড় হাজার বছর। ইঙ্কান সভ্যতার আগে টিয়ানওয়াকু জাতির সময়ে এই মন্দির অস্তিত্ব লাভ করে। মন্দিরের পাথর এবং স্বর্ণের জিনিসপত্র ছাড়াও এখানে সুড়ঙ্গ আবিষ্কৃত হয়।
ফিচার ইমেজ সূত্র: ClipGround