রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে শেষ হলো কসোভোর যুদ্ধ (১৩৮৯)। এ যুদ্ধে বিজয়ী ও বিজিত উভয় পক্ষই তাদের অনেক সৈন্য হারায়। বিজয়ের মালা নিজেদের করে নিলেও এ যুদ্ধেই নিহত হয়েছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের তৃতীয় সুলতান প্রথম মুরাদ। এরপর সুলতানীর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন সদ্য গত হওয়া সুলতানেরই ছেলে বায়েজিদ, চতুর্থ সুলতান প্রথম বায়েজিদ।
যুবক বয়স থেকেই সামরিক প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন সরকারি কাজে কোথাও গমন ও প্রশাসনিক বিভিন্ন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো করে গড়ে তোলা হচ্ছিলো বায়েজিদকে। ইসলাম শিক্ষা কিংবা সামরিক প্রশিক্ষণ, সব ক্ষেত্রেই তৎকালীন বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয় তার। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের নেতৃত্বের আসনে বসার আগে বায়েজিদের কর্মজীবন শুরু হয়েছিলো কুতাহইয়া শহরে গভর্নরের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। জার্মিয়ানীয়দের কাছ থেকে এ শহরটি জয় করে নিয়েছিলো ওসমানীয় বাহিনী। কারামানীয়দের বিপক্ষে যুদ্ধে অসাধারণ ক্ষিপ্রতা তাকে ‘বিদ্যুত’ (তুর্কী ভাষায় ‘য়িলদিরিম’) খেতাবটি এনে দেয়।
কসোভোর যুদ্ধের পর সিংহাসনে বসেন বায়েজিদ। অবশ্য এর আগে একটি বিতর্কিত কাজ করে বসেন তিনি। বাবার মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই ভাই ইয়াকুব সেলেবীকে নিজ তাঁবুতে ডেকে পাঠান তিনি। আসামাত্রই শ্বাসরোধ করে খুন করা হয় তাকে। সিংহাসনের দাবীদার যাতে আর কেউ না থাকে, সেজন্যই তিনি এমনটি করেছিলেন। এ ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তৎকালীন ঐতিহাসিক আশিকপাশাজাদে।
কসোভোর যুদ্ধে সার্বিয়ানরা তাদের অধিকাংশ সেনা হারিয়েছিলো। ফলে কিছুদিনের মাঝেই সার্বিয়ার বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্য একে একে ওসমানীয়দের সামন্তরাজ্যের তালিকায় নাম লেখাতে শুরু করে। ১৩৯০ সালে সার্বিয়ার সাবেক শাসক লাজার রেবেল্য়ানোভিচের মেয়ে অলিভেরা ডেসপিনাকে স্ত্রী হিসেবে ঘরে তুলে নেন সুলতান। সেই সাথে লাজারের ছেলে স্টেফান লাজারেভিচকে সার্বিয়ার নতুন শাসক হিসেবেও স্বীকৃতি প্রদান করেন তিনি।
১৩৯১ সালে জেনারেল পাশায়ীত স্কোপ্য়ে শহর বিজয়ের আগপর্যন্ত সার্বিয়ার একটি অংশের লোকেরা ওসমানীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসছিলো। জেনারেল শহরটিকে ওসমানীয়দের গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলেন। একই সময়ে সুলতান ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আনাতোলিয়াকে তার রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টায়।
১৩৯০ সালের গ্রীষ্ম ও শরৎকাল মিলিয়ে এক যুদ্ধযাত্রা শুরু করেছিলেন বায়েজিদ। সেই যাত্রায় আয়দিন, সারুহান ও মেন্তেস জয় করে নেন তিনি। তখন সুলতানের প্রধান শত্রু ছিলেন কারামানের আমির সুলায়মান। সেই সুলায়মান আবার মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন সিভাসের শাসক কাজী বুরহান আল-দীন ও অন্যান্য তুর্কী ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর সাথে।
এতকিছু করেও অবশ্য খুব একটা সুবিধা করতে পারে নি সুলতান বায়েজিদের প্রতিপক্ষ দল। ১৩৯০ সালের শরত ও শীতকাল মিলিয়ে হামিদ, তেকে ও জার্মিয়ান জয় করে নেন তিনি। আকশেহির ও নীদে শহর এবং কারামানদের রাজধানী কোনইয়াও চলে এসেছিলো ওসমানীয়দের নিয়ন্ত্রণে। ১৩৯১ সালে অবশেষে তার সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয় কারামানীয়রা। এরপর সুলতান উত্তরে কাস্তামনুর দিকে যাত্রা করেন। তার বাহিনী থেকে পালিয়ে যাওয়া অনেকেই এ শহরে আশ্রয় পেয়েছিলো। এ যাত্রায় কাস্তামনুর পাশাপাশি সাইনোপ শহরও জয় করেন তিনি।
কাজী বুরহান আল দীনকে শায়েস্তা করতে সুলতানের ছেলে আর্তুরুল সেলেবীর নেতৃত্বে পাঠানো বাহিনীটি প্রথমে ওসমানচিক দূর্গ জয় করে। কিন্তু পরবর্তীতে কির্কদিলিসীর যুদ্ধে বুরহানের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয় আর্তুরুলের বাহিনী, হত্যা করা হয় আর্তুরুলকে।
১৩৮৯ থেকে ১৩৯৫ সাল পর্যন্ত বুলগেরিয়া ও গ্রীসের উত্তরাংশ চলে আসে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। এ সময়ের মাঝে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছিলো ওসমানীয় বাহিনী। এখন একে একে সেই যুদ্ধগুলোর কাহিনীই তুলে ধরছি।
কারানোভাসার যুদ্ধ
ওসমানীয় খিলাফতের চতুর্থ সুলতাম প্রথম বায়েজিদের নেতৃত্বাধীন ওসমানীয় সেনাবাহিনী এবং ওয়ালাশিয়ার প্রিন্স মির্চা দ্য এল্ডারের নেতৃত্বাধীন ওয়ালাশিয়ান সেনাবাহিনীর মাঝে সংঘটিত হয়েছিলো এ যুদ্ধ। ১৩৯৪ সালের ১০ অক্টোবর আর্জেস নদীর তীরে হওয়া এ যুদ্ধের সাথে অবশ্য অনেকে ১৩৯৫ সালের ১৭ মে একই স্থানে হয়ে যাওয়া রোভাইনের যুদ্ধকে গুলিয়ে ফেলেন।
পাঠকদের সুবিধার্থে তাই দুটি যুদ্ধ সম্পর্কেই একে একে তাদের সংঘটিত হবার সময়কাল অনুযায়ী আলোচনা করা হচ্ছে।
কারানোভাসার যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই আমাদেরকে এর পটভূমি সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে হবে।
চতুর্দশ শতকের শুরুর দিকে আনাতোলিয়ান উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাংশে ছোটখাট এক রাজ্য হিসেবে অভ্যুদয় ঘটেছিলো ওসমানী সাম্রাজ্যের। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশক ধরে পূর্ব দিকে আনাতোলিয়ার অধিকাংশ ও পশ্চিমে বলকান উপদ্বীপে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় তারা। এর পেছনে ওসমানীয় সুলতানদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলো। এভাবে চলতে চলতে ওসমানীয়দের তৃতীয় সুলতান প্রথম মুরাদের শাসনামলে ১৩৮৭ সালে গ্রীসের অধিকাংশ এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৩৮৯ সালে কসোভোর যুদ্ধে ব্যাপক সংঘর্ষের পর জয় গিয়েছিলো ওসমানীয়দের পক্ষেই। এসব জয় ও রাজ্যের ক্রম বিস্তৃতি তাদের ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী এক রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছিলো।
কসোভোর যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন সুলতান প্রথম মুরাদ, ক্ষমতায় আসেন তার পুত্র প্রথম বায়েজিদ। ১৩৯০ সালের প্রথমভাগে সার্বিয়া (শাসক স্টেফান লাজারেভিচ), উত্তর-মধ্য বুলগেরিয়ার টার্নোভো (শাসক ইভান শিশমান) এবং উত্তর-পশ্চিম বুলগেরিয়ায় দানিয়ুব নদীর দক্ষিণ তীরের বন্দর নগরী ভিদিনের (শাসক ইভান স্ট্রাটসিমির) ওসমানীয়দের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে কালক্রমে ওসমানীয় সাম্রাজ্য বলকান অঞ্চলের এক শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। আর তাদের এ উত্থানই হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মধ্য ইউরোপের ওয়ালাশিয়া, মল্ডাভিয়া, হাঙ্গেরী ও এজিয়ান সাগরে ভেনিশিয়ান কলোনিগুলোর জন্য।
সেই সময় ওয়ালাশিয়ার প্রিন্স ছিলেন মির্চা দ্য এল্ডার। অন্যদিকে দক্ষিণ-মধ্য আনাতোলিয়ায় তখন ছিলো কারামানীয় রাজবংশের রাজত্ব। ওসমানীয়দের অগ্রযাত্রা রুখতে মির্চা আগেই বেশ কজন কারামানীয় প্রিন্সের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলেন যারা নিজেরাও ওসমানীয়দের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো। একসময় কারামানীয়রাও ওসমানীয়দের অগ্রযাত্রার কাছে হার মেনে শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলো।
এতকিছুর পরও সুলতানের প্রতিটি পদক্ষেপই ফেলতে হচ্ছিলো অত্যন্ত মেপে মেপে। কারণ তুর্কী অভিজাত মুসলিম সমাজে তার বন্ধুর চেয়ে শত্রুর সংখ্যাই ছিলো বেশি। তাই সেসব শত্রুর কেউ কেউ কারামানীয় প্রিন্সদের তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৈন্য দিয়ে সহায়তা করলেও তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছিলেন না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ঠিকই চাচ্ছিলেন তাদের উচিত শিক্ষা দিতে। আর তাই তিনি অপেক্ষায় ছিলেন উপযুক্ত সময় ও মোক্ষম সুযোগের।
একসময় সুলতানের প্রতীক্ষিত সেই সুযোগ এসে যায়। আর এর পেছনে দায়ী ছিলো উত্তর-মধ্য বুলগেরিয়ার টার্নোভোর শাসক ইভান শিশমানের বিশ্বাসঘাতকতা। এ পর্যায়ে তাই শিশমানকে নিয়ে একটু কথা বলা দরকার, পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার তার বিশ্বাসঘাতকতার সাথে।
১৩৭১ সালে টার্নোভোর শাসকের পদে বসেন ইভান শিশমান। ১৩৮৭ সালে সার্বিয়া ও বসনিয়ার সম্মিলিত বাহিনীর কাছে যে প্লচনিকের যুদ্ধে পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিলো ওসমানীয় বাহিনী, সেই ঘটনা তো আগের পর্বেই আলোচনা করেছি। ওসমানীয় বাহিনীর এমন পরাজয়ে যেন আশার আলো দেখতে পান শিশমান। তাই তিনি টার্নোভোকে আর ওসমানীয়দের সামন্তরাজ্য হিসেবে না রাখার সিদ্ধান্ত সরাসরিই জানিয়ে দেন তৎকালীন সুলতান প্রথম মুরাদকে। সেই সাথে ১৩৮৮ সালে বসনিয়া ও ওসমানীয়দের মাঝে সংঘটিত বিলেচার যুদ্ধে তিনি মুরাদকে সৈন্য দিয়ে সহায়তা করতেও জানান অস্বীকৃতি।
শিশমানের এমন ঔদ্ধত্য মেনে নিতে পারেন নি তৃতীয় সুলতান প্রথম মুরাদ। তাই তিনি প্রধান উজির আলী পাশার নেতৃত্বে ৩০,০০০ ওসমানীয় সেনার বিশাল এক বাহিনী প্রেরণ করেন তাকে শায়েস্তা করতে। একে একে তাদের হাতে পতন ঘটে শুমেন, মাদারা, ভেন্চান ও ওভেচ দুর্গের। শিশমান তখন টার্নোভো ছেড়ে পালিয়ে যান নাইকোপোলে। অবশ্য এতেও শেষ রক্ষা হয় নি তার। ওসমানীয় বাহিনীর হাতে ঠিকই ধরা পড়ে যান তিনি। তখন তাদের সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হন শিশমান। চুক্তির শর্তানুসারে তাকে আবারো ওসমানীয়দের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিয়ে সামন্তরাজ হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পাশাপাশি তৎকালে দানিয়ুব নদীর তীরবর্তী সবচেয়ে জনবহুল বুলগেরীয় শহর সিলিস্ত্রাকেও ওসমানীয় বাহিনীর হাতে সমর্পন করতে বাধ্য হন তিনি।
কিন্তু শিশমানও ছেড়ে দেবার পাত্র ছিলেন না। একই সময়ে তিনি গোপনে যোগাযোগ রাখছিলেন প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সাথে যারা ছিলো ওসমানীয়দের প্রতিপক্ষ। তারা শিশমানকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি ওসমানীয়দের শুধু সিলিস্ত্রায় ঢুকতে বাধা প্রদান করেন ক্ষান্ত হন নি, সেই সাথে শহরের প্রতিরক্ষা দেয়ালকেও করে তোলেন আরো শক্তিশালী।
আবারো বলকান পর্বতমালা ধরে বিশাল বাহিনী নিয়ে ছুটে এলেন আলী পাশা। যাত্রাপথে একে একে শুমেন, চারভেন, স্ভিশ্তভ দখলে আসে তার, নাইকোপলে আবারো ধরা পড়ে যান শিশমান। ওসমানীয়দের এমন অকস্মাৎ আক্রমণ ছিল তার প্রত্যাশার বাইরে। সেই সাথে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত সাহায্য না পাওয়ায় ব্যর্থ মনোরথে আবারো তিনি শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হন। তবে এবারের শর্তগুলো ছিলো আরো কঠোর। এবার শুধুমাত্র সিলিস্ত্রায় নিজেদের আধিপত্য দাবি করেই ক্ষান্ত হলো না ওসমানীয় বাহিনী, সেই সাথে বুলগেরিয়ার অন্যান্য শহরেও (বিশেষত শুমেন ও ওভেচ) ওসমানীয় সেনাবাহিনী নিযুক্ত করে রাখা হবে বলে জানিয়ে দেয়া হলো।
এভাবে সবসময়ই ওসমানীয়দের সাথে ঝামেলা চলে আসছিলো ইভান শিশমানের। একসময় দানিয়ুবের দক্ষিণে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের তুলনামূলক দুর্বল সামন্তরাজ্যগুলোতে হামলা চালায় ওয়ালাশীয় ও হাঙ্গেরীয় বাহিনী। এ আক্রমণে ওয়ালাশীয় বাহিনী ক্ষুদ্র রাজ্য কারভুনা এবং সিলিস্ত্রা দখল করে নেয় যার পেছনে শিশমানের হাতও ছিলো। অন্যদিকে হাঙ্গেরীয়রা উত্তর-পশ্চিম বুলগেরিয়ায় দানিয়ুব নদীর দক্ষিণ তীরের বন্দর নগরী ভিদিনের দখল নেয়ার চেষ্টা করেছিলো। এতদিন ধরে সুযোগের অপেক্ষায় থাকা সুলতান বায়েজিদ যেন এ সময়টির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তাই এবার তিনি প্রস্তুত হলেন শত্রুকে শায়েস্তা করতে।
১৩৯৩ সালে কারভুনা ও সিলিস্ত্রা থেকে ওয়ালাশীয়দের বিতারণ করে সুলতানের বাহিনী। সেই সাথে টার্নোভোকে ঘোষণা করা হয় ওসমানীয়দের একটি পাশালিক (Pashalik) হিসেবে। ‘পাশা’ বলতে ওসমানীয়দের রাজপ্রতিনিধিকে বোঝাতো। আর পাশালিক বলতে সেই পাশার শাসনাধীন কোনো অঞ্চলকে বোঝায়।
এতক্ষণের এ ঘটনাগুলোই আসলে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলো কারানোভাসার যুদ্ধকে। এবার তাহলে যুদ্ধযাত্রা করা যাক।
১৩৯৪ সালের শরৎকাল চলছে তখন। দানিয়ুব নদীর তীর ধরে সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান প্রথম বায়েজিদ। বলকান সামন্তরাজ্যসমূহ ও ওসমানীয় রুমেলিয়ান বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সুলতান নিজেই। নাইকোপলিসে পৌঁছে দানিয়ুব নদী পেরোয় তার সেনাবাহিনী। এরপর তারা এগোতে শুরু করে আর্জেস নদীর তীর ধরে, উদ্দেশ্য ওয়ালাশিয়ার রাজধানী কার্টিয়া দ্য আর্জেস (Curtea de Argeş) দখল করা। প্রায় এক সপ্তাহ চলার পর অক্টোবরের ১০ তারিখ ওয়ালাশীয় সেনাবাহিনীর দেখা পেয়ে যায় তারা। তবে এটাই ছিলো ওসমানীয়দের দুর্ভাগ্য!
ওসমানীয় বাহিনীর চলাচলের উপর আগে থেকেই নজর রেখে চলেছিলো ওয়ালাশীয় বাহিনী। তাই সেদিন পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চল থেকে অতর্কিতে হামলে পড়ে তারা। এমন আক্রমণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না ওসমানীয় বাহিনী। তাই বেশ বিপর্যয়ের মাঝে পড়ে যায় তারা। ওয়ালাশীয় বাহিনীর আক্রমণের মুখে ওসমানীয় বাহিনী আস্তে আস্তে আর্জেস নদীর তীরের দিকে পিছু হটতে থাকে।
যুদ্ধ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিলো ওসমানীয় বাহিনীর শিবিরের কাছেই। সেখানে নিজেদের রক্ষার্থে আগেই দেয়াল, পরিখা ও প্যালিসেইড (শক্ত ও চোখা কাঠের খুঁটির তৈরি বেড়া) বানিয়ে রেখেছিলো সুলতানের বাহিনী। শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থাতেও সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনোক্রমে ওয়ালাশীয় বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় ওসমানীয়রা। দানিয়ুব পেরিয়ে কোনোক্রমে সেইবার জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন বায়েজিদ। তবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো তার সাথে যাওয়া বাহিনীর অধিকাংশই।
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে গেলেন সুলতান বায়েজিদ, খুঁজতে লাগলেন হারের কারণ। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো শত্রুদের সাথে ইভান শিশমানের হাত মেলানোর খবর। সুলতানের নির্দেশে তাই তাকে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় করে দেয়া হয়। পরবর্তী শীত ও বসন্তকাল সেলজুক প্রিন্সদের সাথে যুদ্ধ করেই কেটে যায় সুলতানের, সেনাবাহিনী দিয়ে ঘিরে ফেলেন কনস্টান্টিনোপলও। ওদিকে দানিয়ুবের দক্ষিণে ওসমানীয় বাহিনীকে হারানো নেতা মির্চার আধিপত্য চলছিলো। শত্রুর বিরুদ্ধে থেমে ছিলো না তার প্রয়াসও। দক্ষিণে রুমেলিয়া পর্যন্ত ওসমানীয় বিরোধী বিদ্রোহ শুরু করতে কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি।
রোভাইনের যুদ্ধ
কারানোভাসার যুদ্ধে পরাজয় স্বাভাবিকভাবেই ক্ষেপিয়ে তুলেছিলো সুলতান বায়েজিদকে। মির্চা দ্য এল্ডারের অধীন ওয়ালাশীয় বাহিনীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে তাই একরকম প্রতিজ্ঞাই করে বসলেন তিনি।
১৩৯৫ সালের মে মাসের কথা। ওসমানীয়দের নিজস্ব সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সামন্তরাজ্যগুলো থেকে আসা সেনাদের সমন্বয়ে বিশাল এক বাহিনী গঠিত হয়। নাইকোপলিস ও ভিদিন-ক্রাইওভা হয়ে দ্বিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করে ওসমানীয় বাহিনী। আরেকটি আক্রমণ পরিচালনা করেছিলো মির্চারই এক আত্মীয়, যাকে প্রথম ভ্লাদ নামে চিনতো সবাই। তুর্কী বাহিনীর সহায়তায় সিংহাসন পুনরুদ্ধার করাই ছিলো ভ্লাদের অভিযানের মূল লক্ষ্য।
সেই যুদ্ধযাত্রায় সুলতানের বাহিনীতে ছিলো সর্বমোট ৪৮,০০০ সেনা। এর মাঝে ৪০,০০০ এসেছিলো সরাসরি ওসমানীয় সেনাবাহিনী থেকেই। অবশিষ্ট ৮,০০০ সেনা এসেছিলো বিভিন্ন সামন্তরাজ্য থেকে। অপরপক্ষে মির্চার বাহিনীতে ছিলো সেই তুলনায় অনেক কম সেনা, মাত্র ১০,০০০। তাই ওসমানীয়দের সাথে শুরুতেই সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে তাদের উপর গেরিলা হামলা চালাতে শুরু করে তার বাহিনী। এভাবে লুক্সেমবার্গের সিগিসমুন্ডের কাছ থেকে সাহায্য আসার আগপর্যন্ত ওসমানীয় বাহিনীকে কোনোমতে ঠেকিয়ে রাখেন মির্চা দ্য এল্ডার।
১৩৯৫ সালের ১৭ মে ছিলো সেদিন। যুদ্ধটি ঠিক কোথায় সংঘটিত হয়েছিলো তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। কারো কারো মতে সেটা আর্জেস নদীর তীরেই হয়েছিলো। আবার এ মতবাদের বিরোধীতা করা মানুষও আছেন।
এগিয়ে আসা ওসমানীয় বাহিনীকে প্রথমেই পড়তে হয় ওয়ালাশীয় বাহিনীর তীরন্দাজদের সম্মুখে। বৃষ্টির মতো তাদের ছোঁড়া সেই তীরের তীব্রতায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ওসমানীয় বাহিনী, মারা যায় তাদের বেশ কিছু সেনা। এরপরই ওসমানীয়দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়ালাশীয় অশ্বারোহী বাহিনী।
পরপর দুটি তীব্র আঘাতে বেশ অসুবিধাতেই পড়ে যায় সুলতান বায়েজিদের বাহিনী। তারা পিছু হটতে বাধ্য হয় সেদিন। তবে পিছু হটলেও পালিয়ে যায় নি তারা। বরং সুলতানের নিজস্ব রক্ষীবাহিনী জেনিসারিদের সহায়তায় ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় তারা। সুলতানের বাহিনীর বিশালতা আর দৃঢ়তার কাছে এবার আর টিকতে পারলো না মির্চার বাহিনী। বেশ কয়েকবারের প্রচেষ্টাতেও ওসমানীয়দের আর কাবু করতে না পেরে অবশেষে পিছু হটেন মির্চা, পালিয়ে যান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, আশ্রয় নেন হাঙ্গেরীতে।
যাবার আগে ভ্লাদকে ওয়ালাশিয়ার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যান সুলতান। তবে ভ্লাদের কপালে এ সুখ খুব বেশি দিন সয় নি। মাত্র তিন বছর পরেই হাঙ্গেরীয়দের সহায়তায় ভ্লাদকে উৎখাত করেন মির্চা, ফিরে পান ওয়ালাশিয়ায় তার হারানো মুকুট।
ওসমানীয় সাম্রাজ্যের চতুর্থ সুলতান প্রথম বায়েজিদকে নিয়ে আমাদের আজকের পর্ব এখানেই শেষ করছি। তার জীবনে সংঘটিত রোমহর্ষক যুদ্ধগুলো নিয়ে খুব শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে আরো দুটি পর্ব। ততদিন পর্যন্ত রোয়ার বাংলার সাথেই থাকুন।
ওসমানীয় সাম্রাজ্য নিয়ে পূর্ববর্তী পর্বসমূহঃ
(৪) কসোভোর যুদ্ধ