এশিয়ার ইতিহাসে ভিয়েতনামের একটি বিশেষ জায়গা আছে। গত শতাব্দীর একটা বড় সময় ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত পরাশক্তিগুলোর বিপক্ষে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন পৃথিবীর সমস্ত উপনিবেশ একের পর এক স্বাধীন হচ্ছিল, তখনও দুর্ভাগা ভিয়েতনামের জনগণকে ফরাসি সেনাবাহিনীর বিপক্ষে সামরিক লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে স্রেফ স্বাধীনতার জন্য। ফরাসিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেলেও এরপর আবার মার্কিনিদের বিরুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে ভয়াবহ এক যুদ্ধে। দুই দশকের যুদ্ধের ইতিহাসে শেষ পর্যন্ত মার্কিন সামরিক বাহিনীকে ইতিহাসের অন্যতম লজ্জাজনক পরাজয় উপহার দিয়েছে ভিয়েতনামের সাধারণ জনগণ। যে কারণে এশিয়ার ইতিহাসে ভিয়েতনামের একটি অনন্য অবস্থান আছে, তা হচ্ছে মাত্র তিন দশকের মধ্যেই দুটো পরাশক্তিকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে ভিয়েতনাম। সম্প্রতি তাদের এই কৃতিত্বে ভাগ বসিয়েছে আফগানিস্তান।
ভিয়েতনামেরই এক গোয়েন্দার কথা বলছি, যিনি একইসাথে দক্ষিণ ভিয়েতনামে অবস্থান করে উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীর কাছে বিভিন্ন স্পর্শকাতর তথ্য সরবরাহ করতেন, আবার আমেরিকার বিখ্যাত সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিনেও তিনি বছরের পর বছর ধরে সাংবাদিকতা করে গিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি ছিলেন উত্তর ভিয়েতনাম সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিটের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি এতটাই সফলতার সাথে এই ‘দ্বৈত জীবন’ যাপন করেছিলেন যে, টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুঁজিবাদী সরকার কিংবা বিখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ– কেউই টের পায়নি যে তিনি উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছে বিভিন্ন তথ্য পাচার করছেন। এক কিংবা দুই বছর নয়, দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই কাজ করেছেন। কেউ তাকে ‘ডাবল এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা তো দূরের কথা, সন্দেহও করতে পারেনি, এতটাই নিখুঁতভাবে তার সমস্ত কাজ সম্পাদনা করতেন তিনি। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, “আমার স্ত্রীও বোধহয় জানে না, আমি বছরের পর বছর এই কাজ (গুপ্তচরবৃত্তি) করেছি।“
ভিয়েতনামের এই বিখ্যাত ‘ডাবল এজেন্ট’ ফ্যাম জুয়ান অ্যানের পেশাগত জীবনের শুরুটা জেনে নেয়া যাক। গত শতকের চল্লিশের দশকেই ফ্যাম ভিয়েত মিন তথা ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন। তবে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আরও পরে। ফরাসিরা যখন ভিয়েতনামে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন ভিয়েতনামের মেধাবী তরুণ ফ্যাম জুয়ান অ্যান যোগ দেন ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির ‘ইন্টেলিজেন্স’ শাখায়। সেটা ১৯৫২ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময় (১৯৪৫-পরবর্তী সময়ে) ফ্রান্স এমনিতেই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছিল। ফ্রান্সের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো অক্ষশক্তির আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। এদিকে ভিয়েতনামের কৌশল ছিল যেকোনো মূল্যে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করা। কারণ প্রতিদিন যুদ্ধের বিশাল অংকের ব্যয়ভার বহনের জন্য বেশ অর্থ খরচ হচ্ছিল ফরাসি সরকারের। ভিয়েতনামের নেতারা চেয়েছিলেন যত বেশি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে, তত বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে ফরাসিদের, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তৎকালীন ফ্রান্সকে বাধ্য হয়ে যুদ্ধ থেকে সরে যেতে হবে। বলা বাহুল্য, ভিয়েতনামের নেতাদের এই কৌশল কাজে দিয়েছিল। বাস্তবিকই ফ্রান্সের দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছিল না। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স পূর্ণ স্বাধীনতা হস্তান্তর করে ভিয়েতনাম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়।
ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও মতাদর্শিক কারণে ভিয়েতনাম সতের ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর ভাগ হয়ে যায়। উত্তর ভিয়েতনামে সরকার গঠন করে কমিউনিস্ট পার্টি, অপরদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। জন্মলগ্ন থেকেই দুই ভিয়েতনামের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। সীমান্তে ছিল একধরনের চাপা উত্তেজনা, যেকোনো সময়ে যুদ্ধ লেগে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এর পাশাপাশি দুই ভিয়েতনামেই প্রোপাগাণ্ডার বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তাদের প্রিয় ভিয়েতনামের এই বিভাজন মেনে নিতে পারেননি। তারা চিন্তা করছিলেন কীভাবে দুই ভিয়েতনামের একত্রীকরণ ঘটিয়ে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। উত্তর ভিয়েতনামের নেতারা দেখতে পান, আলোচনার মাধ্যমে দুই কোরিয়া একত্র করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাদের কাছে শেষ পর্যন্ত একটিমাত্র পথ খোলা ছিল– সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দক্ষিণ ভিয়েতনাম দখল করে নিয়ে দুই ভিয়েতনামের একত্রীকরণ ঘটিয়ে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা।
উত্তর ভিয়েতনাম সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স উইংয়ে কাজ করা তরুণ অ্যান প্রথমদিকে যখন ফরাসিদের বিপক্ষে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন, তখন ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির ধ্যানধারণা তার ভালো লেগেছিল। কিন্তু ফরাসিদের বিতাড়িত করার পর যখন উত্তর ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা রীতিমতো সরকার গঠন করে বসলেন, তখন তাদের কিছু গোঁড়ামি ও বিরুদ্ধমত দমনের ব্যাপার ভালো লাগেনি। ফরাসিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পরেই উত্তর ভিয়েতনামের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই দুই ভিয়েতনামের একত্রকরণ ঘটানো হবে। এজন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতিও গ্রহণ করে। বাইরের দেশ, যেমন- কমিউনিস্ট চীন উত্তর কোরিয়ার নেতাদের এই প্রস্তাবে সমর্থন জ্ঞাপন করলে উত্তর কোরিয়ার নেতারা বাড়তি উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস লাভ করেন। তরুণ অ্যান বেশ কিছু কারণে উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার উপর কিছুটা ভরসা হারালেও দুই ভিয়েতনাম একত্রকরণের যে ধারণা, সেটার প্রতি নিজের সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি ছোট থেকে এক ও অখন্ড ভিয়েতনাম দেখে বেড়ে উঠেছিলেন, এবং পরবর্তীতে কোরীয় উপদ্বীপের মতো ভিয়েতনামের বিভাজন মেনে নিতে পারেননি।
১৯৫৫ সালে দুই ভিয়েতনামের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ বেধে যায়। এই যুদ্ধে উত্তর ভিয়েতনামের পক্ষে মাও সে তুংয়ের চীন সামরিক সহায়তা প্রদান করে, অপরদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে আমেরিকা সরাসরি তার দক্ষ গোয়েন্দাবাহিনী, বিশাল সৈন্যবহর এবং সামরিক সহায়তা নিয়ে হাজির হয়। উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধে তার ইন্টেলিজেন্স উইংকে সফলভাবে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ইন্টেলিজেন্স উইংয়ে কর্মরত অ্যান ছিলেন সবচেয়ে চৌকস গোয়েন্দাদের একজন। ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন, যদি সাংবাদিকের বেশে অ্যানকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে পাঠানো যায়, তাহলে দক্ষিণ কোরিয়ার কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ কিংবা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র শকুনি চোখকে ফাঁকি দিতে অ্যানের সুবিধা হবে। তাছাড়া সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ কিংবা প্রেরণের ক্ষেত্রে যে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়, সেটি অন্য পেশায় থেকে অসম্ভব ছিল। আর সাংবাদিকের ছদ্মবেশে না পাঠিয়ে এমনি সরাসরি গুপ্তচরবৃত্তির জন্য পাঠালে ধরা পড়ার ভালই সম্ভাবনা ছিল।
উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে মেধাবী অ্যানকে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় পাঠানো হয়, যাতে তিনি সাংবাদিকতা বিষয়ে গভীর পড়াশোনার পাশাপাশি আমেরিকানদের সংস্কৃতি ভালোমতো রপ্ত করতে পারেন। কারণ উত্তর ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির পরিকল্পনা ছিল সাংবাদিকতা অধ্যয়নের পর অ্যানকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে কাজ করতে হবে, যেখানে যুদ্ধের জন্য অসংখ্য মার্কিন ব্যক্তি আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন। মার্কিন সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা থাকলে সেখানকার পরিবেশের সাথে তার মানিয়ে নিতে সুবিধা হবে। অবশেষে ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জ কোস্ট কলেজে ভর্তি হন তিনি। অ্যান যেহেতু মেধাবী ছিলেন, তাই ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ভালো করছিলেন, এর পাশাপাশি সময়ের ব্যবধানে আমেরিকান সংস্কৃতি সম্পর্কে তার ভালো ধারণা অর্জিত হচ্ছিল। তিনি যে শুধু পড়াশোনাই করছিলেন, তা কিন্তু নয়। এর পাশাপাশি কলেজের একটি পত্রিকায় কাজ করছিলেন, সহপাঠ্যক্রমিক বিভিন্ন কার্যক্রমে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। অরেঞ্জ কোস্ট কলেজে নির্ধারিত সময়ে পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তিনি স্থানীয় পত্রিকা ‘দ্য স্ক্র্যামেন্টো বি’তে ইন্টার্নশিপও করেছিলেন।