সময় পরিভ্রমণের অবিশ্বাস্য আরো কিছু ঘটনা

সময় পরিভ্রমণ বা টাইম ট্রাভেলিং মানুষের আগ্রহ ধরে রেখেছে কয়েক যুগ ধরে। পাকাপাকিভাবে সময় পরিভ্রমণের কোনো প্রমাণ আজ অবধি পৃথিবীতে না থাকলেও  মানুষ নানান সময়ে আলোচনা ও বিতর্কের সূচনা করেছে কিছু তথাকথিত সময় পরিভ্রমণের ঘটনা নিয়ে। এসব ঘটনা অলীক না বাস্তব তা নিয়ে যেমন মতভেদ রয়েছে, তেমনি রহস্যাবৃত রয়ে গেছে অনেক প্রশ্নের উত্তরও। তেমনি কিছু আলোচিত ও বিতর্কিত সময় পরিভ্রমণের ঘটনা নিয়ে হাজির হয়েছি এ নিয়ে লেখাটির দ্বিতীয় পর্বে।

সুইস ঘড়ি ও প্রাচীন চীনা কবর

২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের শাংসি কাউন্টিতে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ ৪০০ বছরের পুরনো একটি সি কুইং কবর খুঁজে পান। তারা সেখানে আংটির মতো একটা কিছু খুঁজে পান। পরে সেটিকে ভালভাবে পরিষ্কার করার পর দেখা যায় সেটি আসলে একটি ঘড়ি!  তখনই অনেকে ভাবেন ৪০০ বছরের পুরনো কবরে কি করে আধুনিক ঘড়ি পৌঁছতে পারে। কোনো সময় পরিভ্রমণকারীর কাজ নয় তো? বন্ধ ঘড়িটিতে সময় ১০:০৬ দেখাচ্ছিল এবং তাতে খোদাই করা ছিল ‘সুইস’, যদিও পরে জানা যায় এই ঘটনাটিও সাজানো। ঘড়িটি কোনো সময় পরিভ্রমণকারীর নয়।

চীনা কবরে পাওয়া গেছে বলে দাবী করা ঘড়িটি

বৈমানিকের গল্প

এই গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র এয়ার মার্শাল স্যার ভিক্টর গডার্ড। ১৯৩৫ সালে তিনি উইং কমান্ডার থাকাকালে একদিন তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের নিকটস্থ ড্রেম এ একটি পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি পর্যবেক্ষণ করে আসার। তিনি বিমানঘাঁটিটিকে খুবই বেহাল দশায় দেখতে পান এবং সেখানে টারম্যাক ভেদ করে গজিয়ে ওঠা ঘাসে গৃহপালিত পশুদের অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করেন। কাজ শেষে ফেরার পথে তিনি খারাপ ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্মুখীন হন। যে কোনো সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে  তিনি পুনরায় বিমান ঘাঁটিটিতে ফিরে যেতে মনস্থ করেন এবং আবহাওয়া ভাল হলে ফিরবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।

কিন্তু বিমানঘাঁটিতে ফিরে তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন প্রচন্ড বৃষ্টি কিভাবে যেন রৌদ্রজ্বল সূর্যালোকে পরিণত হয়েছে! এবং জীর্ণদশার বদলে তিনি দেখেন বিমানঘাঁটিটি সচল! সেখানে রানওয়ে একদম ঠিকঠাক এবং নীল রঙা পোশাক পড়ে কাজ করছেন কর্মীরা। তিনি সেখানে হলুদ রঙা বিমান দেখতে পান যার একটিকে তিনি কোনোভাবেই চিনতে পারেন নি। এহেন ঘটনা দেখে উনি বেশ বিভ্রান্ত হয়ে যান। কেননা কর্মীরা সে সময়ে খাকি রঙা পোশাক পড়তো এবং বিমানবাহিনী তাদের বিমানগুলোকে রূপালী রঙ করতো তখন। তাছাড়া রাতারাতি বিমানঘাঁটিতে এত বড় রূপান্তর ঘটতে পারে না!

স্যার ভিক্টর গডার্ড

এর চেয়েও বেশি চমকিত তিনি হন ৪ বছর পর ১৯৩৯ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তাকে আবারো তাকে ড্রেম এ ফিরে যেতে হয়। এবার সেখানে গিয়ে তিনি যা দেখেন তা হলো ৪ বছর আগে দেখা ঘটনার হুবহু পুনরাবৃত্তি! তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এমনকি যে বিমানটিকে তিনি চিনতে পারেননি সেটিও সেখানে উপস্থিত ছিল (মাইলস ম্যাজিস্টার)। অনেকে বলেন দৈবক্রমে স্যার গডার্ড ১৯৩৫ সালের সেদিনে ৪ বছর ভবিষ্যতে কিছুক্ষণের জন্য চলে গিয়েছিলেন। জে. এইচ. ব্রেহন্যান তার ‘টাইম ট্রাভেল: আ নিউ পারস্পেকটিভ’ বইয়ে এই ঘটনাটির উল্লেখ করেন। স্যার গডার্ড ১৯৮৭ সালে মারা যান।

২০০ বছর পেরিয়ে ……

২০০৩ সালের ৮ই জানুয়ারি পুলিশ অ্যান্ড্রু কার্লসিন নামক এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। এই লোকটি মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় ৮০০ ডলারের বিনিয়োগ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করেন! স্টক মার্কেটে তার সাফল্য দেখলে মনে হয় তিনি যেখানেই হাত দেন সেখানেই সোনা ফলে! প্রায় প্রতিটি বড় বিনিয়োগে তিনি সাফল্যের সঙ্গে উতরে যান!

কিন্তু এই শতাব্দীতে স্টক মার্কেটের করুণ অবস্থার কথা কারোই অবিদিত নেই এবং মাত্র দুই সপ্তাহে এহেন সাফল্য সাধারণ উপায়ে সম্ভব না। এর জন্য অবশ্যই স্টক মার্কেটের গোপন ও অভ্যন্তরীণ তথ্য জানা থাকতে হবে। এই সন্দেহে পুলিশ এই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। কিন্তু তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি এই লোক জবানবন্দিতে কি বলবে।

আন্ড্রু কার্লসিন

কার্লসিন বলেন তিনি আসলে ২২৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে আগত মানুষ! উনি যেহেতু ভবিষ্যতের মানুষ, তাই আগে থেকেই জানতেন স্টক মার্কেট কিভাবে উঠানামা করবে। তাই টাকার অঙ্ক বাড়াতে তিনি এখানে চলে আসেন। তিনি এও বলেন যে, তিনি নিজে ছোটখাটো কিছু ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে আর্থিক লোকসান দিয়েছেন যাতে মানুষের সন্দেহ না হয়। তিনি তার টাইম মেশিনের হদিশ বা তার বর্ণনা দিতেও অস্বীকৃতি জানান পাছে এই প্রযুক্তি ভুল লোকের হাতে পড়ে এই ভয়ে। পুলিশ স্বাভাবিকভাবেই এসব তথ্য বিশ্বাস করেনি। তবে জামিনে ছাড়া পাবার পর লোকটিকে আর খুঁজতে পাওয়া যায় নি! তবে কি সে সত্যিই ২০০ বছর পরের মানুষ?! জানার উপায় নেই। তবে সে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের তারিখ একদম সঠিকভাবে উল্লেখ করেছিল।

ট্যোরড এর লোকটি

এই ঘটনাটি যথেষ্টই চমকপ্রদ। ১৯৫৪ সালের গ্রীষ্মের এক বিকেলে জাপানের হানেদা বিমানবন্দরে (টোকিও ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) এক ব্যক্তির আগমন ঘটে। দাড়িওয়ালা ককেশিয়ান লোকটিকে ফ্রেঞ্চ বলে মনে হচ্ছিল, যদিও সে অন্যান্য অনেক ভাষায় (যেমন জাপানি) বেশ পারদর্শী ছিল। এখন লোকটিকে নিয়ে বিভিন্ন রকম কাহিনী শোনা যায়। একটি কাহিনীতে লোকটি নিজেই তার পাসপোর্ট সিল মারার জন্য জাপানি ইমিগ্রেশন অফিসারদের দেয়। অফিসাররা লক্ষ্য করেন তার পাসপোর্ট একদম ঠিকঠাক হলেও ‘ট্যোরড’ নামক যে দেশটির পাসপোর্ট সেটি, তার আসলে পৃথিবীতে অস্তিত্বই নেই!

ট্যোরড এর লোকটি

অন্য কাহিনীতে জানা যায় লোকটি নিজেই বলে সে ট্যোরড এর লোক এবং তার পাসপোর্ট দেখায়। তার কথা বিশ্বাস না করলে সে আপ্রাণ চেষ্টা চালায় বিশ্বাস করানোর এবং তার দেশ ফ্রান্স এবং স্পেনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত বলে জানায়। তার মতে তার দেশটি সেখানে এক হাজার বছর ধরে আছে! পরে তার সামনে বিশ্ব মানচিত্র খুলে দেখানো হলে তিনি যে জায়গাটি ট্যোরড বলে চিহ্নিত করেন তা প্রকৃতপক্ষে এন্ডোরা নামে পরিচিত। লোকটি ভেবে পাচ্ছিল না ঐ জায়গাকে সবাই এন্ডোরা বলছে কেনো!

বলা বাহুল্য তার কোনো কথাই বিশ্বাস না করে তাকে পুলিশি হেফাজতে নেয়া হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি হোটেলে স্থানান্তর করা হয়। তার কক্ষের বাইরে দুজন গার্ডও মোতায়েন করা হয়। কিন্তু পরদিন সকালে কক্ষের ভেতরে গিয়ে দেখা যায় লোকটি স্রেফ উধাও হয়ে গেছে! এমনকি তার সব কাগজপত্রও গায়েব এবং লোকটির পালাবার কোনো চিহ্নই নেই! লোকটি কি তবে ভবিষ্যতের মানুষ? নাকি তার আগমন কোনো সমান্তরাল বিশ্ব থেকে যেখানে এন্ডোরা ট্যোরড নামে পরিচিত? জানার কোনো উপায় আপাতত নেই।

শার্লট এনি মবারলি এবং ইলিনর জার্ডেইন

বিংশ শতাব্দীতে ভার্সেইলি ভ্রমণের সময় দূর্গে সময়ের বিচিত্র ঘোরপ্যাচে পড়েন বলে দাবী তাদের্। ইলিনর তার লেখা বই এন এডভেঞ্চার এ লেখেন “হঠাত্‍ করেই সব অপ্রাকৃতিক লাগতে শুরু করে এবং অপ্রীতিকরও। এমনকি গাছগুলো পর্যন্ত অসাড় ও প্রাণহীন লাগছিল অনেকটা ট্যাপেস্ট্রিতে করা কাঠের কাজের মতো। সেখানে আলো-ছায়ার কোনো প্রভাব ছিল না, গাছের পাতা আন্দোলিত করার ছিল না কোনো বাতাস।

শার্লট এনি মবারলি এবং ইলিনর জার্ডেইন

এই প্রাণহীন পরিবেশে এই দুই নারী ম্যারি এন্টোইনেট সহ আরো অনেক বিপ্লবী আমলের সৈনিকদের দেখতে পান বলে উল্লেখ করেন। যদিও এই দুজন নারীর উভয়েই উচ্চশিক্ষিতা, তারপরেও কেউ তাদের কথা আমলে নেয়নি। ভেবেছিল তাদের উভয়েরই হ্যালুসিনেশন হয়েছিল।

এল.সি. এর গল্প

১৯৬৯ সালের ২০শে অক্টোবর এল.সি. এবং তার ব্যবসায়িক অংশীদার বব (ছদ্মনাম) আমেরিকার দক্ষিণ লুইজিয়ানার এব্বেভিলে দুপুরের খাবার খেয়ে লাফায়েতের অয়েল সেন্টার সিটিতে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় তারা  সামনে একটি টার্টল ব্যাক গাড়ি দেখতে পান। গাড়িটি সে সময়ের সাপেক্ষে অস্বাভাবিক হওয়ায় তা তাদের কৌতূহলের উদ্রেক করে। গাড়িটির নাম্বারপ্লেট ছিল কমলারঙা এবং তাতে ১৯৪০ লেখা ছিল। এতে তারা অবাক হন কেননা এত পুরনো গাড়ি কোনো উত্‍সবমুখর যাত্রা বা প্যারেড ছাড়া ব্যবহারের অনুমতি সরকার দেয় না। তাছাড়া গাড়িটিকে দেখে পুরনো মনে হচ্ছিল না, বরং স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল।

তারা গাড়িটিকে ভালভাবে দেখার জন্য এগিয়ে যান এবং গাড়ির সমান্তরালে গিয়ে দেখেন ভেতরে পুরনো আমলের জামাকাপড় পড়া একজন মহিলা ও শিশু রয়েছে. তাদের দেখে মহিলা হঠাৎ ভয় পেয়ে যান এবং কোথায় আছেন তা ঠাউর করে উঠতে পারেন না। এরপর মহিলাটিকে সাহায্য লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করাতে মহিলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। এরপর মহিলা সামনে গাড়ি থামান এবং এল.সি.ও গাড়ি তার সামনে ঘুরিয়ে থামান। কিন্তু পিছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখেন মহিলাসমেত গাড়িটি অদৃশ্য হয়ে গেছে! মহিলাটির কোনো হদিশ না পেয়ে তারা সামনে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।

কিছুদূর সামনে তারা আবারো একটি পুরনো ও একটি নতুন আমলের গাড়িকে পাশাপাশি চলতে দেখেন। সেগুলোর গতি এতই ধীর মনে হচ্ছিল যেন প্রায় চলছিলই না। নতুন গাড়িটি পুরনোটিকে অতিক্রম করে সামনে গিয়ে থামাতেই পুরনো গাড়িটি অদৃশ্য হয়ে যায়! সেই গাড়ির চালকও হতভম্ব হয়ে যান। তিনি পুলিশের কাছে যেতে চাইলেও অন্য দুজন রাজী না হওয়ায় যেতে পারেননি পাছে লোকে পাগল ভেবে বসে।

প্রশ্ন হল মহিলাটি কে ছিল? পুরনো গাড়িগুলো কি কোনো কারণে সময় অতিক্রম করে কিছুক্ষণের জন্য ভবিষ্যতে চলে এসেছিল? নাকি মহিলাটি সময় ঘূর্ণিতে আটকা পড়া কোনো মানুষ? এর সদুত্তর আজ অবধি।পাওয়া যায়নি।

ইতিহাসে এমন নানান বিতর্কিত ও আলোচিত সময় পরিভ্রমণের ঘটনা বিদ্যমান যার সুরাহা আজ অবধি হয়নি। হয়তো আধুনিক বিজ্ঞান অদূর ভবিষ্যতে বের করতে পারবে সময় পাড়ি দেবার প্রযুক্তি। সেদিন হয়তো উন্মোচিত হবে রহস্য।

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/Time_travel_claims_and_urban_legends

২) io9.gizmodo.com/all-the-evidence-that-time-travel-is-happening-all-arou-1446262029

৩) indiatimes.com/culture/who-we-are/7-real-accounts-of-time-travel-that-ll-leave-you-questioning-everything-258251.html

৪) metro.co.uk/2015/10/21/5-real-world-events-which-prove-that-time-travel-actually-exists-5453426/

৫) ranker.com/list/real-life-time-travelers/jacob-shelton

৬) express.co.uk/news/weird/600855/PICTURED-The-STAGGERING-photos-thought-to-PROVE-time-travel-EXISTS

৭) cracked.com/pictofacts-406-19-photos-youd-swear-were-taken-by-time-travelers/

Related Articles

Exit mobile version