বিশ্বজুড়ে সংগঠিত যুদ্ধগুলোর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। যুদ্ধ পরিবার, শহর, বন্দর, দেশ; সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। শুধু সাময়িক ক্ষতি নয়, যুদ্ধের ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে, যা কখনও মঙ্গল বয়ে আনে না। পৃথিবীতে যদি যুদ্ধ বন্ধ না হয় তাহলে এখানে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর মতো আরও অগণিত ঘটনা ঘটেই যাবে। যার ফলশ্রুতিতে হয়তো একটা সময় বাস্তবে পরিণত হবে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি’র সেই বিখ্যাত উক্তিটি, “যুদ্ধ মানবজাতিকে শেষ করার আগেই মানুষের যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত।”
করুণ মৃত্যু
পার্ল হারবার আক্রমণের পরদিন আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ধ্বংসাবশেষ থেকে আঘাত করার শব্দ এলেও বেঁচে যাওয়া লোকজন খুব একটা গায়ে মাখেননি। কিন্তু পরে তারা বুঝতে পারলেন ওটা কোনো সাধারণ আওয়াজ ছিল না। ডুবন্ত জাহাজের ভেতরে আটকা পড়া কয়েকজন ব্যক্তি বাইরে বের হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। মরিয়া হয়ে তাদের বাইরে বের হওয়ার চেষ্টার কারণেই শব্দের উৎপত্তি। কিন্তু আটকা পড়া ব্যক্তিদেরকে উদ্ধার করার কোনো উপায় ছিল না। ডাঙায় থাকা নাবিকগণ নিজেদের কান ঢেকে নিশ্চিত মৃত্যু বরণ করতে যাওয়া ব্যক্তিদের আত্মার শান্তি কামনা ছাড়া আর কিছু করতে পারেননি তখন।
পরবর্তীতে ৬ মাস পর যুদ্ধজাহাজটিকে পানি থেকে উত্তোলন করে, জাহাজের স্টোররুমে ৩ জনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। তাদের লাশের পাশে একটা ক্যালেন্ডারও ছিল, সেই ক্যালেন্ডারের তারিখগুলোতে অঙ্কিত দাগ থেকে বোঝা গিয়েছিল মৃত্যুর আগে ওই তিনজন ব্যক্তি ১৬ দিন জাহাজের ভেতরে জীবিত অবস্থায় আটকে ছিলেন।
এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি নিহতদের পরিবারের কাছে গোপন রাখা হয়। পরবর্তীতে নিহতদের কিছু ভাই-বোন সত্যিটা জানতে পারলেও বাবা-মায়ের কাছে বিষয়টা গোপন রাখেন। তরুণ সন্তানদের করুণ মৃত্যুর কাহিনী তাদেরকে বলে বুক ভেঙে দিতে চাননি কেউ। নিহতরা হলেন রোনাল্ড এন্ডিকট, ক্লিফোর্ড ওল্ডস এবং লুইস কসটিন। গোরস্থানে তাদের ফলকের উপর মৃত্যুর তারিখ হিসেবে ডিসেম্বর ৭, ১৯৪১ খোদাই করা রয়েছে।
সাত ভাই যুদ্ধে
ফ্রেডরিক স্মিথ ও ম্যাগি স্মিথ নামক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতির সাত সন্তান যোগ দিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। সবার ছোট দুজন যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য এতটাই উৎসাহী ছিল যে, তারা ভূয়া নাম লিখিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেছিল। কারণ যুদ্ধে যেতে হলে ন্যূনতম বয়স হতে হতো ২১ বছর, কিন্তু তাদের বয়স আরও কম ছিল। তাদের ভাষ্য ছিল, সব যুদ্ধ শেষ করতে হলে এই যুদ্ধ করতে হবে।
দুর্ভাগ্যবশত, যুদ্ধ থেকে মাত্র একজন ফিরে আসেন। ফ্রান্সিস হিউম স্মিথ, ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাছাড়া বাকি ৬ ভাই যুদ্ধে মারা যান। ১৯২৩ সালে ফ্রান্সিসও ট্রামের নিচে চাপা পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে কনিষ্ঠ যোদ্ধা
পশ্চিম ফ্রন্টের পরিখা থেকে বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস পরিষ্কার করার পর দেখা গেল ১ হাজার সৈনিকের লাশ পড়ে রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো জার্মান সৈন্যরা সেই গ্যাস ব্যবহার করেছিল। ফলে ১৯১৫ সালে সংগঠিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের মধ্যে এটা একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
পরে মৃত সৈনিকদের শেষকৃত্যের সময় আবিষ্কৃত হয় এক শোচনীয় সত্য। পরিখায় একজন সাহসী সৈনিকের লাশ পাওয়া যার বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর!
জন কনডন নামের সেই সৈনিক যখন দুই বছর আগে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন তখন উপরস্থ কর্মকর্তাকে নিজের বয়সের ব্যাপারে মিথ্যে বলেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, তার বয়স ১৮ বছর, যদিও প্রকৃত বয়স ছিল মাত্র ১২। গোরস্থানে কনডনের স্মৃতিফলক দেখতে সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভিড় জমিয়ে থাকেন। যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুবরণকারী সর্বকনিষ্ঠ সৈনিক হিসেবে তার নাম ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।
হাডারসফিল্ডের মহীয়সী নার্স
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হাডারসফিল্ডের ৩,৪০০-এর বেশি সৈনিক মারা গিয়েছিল। তাদের সবারই পরিবার-পরিজন ছিল। পরিবারের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা। তাদের মধ্যে অ্যাডা স্ট্যানলি নামের একজন নার্সের কাহিনী সবচেয়ে করুণ। হাডারসফিল্ড রয়্যাল ইনফারমারি থেকে প্রশিক্ষণ দেবার পর তাকে ডারডিনেলস নামের এক জাহাজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল আহত সৈন্যদের সেবা করার জন্য।
জাহাজে চড়ে ফিরতি পথে ৪৪ বছর বয়সী এই মহীয়সী নার্স আমাশয়ে আক্রান্ত হন। কিন্তু নিজের স্বাস্থ্যের কথা না ভেবে তিনি আহত সৈন্যদেরকে সেবা দিয়েছিলেন। ১৯১৫ সালের ডিসেম্বরে অ্যাডা স্ট্যানলি আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পড়ে ভেঙে পড়েন এবং অল্প কিছুক্ষণ পরেই মারা যান। তিনিই ছিলেন হাডারসফিল্ডের একমাত্র নারী যিনি কিনা দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ইহকাল ত্যাগ করেছিলেন।
ইতিহাসের আড়ালে থাকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাহাজডুবি
টাইটানিক বা লুসিতানিয়া ডোবার ঘটনাগুলো মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের একটি জাহাজডুবির ঘটনা এখনও ইতিহাসের আড়ালেই রয়ে গেছে।
১৯৪০ সালের জুন মাস। ল্যানকাসট্রিয়া নামের জাহাজটি ব্রিটিশ সৈনদেরকে মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসছিল। কিন্তু জার্মানরা জাহাজটির উপর বোমাবর্ষণ করে। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে ডুবে যায় ল্যানকাসট্রিয়া। নারী-শিশুসহ মোট ৪ হাজার তাজা প্রাণ ঝরে যায় সেখানে। পরবর্তীতে বিস্তারিত রিপোর্টে পাওয়া যায়, জাহাজ ডোবার সময় অসহায় নিরুপায় সৈনিকরা গান গেয়ে নিজেদেরকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছিল।
৭৫ বছর পার হয়ে গেলেও ওই ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সদস্যগণ আজও তাদের স্বজনদের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন।
বোতলের ভেতরে বার্তা
জুন, ১৯১৬ সাল। ১৯ বছর বয়সী উইল উইলিয়াম দক্ষিণ সাগরগামী এক জাহাজে চেপে বসেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল তখন। অন্যান্য সাহসী সেনাদের সাথে যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য যাত্রা করেছিলেন উইল। কিন্তু তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন, তারা বাবা-মা এই বিষয়টা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন রয়েছেন। তাই এক টুকরো কাগজে ছোট্ট করে বার্তা লিখে সেটাকে বোতলে ভরে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
পরবর্তী সালের জানুয়ারিতে সেই বোতল ইয়র্ক পেনিনসুলাতে ভেসে ওঠে। যারা বোতলটি উদ্ধার করেছিলেন তারা দায়িত্ব নিয়ে বার্তাটা উইলিয়ামের বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দেন। বার্তা পেয়ে বাবা-মা খুব খুশি। কারণ, ওতে লেখা ছিল উইলিয়াম ভাল আছে, কোনো দুশ্চিন্তা যেন না করা হয়।
তবে বাবা-মায়ের সেই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ীত্ব্ পায়নি। কয়েক সপ্তাহ পর ফ্রন্ট থেকে বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়, তাদের সন্তান ধ্বসে পড়া এক পরিখার ভেতরে আটকে থাকা অবস্থায় জার্মান স্নাইপারের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেছে।
শেষ চিঠি
ইরাকে কয়েক শ’ মিশন সম্পন্ন করে, উত্তর ইরাকের ইন্টেলিজেন্স সেন্টার চালিয়ে, বিভিন্ন দেশে সিনিয়র অ্যানালিস্ট হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে করতে ডেনিয়েল সোমারস মস্তিষ্কে ইনজুরির পাশাপাশি পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তখন তার বয়স মাত্র ৩০। নিজের এই অবস্থা কীভাবে তার পরিবারের উপর প্রভাব ফেলতে পারে এটা উপলব্ধি করে তিনি চিঠির আঙ্গিকে একটি সুইসাইড নোট লিখেছিলেন।
চিঠিতে জানিয়েছিলেন, পরিবারকে তিনি কতটা ভালবাসেন। জানিয়েছিলেন, নিজে যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন সেটাতে পরিবারকে জড়াতে চান না। নিজের শারীরিক কষ্টের বিষয়গুলোও বিস্তারিত লিখেছিলেন চিঠিতে। বলেছিলেন, একমাত্র চিরস্থায়ী ঘুমই পারে তাকে স্বস্তি ও শান্তি দিতে।
এই ঘটনার জন্য পরিবারের সদ্যদেরকে দোষী ভাবতে মানা করে গেছেন তিনি। তিনি জানিয়েছিলেন, তার মৃত্যু হবে দ্রুত এবং যন্ত্রণামুক্ত। সবশেষে আশাব্যক্ত করেছিলেন এই বলে, একটা সময় তার পরিবার শোক কাটিয়ে উঠে সুখী হবে আর তিনিও মুক্তি পাবেন। ২০১৩ সালের ১০ জুন, ডেনিয়েল সোমার নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন। নিজের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরেই ছিলেন তিনি, তার স্ত্রী তখন অফিসে কাজে ব্যস্ত ছিল।
আয়লান কুর্দি
২০১৫ সালে ঘটনা। সিরিয়ায় চলা যুদ্ধ থেকে বাঁচতে কোবানি পরিবার একদল শরণার্থীর সাথে যোগ দিয়েছিলেন, যারা কস নামের গ্রিসের এক দ্বীপের উদ্দেশে রওনা করেছিল।
দুটো ছোট ছোট নৌকায় ২৩ জন শরণার্থী ছিল সেদিন। ৩ বছর বয়সী আয়লান কুর্দি আর তার ৫ বছর বয়সী বড় ভাই ও বাবা-মা ছিল সাথে। বোড্রাম থেকে রওনা হওয়ার পর তাদের নৌকা দুটো স্রোতে উল্টে যায়। আয়লান ও তার ভাইসহ মোট ৫ জন শিশু ডুবে যায় পানিতে।
তুরস্কের এক সমুদ্র সৈকতে আয়লানের লাশ ভেসে ওঠে। সৈকতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকাবস্থায় ছোট্ট আয়লানের মৃতদেহের ছবি পুরো পৃথিবীকে স্তম্ভিত করে দেয়। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া আয়লানের বাবা সংবাদ মাধ্যমকে জানান, নৌকা উল্টে যাওয়ার সময় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু ছেলে দুটো হাত ফসকে হারিয়ে গিয়েছিল।
Feature Image: thenational.ae