সুউচ্চ দুর্গের একমাত্র জানালাটা দিয়ে রাজকুমারী আকাশ দেখত। মন খারাপ করত আর ভাবত, বাইরের পৃথিবীতে না জানি কত রহস্য লুকিয়ে আছে! কিন্তু সেই দুর্গের বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না তার। তার কথিত ‘মা’ তাকে বারবার বলত, বাইরের পৃথিবী কত ভয়ংকর, কত ক্ষতি করতে পারে রাজকুমারীর। তবুও এক দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করত সে। রোজ তার মা সেই দুর্গের একমাত্র জানালা দিয়ে রাজকুমারীর চুল বেয়ে নিচে নেমে যেত, সন্ধ্যায় আবার ফিরে আসত। হ্যাঁ, রাজকুমারীর চুল বেয়ে। অস্বাভাবিক লম্বা সোনালী চুল ছিল রাজকুমারীর, যে সর্বনাশা চুলের কারণে নিজ পরিবার থেকে দূরে অজ্ঞাতবাসের জীবন ভাগ্যে জুটেছিল তার। কারণ তার অসাধারণ ঘন সোনালী চুলের ছিল অলৌকিক আরোগ্য ক্ষমতা, যার প্রভাবে ডাইনী যৌবন ধরে রেখে মৃত্যু এড়িয়ে যাচ্ছিল।
গল্পটা খুব পরিচিত সবারই, ‘রাপাঞ্জেল’ ও তার অলৌকিক লম্বা চুলের কাহিনী কার না জানা? তবে গল্পের রাপাঞ্জেলের মতো না হলেও আসল পৃথিবীতেই ছিল লম্বা চুলে বিস্ময় জাগানো সাত রুপাঞ্জেল। তারা রাজকুমারী ছিলেন না যদিও, চুলেও ছিল না কোনো অলৌকিক ক্ষমতা, কিন্তু সাতজনের মোট ৩৭ ফুট লম্বা ঘন চুলও কম বিস্ময় ছিল না মানুষের জন্য।
এই সাত বোনের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের নায়াগ্রা কান্ট্রি নামক স্থানে, ১৮৪৫-৬০ সালের মধ্যে। তাদের নাম ছিল যথাক্রমে সারাহ, ভিক্টোরিয়া, ইসাবেলা, গ্রেস, নাওমি, ডোরা ও মেরি। তবে আলাদা আলাদাভাবে পরিচিত হবার চেয়ে সত্যিকারের এই সাত রাপাঞ্জেল পরিচিত ছিল ‘সেভেন সাদারল্যান্ড সিস্টার্স’ নামে।
মূলত তাদের ওই নামের একটি গানের দল ছিল এবং সাতজনই বেশ বিখ্যাত ছিল, যত না তাদের গায়কীর জন্য, তার চেয়ে বেশি মাটি স্পর্শ করা লম্বা চুলের জন্য। যদিও তারা বেশ ভালোই বাদ্যযন্ত্র বাজাতো ও গান করত, কিন্তু সে ব্যাপারে আসলে শ্রোতা ও দর্শকের আগ্রহ কমই ছিল। তারা আসত অস্বাভাবিক লম্বা চুল দেখতে!
বেশ দরিদ্র ঘরেই জন্ম হয়েছিল এই সাত বোনের। মায়ের তৈরী ঘরোয়া টোটকার চুলের তেল যতটা না ছিল চুল পরিচর্যার উপায়, তার চেয়ে বেশি ছিল টাকা বাঁচানোর উপায়। বিদঘুটে গন্ধ উপেক্ষা করেই রোজ সেই তেল মাথায় দিয়ে দিতেন মা। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সেই তেলের ফলাফল পায় তারা একটা সময়ে এসে। অদ্ভুত লম্বা এই চুলের কল্যাণে ভাগ্য ফিরে যায় তাদের। এত খ্যাতি ও অর্থবিত্ত হয়, যা তাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। তবে দুঃখের ব্যাপার হল এই ভাগ্য তাদের মা দেখে যেতে পারেননি।
বিখ্যাত হওয়ার গল্প
মা মারা যাওয়ার পর তাদের বাবা ফ্লেচার সাদারল্যান্ড সাত কন্যা ও এক পুত্র নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হন। সেই সময় তিনি তার পুত্র-কন্যাসহ বিভিন্ন দেশে মেলা ও গির্জায় গান করতেন। ধীরে ধীরে ফ্লেচার বুঝতে পারেন, মেয়েদের লম্বা চুলকে কাজে লাগিয়ে আরো বেশি দর্শক আকৃষ্ট করা সম্ভব।
তাই একপর্যায়ে গানের দল থেকে ছেলেকে সরিয়ে নিয়ে কন্যাদের ‘সাত আশ্চর্য’ নামে প্রচার করতে থাকেন। ১৮৮০ সালে সাত বোনের প্রথম ‘ব্রডওয়ে’তে আবির্ভাব ঘটে। সাত বোনের মাঝে সবচেয়ে লম্বা চুল ছিল ভিক্টোরিয়ার, তাই দর্শকদের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুও থাকত সে। যে সময়টায় নারীর লম্বা ঘন চুল ছিল প্রেমময় কবিতা ও চিত্রকর্মের মূল উপাদান, সেই সময়ে স্বচক্ষে এমন দৃশ্য দেখা যে কেউ সৌভাগ্যই মনে করত। সাথে সুরেলা কন্ঠে গান তো আছেই।
ধীরে ধীরে সাত বোনের নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ডাইম মিউজিয়ামে পি. টি. বারনাম ও বেইলির বিখ্যাত সার্কাস শোতেও তারা নিয়মিত আবির্ভূত হতে শুরু করে। তাদের শো এর হ্যান্ডবিলে লেখা থাকত ‘বিশ্বের ৭ আশ্চর্য’, ‘৭ সুদক্ষ সুরকার’ এমন আরো অনেক বিশেষণ। মঞ্চে সাত বোন তাদের সুর দক্ষতার সর্বোচ্চ প্রদর্শন করত, কিন্তু দর্শকের অপেক্ষা থাকত সেই মুহূর্তের, যখন তারা তাদের সুবিশাল চুল খুলে দেবে আর তা মঞ্চে ছড়িয়ে পরবে ঢেউয়ের মতো।
ভিক্টোরিয়ান যুগে লম্বা চুল ছিল নারীত্বের প্রতীক। শিল্পীর তুলিতে বা কবির কল্পনায় নারী মূর্তি মাত্রই লম্বা ঘন চুলের অধিকারী ছিল। তবে অবাধ লম্বা চুল নিয়ে আসত খুব সূক্ষ এক কলঙ্কের দাগও। সাধারণত সেই যুগে মেয়েরা একটা নির্দিষ্ট বয়সে পড়লে, সাধারণত ১৮ বছর হলেই আশা করা হত তারা চুল সবসময় বেঁধে রাখবে এবং পাড়যুক্ত পোশাক পরবে, যাতে বোঝা যায় তারা বিবাহযোগ্য হয়েছে। একজন সম্ভ্রান্ত নারী কখনোই তার চুল প্রকাশ্যে খুলবে না, খুললেও শুধুমাত্র ব্যক্তিগত কক্ষে। তাই সাদারল্যান্ড বোনেদের প্রকাশ্য এই আবেদনের আকর্ষণ এড়ানো সম্ভব হয়নি কারো পক্ষেই।
১৮৮৩ সালে সাদারল্যান্ড সিস্টার্স মেক্সিকোতে ভ্রমণ করে ডব্লিউ ডব্লিউ কোল সার্কাসের সাথে। ১৮৮৪ সাল থেকে তারা বারনামের সার্কাসের সাথে শো করা শুরু করে। তবে দুঃখের ব্যাপার হল সার্কাসে তাদেরকে ‘সাইড শো’তেই ডাকা হতো, যেখানে জন্ম থেকেই অদ্ভুত শারীরিক আকৃতির মানুষরা বিভিন্ন খেলা বা প্রতিভার প্রদর্শন করত। সার্কাসে তাদের ‘ফ্রিক’ ডাকা হত এবং এই শব্দটি বেশ প্রচলিত ছিল। বলা হয় যে, ১৮৮৩ সালে সাদারল্যান্ড বোনেরা রানী ভিক্টোরিয়ার সামনেও তাদের গান পরিবেশন করেন, কিন্তু সাইড শো হিসেবেই। তবে একসময় বেশকিছু সাইড শো শিল্পী একত্র হয়ে সার্কাসের ম্যানেজারদের কাছে প্রাপ্য সম্মান দাবি করে আন্দোলন করেন। এর ফলে ফ্রিক শব্দটি পরে ‘প্রডিজি’ দিয়ে বদলে যায়।
সাদারল্যান্ড ‘হেয়ার গ্রোয়ার’ টনিক
১৮৮০ সালের শুরুর দিকে সাত বোনের বাবা ফ্লেচারের মাথায় এক বুদ্ধি এলো। তিনি বুঝতে পারলেন মেয়েদের এই চুলকে কাজে লাগিয়ে আরো বেশি আয় করা সম্ভব। কারণ অমন চুল দেখে সবাই নিজেও তেমন পাওয়ার আশা করে। এই আশাকে কাজে লাগিয়ে ফ্লেচার চুল গজানোর এক ঔষধ পেটেন্ট করান, যার ভিত্তি হিসেবে তিনি নিজের মেয়েদের চুলের দৈর্ঘ্যকে কাজে লাগান। তিনি দাবি করতেন, সেটিই তার স্ত্রীর ঘরে বানানো টোটকার প্রণালী, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার মৃত স্ত্রীর সাথে সেই প্রণালীও মুছে গিয়েছিল চিরতরে। তবে আসল প্রণালী হোক বা না হোক, সেই ঔষধ সাদারল্যান্ড পরিবারকে এনে দিয়েছিল অকল্পনীয় বিত্ত।
‘সেভেন সাদারল্যান্ড সিস্টার্স কর্পোরেশান’ নামের প্রতিষ্ঠান থেকে ১৮৮৩ সালে ‘সেভেন সাদারল্যান্ড সিস্টার্স হেয়ার গ্রোয়ার’ নামে চুল গজানো ও লম্বা করার ঔষধ বাজারে আসে। এই ঔষধের চার আউন্সের দাম ছিল ৬০ সেন্ট, যা বর্তমানে ১৫ ডলারের সমমূল্য। প্রথম বছরেই নব্বই হাজার ডলার মূল্যের ঔষধ বিক্রি হয়ে যায়, যার বর্তমান বাজার দর প্রায় আড়াই মিলিয়ন ডলার। ১৮৯০ সাল পর্যন্ত তিন মিলিয়ন ডলার মূল্যের ঔষধ বিক্রি হয়। প্রতিটি ঔষধের বোতল দেড় ডলার করে বিক্রি হত। একটা সময়ে আমেরিকান মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের সাজসজ্জার মুখ্য উপকরণ হয়ে দাঁড়ায় চুলের এই টনিক।
চুল গজানোর ঔষধের ব্যাপক সাফল্যের পর চুল সম্পর্কিত আরো কিছু পণ্য বাজারে আনে ফ্লেচার। তার মধ্যে বিখ্যাত ছিল মাথার ত্বক পরিষ্কারকারী একধরনের টনিক ও চিরুনী। পরবর্তীতে সাত বোন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে নিজেদের পণ্যের প্রচার করত, সার্কাসে ঘুরে গান গাওয়ার দরকার পড়েনি তাদের আর।
কিছু সময়ের মধ্যেই তারা এত অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যায় যে নিজেদের এলাকায় অর্থাৎ নায়াগ্রা কান্ট্রিতে বিশাল এক অট্টালিকা তৈরি করে। ধীরে ধীরে তারা বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। টাকা-পয়সা খরচের ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো কার্পণ্য দেখা যায় নি। কিন্তু ভালো সময় খুব বেশিদিন থাকেনি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বব কাট চুলের প্রচলন লম্বা চুলের আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতা অনেকখানিই কমিয়ে দেয়, যার কারণে বোনেদের ব্যবসায়ও মন্দা নামতে শুরু করে। ১৯৩৬ সাল নাগাদ তাদের দোকান একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। কপর্দকশূন্য অবস্থায় সাদারল্যান্ডদের শেষ বোন গ্রেস ১৯৪৬ সালে মারা যাওয়ার সাথে সাথে মানুষও ভুলে যেতে থাকে তাদের। এভাবেই এই সাত বোনের অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।