১১ অক্টোবর, ১৭৭৫, তিমি শিকারের জাহাজ হেরাল্ডে নাবিক আর ক্যাপ্টেন সবাই ব্যস্তভাবে কাজ করে চলেছেন। গ্রিনল্যান্ডের এই হিমশীতল জলে তিমি শিকার করা বেশ ঝক্কির কাজ, তাই অন্যদিকে নজর দেবার সময় তাদের খুব কম। কুয়াশায় ঢাকা আবছা আবহাওয়ায় হঠাৎ করেই এক স্কুনারের সাথে প্রায় ধাক্কা লেগে যাবার দশা হলো হেরাল্ডের। মাঝ সমুদ্রে বিকল হয়ে যাওয়া কোনো জাহাজ হবে হয়তো ভেবে সেদিকে অত বেশি মনোযোগ দিলেন না নাবিকেরা। কিন্তু একেবারে গায়ের উপর এসে পড়া জাহাজকে তো আর উপেক্ষা করা চলে না। তাই কাছ থেকে স্কুনারটি পর্যবেক্ষণের সিধান্ত নেয়া হয়।
ক্যাপ্টেনের নির্দেশে খারাপ আবহাওয়া আর কনকনে শীত উপেক্ষা করেই মাঝ সাগরে ভাসতে থাকা রহস্যময় জাহাজের দিকে রওয়ানা হলো হেরাল্ডের একটি উদ্ধারকারী দল। কাছাকাছি যাবার পর তারা বুঝতে পারে- উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভাসতে থাকা রহস্যময় জাহাজটি বেশ ভালোই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পালগুলো শতচ্ছিন্ন হয়ে মাস্তুলের গায়ে লেপ্টে আছে। জাহাজের গায়েও বহু ঝড়ঝাপ্টা সামলানোর ছাপ স্পষ্ট। কাছাকাছি পৌঁছে নামটাও উদ্ধার করা গেল জাহাজের- অক্টাভিয়াস। তবে কোনো কর্মীর আনাগোনা চোখে পড়লো না জাহাজের ডেকে। বাজে আবহাওয়ার কারণে হয়তো সবাই ভেতরে রয়েছে। ডেকে উঠে নাবিকদের খোঁজ করা যাবে ভেবে হেরাল্ড থেকে আসা উদ্ধারকারী দলটি এগিয়ে চললো অক্টাভিয়াসের উদ্দেশ্যে।
এবার একটু ফিরে দেখা যাক অতীতে।
১৭৬১ সাল, হেরাল্ডের নাবিকেরা যখন অক্টাভিয়াসের দিকে এগিয়ে চলেছে তার প্রায় চৌদ্দ বছর আগের ঘটনা। জাঁকজমকপূর্ণ পালতোলা জাহাজ অক্টাভিয়াস লন্ডনের বন্দর ত্যাগ করছে। পূর্ণ লোকবলসম্পন্ন জাহাজটি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে প্রচুর মালামাল নিয়ে চীনের দিকে রওয়ানা হচ্ছে। ২৮ জন নাবিক, জাহাজের ক্যাপ্টেন, তার স্ত্রী আর সন্তান তখন অবস্থান করছিল অক্টাভিয়াসে। কোনো রকম গোলযোগ ছাড়াই নির্ধারিত সময়ে চীনে পৌঁছে তারা। মাল খালাসের কাজও সম্পন্ন হয় ভালোভাবে।
আবহাওয়া সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশ উষ্ণ মনে হওয়ায় প্রচলিত পথে না গিয়ে নর্থ-ওয়েস্ট প্যাসেজ হয়ে বাড়ি ফেরার কথা ভাবলেন অক্টাভিয়াসের ক্যাপ্টেন। এই পথে আগে কেউ পাড়ি দেয়নি জেনেও সেদিক দিয়েই যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করলেন তিনি। চীনে বাণিজ্য শেষ করে তাই এই নতুন পথে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো অক্টাভিয়াস। আর সেটাই ছিলো অক্টাভিয়াসের ব্যাপারে যে কারো জানা শেষ তথ্য। কারণ আর কখনোই লন্ডনের বন্দরে ফিরে আসেনি জাহাজটি। কোনো খবরও পাঠায়নি বিপদে পড়ার। কোনো সন্ধান না পাওয়া যাওয়ায় অবশেষে অক্টাভিয়াসকে নিখোঁজ বলে ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু সেই ঘটনারও বহু বছর পর হেরাল্ডের নাবিকদের এই অভিযান। কোনো জাহাজকে নিখোঁজ ঘোষণা করার এক যুগেরও বেশি সময় পর স্বভাবতই কেউ সেই বিষয়ে মনে রাখে না। তাই হেরাল্ডের ক্যাপ্টেন বা কর্মীদের কাছেও অক্টাভিয়াসকে আর দশটা সাধারণ বিকল হওয়া জাহাজের মতোই মনে হয়েছিল। কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয় যখন হেরাল্ড থেকে আসা উদ্ধারকারী দলটি অক্টাভিয়াসের ডেকে উঠে আসে।
ডেকের উপড়ে থাকতেই অভিজ্ঞ নাবিকরা বুঝতে পারে জাহাজে কোনো বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। কারণ চলন্ত কোনো জাহাজ হঠাৎ বিকল হয়ে পড়লে যে ধরনের অবস্থা থাকার কথা এখানকার পরিবেশ তার থেকে অন্য রকম। জাহাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো সবকিছু যেভাবে ছড়িয়ে আছে তাতে এই জাহাজ ভেসে বেড়াচ্ছে কী করে সে বিষয়েই খটকা লাগতে শুরু করলো হেরাল্ড থেকে আসা নাবিকদের মনে। কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে হ্যাচ ভেঙে জাহাজের সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে নেমে গেলো দলটি।
অক্টাভিয়াসের নাবিকদের খোঁজার আশায় তাদের কোয়ার্টারগুলোয় যেতেই বিস্ময়ে পাথর হয়ে যাবার অবস্থা হয় উদ্ধারকারী দলটির। ২৮ জন নাবিককেই খুঁজে পায় তারা। কিন্তু তাদের কেউ বেঁচে নেই। ঠান্ডায় জমে মারা গেছে সবাই। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, মৃত নাবিকদের দেহাবশেষের অবস্থা এমন ছিল যে হঠাৎ করেই যেন কোনো কাজ করতে করতে জমে গেছে তারা। জাদুঘরে রাখা মোমের পুতুলের মতোই যেন নিঃসাড় দেহগুলো পরে আছে ভূতুড়ে এই জাহাজে।
সেখান থেকে বের হয়ে হেরাল্ডের নাবিকেরা পৌঁছায় ক্যাপ্টেনের কেবিনে। সেখানেও একই ভৌতিক মৃত্যু দেখতে পায় তারা। নিজের কাজ করার ডেস্কে বসে আছেন ক্যাপ্টেন। টেবিলের উপর লগবুক খোলা অবস্থাতেই আছে আর ক্যাপ্টেনের হাতে ধরা আছে কলম। শুধু লিখতে পারার অবস্থায় নেই ক্যাপ্টেন। যে কারণেই হোক, যেভাবেই হোক কলম হাতে লগবুকে লেখার সময়ই ঠাণ্ডায় জমে মারা গেছেন অক্টাভিয়াসের ক্যাপ্টেন। টেবিলের উপর কালির দোয়াত আর দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিষগুলো এমনভাবে পড়ে আছে যেন কিছুক্ষণ আগেই ব্যবহার করছিলেন ক্যাপ্টেন। ঘরের অপরপ্রান্তে গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকা ক্যাপ্টেনের স্ত্রী আর ছেলেকে খুঁজে পায় দলটি। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে যেন চুপ করে কম্বলের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে তারা। কিন্তু আসলে অন্য সবার মতোই আকস্মিক ঠাণ্ডায় মৃত্যু হয়েছে তাদের।
জাহাজের এই পরিবেশে ভয়, আতঙ্ক আর অজানা মৃত্যুর আশঙ্কায় প্রায় পাগল হবার যোগাড় হয় উদ্ধারকারী দলের। নিজ জাহাজে ফিরে যাবার আগে ক্যাপ্টেনের লগবুক সাথে নিতে ভুল করেনি তারা। কিন্তু বিপত্তি ঘটে অন্য যায়গায়। অক্টাভিয়াস থেকে নিজেদের জাহাজে ফেরার তাড়াহুড়োয় কোথাও খুলে পড়ে যায় সেই লগবুকের মাঝের পাতাগুলো। এমনিতেই ঠাণ্ডায় জমে শক্ত হয়ে ছিলো লগবুকটি। পুরনো বাইন্ডিং ছিড়ে তাই কোনো এক জায়গায় হারিয়ে যায় মাঝের অনেকগুলো পাতা। উদ্ধারকারী দলটি হেরাল্ডে ফিরে এসে জানায় তারা কী দেখেছে সেই জাহাজে। সেই সাথে উদ্ধারকরা লগবুকটি তাদের ক্যাপ্টের হাতে তুলে দেয় দলটি, আর তখনই ধরা পড়ে মাঝের পৃষ্ঠা হারিয়ে যাবার ঘটনা।
বেশিরভাগ পাতা হারিয়ে গেলেও প্রথম আর শেষের যে কয়টি পাতা অবশিষ্ট ছিলো সেখান থেকেই ঘটনা আঁচ করতে পারেন হেরাল্ডের অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন। অক্টাভিয়াসের ক্যাপ্টেন যত্ন সহকারে ১৭৬১ সালে যাত্রার শুরুর কথা লগে উল্লেখ করেছেন। মাঝের পাতা না থাকায় আবার উল্লেখ পাওয়া যায় সে সময়ের যখন তিনি অক্টাভিয়াসকে নর্থ-ওয়েস্ট প্যাসেজ ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টাই করছিলেন। কিন্তু আবহাওয়ার ব্যাপারে কোনো ধারণা না থাকায় জাহাজ সমেত সেখানে আটকা পড়ে তারা। ১৭৬২ সালে লেখা শেষ এন্ট্রিতে উল্লেখ করা ছিলো জাহাজের অবস্থান 75 N 160 W, যার মানে সেই সময় অক্টাভিয়াস আলাস্কা থেকে ২৫০ মাইল উত্তরে অবস্থান করছিল।
এতকিছু ঘটে যাবার পরে হেরাল্ডের নাবিকদের কাছে পুরো ব্যাপারটা অভিশপ্ত কিছু বলেই মনে হলো। তের বছর আগে মরে যাওয়া নাবিক আর ক্যাপ্টেন নিয়ে ভেসে বেড়ানো জাহাজকে ভূতুড়ে আর অভিশপ্ত ভাবার যথেষ্ট কারণ তাদের কাছে ছিল। সেই কারণে অক্টাভিয়াসকে নিজের মতো ভাসতে দিয়ে হেরাল্ড পুনরায় যাত্রা করে। এরপর আর কোথাও এই ভৌতিক জাহাজ দেখতে পাবার খবর শোনা যায় না। তবে কাছাকাছি সময়ে নাবিক এবং মৃত ক্যাপ্টেনের শীতল দেহসমেত ভেসে বেড়ানো অপর একটি জাহাজের কাহিনী শুনতে পাওয়া যায়। দুটো জাহাজ একই কি না সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি কারণ দ্বিতীয় এই জাহাজের নাবিক আর ক্যাপ্টেনের মৃত্যুর ঘটনা প্রায় কাছাকাছি হলেও জাহাজের নাম ভিন্ন বলে দাবি করা হয়।
ঠিক কী ঘটেছিলো অক্টাভিয়াসের নাবিক আর ক্যাপ্টেনের ভাগ্যে সেই বিষয়ে ধারণা করা কঠিন। কারণ প্রায় আড়াইশো বছরে ঘটনার কতটা পরিবর্তন ঘটেছে সেটা খুঁজে বের করার আর উপায় নেই। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ আর বেঁচে নেই, এবং ঘটনার প্রধান চরিত্র অক্টাভিয়াস জাহাজ আর এর অধিবাসীদের কোনো খোঁজ মেলেনি এই আড়াইশো বছরে।
মানুষের মুখে ঘুরে সময়ের সাথে বদলে অনেক ভৌতিক কাহিনীর জন্ম দিয়েছে জাহাজটি। তৈরি হয়েছে বহু সামদ্রিক রুপকথা। তবে যে ধারণাগুলোকে সত্যের কাছাকাছি ধরা যায় তার মাঝে একটি হলো, নর্থ প্যাসেজ ধরে যাওয়ার চেষ্টা করার ফলেই এই দুর্ঘটনার স্বীকার হয় অক্টেভিয়াস।
অতিমাত্রায় শীতল পানি জমাট বেধে বরফে পরিণত হওয়ায় হয়তো সেখানে লম্বা সময়ের জন্য আটকে যায় জাহাজটি। সাথে থাকা রসদ আর জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় মৃত্যু ঘটে জাহাজের সকলের। তবে সেক্ষেত্রে একে একে সবাই মারা পড়লে এর চিহ্ন হয়তো থাকতো। প্রচলিত কাহিনীতে সবার একইসাথে মুহূর্তের মাঝে জমে যাবার ব্যাপারটি এখানে ধোঁয়াশা থেকে যায়। অপর এক অনুমানে বলা হয়, অক্টাভিয়াস আলাস্কার যে অঞ্চলে প্রবেশ করেছিলো (ক্যাপ্টেনের লগবুকের শেষ এন্ট্রি অনুযায়ী) সেখানকার প্রচন্ড শীতল আবহাওয়ার সাথে যুদ্ধ করার পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় জাহাজের সবাই একইসাথে জমে মারা যায়।
মৃত্যুর কারণ যা-ই হোক, ভূতুড়ে এই জাহাজের ব্যাপারে প্রচলিত কাহিনীগুলো সমুদ্রের নাবিকদের সাথে সাথে সাধারণ মানুষকেও বিহ্বল করে রেখেছে বিগত আড়াইশো বছর ধরে। হয়তো কোনো একদিন আবিষ্কার হবে অক্টাভিয়াসের ধ্বংসাবশেষ, হয়তো জানা যাবে ঠিক কী ঘটেছিলো হতভাগ্য ক্যাপ্টেন আর নাবিকদের সাথে। কিন্তু সেই সত্য জানার আগপর্যন্ত ভৌতিক জাহাজের মৃত্যু শীতল স্পর্শের কাহিনীই জমাট বেধে থাকবে আমাদের সবার চিন্তায়।