বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একজন ফুতু। তার এবং তার পরিবারের করুণ কাহিনী উঠে এসেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের Sarah A. Topol-এর The Schoolteacher and the Genocide শিরোনামের একটি সুদীর্ঘ আর্টিকেলে। আমাদের এই সিরিজটি সেই আর্টিকেলেরই অনুবাদ। এটি হচ্ছে সিরিজের ষষ্ঠ পর্ব।
সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব
(গত পর্বের পর থেকে)… কয়েকদিন পর এক সকালে গ্রামবাসীরা প্রধান সড়কের উপর এক ডজন বিজিপি ট্রাক পার্ক করা অবস্থায় দেখতে পায়। ফুতু এবং তার বাবা দৌড়ে বাসায় গিয়ে ফুতুর ডায়েরিগুলি লুকিয়ে ফেলেন। তারা সেগুলোকে একটি বস্তার ভেতর ভরে ধানক্ষেতের মধ্যে কিছু ঝোপের আড়ালে ফেলে রাখেন। বাড়িতে ফেরার সময় তারা দেখতে পান, বিজিপি অফিসাররা বড় গ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বেলা ১১টার দিকে তারা সাইঙ্গমদের ঘোষণা শুনতে পান: ১২ বছরের বেশি বয়সী সকল পুরুষকে বড় গ্রামে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে!
বড় গ্রামে পৌঁছে ফুতু তাদের প্রতিবেশীদেরকে দেখতে পান। কয়েকশ, কিংবা কে জানে হয়তো কয়েক হাজার মানুষ সেখানে সারি বেঁধে একইরকম অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসেছিল। দুই পা সামনের দিকে ছড়িয়ে, মাথা নিচু করে, দুই হাত দিয়ে ঘাড়ের পেছনে আঁকড়ে ধরে বসেছিল তারা। বিজিপি সেনারা লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিল। নতুন বন্দীরা আসামাত্রই অফিসাররা তাদেরকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিল অথবা বুট দিয়ে এলোপাথাড়ি লাথি মারছিল। তারা প্রতিটি বন্দীকে তাদের ঘড়ি খুলে বড় একটি চকচকে স্তূপের মধ্যে ফেলে দিতে বাধ্য করছিল।
ফুতু তার ঘড়িটা দিয়ে দিলেন। এটা ছিল শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে দেওয়া বিয়ের উপহার, যেটা তারা নিয়ে এসেছিল মায়ানমারের সাবেক রাজধানী ইয়াঙ্গুন থেকে। কিন্তু নিজের জায়গায় গিয়ে বসার আগেই ফুতুকে লাইনের বাইরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো। অফিসাররা তার হাতদুটি পিঠের পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলল এবং তাকে পেটাতে শুরু করল। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই তারা তার মাথায় এবং শরীরে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছিল।
ফুতু মাটিতে পড়ে গেলেন, কিন্তু আঘাত বন্ধ হলো না। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করল, তার মাথা ঘোরাতে লাগলো, এবং একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। মাঝে মাঝে একটু সময়ের জন্য তার জ্ঞান ফিরে আসছিল। এরমধ্যেই তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হতে লাগলো। অফিসাররা ধারালো ছুরির অগ্রভাগ দিয়ে তার শরীরের চামড়ায় খোঁচা দিতে লাগলো, সিগারেট দিয়ে তার বাহুতে ছ্যাঁকা দিতে থাকল। গ্রামবাসীদের সামনেই ফুতুর উপর নির্যাতন চলছিল, কিন্তু তারা কেউ তাতে অবাক হয়নি। শিক্ষিতদের সাথে কর্তৃপক্ষ কী ধরনের আচরণ করে, সেটা তাদের সবার জানা ছিল।
ফুতু যখন জ্ঞান ফিরে পেলেন, তখনও তার হাতদুটি পেছন দিকে বাঁধা ছিল। তার পিঠ, পেট, হাত, মাথা, সারা শরীর ব্যথা করছিল। তাকে দল থেকে কিছুটা দূরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কেউ তার অবস্থার প্রতিবাদ করলে কিংবা তার দিকে তাকালে তাকে আরো কঠোরভাবে মারধর করা হচ্ছিল।
বিজিপি অফিসাররা সিগারেট জ্বালিয়ে ধূমপান করছিল এবং নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল। একজন অফিসার তার মোবাইল ফোন দিয়ে ফুতুকে ভিডিও করছিল। সে ফোনটা মাঝে মাঝে এমনভাবে ঘুরিয়ে নিজের মুখের দিকে ধরছিল, যেন সে ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে গিয়ে সেলফি তুলছে।
একজন অফিসার চিৎকার করে ফুতুকে উঠে দাঁড়াতে নির্দেশ দিলো। ফুতু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না, কিন্তু তারপরেও তিনি অফিসারটাকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু একটা উন্মুক্ত জায়গায় গেলেন, যেখানে তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সুপারি গাছের ছায়ায় বসেছিল।
তাদের একজন ফুতুকে জিজ্ঞেস করল, “তুই প্রতিনিধিদলের হয়ে অনুবাদ করেছিলি?”
ফুতু সায় দিলেন, তিনি অনুবাদ করেছিলেন। “এটা তোদের দেশ না,” অফিসারটি বলতে লাগলো। “তোরা রোহিঙ্গা। তোদের পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশ থেকে এসেছিল। অথচ তোরা দাবি করিস তোরা এই দেশের আদিবাসী? তোরা অধিকার চাস? কত বড় সাহস তোদের!”
ফুতু লক্ষ্য করলেন, অফিসারদের মধ্যে একজন ছিল নিকটবর্তী বিজিপি পোস্টের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। আরেকজন ছিল এমন এক জন, যার সাথে তিনি ফুটবল খেলতেন। ফুতু তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি এখানকার একজন স্কুলশিক্ষক।”
“প্ল্যাকার্ডগুলি কে লিখেছিল?” অফিসাররা তাকে জিজ্ঞেস করল।
“আমি জানি না,” ফুতু উত্তর দিলেন। “আমি জানি না।”
চেকপোস্টের প্রধান অফিসারটি এগিয়ে ফুতুর মাথায় একটি রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করল।
অফিসাররা তার কাছ থেকে আরসা সম্পর্কে জানতে চাইছিল। ফুতু বললেন, তিনি তাদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
রাখাইন চেয়ারম্যান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অফিসাররা তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেমন মানুষ এ?”
“আমি এর বাবা-মাকে চিনি, এর পূর্বপুরুষদেরকে চিনি,” চেয়ারম্যান উত্তর দিলেন। “সে মানুষ হিসেবে ভালো। সোজা স্কুলে যায়, এরপর স্কুল থেকে সোজা বাসায় ফিরে যায়। প্ল্যাকার্ড লেখার সাথে হয়তো সে জড়িত থাকতে পারে, কিন্তু তার সাথে কোনো খারাপ লোকের সম্পর্ক নেই।”
ফুতু যতটা আশা করেছিলেন, এটা ছিল তার জন্য তার চেয়েও ভালো ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট। “অন্যান্য পুলিশ এবং সেনাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন আমাদের সম্পর্ক কতটা ভালো ছিল।” নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে অনুনয়ের স্বরে বললেন ফুতু। “তাদের সামনে দিয়ে আমি স্কুলে যাই এবং স্কুল থেকে সরাসরি ফিরে আসি! প্রতিদিন! আমি এই লোকগুলোর কাউকেই চিনি না। আমি কখনও এ ধরনের কাজে জড়িত ছিলাম না!”
অবশেষে ফুতুকে অন্যদের কাছে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। তার জীবন আপাতত রক্ষা পেয়ে গেল।
সন্ধ্যা নাগাদ বৃষ্টি শুরু হলো। রোহিঙ্গা বন্দীরা যে কাদামাটির উপর বসেছিল, সেটা সরে যেতে শুরু করল। অফিসাররা বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া বন্দীদেরকে উঠে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলো। তাদেরকে দোতলা একটা খড়ের চালের বাড়ির ভেতর নিয়ে যাওয়া হলো, যার ভেতরের দেয়ালগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কয়েকশ মানুষকে গাদাগাদি করে, একজনের উপর আরেকজনকে ফেলে ঘরটির ভেতর ঠেলে দেওয়া হলো।
সকাল বেলা নারী এবং শিশুরা উপস্থিত হলো। তাদেরকে বলা হয়েছিল, তারা বন্দীদের জন্য খাবার আনতে পারবে। ফুতুর মা ভাত আর মাছের তরকারী নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু ব্যথার জন্য ফুতু খাবার গিলতে পারছিলেন না।
পুরুষরা যখন খাবার খাচ্ছিল, বিজিপি সৈন্যরা তখন মহিলাদের উপর হানা দিচ্ছিল। তারা বড় গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অভিযান শুরু করেছিল, বাড়িঘরের জিনিসপত্র তন্ন তন্ন করে সার্চ করতে শুরু করেছিল। মহিলাদের গলা থেকে স্বর্ণালঙ্কার এবং ব্লাউজের ভেতরে লুকানো মোবাইল ফোনগুলো তারা ছিনিয়ে নিচ্ছিল। তারা মহিলাদেরকে ধাওয়া করছিল এবং যাদেরকে ধরতে পারছিল, তাদের সারা শরীর স্পর্শ করছিল।
ফুতুর বাড়িতে তাঁর স্ত্রী, ফুতুর এক বোন এবং তার ১১ বছর বয়সী ভাই একটা গাছের নিচে বসে অফিসারদেরকে তাদের বাড়ির জিনিসপত্র বাইরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে দেখছিল। অফিসাররা ফুতুর সিন্দুক ভেঙ্গে তার কাগজপত্রগুলো সংগ্রহ করতে শুরু করেছিল। ফুতু ছাড়া অন্য সবার কাছে কাগজপত্রগুলো ছিল মূল্যহীন। এমনকি তার সদাসতর্ক বাবাও সেগুলো লুকানোর চিন্তা করেননি।
ফুতুর স্ত্রী ছিলেন আট মাস গর্ভবতী, তার গর্ভে ছিল তাদের দ্বিতীয় সন্তান। তিনি কখনও তার শাশুড়িকে সাহসী বলে জানতেন না। কিন্তু সেদিন তার শাশুড়ি অফিসারের সামনে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “আপনারা কী করছেন? কেন আপনারা আমার ছেলের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছেন?” মাত্রই আহত ছেলেকে দেখে এসেছিলেন তিনি, আর কতক্ষণ তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব?
ফুতুর স্ত্রী বিস্ফোরিত চোখে দেখতে পেলেন, তার শাশুড়ি একজন অফিসারের হাত থেকে কিছু কাগজপত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। লোকটি কাগজগুলো ছাড়ল না। একটিমাত্র পৃষ্ঠা, যেটি ফুতুর মা মাটি থেকে কুড়িয়ে তার বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন, সেটি বাদে বাকি সবগুলো কাগজপত্র নিয়ে তারা চলে গেল। ফুতুর ডায়েরিগুলো অবশ্য নিরাপদ ছিল। সেগুলো সেদিন সকালেই তিনি এবং তার বাবা মিলে লুকিয়ে ফেলেছিলেন।
বিজিপি কমান্ডার ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেহেতু আইয়ুবকে আটক করা হয়েছে এবং তার দুই ডেপুটি পালিয়ে গেছে, তাই তাদের নতুন একটি নেতৃত্বের দরকার। তিনি ফুতুকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি দায়িত্ব নিতে চান কি না। ফুতু উত্তর দিলেন, “আমি শুধু একজন শিক্ষক। এই দায়িত্ব আমি নিতে চাই না।”
কমান্ডার রোহিঙ্গা বন্দীদেরকে তাদের নতুন নেতা বাছাই করার নির্দেশ দিলেন। সবাই ফয়েজ উল্লাহর দিকে তাকাল, কারণ আইয়ুবের আগে তিনিই এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফয়েজ উল্লাহ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। মেনে নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না।
কমান্ডার তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এবার আমরা তোদেরকে ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু পরের বার আমরা তোদের ঘরগুলো পুড়িয়ে সেগুলোকে ছাই বানিয়ে দিবো।” ভিড়ের দিকে নিজের রাইফেলটি তাক করে তিনি বললেন, “এবার আমরা শুধু তোদেরকে মুখে সতর্ক করে দিলাম। পরের বার এটা কথা বলবে!”
অফিসাররা ফুতুর সামনে একটি সাদা কাগজ নিয়ে এলো। সেখানে ফুতুকে লিখতে বাধ্য করা হলো: “বিজিপি আমাদের গ্রামে এসেছিল। তারা সবকিছু ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করে দেখেছে। তারা কোনো হয়রানি বা লুটপাট করেনি। তারা আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেছে।” রোহিঙ্গা বন্দীরা সেই কাগজের নিচে নিজেদের নাম সই করল।
পরবর্তী পর্ব পড়ুন এখান থেকে।
সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব