প্রেসিডেন্ট লিংকনের হত্যা এবং আসামীর জেল পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা

প্রিজন ব্রেক কিংবা দ্যা শশাংক রিডেম্পশন দেখেছেন কিন্তু জেল পালানোর রহস্য নিয়ে রোমাঞ্চিত হননি, এমন মানুষ খুব কমই আছেন। রূপালী পর্দার অভিনেতাদের মৃত্যুকূপ ভেদ করে মুক্ত জগতে প্রবেশ করার রোমাঞ্চকর দৃশ্য শিহরিত করে সকল রহস্যপ্রেমীকে। কিন্তু বাস্তব জীবনে এমন দৃশ্য কি রূপালী পর্দার মতোই এতো রোমাঞ্চকর হয়ে থাকে? মুদ্রার অপর পিঠও তো বিবেচনায় রাখতে হয়। একটি ভুল সিদ্ধান্ত কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে গোটা জীবনের জন্য। আর এমনটাই হয়েছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের হত্যাকারী জন উইলকিস বুথের সহযোগী ডা. স্যামুয়েল মাডের সাথে

প্রেসিডেন্ট লিংকনের সরাসরি হত্যাকারী হিসেবে উইলকিস বুথের নাম আসলেও, তার সহযোগী এবং তথ্য গোপনের দায়ে আদালতের মুখোমুখি হতে হয় স্যামুয়েল আরনল্ড, মাইকেল ও’লাফলেন, এডমান স্পাংলার এবং ডা. স্যামুয়েল মাডকে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে অপহরণের কাজে তারা সকলে জড়িত থাকার কথা ছিল। কিন্তু অপহরণের কাজটি আর না হলেও, হত্যাকাণ্ডের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার দায়ে তাদের সকলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং তাদের সকলকে পাঠিয়ে দেয়া হয় লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন ফ্লোরিডার ড্রাই টরটুগাস দ্বীপে অবস্থিত ফোর্ট জেফারসন কয়েদিখানায়

ডা. স্যামুয়েল মাড; Image source: The Washington Post

সালটা তখন ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দ। ফোর্ট জেফারসন সেসময় ব্যবহার হতো আমেরিকার সবচেয়ে দাগী আসামীদের কয়েদিখানা হিসেবে। বসবাসের পরিবেশ হিসেবে মোটেও সুবিধার ছিল না সেখানকার অবস্থা। স্কার্ভি, ডায়েরিয়া, ডেংগু এবং অন্যান সকল ছোঁয়াচে রোগে ভরপুর ছিল সেখানকার পরিবেশ। স্বাভাবিকভাবেই ডা. মাড এবং অন্যান্যরা সভ্য লোকালয় ছেড়ে এসে মোটেও এখানকার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি। সভ্য দুনিয়ায় তিনি যতই নামী হয়ে থাকুক না কেন, ফোর্ট জেফারসনে ডা. মাডের পরিচয় বাকিসব কয়েদিদের মতোই এক। জেলখানার নিরাপত্তারক্ষীরা বাকি সকলের সাথে যে আচরণ করতেন, ডা. মাডের সাথে সেই আচরণই দেখাতেন।

সে সময়ের ফোর্ট জেফারসন; Image source: CDV

পাশাপাশি ডা. মাড ক্রীতদাস প্রথার পক্ষপাতী ছিলেন বিধায়, তার প্রতি অন্যান্য কয়েদিদের ব্যবহারও তেমন সুবিধার ছিল না। পরিস্থিতি বিবেচনায় জেলে আসার ২ মাসের মাথায় ডা. মাড জেল পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বেশ পাগলাটে এবং অবাস্তব মনে হলেও, ডা. মাডের দিনলিপি থেকে জানা যায় তারা এখানে আসার পর দুই মাসে অন্তত ৩০ জন কয়েদি জেল থেকে পালিয়েছে। আর এখান থেকে পালানোর রাস্তা একটাই। সেটা হলো জাহাজে করে লুকিয়ে পালানো।

ড্রাই টরটুগাস দ্বীপটি লোকালয় থেকে খুবই বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এখানে কয়েদিদের চলাচলের উপর বলতে গেলে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া ছিল। এমনই স্বাধীনতা যে, কয়েদিরা চাইলে রাতে জেলখানার প্রাচীর ঘেঁষে ঘুমাতে পারতো এবং বর্তমান জেলখানাগুলোর মতো রাতে সেখানে সবার উপস্থিতিও নেয়া হতো না! এখান থেকে যাতায়াত বলতে সপ্তাহে একদিন জাহাজ নোঙ্গর করতো প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী এবং অন্যান্য রসদ পৌঁছে দেয়ার জন্য। শুধুমাত্র সেদিন কয়েদিদের চলাচলের উপর কড়াকড়ি আরোপ করা হতো। জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের সুযোগ নিয়েই অনেক কয়েদি তাদের পালানোর রাস্তা করে নিতো।

বর্তমানের ফোর্ট জেফারসন; Image source: Marinas.com

ডা. মাড তার পরিকল্পনা সাজানোর ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধানী ছিলেন। কারাগারের কারো সাথে তো দূরে থাক, তার সাথে বন্দী হওয়া বাকি তিনজনকেও তিনি তার পরিকল্পনার কথা বলেননি। তিনি জানতেন, কারাগারে আসা এবং কারাগার থেকে যাওয়া সকল চিঠি আগে একবার খুলে দেখা হয়। তাই তিনি তার স্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠানোর সময়ও এমনভাবে লিখতেন যেন তাকে সন্দেহ করার বিন্দুমাত্র অবকাশ না থাকে। কারাগারে আসার মাস দুয়েক পর তিনি এমন একটি চিঠি পাঠান যাতে লেখা ছিল –

আমি এখান থেকে পালানোর জন্য বেশ কয়েকবার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এমনটা করা হবে অন্যায় এবং অনুশোচনামূলক। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাকি সময়টা আমি এখানেই কাটিয়ে দিতে চাই এবং সরকারকে এই কাজে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে চাই।

কিন্তু তিনি পালানোর পরিকল্পনা সাজাচ্ছিলেন। এজন্য তিনি প্রতি সপ্তাহে ড্রাই টরটুগাসে নোঙ্গর করা জাহাজ থমাস এ. স্কট এর তরুণ নাবিক হেনরি কেলির সাথে একটি সমঝোতায় যান। কেলির বয়স ছিল তখন মাত্র ১৮ বছর। তাই সহজেই সামান্য অর্থের বিনিময়ে কেলি ডা. মাডকে সহযোগিতা করতে রাজি হয়ে যায়।

পালানোর আগের রাতে ডা. মাড সারারাত জেলখানার বাইরে কাটিয়ে দেন এবং সকাল বেলা জাহাজ আসার আগেই তিনি তার পোশাক পাল্টে ফেলেন। হেনরি কেলির সহযোগিতায় তিনি আগেই তার পোশাক প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। জাহাজ আসার পর মালামাল নামানোর সময় তৈরি হওয়া হট্টগোলের সুযোগ নিয়ে ডা. মাড জাহাজের ভিতরে প্রবেশ করে ফেলেন এবং জাহাজের নিচের অংশে কয়লা রাখার ঘরে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন।

পরবর্তী পরিকল্পনা বেশ সহজ। জাহাজ থেকে পণ্য নামানো শেষ হলে তা ফিরে যাবে এবং সেই সাথে ডা. মাডও পালিয়ে যাবেন। কিন্তু বেচারা ডা. মাডের সেদিন সত্যিই কপাল বেশ খারাপ ছিল। ফোর্ট জেফারসনে এমন কেউ ছিল না যে ডা. মাডের চেহারা চিনে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকা একজনকে কেউ চিনবে না, এমনটা ভাবার প্রশ্নই উঠে না! পণ্য খালাসের সময় ফোর্ট জেফারসনের মালামাল রক্ষক জনাব জ্যাকসন ডা. মাডকে লক্ষ্য করেন জাহাজের ভিতর প্রবেশ করতে। সাথে সাথে তিনি নিরাপত্তাকর্মীদের জানিয়ে দিলেন যে, “ডা. মাড জাহাজের ভিতর গিয়েছে এবং ফেরত আসেনি!”

তখনই পুরো জাহাজে খোঁজ চালানো শুরু হয়। সবাই জানে কাকে তারা খোঁজ করছে। এখানে ডা. মাডের সাথে অন্য কেউ পালিয়ে থাকলেও, তাদের চেয়ে ডা. মাডকেই খুঁজে পাওয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কোনো নিরাপত্তাকর্মীর কাছে ডা. মাড সরাসরি ধরা না পড়লেও, তার আটক হওয়ার ঘটনাটা করুণই বটে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্যমতে, ডা. মাড জাহাজের জ্বালানি ঘরে লুকিয়ে ছিলেন। একজন অফিসার সেখানে থাকা কয়লার বাক্সগুলোতে তার তলোয়ার চালিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। এরই একটিতে লুকিয়ে ছিলেন ডা. মাড। অফিসারের তলোয়ারের খোঁচা খেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠেন তিনি এবং সাথে সাথেই ধরা পড়ে যান।

শিল্পীর চোখে মাডের ধরা পরার দৃশ্য; Image source: House Divided – Dickinson College

ডা. মাডকে তখনই আটক করা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ফোর্ট জেফারসনে দ্রুত সন্ধান চালিয়ে মাডের সাথে আসা বাকি ৩ জন বন্দীকে সামনে আনা হয়। দেখা যায় মাডের কার্যক্রমের ব্যাপারে তাদের কারো কোনো আগ্রহ নেই। অর্থাৎ ডা. মাড একাই তার পালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। বেচারা ডা. মাডের কপাল এতোটাই খারাপ ছিল যে, সেদিন তার পাশাপাশি আরও ৪ জন পালানোর পরিকল্পনা করেছিল এবং তারা কেউই পালানোর বেলায় ধরা পড়েনি। তার ভাষ্যমতে–

তারা আমাকে আটক করতে পেরে এতটাই উচ্ছ্বসিত ছিল যে, তারা বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখার কথা চিন্তাও করেনি। এর ফল হলো থমাস এ. স্কট জাহাজটি ফেরত যাওয়ার সময় আরও ৪ জন কয়েদিকে সাথে করে নিয়ে যায়, যারা অবশ্যই তাদের মুক্তি খুঁজে পাবে।

জিজ্ঞাসাবাদে মাড তার সহযোগী হেনরি কেলির কথা প্রকাশ করে দেয়। কেলিকে তখন আটক করা হয় এবং মাডের সাথেই কারাবন্দী করে রাখা হয়। মজার ব্যাপার হলো, আটক হওয়ার সপ্তাহ খানেকের মাঝেই কেলি তার এক সহযোগী কয়েদিকে সাথে নিয়ে ফোর্ট জেফারসন থেকে পালিয়ে যায়। অবশ্য এর আগেই সে ডা. মাডকে ক্ষমা করে দিয়ে যায়। কেলির ভাষ্যমতে, “তারা এতোই বোকা যে, তারা ভেবেছে আমাকে এখানে আটকে রাখা সম্ভব হবে।”

হেনরি কেলি পালিয়ে গেলেও, ডা. মাডের কপালে আর পালানোর সুযোগ ছিল না। জেল পালানোর চেষ্টার শাস্তি হিসেবে তাকে স্বশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং সকল গার্ডের নজরে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ইট ভাঙ্গার মতো কঠোর পরিশ্রম করতে হতো ডা. মাডকে। অথচ জেল পালানোর চেষ্টা করার আগে তিনি ছিলেন জেলখানা হাসপাতালের একজন চিকিৎসা সহযোগী। শুধু তা-ই নয়। প্রতি সপ্তাহে জাহাজ আসার সময় তাকে আলাদা নজরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। জাহাজ না চলে যাওয়া পর্যন্ত তার পাহারায় আলাদা নিরাপত্তাকর্মী নিযুক্ত করে রাখা হয়।

১৮৬৯ সালে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাকি সময়টা এভাবেই কাটান তিনি। তার অনুশোচনা পত্রে তিনি বলেন- “ধরা পড়ার আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ফেরতে চলে আসার। কারও চোখে না পড়ে চলে আসতে পারলে সেটা ভালোই হতো।”

ফোর্ট জেফারসনে ডা. মাডের স্মৃতি; Image source: Smithsonian Magazine

কিন্তু এটি যে তার ব্যর্থতা ঢাকার একটি কৌশল মাত্র সেটা কাউকে বলে দিতে হয়নি। অবশেষে ১৮৮৩ সালের ১০ই জানুয়ারি মাত্র ৪৯ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

This is a Bengali article featuring the escape attempt of Dr. Samuel Mudd from the Fort Jefferson. All resources are hyperlinked.

Feature image: Britannica

 

Related Articles

Exit mobile version