১৯৭৩ সালের জুন মাসের এক ঝলমলে বিকেলবেলা। প্যারিসের লে বুর্জে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক বিমান প্রদর্শনী। প্যারিস এয়ার শো বরাবরই পৃথিবী-বিখ্যাত। সেই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়েও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
প্রতি বছর এই এয়ার শোতে অংশ নেয় পৃথিবীর বড় বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের উদ্ভাবিত নতুন নতুন প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান, যাত্রীবাহী বিমান থেকে শুরু করে প্রাইভেট বিজনেস জেট, সবকিছুই প্রদর্শন করা হয় এখানে। সব মিলিয়ে প্যারিস যেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান মেলায় পরিণত হয়। প্রত্যেক বিমান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানই তাদের উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি এবং তাদের বিমানের কার্যকরিতা দেখিয়ে মুগ্ধ করে দর্শকদের, পাশাপাশি অর্জন করে বাণিজ্যিক সফলতা।
লে বুর্জের সেই এয়ার শোতেও অংশ নেয় তৎকালীন বিশ্বমোড়ল দেশগুলোর বিমান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলো হাজির হয় তাদের নিজ নিজ উদ্ভাবিত বিমান নিয়ে। উদ্দেশ্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে সামরিক এবং যাত্রীবাহী বিমান ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা। পাশাপাশি তাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ দেখিয়ে বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়া যে, আমরাই বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির অধিকারী! এক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলো একে অপরকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এই এয়ার শো-তে আসেনি।
১৯৭৩ সালের এই এয়ার শো-তে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল দুটি যাত্রীবাহী বিমান। দুটি বিমানই উড়তে পারত শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে, যাকে বলা হয় সুপারসনিক প্যাসেঞ্জার এয়ারক্রাফট। অবশ্য শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন বিমান আবিষ্কার নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছিল বিগত প্রায় দুই দশক ধরে। মনে করা হত, এই প্রতিযোগিতায় যে জিতবে এবং সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন বিমান সফলতার সাথে যে তৈরি করতে পারবে, আকাশ যেন তার হাতের মুঠোয় থাকবে। অবশ্য সোভিয়েত রাশিয়া সর্বপ্রথম এ জাতীয় বিমানের প্রোটোটাইপ তৈরি করে আকাশে উড়িয়েছিল। সেক্ষেত্রে বলা যায়, সোভিয়েত রাশিয়া ছিল এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী।
একইভাবে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সর্বপ্রথম শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন বিমান হিসেবে তৈরি করে কনকর্ড। অপরদিকে সোভিয়েত রাশিয়াও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তারাও হাজির করে সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন টুপলেভ টিইউ-১৪৪। যদিও পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এই বিমানকে কনকর্ডস্কি নামে ডাকত। এ নামে ডাকারও অবশ্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। কেননা, আমেরিকা এবং ইউরোপের ধারণা ছিল সোভিয়েত রাশিয়া কনকর্ডের প্রযুক্তি চুরি করে এই বিমানটি তৈরি করেছে। এই সময়টাতে সোভিয়েত রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ ছিল তুঙ্গে। ব্রিটেনের দাবী ছিল কনকর্ডের মডেল চুরির জন্য সোভিয়েত রাশিয়া তাদের গুপ্তচর লেলিয়ে দিয়েছে, এবং গুপ্তচরদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী তারা তৈরি করেছে টুপলেভ টিইউ-১৪৪।
স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েত রাশিয়ার টুপলেভ টিইউ-১৪৪ এবং ব্রিটেনের কনকর্ডের মধ্যে অসাধারণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আকার-আকৃতির দিক দিয়ে দুটো ছিল প্রায় একই রকম। দুটি বিমানেরই নাক ছিল তীক্ষ্ণ। সেসময় অবশ্য পশ্চিমা দুনিয়া টুপলেভ টিইউ-১৪৪-কে খুব কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখতে পারেনি। বাহ্যিক আকার-আকৃতি দেখেই তারা ধারণা করেছিল, কনকর্ডের তথ্য চুরি করে একই আকৃতির এই বিমান তৈরি করা হয়েছে।
প্যারিসের এয়ার শো-তে সেদিন মাঠে উপস্থিত ছিল ৩ লাখের বেশি দর্শক। এরই মধ্যে টান টান উত্তেজনা নিয়ে গতির ঝড় তুলে আকাশে উড়লো টুপলেভ টিইউ-১৪৪। এর গতি ছিল ঘন্টায় প্রায় ২,৪৩০ কিলোমিটার। সব কিছু ঠিকমতোই চলছিল। হঠাৎ করেই শুরু হলো দুর্যোগ। বিমানটি খাড়া আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছিল। এরপর বিমানের নাক নেমে যায় নিচের দিকে। যারা বিমান সম্পর্কে এতটুকুও জানেন, তারা সহজেই বুঝতে পেরেছিল যে এটা স্বাভাবিক কোনো কসরত নয়।
এরপর বিমানটি সোজা নিচের দিকে নামতে থাকল। পাইলট তখন স্পষ্টই বুঝতে পারেন যে বিমানটিতে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়েছে। বিমানের গতি এত বেশি ছিল যে মাত্র কয়েক সেকেন্ডই সময় পাওয়া গিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে পাইলট কোনো পদক্ষেপই নিতে পারেননি। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানবন্দরের উল্টোদিকে বিধ্বস্ত হয় টুপলেভ টিইউ-১৪৪। আকাশে থাকাবস্থাতেই বিমানটি বিস্ফোরিত হয়ে যায়।
বিমানটিতে যে ছ’জন পাইলট ছিল তাদের সবাই নিহত হয়। এছাড়া যে গ্রামের উপরে গিয়ে বিমানটি আছড়ে পড়ে, সেই গ্রামের আটজন মানুষও মারা যায়, যাদের মধ্যে তিনজনই ছিল শিশু। এই মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়েই সেদিন কনকর্ড ও টুপলেভ টিইউ-১৪৪ এর শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিযোগিতার সমাপ্তি ঘটে।
নিজেদের এই সফল আবিষ্কার ব্যর্থ হওয়ার পর সোভিয়েত রাশিয়া এর একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিল। তারা জানায়, এয়ার শো-তে ছবি তোলার জন্য তাদের টুপলেভ টিইউ-১৪৪ এর ককপিটে একজন ফটোগ্রাফার ছিল। ছবি তুলতে গিয়ে সে হঠাৎ করে পিছলে সামনের দিকে পড়ে যায়। এর কারণে বিমানে একটি বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। তারপর আর বিমানের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। মূলত রুশ সরকার এই ব্যাখ্যা তৈরি করে এই কারণে যে, তারা আসলে বোঝাতে চাচ্ছিল বিমানটিতে কোনো কারিগরি ত্রুটি ছিল না। তবে ফরাসিরা এই যুক্তি কোনোভাবেই মেনে নেয়নি।
যেহেতু এয়ার শো-টি ফরাসিদের আয়োজনে হচ্ছিল, তাই শো-র নিয়ন্ত্রণও ছিল তাদের হাতেই। এজন্য অনেকের ধারণা, এই ঘটনার পেছনে ফরাসি গোয়েন্দাদের হাত থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই টুপলেভ টিইউ-১৪৪ সম্পর্কে ফরাসিরা তথ্যানুসন্ধান করতে চাচ্ছিল। পরে অবশ্য জানা যায়, টুপলেভ টিইউ-১৪৪ বিমানটি যখন আকাশে উড়ছিল, ঠিক তখন এর কয়েক হাজার ফুট উপর দিয়ে আকাশে উড়ছিল একটি ফরাসি গোয়েন্দা বিমান। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল টুপলেভ টিইউ-১৪৪ এর ম্যানুভারিং কৌশলগুলো রেকর্ড করা।
যখন গোয়েন্দা বিমানটি টুপলেভ টিইউ-১৪৪ এর পাইলটের নজরে আসে, সেক্ষেত্রে পাইলটরা যা করে থাকেন তারাও সেটাই করেছিলেন। যখন কোনো বিমান প্রদর্শনীতে কোনো পাইলট দেখতে পান যে অপর একটি বিমান খুব নিকটে চলে এসেছে, তখন তারা উপরে ওঠা বন্ধ করে দেয় এবং অন্য বিমানটির নিচ দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ধারণা করা হয়, ঐ গোয়েন্দা বিমানটি নজরে আসার পরই পাইলটরা উপরে ওঠা বন্ধ করে নিচের দিক দিয়ে বের হয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে যায়।
যাত্রীবাহী এই বিমানটি দ্বিতীয়বার দুর্ঘটনায় পড়ার পর সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৭৮ সালে এর উড্ডয়ন বন্ধ করে দেয়। তবে ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এক যৌথ গবেষণায় এই বিমানটি আরেকবার আকাশে ওড়ে। এছাড়া মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এই বিমানটি ব্যবহার করত। ১৯৯৯ সালে নাসার হয়ে সর্বশেষ বিমানটি আকাশে উড়েছিল।
টুপলেভ টিইউ-১৪৪ সর্বপ্রথম আকাশে ভেসেছিল ৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে। এর সুপারসনিক স্পিড ছিল ম্যাক ২.১৫ বা ঘন্টায় প্রায় ২,৪৩০ কিলোমিটার। অন্যদিকে ব্রিটেন-ফ্রান্সের তৈরি কনকর্ড সর্বপ্রথম আকাশে ওড়ে ২ মার্চ ১৯৬৯ সালে, যার সুপারসনিক স্পিড ছিল ম্যাক ২.০৪ বা ঘন্টায় প্রায় ২,১৮০ কিলোমিটার। সেই হিসেবে ইতিহাসের প্রথম সুপারসনিক প্যাসেঞ্জার বিমান ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার টুপলেভ টিইউ-১৪৪। এরপর দুবার আকাশের প্রতিযোগিতায় কনকর্ডকে হারায় টুপলেভ টিইউ-১৪৪। যদিও পশ্চিমা আজও দাবী করে যে কনকর্ডই ছিল বিশ্বের প্রথম সুপারসনিক প্যাসেঞ্জার এয়ারক্রাফট।
কনকর্ড এবং টুপলেভ টিইউ-১৪৪ এর প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র আকাশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশ্বব্যাপী সোভিয়েত রাশিয়া এবং ফ্রান্সের মধ্যে শীতল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইতিহাস হয়ে আছে আজও। জার্মানিতে এখনও মিউজিয়ামে স্থাপন করে রাখা আছে ইতিহাসের এই দুই বিখ্যাত জায়ান্টের প্রোটোটাইপ। সেদিনের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার ফলে সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বের প্রথম যাত্রীবাহী সুপারসনিক বিমান আবিষ্কার করা সত্ত্বেও সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। কিন্তু তাদের এই প্রযুক্তি তৎকালীন বিশ্বকে চমকে দেয়। একইভাবে এই বিপর্যয়ের ফলে তাদের প্রযুক্তির গায়ে কাদাও লেগে যায়, রচিত হয় বিশ্বের প্রথম সুপারসনিক জেট বিমানের করুণ ইতিহাস।