প্রায় ২২৫ মিলিয়ন বছর আগে পুরো পৃথিবীতে প্যানজিয়া নামক একটিমাত্র সুবিশাল ভূখণ্ড ছিল, আর এই ভূখণ্ডকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে ছিল প্যানথালাসা নামক এক মহাসাগর। প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর আগে এই প্যানজিয়া দুইটি আলাদা ভূখণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায় এবং দুই ভূখণ্ডের মাঝে উৎপত্তি হয় আটলান্টিক মহাসাগরের।
দুই ভূখণ্ড থেকে পরবর্তী সময়ে আটলান্টিকের পূর্ব পাশে ইউরোপ ও আফ্রিকা এবং পশ্চিম পাশে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আবির্ভাব ঘটে। কালপরিক্রমায় আটলান্টিক এর দুই পাশে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে দুটি বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠে এবং বহু বছর এদের মাঝে কোনো যোগাযোগ ছিল না।
আটলান্টিকের পূর্ব পাশের মহাদেশগুলো নিয়ে গড়ে উঠা বিশ্বকে ‘পুরাতন বিশ্ব’ এবং পশ্চিম পাশের দুই মহাদেশ নিয়ে গঠিত বিশ্বকে ‘নতুন বিশ্ব’ বলে অভিহিত করা হতো।
১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর। পৃথিবীর ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। এই দিনেই সংঘটিত হয়েছিল যুগান্তকারী এক ঘটনা। ক্রিস্টোফার কলম্বাস নামক একজন ইতালীয় নাবিক স্পেন থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ভুলক্রমে আমেরিকা মহাদেশে চলে আসেন। এই ঘটনার ফলস্বরূপ পরবর্তীকালে পুরো পৃথিবীতে আসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যার জের ধরে মানবসভ্যতার গতিপথে সূচনা হয় এক নতুন বাঁকের।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আগমনের মাধ্যমেই দুই বিশ্বের যোগাযোগ শুরু। যদিও আমেরিকার প্রকৃত আবিষ্কারক কে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবুও এই দুই বিশ্বের মধ্যে কার্যকর এবং সফল যোগাযোগ স্থাপনের কৃতিত্ব যে সম্পূর্ণই কলম্বাসের, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কলম্বাসের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার পর দুই বিশ্বের মাঝে রোগজীবাণু, খাদ্যশস্য, মানুষ, উদ্ভিদ এবং পশুপাখির যে পারস্পরিক স্থানান্তর সংঘটিত হয়, ইতিহাসে সেই ঘটনাই ‘কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ’ নামে পরিচিত। ১৯৭২ সালে আলফ্রেড ক্রসবি নামক একজন মার্কিন ইতিহাস এবং ভূগোলবিদ ‘দ্য কলম্বিয়ান একচেঞ্জ’ শীর্ষক একটি বইয়ে সর্বপ্রথম এই বিষয়টি মানুষের সামনে তুলে ধরেন। তিনিই ‘কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ‘ টার্মটির জনক।
স্থানান্তরের শুরু যখন রোগজীবাণু
নেটিভ আমেরিকানরা ছিল সুস্থ সবল এক জাতি। তারা বছরের নির্দিষ্ট সময় শিকার করে বেড়াতো এবং বাকি সময় শিকারকৃত খাদ্য খেয়ে জীবনধারণ করত। তাদের কোনো রোগবালাই ছিল না বললেই চলে। এমনকি সর্দি কাশি কী, তারা তাও জানত না। তাই সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল না।
কলম্বাসের আমেরিকায় পদার্পণের মাধ্যমে পুরাতন বিশ্ব থেকে জলবসন্ত, গুটিবসন্ত, হাম, টাইফয়েড, কলেরা, প্লেগ, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি সংক্রামক রোগের জীবাণু নতুন বিশ্বে স্থানান্তরিত হয়। ফলে এসব সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে থাকে লাখ লাখ মানুষ।
১৪৯২ সালের পরবর্তী এক-দেড়শ’ বছরের মধ্যেই পুরো ভুখণ্ডের ৮০- ৯৫% মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। হিস্পানোলা দ্বীপের ৬০ হাজার থেকে ৮০ লাখ জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন যায় মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে। ১৫১৭ সালের মাঝেই মধ্য মেক্সিকোর জনসংখ্যা ১ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে মাত্র ১৫ লক্ষে নেমে আসে। ইতিহাসবিদদের মতে, সবচেয়ে কম আক্রান্ত জনপদও ৮০% জনসংখ্যা হারিয়েছে!
অপরদিকে নতুন বিশ্ব তথা আমেরিকা থেকে পুরাতন বিশ্বে যে রোগটি স্থানান্তরিত হয়, সেটি হচ্ছে যৌনবাহিত রোগ সিফিলিস। কলম্বাসের নাবিকেরা নেটিভ আমেরিকান মেয়েদের ধর্ষণের মাধ্যমে সিফিলিস রোগের জীবাণু ইউরোপে বহন করে নিয়ে আসে। জীবাণুবাহক নাবিক হতে সিফিলিস তাদের স্ত্রী এবং স্থানীয় যৌনকর্মীদের মাধ্যমে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
আক্রান্ত নাবিকেরা ইউরোপে আসার মাত্র ৫ বছরের মধ্যে ইউরোপে সিফিলিস মহামারী আকার ধারণ করে এবং ১৪৯৮ সালের মধ্যে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত, ১৫১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া এবং ১৫৬৯ সালের মধ্যে জাপানে ছড়িয়ে পড়ে।
খাদ্যপণ্য স্থানান্তর
আজকের দিনে আলু, কাঁচা মরিচ, টমেটো প্রভৃতি রন্ধনশিল্পের অপরিহার্য উপাদান। এগুলো ছাড়া তরকারি কল্পনা করা যায় না। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি, এসব কোথা থেকে এলো?
ঐতিহাসিক সেই ঘটনার মাধ্যমে দুই ভূখণ্ডে খাদ্যশস্যের ব্যাপক বিনিময় ঘটে। আমেরিকা থেকে এমন কিছু কৃষিজ খাদ্যশস্যের আগমন ঘটে, যা মানুষের খাদ্যাভাসের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। যেমন- আলু, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, কাঁচা মরিচ, ভ্যানিলা, কোকো (যা থেকে চকলেট তৈরি হয়), শিম ইত্যাদি; ফলমূলের মধ্যে রয়েছে পেঁপে এবং আনারস।
পরবর্তীতে এসব খাদ্যপণ্য বিভিন্ন দেশে রন্ধনশিল্পের বিপ্লবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- ভারতীয় উপমহাদেশের মসলাযুক্ত খাবারে কাঁচা মরিচ; ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে টমেটো; হাঙ্গেরিতে পাপরিকা (গুঁড়া মরিচ বিশেষ), কোরিয়ায় কিমচি (গাঁজন করা, লবণযুক্ত সবজিজাতীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার)।
নতুন আসা বিভিন্ন খাদ্যশস্য ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়া এবং মাটিতে জন্মাতো। এতে করে এসব পণ্য সহজেই খুব তাড়াতাড়ি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। কিছু শস্য বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। যেমন- লেসেথো এবং জাম্বিয়াতে ভুট্টা; চীন, নাইজেরিয়া, তাঞ্জানিয়া প্রভৃতি দেশে মিষ্টি আলু। কোনো কোনো দেশে এসব খাদ্য প্রধান-খাদ্য হয়ে যায়। যেমন- আয়ারল্যাণ্ডে আলু।
স্থানান্তরিত খাদ্যশস্যের মধ্য আলুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। আলু প্রচুর ক্যালরি সম্পন্ন পুষ্টিকর একটি সবজি। আলু খাওয়ার দরুন ইউরোপের মানুষজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে থাকল। মেয়েদের পিরিয়ডের সময়কাল এগিয়ে এলো এবং পুরুষদের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেল। এতে করে ইউরোপের জনসংখ্যা হু হু করে বাড়তে লাগল। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি ছাড়াও নগরায়নেও আলু ভূমিকা পালন করেছে।
কোকো
আজকের দিনে চকলেট কে না ভালোবাসে? ছোট থেকে বড় সবাই চকলেটের দারুণ ভক্ত। এই চকলেট তৈরি হয় কোকো বীজ থেকে। ল্যাতিন আমেরিকায় অ্যাজটেক, মায়ান প্রভৃতি সভ্যতার মানুষদের চকলেট পানীয় পান করার ইতিহাস পাওয়া যায়। ১৪৯২ সালের পরে এটি ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এই চকলেট ব্যবসাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি।
আমেরিকায় স্থানান্তরিত কৃষিজ পণ্য
নতুন করে আমেরিকা আবিষ্কারের পর দেখা গেল আমেরিকার মাটি এবং জলবায়ু পুরাতন বিশ্বের কিছু ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে উপযোগী। ফলে ধান, গম, আখ, বার্লি ইত্যাদি ফসলি পণ্য আমেরিকায় নিয়ে আসা হলো চাষাবাদের উদ্দেশ্যে।
এসব ফসলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে আখ। কলম্বাস ১৪৯৩ সালে দ্বিতীয়বার যখন আমেরিকায় আসেন তখন স্পেন থেকে আখ সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। আমেরিকার বেশিরভাগ ভূমিই আখ চাষের উপযোগী ছিল, বিশেষত ক্যারিবীয় এবং লাতিন আমেরিকা অঞ্চল। ফলে এসব অঞ্চলে ব্যাপকভাবে আখ চাষ শুরু হয়।
তারই ফলে আজকের দিনে ব্রাজিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চিনি উৎপাদনকারী দেশ। এছাড়া মেক্সিকো, কিউবা, কলম্বিয়া, মাকিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ চিনি উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
সর্বপ্রথম স্প্যানিশরা আমেরিকা থেকে ইউরোপে আখ রপ্তানি করা শুরু করে। অল্পদিনে আখ চাষ খুবই লাভবান একটি ব্যবসায় পরিণত হয়। তাই পরবর্তীতে একে একে পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ এবং ফরাসিরা এই ব্যবসায় যুক্ত হয়।
আখ থেকে চিনি তৈরির ফলে ইউরোপে চিনি একটি বহুল ব্যবহৃত পণ্যে পরিণত হলো। চা, কফি বিভিন্ন পানীয়তে চিনি ব্যবহৃত হতে লাগল। তাছাড়া চিনি সহজেই পরিণত হলো ক্যালরি লাভের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসে।
নতুন বিশ্ব থেকে কলা, লেবু, কমলা, আঙুর এবং জলপাই এর মতো ফলমূল থেকে শুরু করে গরু, ছাগল, ভেড়ার মতো গৃহপালিত প্রাণী কিংবা ঘোড়া, শুকর, গাধা প্রভৃতি প্রাণী আমেরিকায় প্রবেশ করে ইউরোপীয়দের হাত ধরেই।
এসব সাইট্রাস ফলমূলের মাধ্যমে নেটিভদের একদিকে যেমন বিভিন্ন ভিটামিনের যোগান নিশ্চিত হয়েছিল, তেমনি পশুদের মাধ্যমে পরিবহন ক্ষেত্রে সূচনা হয়েছিল এক নতুন বিপ্লবের। নেটিভ আমেরিকানরা শিকারি হওয়ায় ঘোড়ার মাধ্যমে শিকার আরো সহজ হয়ে গিয়েছিল। ফলে খাদ্যের যোগান বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে। এছাড়া গোত্রে গোত্রে বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহেও ঘোড়ার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে।
উদ্ভিদসমূহের স্থানান্তর
তামাক
কলম্বাস দ্বিতীয়বার আমেরিকা গেলে ফেরার সময় তিনি তামাক পাতা ইউরোপে নিয়ে আসেন। নেটিভ আমেরিকানরা তামাক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করত, নেশা হিসেবে নয়। ইউরোপে এটি প্রথমদিকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ধূমপানের মাধ্যমে এর অপব্যবহার শুরু হয়।
এছাড়াও আসে কোকা উদ্ভিদ, যা থেকে কোকেইন নামক মাদক তৈরি হয়। সারা বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় পানীয় কোকাকোলার অন্যতম উপাদানও এই কোকা উদ্ভিদের নির্যাস। বর্তমান সময়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষকৃত রাবার গাছ, যা থেকে রাবার সংগ্রহ করা হয়, সেটিও আমেরিকা হতে আসা উদ্ভিদগুলোর একটি।
কুইনাইন
লাতিন আমেরিকার পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, বলিভিয়া এসব দেশে সিনকোনা গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতো। এই সিনকোনা গাছের বাকল থেকে ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক কুইনাইন পাওয়া যায়।
১৪৯২ সালের পর ইউরোপীয়রা লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে। ফলস্বরূপ সিনকোনা ইউরোপ এবং পরবর্তীতে আফ্রিকা ও এশিয়ায় চলে আসে। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে কুইনাইনের গুরুত্ব অপরিসীম। কুইনাইন ব্যবহারের ফলে তৎকালীন সময়ে আফ্রিকা এবং এশিয়ায় ম্যালেরিয়া রোগে মৃত্যুহার অনেক কমে যায়।
উপনিবেশ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় সৈনিকদের ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চলে কুইনাইনসহ পাঠানো হতো। এভাবে ইউরোপীয়দের আফ্রিকা এবং এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে কুইনাইনের।
পরোক্ষ প্রভাব
কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর সাদা চামড়ার ইউরোপীয়রা পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন এই মহাদেশে পাড়ি জমাতে থাকে। সদ্য আবিষ্কৃত এই ভূখণ্ডের জমি অতি উর্বর হওয়ায় ইউরোপীয়রা স্থানীয় আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাদের জমি দখল করতে থাকে।
কিন্তু হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত এই অনাবাদী জমি চাষাবাদ করার মতো জনবল কোথায়? নেটিভ আমেরিকানরা তো সংক্রামক রোগের মহামারীতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে! তাই ইউরোপীয়রা কৃষিকাজের উদ্দেশ্যে আফ্রিকা থেকে ব্যাপকভাবে মানুষজন দাস হিসেবে ধরে নিয়ে আসতে শুরু করে। শুরু হয় ট্রান্স আটলান্টিক দাস ব্যবসা নামক ইতিহাসের আরেক কলঙ্কময় অধ্যায়।
১৫০২ সালে স্প্যানিশদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই নির্মম অধ্যায়ে একে একে সামিল হয়েছে পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ এবং ফরাসীরা এবং দেখিয়েছে শোষণ, অমানবিকতা ও নির্মমতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা।
১৫০২ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশ বছর ধরে চলতে থাকা এই দাস ব্যবসায় আফ্রিকার প্রায় এক থেকে দেড় কোটির মতো নারী, পুরুষ ও শিশুকে দাস বানিয়ে ধরে আনা হয়েছিল। যাদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই মারা পড়েছিল সমুদ্র পথে নিয়ে আসার সময়, তাদের ওপর চালানো অত্যাচারে কিংবা ক্ষুৎপিপাসা ও রোগশোকে।
পুরাতন বিশ্ব থেকে সদ্য আবিষ্কৃত মহাদেশে স্বেচ্ছায় অভিবাসন গ্রহন করেছিল প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মানুষ। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষও এই অভিবাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ক্রিকেটার শিবনারায়ণ চন্দরপল কিংবা সুনীল নারাইনেরা সেই ভারতীয়দেরই বংশধর।
কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী হলো পুরাতন বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপ। এই এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ইউরোপে আসা খাদ্যশস্য কিংবা নতুন মহাদেশে চাষাবাদকৃত খাদ্যশস্য শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে ইউরোপের উত্থানের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অপরদিকে আমেরিকা এবং আফ্রিকা হারিয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন অধিবাসী। যদিও এই দুই মহাদেশ এই বিনিময় প্রক্রিয়ার সুফলও ভোগ করেছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, প্রাপ্ত সুফলকে ছাপিয়ে গেছে বহুগুণে।
কলম্বাসের আমেরিকায় আগমন না হলে মানবসভ্যতার ইতিহাস হয়তো ভিন্নভাবে লেখা হত। হয়তো আলু, চকলেটের মতো খাদ্যদ্রব্য আমাদের কাছে অচেনাই থেকে যেত। হয়তো আফ্রিকার মিলিয়ন মিলিয়ন হতভাগ্য মানুষগুলোকে সেই নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হত না। কিংবা হতভাগ্য নেটিভ আমেরিকান মানুষগুলো বাঁচতে পারত নিজের মতো করে।